২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫
`
সুশাসন

রাষ্ট্রপতির যোগ্যতা, নির্বাচন, ক্ষমতা ও স্বাতন্ত্র্য

-

সংবিধান প্রণয়ন-পূর্ববর্তী বাংলাদেশের সরকারব্যবস্থা সংসদীয় পদ্ধতির আদলে গঠিত হয়েছিল। স্বাধীনতা ও মুক্তি সংগ্রাম চলাকালীন যে সরকারটি গঠিত হয়েছিল সেটি মুজিবনগর সরকার নামে অভিহিত। এ সরকারটিতে শেখ মুজিবুর রহমানের অনুপস্থিতিজনিত কারণে সৈয়দ নজরুল ইসলামকে ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতিরূপে নিয়োগ দেয়া হয়। এ সরকারটির প্রধানমন্ত্রী পদে আসীন ছিলেন তাজউদ্দীন আহমদ। ১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দের ১৬ ডিসেম্বর বিজয় দিবস-পরবর্তী ১০ জানুয়ারি ১৯৭২ খ্রিষ্টাব্দে শেখ মুজিবুর রহমানের স্বদেশে প্রত্যাবর্তন ঘটলে ১২ জানুয়ারি তিনি প্রধানমন্ত্রী হিসেবে অধিষ্ঠিত হন যদিও মুজিবনগর সরকারে রাষ্ট্রপতির পদটি তাঁর জন্য শূন্য রাখা হয়েছিল। ঐদিন আবু সাঈদ চৌধুরীকে রাষ্ট্রপতি পদে নিয়োগ দেয়া হয়।
১৯৭২ খ্রিষ্টাব্দের ১৬ ডিসেম্বর সংবিধান কার্যকর হলে সংসদীয় পদ্ধতির সরকার ব্যবস্থায় শেখ মুজিবুর রহমান প্রধানমন্ত্রী এবং আবু সাঈদ চৌধুরী রাষ্ট্রপতি পদে পূর্বেকার ন্যায় আসীন থাকেন। ১৯৭৫ খ্রিষ্টাব্দের ২৫ জানুয়ারি সংবিধানের চতুর্থ সংশোধনীর মাধ্যমে বাকশাল প্রতিষ্ঠা করা হলে রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকারব্যবস্থার প্রবর্তন ঘটে এবং শেখ মুজিবুর রহমানকে আমৃত্যু রাষ্ট্রপতি ঘোষণা করা হয়। পরবর্তী সময়ে ১৯৭৫ খ্রিষ্টাব্দের ১৫ আগস্ট সামরিক অভ্যুত্থানে শেখ মুজিবুর রহমান নিহত হলে বাকশাল শাসনব্যবস্থার অবসান ঘটলেও রাষ্ট্রপতি শাসিত শাসনব্যবস্থা সংবিধানের দ্বাদশ সংশোধনী প্রণয়ন-পূর্ববর্তী ১৭ সেপ্টেম্বর ১৯৯১ খ্রিষ্টাব্দ অবধি বহাল ছিল। দ্বাদশ সংশোধনীর মাধ্যমে প্রবর্তিত সংসদীয় পদ্ধতির সরকারব্যবস্থা অদ্যাবধি বহাল রয়েছে।

এ দেশে রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকারব্যবস্থা বহাল থাকাকালীন রাষ্ট্রের নির্বাহী ক্ষমতা রাষ্ট্রপতি কর্তৃক তাঁর কর্তৃত্বে প্রযুক্ত হতো। সংসদীয় পদ্ধতির সরকারব্যবস্থায় রাষ্ট্রের নির্বাহী ক্ষমতা প্রধানমন্ত্রী কর্তৃক তার কর্তৃত্বে প্রযুক্ত হয়ে আসছে। রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকারব্যবস্থায় রাষ্ট্রপতি মন্ত্রিপরিষদের সভায় সভাপতিত্ব করতেন। বর্তমানে সংসদীয় পদ্ধতির সরকারব্যবস্থায় প্রধানমন্ত্রী মন্ত্রিসভায় সভাপতিত্ব করে থাকেন।
রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকারব্যবস্থায় বাকশালের সময়কাল ব্যতীত প্রত্যক্ষ ভোটের মাধ্যমে রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের বিধান ছিল। বর্তমানে সংসদীয় পদ্ধতির সরকার ব্যবস্থায় রাষ্ট্রপতি সংসদ সদস্যদের ভোটে নির্বাচিত হন অর্থাৎ পরোক্ষ ভোটে নির্বাচিত হন। সংসদীয় পদ্ধতির সরকারব্যবস্থায় একজন ব্যক্তিকে রাষ্ট্রপতি পদে আসীন হতে হলে তার বয়স অন্যূন ৩৫ হতে হয়। কোনো ব্যক্তি সংবিধানের অধীনে অভিশংসন দ্বারা রাষ্ট্রপতির পদ হতে অপসারিত হলে তিনি রাষ্ট্রপতি পদে নির্বাচনের জন্য অযোগ্য বিবেচিত হন। তাছাড়া বয়সের সীমারেখা ব্যতীত একজন ব্যক্তির সংসদ সদস্য নির্বাচিত হওয়ার ক্ষেত্রে যেসব যোগ্যতার প্রয়োজন রাষ্ট্রপতি পদে নির্বাচনের ক্ষেত্রেও অনুরূপ যোগ্যতার আবশ্যকতা রয়েছে। যেমন তাকে বাংলাদেশের নাগরিক হতে হবে, কোনো উপযুক্ত আদালত কর্তৃক অপ্রকৃতিস্থ ঘোষিত হওয়া যাবে না, দেউলিয়া ঘোষিত হওয়ার পর দায় হতে অব্যাহতি লাভ করতে হবে, বিদেশী নাগরিকত্ব গ্রহণ বা বিদেশী রাষ্ট্রের প্রতি আনুগত্য ঘোষণা করা যাবে না, নৈতিক স্খলনজনিত ফৌজদারি অপরাধে অন্যূন দুই বছর দণ্ডিত হওয়ার পর মুক্তিলাভ-পরবর্তী পাঁচ বছর অতিবাহিত হতে হবে, ১৯৭২ খ্রিষ্টাব্দের যোগসাজশকারী আদেশের অধীনে কোনো অপরাধে দণ্ডিত হওয়া যাবে না এবং আইনের দ্বারা অযোগ্য ঘোষণা করছে না এমন পদ ব্যতীত প্রজাতন্ত্রের কোনো লাভজনক পদে অধিষ্ঠিত হওয়া যাবে না।
নির্বাচন কমিশন কর্তৃক রাষ্ট্রপতি পদের নির্বাচন পরিচালিত হয় এবং নির্বাচন কমিশন সংসদ সদস্যদের সমন্বয়ে রাষ্ট্রপতি পদে ভোটদানের জন্য ভোটার তালিকা প্রস্তুত করেন। রাষ্ট্রপতি সংসদ সদস্যদের প্রকাশ্য ভোটে নির্বাচিত হন। প্রত্যেক ভোটার ব্যালট পেপারের কাউন্টার ফয়েলে স্বাক্ষর প্রদানপূর্বক ব্যালট পেপার সংগ্রহ করেন এবং তিনি যে প্রার্থীকে ভোট দান করবেন ব্যালট পেপারের আউটার ফয়েলে তার নামের বিপরীতে নিজের পূর্ণ নাম স্বাক্ষর করে ভোট প্রদানের পর তা সংরক্ষিত ব্যালট বাক্সের অভ্যন্তরে রাখেন। রাষ্ট্রপতি নির্বাচন আইনটি ১৯৯১ খ্রিষ্টাব্দে প্রণীত হয়। এ আইনে ভোটদানের যে পদ্ধতির উল্লেখ রয়েছে তাতে সুস্পষ্টভাবে প্রতিভাত যে, একজন সংসদ সদস্য যে দল হতে নির্বাচিত সে দলের মনোনীত রাষ্ট্রপতি প্রার্থী ব্যতীত অপর কোনো প্রার্থীকে তার পক্ষে ভোটদানের সুযোগ বারিত। এ বিষয়ে সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদ প্রাসঙ্গিক। এ অনুচ্ছেদটিতে উল্লেখ রয়েছে- একজন সংসদ সদস্য সংসদে তিনি যে দল হতে নির্বাচিত উক্ত দলের বিপক্ষে ভোটদান করলে সংসদে তার আসন শূন্য হবে।

রাষ্ট্রপতি রাষ্ট্রপ্রধানরূপে রাষ্ট্রের অন্য সব ব্যক্তির ঊর্ধ্বে স্থান লাভ করেন এবং প্রধানমন্ত্রী ও প্রধান বিচারপতি নিয়োগ ব্যতীত রাষ্ট্রপতি তার অপর সব দায়িত্ব প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শ অনুযায়ী সম্পন্ন করেন। দেশের যেকোনো আদালত কর্তৃক যে কোনো দণ্ডের মার্জনা, বিলম্বন ও বিরাম মঞ্জুর করার এবং যে কোনো দণ্ড মওকুফ, স্থগিত বা হ্রাস করার ক্ষমতা রাষ্ট্রপতির রয়েছে।
একজন রাষ্ট্রপতি কার্যভার গ্রহণের তারিখ হতে পাঁচ বছরের মেয়াদে তার পদে অধিষ্ঠিত থাকেন এবং তার পদের মেয়াদ শেষ হওয়া সত্ত্বেও তার উত্তরাধিকারী কার্যভার গ্রহণ না করা পর্যন্ত তিনি স্বীয় পদে বহাল থাকেন। একাদিক্রম বা একাদিক্রম ব্যতীত দু’মেয়াদের অধিক একজন ব্যক্তি রাষ্ট্রপতি পদে আসীন থাকতে পারেন না। রাষ্ট্রপতি পদত্যাগ করতে চাইলে স্পিকারের বরাবর স্বাক্ষরযুক্ত পত্রযোগে তিনি স্বীয় পদ হতে পদত্যাগ করতে পারেন। রাষ্ট্রপতি তার কার্যভারকালে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হওয়ার যোগ্য নন এবং একজন সংসদ সদস্য রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হলে তার কার্যভার গ্রহণের দিন সংসদে তার আসন শূন্য হয়। রাষ্ট্রপতির কার্যভার কালে তার বিরুদ্ধে কোনো আদালতে কোনো প্রকার ফৌজদারি কার্যধারা দায়ের করা যায় না এবং তার গ্রেফতার বা কারাবাসের জন্য কোনো আদালত হতে পরোয়ানা জারি করা যায় না। রাষ্ট্রপতির কার্যভারকালে কোনো আদালত কর্তৃক তাকে জবাবদিহি করা যায় না।
মেয়াদ অবসানের কারণে রাষ্ট্রপতির পদ শূন্য হলে মেয়াদ সমাপ্তির তারিখের পূর্ববর্তী ৯০ হতে ৬০ দিনের মধ্যে শূন্য পদ পূরণের জন্য রাষ্ট্রপতি নির্বাচন অনুষ্ঠানের বিধান রয়েছে; তবে রাষ্ট্রপতি যে সংসদের দ্বারা নির্বাচিত হয়েছেন সে সংসদের মেয়াদকালে রাষ্ট্রপতির কার্যকাল শেষ হলে সংসদের পরবর্তী সাধারণ নির্বাচন না হওয়া পর্যন্ত অনুরূপ শূন্য পদ পূরণের জন্য নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় না এবং অনুরূপ সাধারণ নির্বাচনের পর সংসদের প্রথম বৈঠকের দিন হতে ৩০ দিনের মধ্যে রাষ্ট্রপতির শূন্যপদ পূরণের জন্য নির্বাচন অনুষ্ঠান করতে হয়।
মৃত্যু, পদত্যাগ, অভিশংসন বা অপসারণের কারণে রাষ্ট্রপতির পদ শূন্য হলে পদটি শূন্য হওয়ার পরবর্তী ৯০ দিনের মধ্যে তা পূরণের জন্য নির্বাচন অনুষ্ঠান করতে হয়।
সংবিধান লঙ্ঘন বা গুরুতর অসদাচরণের অভিযোগে রাষ্ট্রপতিকে সংসদের মাধ্যমে অভিশংসন করা যায়। এ ক্ষেত্রে সংসদের মোট সদস্যসংখ্যার অন্যূন দুই-তৃতীয়াংশ ভোটে অভিশংসনের প্রস্তাবটি গৃহীত হলে রাষ্ট্রপতির পদ শূন্য হয়। তাছাড়া শারীরিক বা মানসিক অসামর্থ্যরে কারণেও রাষ্ট্রপতিকে স্বীয় পদ হতে অপসারণ করা যায়। এ ক্ষেত্রেও অপসারণের প্রস্তাব সংসদের মোট সদস্য সংখ্যার অন্যূন দুই-তৃতীয়াংশ ভোটে গৃহীত হলে রাষ্ট্রপতির পদটি শূন্য হয়।

রাষ্ট্রপতির পদ শূন্য হলে কিংবা অনুপস্থিতি, অসুস্থতা বা অন্য কোনো কারণে রাষ্ট্রপতি দায়িত্ব পালনে অসমর্থ হলে ক্ষেত্রমতো রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত না হওয়া পর্যন্ত কিংবা রাষ্ট্রপতি পুনরায় স্বীয় কার্যভার গ্রহণ না করা পর্যন্ত স্পিকার রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব পালন করেন।
সচরাচর সংসদে সংখ্যাগরিষ্ঠতা রয়েছে এমন দলের প্রার্থী ব্যতীত অপর কোনো প্রার্থীর রাষ্ট্রপতি পদে বিজয়ী হওয়ার সম্ভাবনা একেবারেই নেই। রাষ্ট্রপতির পদটি শপথের অধীন এবং স্পিকার কর্তৃক রাষ্ট্রপতির শপথ অনুষ্ঠান পরিচালিত হয়। শপথ গ্রহণ ব্যতিরেকে রাষ্ট্রপতি পদে আসীন হন না এবং শপথ গ্রহণের তারিখ হতে তার মেয়াদকাল গণনা করা হয়। শপথগ্রহণ করার সময় অপরাপর বিষয়ের পাশাপাশি রাষ্ট্রপতিকে ব্যক্ত করতে হয়- তিনি সংবিধানের রক্ষণ, সমর্থন ও নিরাপত্তা বিধান করবেন এবং ভীতি বা অনুগ্রহ, অনুরাগ বা বিরাগের বশবর্তী না হয়ে সবার প্রতি আইন অনুযায়ী যথাবিহিত আচরণ করবেন।
রাষ্ট্রপতি প্রধানমন্ত্রী ও প্রধান বিচারপতি নিয়োগ ব্যতীত স্বীয় ইচ্ছায় কোনো নির্বাহী কার্য সম্পন্ন করতে না পারার কারণে তাকে তার সব নির্বাহী কার্য প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শ অনুযায়ী সম্পন্ন করতে হয়। প্রধানমন্ত্রী ও প্রধান বিচারপতি নিয়োগের ক্ষেত্রে রাষ্ট্রপতির স্বেচ্ছাধীন ক্ষমতা প্রয়োগের সুযোগ থাকলেও তার এ ক্ষমতাটিও নিয়মের বেড়াজালে আবদ্ধ। সংসদ নির্বাচন-পরবর্তী সংখ্যাগরিষ্ঠ আসনে বিজয়ী দলের নেতা ব্যতীত অন্য কোনো দলের প্রার্থীকে রাষ্ট্রপতি কর্তৃক প্রধানমন্ত্রী নিয়োগের সুযোগ নেই। প্রধান বিচারপতি নিয়োগের ক্ষেত্রেও জ্যেষ্ঠতা লঙ্ঘনপূর্বক নিয়োগ কার্যটি সমাধা করা হলে এটি প্রশ্নবিদ্ধ হয়। আমাদের দেশে প্রধান বিচারপতি নিয়োগের ক্ষেত্রে সংসদীয় পদ্ধতির সরকারব্যবস্থায় একাধিকবার জ্যেষ্ঠতা লঙ্ঘনের ঘটনা প্রত্যক্ষ করা গেছে; যদিও রাষ্ট্রপতির নাম ব্যবহার করে নিয়োগ কার্যটি সম্পন্নের কথা বলা হয় কিন্তু আদতে যে তাঁকে এ কাজটি প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শে করতে হয়েছে তা অজানা নয়।
সংসদীয় পদ্ধতির সরকারব্যবস্থায় এ যাবৎকাল পর্যন্ত যারা দলীয় প্রধানের সিদ্ধান্তে রাষ্ট্রপতি পদে আসীন হয়েছেন এদের মধ্যে দু-একজন নিজ স্বাতন্ত্র্য ও স্বকীয়তা বজায় রেখে কার্য সম্পাদনে উদ্যোগী হলে তাদের নিগৃহীত হয়ে পদ হারাতে হয়েছে অথবা পদ হারানো-পরবর্তী অবজ্ঞা ভরে উপেক্ষিত হয়েছেন। অপর সবাইকে নতজানু হয়ে ব্যক্তিত্ব বিবেকের বিসর্জনে আজ্ঞাবহ হয়ে মনিবের তুষ্টিতে বিলীন হতে হয়েছে।
লেখক : সাবেক জজ, সংবিধান, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক বিশ্লেষক
E-mail: iktederahmed@yahoo.com


আরো সংবাদ



premium cement