২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫
`

ভার্চুয়াল ও অ্যানালগ বিশ^

-

আমার মাছ ধরার নেশা আশৈশব। বড়শি হলে তো কথা-ই নেই। লন্ডন এক পেশাদার বড়শিওয়ালা দেখে তখনই ইচ্ছে করছিল বসে পড়ি। লন্ডন মাসিক ও বার্ষিক চাঁদা দিয়ে মাছ ধরতে হয়। সুইডেন হাজার হাজার জলাশয়। কোনো কোনোটি যেন ভূমধ্যসাগর। এসব জলাশয়ে মাছ আছে কি না জানতে চাই মল্লিকার কাছে। ইতিবাচক উত্তর পেয়েই মন উসখুস করতে শুরু করে।
প্রস্তাব করি ছিপ-বড়শি জোগাড় করে দেয়ার জন্য। এখানে অনেক জলাশয়ে মাছ ধরতে চাঁদা লাগে না। মল্লিকার হাবভাব দেখে বুঝতে পারি, খুব তাড়াতাড়ি আমাকে ছাড়ছে না। আমিও শুয়ে বসে কাটানোর লোক নই। মেয়েও টের পেয়েছে, কাজ ছাড়া এ বাবাকে দুই দিনও রাখা যাবে না।
আমার আবদারে মল্লিকা তার এক বান্ধবীর বাসা থেকে এক জোড়া হাতবড়শি নেয়। পাউরুটির টোপ বানিয়ে সকাল সকাল হাজির হই বিশ^বিদ্যালয়ের জলাশয়ে। লিনিয়াস বিশ^বিদ্যালয়ের পেছনে বেশ কয়েকটি জলাশয়। সকালের কাঁচা রোদে মোটা কাপড় পেতে ঘাসের ওপরই বসে পড়ি বাপ-বেটি। আল্লাহর নাম নিয়ে ছিপ ফেলি। জলাশয়ে এক জোড়া পানকৌড়ি। নির্ভয়ে ডুবসাঁতার কাটছে।
জলাশয়ে নিশ্চয়ই মাছ আছে। পানকৌড়ি মাছের বিশারদ। মাছ না থাকলে পানকৌড়ি থাকে না। ঘণ্টাদেড়েকের চেষ্টা করার পর মল্লিকা ফোন করে তার বান্ধবীর কাছে। ফোন করে জানতে পারে ভার্সিটির কোনো এক জলাশয় থেকে কি কারণে যেন মেডিসিন দিয়ে মাছ মেরে ফেলেছে। মাছ মেরে ফেলার বিষয়টি পানকৌড়ি ও আমরা একজনও জানতাম না। ছিপ হাতে চলে যাই রাস্তার পূর্বপাড়ের অন্য একটি জলাশয়ে। পানি একদম পরিষ্কার। চার-পাঁচ ফুট গভীর পর্যন্ত সব দেখা যায়। এরকম পরিষ্কার পানিতে মাছ থাকে না। মাছ টোপ গিলে ঘোলা পানিতে। ‘ঘোলা পানিতে মাছ শিকার’ প্রবাদ বাক্যের জন্ম সেখান থেকেই হয়েছে।
বাসায় এসে নাঈম জানতে পারে, আমাদের মাছ ধরার ব্যর্থতার কথা। নাঈমের কথা, পরিষ্কার পানির মাছ থাকে গভীর জলে। গভীর জলে টোপ ফেলা হাতবড়শির কাজ নয়। নাঈমের যুক্তি ঠিক। নাঈমের পরামর্শ মোতাবেক বিকেলে দূরের শপিংসেন্টার থেকে একজোড়া ছিপ ও আধুনিক চাকা নিয়ে আসি। নিয়ে আসি মাছের খাবারও। দ্বিতীয় দিন বকহুলতে লেক। যে লেকের এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তের গাঁওগেরাম মালুম হয় না। রয়েছে আরাম করে বসার জায়গাও। টিকিট দিয়ে মাছ ধরতে হয়। প্রতি টিকিট সাড়ে তিন হাজার টাকা। এক টিকিটে দুই ছিপ। লোকজন নেই, মোবাইলে লেনদেন। তা দেখে-

-আরে কিসের টিকিট-ফিকিট! আগে ছিপ ফেল। কেউ জানতে চাইলে বলব, টিকিটের নোটিশ চোখে পড়েনি।
-আব্বা, এখানে এসব চলে না। করার সুযোগও নেই। আপনারা আইনের লোক। সারাক্ষণ আইন ভাঙার ফাঁকফোকর খোঁজেন।
মোবাইলে লেনদেন চুকিয়ে ছিপ ফেলি। ছোট ছোট মাছ বড় মাছের তাড়া খেয়ে পানির ওপর লাফিয়ে উঠতে দেখে নিশ্চিত হই এখানে বড় মাছ আছে। বেশি নয়, একটি পেলেই চলবে। এক ঘণ্টা, দুই ঘণ্টা, তিন ঘণ্টা ধৈর্যের সীমা শেষ। বিকেলে বাসায় ফিরে আসি। পরপর দুই দিন মাছ না পেয়ে মন খারাপ। যতদিন মাছ ধরতে না পারব, ততদিন বড়শি ছাড়ব না। খোঁজখবর নিয়েই পরের দিন যাই টেলিবরি লেক। বিশাল বড় টেলিবরি লেক। মাঝখানে সাইকেল রোড।
প্রতিদিনের জন্য টিকিট এক হাজার টাকা। মল্লিকা ও আমি দু’জন দুই ছিপ নিয়ে বসে পড়ি। লেকের কোথাও কোথাও জাল পাতা রয়েছে। আমাদের দেশের জেলেরা বড় মাছের ছান্দিজাল যেভাবে ফেলে রাখে, ঠিক সেভাবে জাল ফেলা। কাঠের ব্রিজের গোড়ায় ছিপ ফেলে মাছ ধরতেও দেখলাম একজনকে। মাছ নেই। প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের লীলাভূমি এই টেলিবরি লেক। এখানেও এক পাড়ে দাঁড়িয়ে আরেক পাড়ের গাঁওগেরাম মালুম হয় না। সাইকেলের স্বর্গরাজ্য সুইডেন। নানা বয়সের নর-নারী সাইকেল চড়ে লেকের পাড় ঘুরতে আসে। এখানে প্রতিটি দর্শনীয় লেকের কিনার দিয়ে রয়েছে সাইকেল রোড। মাছ না পেলেও টেলিবরি ক্যাসেল ও লেকের প্রাকৃতিক দৃশ্য দেখে পুষিয়ে গেছে।
প্রথম দিন বিশ^বিদ্যালয়ের পুকুরে মাছ ধার সময় কাছেই সাঁতার কাটছিল জোড়া পানকৌড়ি। চর্বিযুক্ত পানকৌড়ি। আমাকে ভয়ের কারণ নেই মনে করে এক সময় খুব কাছে চলে আসে। মন বলছিল, ছিপ দিয়ে দিই এক ঘা। মাছ না পেলেও চলবে, মজা করে খাওয়া যাবে পানকৌড়ির গোশত। প্রথম দিন বাসার পাশের জঙ্গলেও একজোড়া পাতিহাঁস দেখেছিলাম। ছোট্ট জলাশয়ে লেজ উপরে রেখে মাথা ডুবিয়ে খাবার খুঁজছিল। ঢিলা দিয়েই ধরাশায়ী করতে পারতাম। এসব কাজে আমরা সিদ্ধহস্ত। আমাদের গাঁয়ের সামনে বিল। শীতকালে বিল ভরে উঠত পাখির কলকাকলিতে। ৮-১০ কেজি ওজনের ধনেশ পাখিসহ কত প্রকারের পাখি দেখেছি, লেখাজোখা নেই। দিনভর পাখির আর্তচিৎকার ও বন্দুকের শব্দ। ফসলের জমির পোকা খাওয়ার জন্য মাঠে বসত সাদা বকের দল। শীতকালে এখন আর পাখি দেখি না। সুইডেন হাতের কাছে চর্বিযুক্ত পাখি দেখলেই শৈশবের কথা মনে পড়ে। চর্বিযুক্ত পানকৌড়ির গোশত খাওয়ার ইচ্ছে অপূর্ণ রেখেই বাসায় ফিরছিলাম। কাছেই বাসস্টপেজ। জার্মানির তৈরি মার্সিডিস বেঞ্জের বড় বড় বাস।
বাসস্টপেজে যেতে হাতের মোবাইলে কয়েকবার ক্লিক করে, মল্লিকা বলে-
-বাসের ভাড়া পরিশোধ করলাম।
-বাসে না উঠেই ভাড়া পরিশোধ?
-আব্বা, কোন জগতে আছেন!
-দু’জনের ভাড়া কত টাকা?
-বাংলাদেশী ৪৫০ টাকা।
ওঠার পর বাস মোড় ঘুরতেই বাস বদলের জন্য আমরা নেমে পড়ি। নেমেই মল্লিকার কাছে জানতে চাই-
-লিনিয়াস ইউনিভার্সিটির উত্তর থেকে দক্ষিণ দিকে আসতেই ৪৫০ টাকা ভাড়া?
-এ ভাড়া দু’জনের দুই ঘণ্টার জন্য।
-দুই ঘণ্টার জন্য যত বাসেই উঠানামা করি, ভাড়া একই।
-উঠলাম আর নামলাম। ভাড়া দিলাম কি, না দিলাম, কী প্রমাণ আছে?
-প্রমাণ আমার মোবাইলেই আছে। (আমার সামনে মোবাইল ধরে) দেখুন এখনো এক দেড় ঘণ্টা হাতে আছে।
-যদি ভাড়া না দিয়ে উঠানামা করতাম। কী প্রমাণ ছিল তাদের হাতে?
-এখানে এই ভুলটি ভুলেও কেউ করবে না। টিকিট পরীক্ষক আছেন। ধরা পড়লে জীবনের ক্যারিয়ার বরবাদ। আমার মোবাইলে সবই সংরক্ষিত আছে। এই দেখুন, (বলেই মোবাইলে ক্লিক করে), এই কালো চিহ্নটাই বাস। দুই স্টপ আগে আছে, এখানে আসতে সময় লাগবে দুই মিনিট।
-ঠিক দুই মিনিট পরই বাস এসে থামল। তা দেখে হতবাক হয়ে-
-ম্যাজিক?

-ম্যাজিকের মতোই। ইউরোপ ভার্চুয়াল বিশ্বে পা রেখেছে। আপনারা এখনো রয়ে গেছেন অ্যানালগ বিশ্বে।
-‘ভার্চুয়াল’ শব্দটিই আমাদের কাছে ভয়ঙ্কর। আমরা এর নাম দিয়েছি ভার্চুয়াল ভাইরাস। A virus is a submicroscopic infectious agent that replicates only inside the living cells of an organism. ভাইরাস ল্যাটিন ভাষা থেকে গৃহীত একটি শব্দ যার অর্থ বিষ। আদিকালে রোগ সৃষ্টিকারী একপ্রকার বিষাক্ত পদার্থকে ভাইরাস বলা হতো। মনুষ্য জাতির ক্ষতিকারক যত বস্তু ও কীটপতঙ্গ আছে তার মধ্যে ভাইরাস অন্যতম। এই ভাইরাস শুধু Natural love and affection-কেই ধ্বংস করেনি, তুঙ্গে তুলেছে জ্ঞানার্জনের জন্য সাধন-ভজনসহ অধ্যয়ন তপস্যায়ও। বাড়ছে ভয়ঙ্কর সব অপরাধ। একসময় চোর চুরি করত অমাবস্যা রাতে, ঘরের সিঁদ কেটে, শরীরে সরিষার তেল মেখে। চুরি করত থালা-বাটি, ধান-চাল, এমনকি শিলনোড়াও। এখন করে সাইবারক্রাইম। Cybercrime দিন দিনই বাড়ছে, বাড়ছে পার্সোনাল ডাটা চুরি, Hacking, phishing, privacy theft, এখন এক দেশের হ্যাকাররা ঘরে বসে আরেক দেশের ব্যাংকের রিজার্ভ নিয়ে যায়। ‘২০১৬ সালের ৫ জানুয়ারি বাংলাদেশ ব্যাংকের ইতিহাসের অন্যতম কালো দিন। ওই দিন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের রিজার্ভ থেকে আট কোটি ১০ লাখ ডলার চুরি করা হয়। ...আর যা কি না এখন পর্যন্ত সর্বকালের সবচেয়ে সাহসী সাইবার হামলা।’ (প্রথম আলো, জুন ২১, ২০২১) এই কাজটি যে করেছে সে ছিল উত্তর কোরিয়ার শীর্ষ বিশ^বিদ্যালয়ের ছাত্র। এ কারণেই ফেসবুক টুইটার, ¯œ্যাপচ্যাট, ইনস্টাগ্রাম, ইউটিউব, ভার্চুয়াল গেম, স্মার্ট ফোন, স্মার্ট টিভি ইত্যাদি ভাইরাস আমাদের ভেতর থেকে কুরে কুরে খেতে শুরু করেছে। এসবের আসক্তি মগজের ভেতরে প্রবেশ করে একদম গভীরে ঢুকে খেয়ে ফেলছে আমাদের মনোযোগ, শরীর, সংসার, পরিবার, সমাজ ও দেশকে। তাই আমরা যথার্থই এর নাম দিয়েছি, ভার্চুয়াল ভাইরাস।
আমার লম্বা বক্তব্যের পর মল্লিকা-

-আপনার লেখালেখির মধ্যে প্রায়ই নিউটনের তৃতীয় সূত্রের উদাহরণ দেখতে পাই। ‘প্রত্যেক ক্রিয়ারই একটি সমান ও বিপরীত প্রতিক্রিয়া আছে’ মর্মে সূত্রটি মাঝে মধ্যেই ব্যবহার করেন। আপনার বিশ^াস, নিউটনের এই সূত্রটি কেবল ভর-বেগ আর বলের ক্ষেত্রে সীমাবদ্ধ নয়- জগত জীবন ও প্রকৃতির প্রতিটি ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। সেই সূত্রেই বলা চলে, ইন্টারনেটের সুফল ও কুফল সমান সমান। ফুলে মধু যেমন আছে- বিষও তেমন আছে। একই ফুল থেকে মৌমাছি মধু সংগ্রহ করে আর মাকড়সা সংগ্রহ করে বিষ। আমাদের দেশ জগতের বাইরেও একটি অদৃশ্য জগত রয়েছে। সেই অদৃশ্য জগতজুড়ে রয়েছে তরঙ্গ যার নাম ওয়ার্ল্ড ওয়াইড ওয়েভ (www)। ওয়াইড ওয়েভে পাতা রয়েছে অদৃশ্য জাল যার নাম ইন্টারনেট। ‘ইন্টারনেট’ নিশ্চয়ই বুঝেন। বিশ^জুড়ে অদৃশ্য এক জাল। ইন্টারনেট অসংখ্য কম্পিউটার ও স্মার্ট ফোনকে একত্র করে তথ্যাদি আদান-প্রদান করে যা ১৯৬০-এর দশকে মার্কিন সামরিক বাহিনীর গবেষণা সংস্থা আরপা পরীক্ষামূলকভাবে করেছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কিছু বিশ^বিদ্যালয় ও তাদের গবেষণাগারের মধ্যে যোগাযোগের জন্য। ১৯৮৯-৯০ সবার জন্য উন্মুক্ত করাসহ পশ্চিমা বিশে^ ব্যাপক বিস্তৃতি লাভ করে। অপার্থিব এই অদৃশ্য জগতই ভার্চুয়াল ওয়ার্ল্ড।

A virtual world is a computer -simulated representation of a world with specific spatial and physical characteristic, and users of virtual worlds interact with each other via representation of themselves called `avatars" Modern virtual worlds differ from traditional video games in the objective. অপার্থিব কিন্তু অলৌকিক নয়। যেমন একজন ভার্চুয়াল বন্ধুর দ্বারা কাজ উদ্ধার করতে পারবেন, গেম খেলতে পারবেন কিন্তু দেখাশোনা, ধরাছোঁয়াসহ খাওয়াতে পারবেন না। অর্থাৎ You may have made a vitual friend on an online gaming side, but don't expect that person to meet you for coffee. (তথ্যসূত্র Internetted Oxford University press.) সুইডেন আসার পর আপনাকে Lyca Mobile (লাইকা মোবাইল)-এর সিম দিয়েছিলাম। সিমটির গুণাগুণসহ ব্যবহারের নিয়মকানুন বলে দেয়ার পরও আপনি ব্যবহার করতে পারেননি। আন্তর্জাতিক মানের এই সিমটি বিশে^র ৬০টি দেশে ব্যবহার করা যায়। সিমটিতে ইন্টার্নেট ব্যবহারসহ কল করা, রিসিভ করা, মেসেজ করা ইত্যাদি সব ব্যবস্থা ছিল। শুনেছি, স্ট্যানস্টেড থেকে ভ্যাক্সজো আসার পথে পিপাসায় কাতর ছিলেন। আপনার পকেটে পাউন্ড ডলার ছিল। আপনার পাশের যাত্রী কেক-কোক কিনে খেয়েছিল। আপনারও ইচ্ছে করছিল। নগদ টাকায় বেচাকেনা হয় না বলে আপনার ইচ্ছেও পূরণ হয়নি। আপনার ইচ্ছের কথা জানতে পারলে আমি বাসায় বসেই কেক-কোকের দামটা পরিশোধ করতে পারতাম। যেমন পরিশোধ করেছিলাম ধানমন্ডি খাবরের দোকানের বিল। ছোট আপু (টগর) চাঁদপুরে ইলিশ মাছের বিল পরিশোধ করেছিল প্যারিসে বসেই। সুইডেন কয়েক একর স্থানজুড়ে একেকটি শপিংমল। কোটি কোটি টাকার মালামাল। কেনাকাটার লোকজন নেই। কোভিড-১৯ বিশ^কে শিখিয়ে দিয়ে গেছে ভার্চুয়াল জগত। কেনাকাটা থেকে শুরু করে স্কুল-কলেজ, লেখাপড়া এমনকি মিটিং-মিছিলও চলছে ভার্চুয়ালের অধীনে। যতদূর জানা যায়, করোনাকালীন অনলাইনের মাধ্যমে আমাদের প্রধানমন্ত্রী এক হাজার ৬০০ ভার্চুয়াল মিটিং করেছিলেন।

সুইডেন থেকে চলে আসার পরও মল্লিকা সর্বক্ষণ খোঁজখবর রাখত। ইউরোস্টার যোগে প্যারিস থেকে লন্ডন সেন্ট প্যানক্রাস ইন্টান্যাশনাল স্টেশনে অবতরণ করার সাথে সাথে মল্লিকার ফোন। সুইডেন থেকে ফোন করে জানিয়ে দিলো কোন গেট দিয়ে বের হতে হবে। গত ২০ মে, ২০২২ লন্ডনের হিথ্রো বিমান বন্দরে কঠোর সঙ্কটে পড়েছিলাম। বিমান যে সময়ে ছাড়ার কথা সে সময় ১৫ মিনিট আগেই পার হয়ে গেছে। বিশে^র ব্যস্ততম বিমান বন্দর হিথ্রো। শতাধিক গেটের মধ্যে ইস্তাম্বুলগামী বিমানের গেট খুঁজছিলাম। আমার মালামাল আগেই পৌঁছে গেছে বিমানে। কেউ কেউ ঊর্ধ্বশ^াসে দৌড়াচ্ছে গেটের দিকে। যারা দৌড়াচ্ছে তারা কোন বিমানের যাত্রী, তাও জানি না। আমার সামনে ৫০ ফুট উচ্চতার একটি এস্কেলেটর। এস্কেলেটরের অর্ধেক নামার পর মনে হচ্ছে, এই এস্কেলেটর আমার নয়। আমি হার্টের রোগী। এ অবস্থায় মনে পড়ে আবু সাঈদ চৌধুরীর কথা। আবু সাঈদ চৌধুরী ১৯৮৭ সালের ২ আগস্ট লন্ডনের আন্ডার গ্রাউন্ডে হয়তো এ অবস্থায়ই হার্ট অ্যাটাক করে মারা গিয়েছিলেন। এস্কেলেটর থেকে নেমে বিবেকহীনভাবে দৌড় দিয়েছিলাম আমিও। যখন দৌড় থামে তখন আমি আর শ^াস টানতে পারছিলাম না। সামনেই আমার গেট। গেটের কাছে গিয়ে আমার দম বন্ধ হয়ে পড়ার উপক্রম হয়েছিল। গেটের সামনের লাইনে একদল যাত্রী। লাইন এগোচ্ছে বিমানে ওঠার জন্য। এতক্ষণে আমার বিমান হয়তো চলে গেছে কয়েক শ’ কিলোমিটার দূরে। ঠিক এ সময় ফোন আসে মল্লিকার। ফোন পেয়ে হাঁফাতে হাঁফাতে বলি-
-এবারই বিদেশ ভ্রমণ শেষ, বাঁচলে আমি আর দেশের সীমানার বাইরে বের হবো না।
-আব্বা, আপনি ব্যস্ত হবেন না। আপনার বিমান ছাড়ার আরো ৩০ মিনিট বাকি আছে। যে বিমানটি দাঁড়িয়ে রয়েছে, এটিই ইস্তাম্বুলগামী বিমান। আপনার হাতের মোবাইলে বিমানের নম্বরটি লিখে নেটে সার্চ করলেই বিমানের ছবিসহ বিস্তারিত দেখতে পাবেন। ব্যবহার জানলে গেটও চিনিয়ে নিয়ে যাবে আপনার মোবাইলই।
ইস্তাম্বুল মাত্র এক ঘণ্টা ট্রানজিট। শুধু এক বিমান থেকে নেমে আরেক বিমানে ওঠা। ইস্তাম্বুল বন্দর বড় কম নয়। নামার আগেই পরবর্তী বিমানের নম্বর দিয়ে নেট চেক করলেই গেট নম্বরসহ সব বিবরণ পেয়ে যাবেন। আপনার হাতে যে মোবাইল ছিল, সেই মোবাইলের নেটে সার্চ করলে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে হিথ্রো বিমানবন্দরে এই কষ্ট করতেন না। (তার পরও মেয়েটি ঘুম যায়নি। বিমান ইস্তাম্বুল ল্যান্ড করার সাথে সাথেই ইস্তাম্বুল টু শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের গেট নম্বর জানিয়ে দিয়েছিল। জানিয়ে দিয়েই প্রশ্ন করেছিল)। আব্বা এবার ঠিক করেন, ভার্চুয়াল নামে ফুল থেকে মধু সংগ্রহ করবেন- না বিষ সংগ্রহ করবেন?
লেখক : আইনজীবী ও কথাসাহিত্যিক
E-mail: adv.zainulabedin@gmail.com


আরো সংবাদ



premium cement