১৯ মার্চ ২০২৪, ০৫ চৈত্র ১৪২৯, ০৮ রমজান ১৪৪৫
`

ফ্যাট খাবার নামে যা খাই

-


ফ্যাট খাবার হিসেবে বেঁচে থাকার সাতটি উপাদানের মধ্যে অন্যতম। এটি দেহের তাপশক্তি উৎপাদন, মস্তিষ্কের বিকাশ, হরমোনের উৎপাদন, চর্বিযুক্ত দ্রবণীয় ভিটামিন শোষণ এবং ত্বক ও অন্যান্য অঙ্গের সুস্বাস্থ্য বজায় রাখতে সহায়তা করে। মূলত ফ্যাট দেহের সঠিক তাপমাত্রা বজায় রাখার জন্য ইনসুলেটর বা অন্তরক হিসেবে কাজ করে। মস্তিষ্কের শতকরা ৬০ শতাংশই ফ্যাট দিয়ে তৈরি।
ফ্যাটজাতীয় খাবারের নামে আমরা কী খাই : আমরা জানি, সব ধরনের খাবারেরই মূল দু’টি উৎস, একটি হলো প্রাণিজ এবং অপরটি উদ্ভিজ। প্রাণিজ উৎসের খাবারে উপাদানের পরিমাণ এবং বিভিন্নতা বেশি থাকে। কিন্তু এ থেকে প্রাপ্ত সব উপাদানই সবার জন্য স্বাস্থ্যকর না। যেমন গরুর গোশতে থাকে সেচুরেটেড ফ্যাট-কোলেস্টেরল এবং মনো আনসেচুরেটেড ফ্যাট থাকে যা স্বাস্থ্যের জন্য ভালো নয়। আর সেচুরেটেড ফ্যাট অপ্রয়োজনীয় ও ক্ষতিকর। কিন্তু প্রোটিন বা ভিটামিন দরকার। গোশত থেকে ভিটামিন ও অ্যামাইনোএসিড পেলেও সাথে বাধ্য হয়েই ক্ষতিকর জিনিস খেতে হচ্ছে। অথচ উদ্ভিদ উৎসের খাবারে এ সমস্যা থাকে না। একাধিক উদ্ভিদ উৎস থেকে খাবার খেলে প্রয়োজনীয় প্রোটিন ও আনসেচুরেটেড ফ্যাটের পরিমাণ প্রাণিজ গোশতের চেয়ে অনেক বেশি থাকে।


ফ্যাটি এসিড চার ধরনের
প্রথমত, সেচুরেটেড ফ্যাটি এসিড বা ‘খারাপ ফ্যাট’
দ্বিতীয়ত, আনসেচুরেটেড ফ্যাটি এসিড বা ‘ভালো ফ্যাট’ যার থেকে অন্ততপক্ষে ৬-১০ শতাংশ ক্যালরি আসা দরকার।
তৃতীয়ত, কোলেস্টেরল যা প্রয়োজনীয় কিন্তু নিয়ন্ত্রণহীন হলে ‘খুব খারাপ’।
চতুর্থত, ম্যান-মেইড ট্রান্সফ্যাট বা ‘আগলি বা কুৎসিত’ ফ্যাট যা সবচেয়ে খারাপ। এটি মূলত আনসেচুরেটেড ফ্যাটি এসিড হলেও ফ্যাটকে সুস্বাদু, সুঘ্রাণযুক্ত ও টেকসই করতে গিয়ে মানুষ এর গুণাগুণ নষ্ট করে ফেলে।
গরুর বা খাশির গোশতের চেনার সহজ উপায় হলো, রান্না করা গোশত ঠাণ্ডা হলে তার উপরের অংশে হলুদাভ চর্বি জমে। এর পুরোটাই সেচুরেটেড ফ্যাট।
সব এসেন্সিয়াল ফ্যাটি এসিডই প্রকৃতিতে আমাদের চার পাশে বিশেষ করে উদ্ভিদে অল্প খরচে পাওয়া যায়। আর সেচুরেটেড ফ্যাটি এসিড অনেক দামি খাবার যা বড় বড় পশুর মাংসে পাওয়া যায় যা রক্তে ‘ভালো কোলেস্টেরল’ বা এইচডিএল এর মাত্রা কমিয়ে দেয়, খারাপ কোলেস্টেরল বা এলডিএল ২০-২৫ শতাংশ এবং ট্রাইগ্লিসারাইডের মাত্রা বাড়িয়ে দেয়। এর ফলে হৃদরোগের ঝুঁকি বাড়ে বহুগুণ।
এ জন্য বিশেষজ্ঞরা বিভিন্ন ধরনের ফলমূল ও সবজি থেকে এসেন্সিয়াল ফ্যাটি এসিডের চাহিদা পূরণের পরামর্শ দেন। কোলেস্টেরলের উৎস কেবল দামি প্রাণিজ গোশত ও ডিম। এর কোনো উদ্ভিদ উৎস নেই।


ট্রান্সফ্যাট, মানব সৃষ্ট মরণ বিষ
ট্রান্স ফ্যাট হলো মানুষের তৈরি প্রথম বিশেষ ধরনের আনসেচুরেটেড ফ্যাট। উইলিয়াম নরম্যান ১৯০২ সালে আবিষ্কার করেন আংশিক হাইড্রোজেনেশন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে তরল উদ্ভিজ চর্বিকে শক্ত, সেমিসপপলিড চর্বিতে রূপান্তরের প্রক্রিয়া। এটি খাবার সুস্বাদু, টাটকা ও পুষ্টিকর করার নামে কুখাদ্য ও পুষ্টিহীন খাবারে রূপান্তর করা যা হৃদরোগ, ডায়াবেটিসসহ অনেক রোগের বড় কারণ। ধূমপান আর মদ্যপানের মতোই ট্রান্স ফ্যাটের কোনো নিরাপদ মাত্রা নেই। নাই কোনো স্বাস্থ্য সুবিধা। আছে শুধু গুপ্তচরের ভূমিকা।
সব ধরনের বেকিং, ফ্রাইং, ফ্রজেন, পারসিয়ালি হাইড্রোজেনেটেড, রেফ্রিজারেটেড, প্রসেজড, ডগনাটস্, ফ্রেঞ্চ ফ্রাই, স্টিক মারগারিন, কেক, কোকিজ, পাইস ইত্যাদি ম্যান মেইড খাবার ট্রান্স ফ্যাটসমৃদ্ধ।
১৯০২ সালের আগে এ খাদ্য সম্পর্কে মানুষের কোনো ধারণাই ছিল না। বর্তমানে বিশ্বে শুধু এর কারণে অতিরিক্ত পাঁচ লাখ লোক প্রতি বছর করোনারি হার্ট ডিজিজে মারা যাচ্ছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ট্রান্স ফ্যাটি এসিডের মাত্রা ২০২২ সালের জানুয়ারির মধ্যে ২ শতাংশে এবং ২০২৩ সালের মধ্যে শূন্যে নামিয়ে নিয়ে আসার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। ডেনমার্ক, সুইজারল্যান্ড, অস্ট্রিয়া ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কিছু রাজ্য ট্রান্সফ্যাট নিষিদ্ধ করেছে।
অবশ্য সংস্থাটির ডাকে সাড়া দিয়ে ৫৮টি দেশ ট্রান্স ফ্যাটবিরোধী আইন প্রণয়ন করেছে।


ঘরের শত্রু বিভীষণ
আমরা ট্রাইগ্লিসারাইড ফর্মে যে ফ্যাট খাই তা ইন্টেস্টাইনে ভেঙে গ্লিসারল এবং ফ্যাটি এসিড হয়। শরীরে ঢোকার পর পরই ইন্টেস্টাইনের কোষে তা আবার ট্রাইগ্লিসারাইডে রূপান্তর হয়। কিন্তু শোষিত কোলেস্টারল, ফ্যাটি এসিড এবং ট্রাইগ্লিসারাইড পানিতে দ্রবণীয় নয়। আমাদের শরীরে ‘লাইপোপ্রোটিন’ নামক বাহনে চড়ে এই ফ্যাট শরীরের বিভিন্ন অংশের কোষে পৌঁছে যায়, আবার অপ্রয়োজনীয় লিপিড লিভারে বহন করে নিয়ে আসে।
আগলি কোলেস্টেরল : ডেনমার্কের কোপেনহেগেন বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক নরডেস্টগার্ড এক গবেষণায় দেখিয়েছেন যে, তিনটি ট্রাইগ্লিসারাইড সমৃদ্ধ লাইপোপ্রোটিনে বাহিত হয় একধরনের রেমন্যান্ট কোলেস্টেরল বা আগলি কোলেস্টেরল যার রক্তে অধিক উপস্থিতি আথারোস্কেলেরসিস তথা হার্ট অ্যাটাক ও স্ট্রোকের ঝুঁকি তিনগুণ বাড়িয়ে দেয়। তিনি বলেন, উন্নত বিশ্বে প্রতি পাঁচজনের একজন কুৎসিত কোলেস্টেরল সমস্যায় ভুগছেন।
হাইপারটেনশনের ভয়ঙ্কর চিত্র : ডব্লিউএইচও বলছে, বিশ্বে ১২৮ কোটি হাইপারটেনশনের রোগী আছে যারা ৩০-৭৯ বয়সী এবং যাদের দুই-তৃতীয়াংশ নিম্ন ও মধ্য আয়ের দেশের মানুষ। পুরুষদের মধ্যে প্রতি চারজনে একজন এবং মহিলাদের প্রতি পাঁচজনে একজন হাইপারটেনশনের রোগী। এর মধ্যে ৭০ কোটি হাইপারটেনশনের রোগীর কোনো চিকিৎসাই হয় না। পৃথিবীব্যাপী অকালে মানুষ মৃত্যুর বড় কারণ এটি।
হাইপারটেনশনের রিস্ক ফ্যাক্টর : অতিরিক্ত লবণ, সেচুরেটেড এবং ট্রান্সফ্যাট, কম পরিমাণে ফল-মূল ও শাকসবজি খাওয়া, শারীরিক কাজ-কর্ম কমিয়ে দেয়া, তামাক-মদজাতীয় খাবারে অভ্যস্ত হওয়া এবং অতিরিক্ত ওজন।
স্থূলতায় উচ্চ রক্ত চাপ, ডিজলিপিডেমিয়া, ডায়াবেটিস, অস্টিওআর্থ্রাইটিস, ক্যান্সার, স্পন্ডলাইসিস, ডিপ্রেশন ইত্যাদিতে আক্রান্ত হয়। স্থূলতা নিয়ন্ত্রণে ফুড পিরামিডের চার্ট হবে সর্বোচ্চ থেকে সর্বনিম্ন ক্রমে যথাক্রমে ফল-শাকসবজি, শরীর চর্চা, স্টার্চ, প্রোটিন, ফ্যাট ও সুগার।
পৃথিবীতে দুর্ভিক্ষে এবং না খেয়ে যত লোক মারা যায় তার চেয়ে অনেক বেশি লোক মারা যায় অতিরিক্ত খেয়ে অতিরিক্ত ওজন বাড়িয়ে এবং স্থূলকায় হয়ে যাবার কারণে।
বিশ্বের সব থেকে স্বাস্থ্যসম্মত খাদ্য বলে পরিচিত তথাকথিত মেডিটেরিয়ান ডায়েটের মধ্যেও ৮ শতাংশ শক্তি আসে ফ্যাট থেকে। খাদ্য তালিকায় সর্বদা কার্বোহাইড্রেট, প্রোটিন ও ফ্যাটের সুষম সমাহার থাকা প্রয়োজন। কোনোও কিছুই প্রয়োজনের অতিরিক্ত বা প্রয়োজনের তুলনায় কম পরিমাণে খাওয়া ক্ষতিকর।
সবই খাওয়া যাবে, তবে কম কম। উদ্ভিজ প্রোটিন, ফলফলাদি ও শাকসবজি খেতে হবে বেশি; অপর দিকে সরল কার্বহাইড্রেট এবং সেচুরেটেড চর্বি এবং প্রাণিজ প্রোটিন জাতীয় খাবার খেতে হবে কম। খাদ্যতালিকায় কিছু সামুদ্রিক মাছ রাখার চেষ্টা করতে হবে, তাতে ফিশ অয়েল এবং ওমেগা-৩ এবং ওমেগা-৬ ফ্যাটি এসিডের চাহিদাটাও মিটবে। প্রক্রিয়াজাত খাবার যত কম খেয়ে পারা যায় ততই ভালো। সোডিয়াম সমৃদ্ধ খাবার এবং কৃত্রিমভাবে লবণযুক্ত খাবার কম খেতে হবে।
প্রোটিন : প্রোটিন খাবারের মূল কাজ রোগ প্রতিরোধ। আবার ফ্যাটের ওপর নির্ভরশীলতা কমানোর একটি বড় উপায় হলো প্রোটিন খাবার বাড়িয়ে দেয়া। কারণ প্রোটিন গ্লুকাগন, গ্রোথ হরমোন এবং মেটাবলিসম বাড়িয়ে এবং ক্ষুধা কমিয়ে ফ্যাট ভাঙতে সাহায্য করে। আবার প্রোটিন খাবারের সাথে অনিবার্যভাবে এসে যায় ভিটামিন এবং মিনারেল। উদ্ভিদ উৎসের খাবারে ট্রান্সফ্যাট, সেচুরেটেড ফ্যাট ইত্যাদি ধরনের ঝুঁকি থাকে না।
লেখক : স্বাস্থ্যবিষয়ক নিবন্ধকার ও কলামিস্ট


আরো সংবাদ



premium cement