২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫
`

‘দাসপ্রথা’ কি ইসলাম করেছিল?

-

আগে আমরা দেখি, দাসপ্রথা আসলে কী। ক্রীতদাসত্ব হলো একটি সামাজিক-অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠান, যাতে ক্রীতদাস নামে কিছু মানুষ ‘প্রভু’ বা ‘মালিক’ হিসেবে পরিচিত অপর মানুষের সম্পদে পরিণত হয়। নিজস্ব স্বাধীনতা ও ইচ্ছা বিবর্জিত ক্রীতদাসরা তাদের মালিকের অনুগত থেকে নিরলস কাজ করতে বাধ্য। তারা মালিকের অস্থাবর সম্পত্তি মাত্র; তাদের মালিককে ছেড়ে চলে যাওয়ার কোনো অধিকার নেই, কাজ করতে অস্বীকার করার উপায় নেই, নেই শ্রমের জন্য পারিশ্রমিক দাবির অধিকার। সমাজে ক্রীতদাসদের অবস্থান অনেকটা গৃহপালিত পশুর মতো, অর্থাৎ মানুষ ভারবাহী পশুগুলোকে যেরূপ কাজে লাগায় তদ্রুপ ক্রীতদাসদেরও প্রভুদের সার্বিক প্রয়োজনে কাজে লাগায়। দাস-ব্যবসা অন্যান্য বাণিজ্যিক লেনদেনের মতোই ক্রীতদাসকৃত মানুষকে পণ্যরূপে বেচাকেনার একটি আর্থসামাজিক ব্যবস্থা বা রীতি। মূলত ক্রীতদাসত্ব হলো সবল কর্তৃক দুর্বলকে শোষণের একটি প্রথা।
এই দাসপ্রথা ইসলামের সৃষ্টি কি না এবং না হলে ইসলাম তা বিলোপ করেছিল কি না সে প্রশ্নের জবাব দিতে আসুন আমরা দাসপ্রথার উৎপত্তি এবং ধারাবাহিক ইতিহাস দেখি।


খ্রিষ্টান ধর্মে দাসপ্রথা
নিউ টেস্টামেন্টে দাসপ্রথা সুস্পষ্টরূপে স্বীকৃত, এমনকি অনুমোদিত। উদাহরণস্বরূপ যিশু ঋণগ্রস্তকে ঋণ পরিশোধের জন্য পরিবারসহ নিজেদের ক্রীতদাসরূপে বিক্রি হওয়ার পরামর্শ দেন। নিউ টেস্টামেন্টের এসব অনুমোদনমূলক উক্তি সম্ভবত অখ্রিষ্টানদের ক্রীতদাসকরণে খ্রিষ্টানদের উৎসাহিত করেছিল। স্পষ্টত খ্রিষ্টান-পূর্ব রোম সাম্রাজ্যে দাসপ্রথা ক্রমেই হ্রাস পাচ্ছিল এবং দাসদের অবস্থার ধীরে ধীরে উন্নত হচ্ছিল। চতুর্থ শতাব্দীতে সম্রাট কনস্টানটাইনের খ্রিষ্টান ধর্ম গ্রহণের পর যখন খ্রিষ্টানরা রাজনৈতিক ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়, তখন পরিস্থিতি পাল্টে যেতে শুরু করে। ৬৯৪ সালে স্পেনীয় সম্রাট চার্চের চাপে ইহুদিদের খ্রিষ্টান ধর্ম গ্রহণ অথবা ক্রীতদাসত্ব বরণ করার নির্দেশ দেন। ধর্মের দোহাই দিয়ে চার্চের ফাদার ও পোপরা মধ্যযুগে খ্রিষ্টান জগতে দাসপ্রথার বৈধতা দেয়। আধুনিক যুগের শুরুতে ইউরোপে এ ঘৃণ্য প্রথার বিরুদ্ধে ক্রমবর্ধমান বিরোধিতার মুখেও তারা দাস-বাণিজ্যের প্রতি সমর্থন অব্যাহত রাখে। বার্ট্রান্ড রাসেল লিখেছেন : ‘প্রত্যেকেই জানে যে, চার্চগুলো যত দিন পেরেছে সাধ্যমতো দাসপ্রথা বিলুপ্তিকরণের বিরোধিতা করেছে।’


প্রাচীন বিশ্বে দাসপ্রথা
ইসলাম দাসপ্রথার প্রবর্তক নয়, এমনকি এই প্রথায় শুধু ইসলামের একচেটিয়া কর্তৃত্বও ছিল না। খুব সম্ভবত সেই আদিম বর্বরতার যুগে দাসপ্রথার উৎপত্তি হয়েছিল এবং তা লিখিত ইতিহাসের পুরোটা ব্যাপী বিশ্বের প্রধান প্রধান সভ্যতার বিশেষ বৈশিষ্ট্য ছিল। দাসপ্রথা ব্যাবিলোনিয়া ও মেসোপটেমিয়াতেও প্রচলিত ছিল। মানবসভ্যতার ইতিহাস অনুযায়ী, খ্রিষ্টপূর্ব ৪০০০ থেকে ৩০০০ সালে মেসোপটেমিয়ায় প্রথম ক্রীতদাস প্রথা চালু হয়। এর হাজার বছর পর থেকে এই প্রথা মিসর হয়ে ছড়িয়ে পড়ে; ‘গ্রেট পিরামিড’ তৈরি করা হয় দাসদের দিয়ে। গ্রিসের প্রাচীন নগররাষ্ট্র, এথেন্স ও স্পার্টায় দাসপ্রথা আর্থসামাজিক ও রাজনৈতিক ব্যবস্থার সাথে জড়িত ছিল। জানা যায়, একসময় এথেন্সে মাত্র দুই হাজার ১০০ জন স্বাধীন নাগরিকের বিপরীতে চার লাখ ৬০ হাজার ক্রীতদাস ছিল। এর অনেক পরে চীনে এই কুপ্রথাটি জেঁকে বসে। পিরামিডের মতোই চীনের মহাপ্রাচীরও নির্মিত হয় দাসদের ঘাম, রক্ত ও কষ্টের ইতিহাস দিয়েই। রোম সাম্রাজ্যের প্রাথমিক যুগে জনসংখ্যার ১৫ থেকে ২০ শতাংশ ছিল ক্রীতদাস। অগাস্টাস সিজারের শাসনামলে (খ্রি:পূ: ৬৩-১৪) এক দাসমালিক নাকি চার হাজার ক্রীতদাস রেখে মারা যান। খ্রি:পূ: ৮০০ হতে ৭০০ সময়ে গ্রিস এবং ২০০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দে রোমে শুরু হয় ক্রীতদাস প্রথার মারাত্মক বিস্তার। খ্রি:পূ: দ্বিতীয় শতাব্দী পর্যন্ত দাসমালিকরা বৈধভাবে ক্রীতদাসকে হত্যা করতে পারত, যদিও তা ঘটত খুবই কম। এভাবে প্রায় বিশ্বজুড়েই একসময় ছড়িয়ে পড়ে এই ভয়াবহ কুপ্রথাটি। এখনো বিভিন্ন নামে ছড়িয়ে আছে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে, বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীতে এবং বিভিন্ন পরিবারে।


দাসপ্রথার খুবই মন্দ রূপটি দেখা গেছে মধ্যযুগে ‘ট্রান্স আটলান্টিক দাস’ ব্যবসায় যা কুখ্যাত ট্রান্স আটলান্টিক দাসপ্রথা বলে সারা বিশ্বে প্রচলিত দাস ব্যবসা। ১৪৯২ সালের ১২ অক্টোবর আমেরিকা মহাদেশের মাটিতে পা রাখেন নাবিক কলম্বাস ও তার সঙ্গীসাথীরা। এর পর থেকেই ইউরোপীয়রা ছুটে আসতে শুরু করল সদ্য আবিষ্কৃত এই মহাদেশে। উত্তর আমেরিকা ও দক্ষিণ আমেরিকার মতো বিশাল দু’টি মহাদেশের হাজার হাজার মাইল অনাবাদি জমি আবাদ করতে আফ্রিকা থেকে লাখ লাখ কালো মানুষ ধরে আনা শুরু হলো। এভাবে প্রথমে পর্তুগিজ এবং স্প্যানিশরা, পরে ইংল্যান্ড, নেদারল্যান্ডস ও ফ্রান্স জড়িয়ে পরে দাস ব্যবসায়। ষোড়শ শতকের শুরু থেকে ঊনবিংশ শতকের মাঝামাঝি পর্যন্ত প্রায় সাড়ে ৩০০ বছরে দাস বানিয়ে ধরে আনা হয়েছিল আফ্রিকার, ৪৫টি ছোট বড় জাতিগোষ্ঠী থেকে, প্রায় দেড় থেকে দুই কোটির মতো নারী, পুরুষ ও শিশুকে যাদের প্রায় তিন ভাগের এক ভাগই মারা পড়েছিল সমুদ্রপথে নিয়ে আসার সময়, তাদের ওপর করা অত্যাচারে কিংবা ক্ষুৎপিপাসা ও রোগ শোকে। শিল্পবিপ্লবের আগ পর্যন্ত ইউরোপীয় উপনিবেশগুলোর অর্থনীতি ছিল দাসনির্ভর।


দাসপ্রথায় ইসলামের ভূমিকা
আমরা দেখব দাসপ্রথার বিষয়ে ইসলামের ভূমিকা কী। বেশির ভাগ মুসলিম বলে যে, ইসলামের ইতিহাসে ক্রীতদাসত্বের কোনো চিহ্নই ছিল না। ইসলামে ধর্মান্তরিত এক অস্ট্রেলীয় আদিবাসী রকি ডেভিস বা শহীদ মালিক বলেন, ‘ইসলাম নয়, খ্রিষ্টান ধর্মই ক্রীতদাসত্বের প্রতিষ্ঠাতা।’ ভারতীয় মুসলিমরা বলে পর্তুগিজরা গোয়া, কেরালা ও বাংলার সমুদ্রোপকূলীয় অঞ্চল থেকে ভয়াবহ অবস্থায় দাস পরিবহন করার লোমহর্ষক কাহিনীর কথা। পাকিস্তানের ইতিহাস বইয়ে রচিত হয়, দাসপ্রথা ও শোষণ ছিল ইসলামের আগে, যা ইসলাম আসার সাথে সাথে নিঃশেষ হয়ে যায়। ইসলামী শাসনের অধীনে ব্যাপকভাবে চর্চাকৃত দাসপ্রথা সম্পর্কে মুসলিমদের এ নীরবতা সম্ভবত তাদের ঐতিহাসিক সত্য সম্পর্কে অজ্ঞতার ফল।


দাসপ্রথা ও কুরআনের বক্তব্য
দাসপ্রথাকে স্বীকৃতি দিয়েছে আল্লাহর কুরআনের অনেক আয়াত। আল্লাহ বলেন, ‘আল্লাহ তোমাদের জন্য তোমাদেরই দৃষ্টান্ত পেশ করেছেন; তোমাদের আমি যে উপজীবিকা দিয়েছে, তোমাদের অধিকারভুক্ত দাসদাসীরা কি তাতে অংশীদার যাতে ওরা তোমাদের সমান হতে পারে? এবং তোমরা তোমাদের সমকক্ষদের যেরূপ ভয় করো, ওদেরও কি সেরূপ ভয় করো? এভাবেই আমি বোধশক্তিসম্পন্ন সম্প্রদায়ের জন্য নিজ নিদর্শনাবলি বর্ণনা করি’ (সূরা রুম, আয়াত ২৮)।
ওই সময় মুশরিকরা মহান আল্লাহর সাথে এমন কিছু ব্যক্তি ও বস্তুকে শরিক করত যারা ছিল মূলত আল্লাহরই সৃষ্টি। কিন্তু তারা এসব ব্যক্তি বা বস্তুকে আল্লাহর মতো ক্ষমতাবান ও এই সৃষ্টিজগত পরিচালনায় তাঁর অংশীদার মনে করত। এই আয়াতে মানুষের এই ভ্রান্ত ধারণা খণ্ডন করে মানুষেরই মতো উদাহরণ তুলে ধরে বলা হচ্ছে : তোমরা যেসব দাস-দাসীর মালিক তাদের কি তোমাদের সম্পদের অংশীদার মনে করো? কিভাবে তোমরা মনে করো যে, সৃষ্টিজগত পরিচালনার ক্ষেত্রে আল্লাহ অন্য কারো সাহায্য নেন? এই আয়াতে আল্লাহ মূলত বলতে চেয়েছেন, আমরা যখন আমাদের অধীনস্থ শ্রমিক ও কর্মচারীদের নিজেদের অংশীদার মনে করতে পারি না তখন আল্লাহর সৃষ্টি কোনো ব্যক্তি বা বস্তুকেও তাঁর অংশীদার করা উচিত নয়। এটি করা হবে সুস্পষ্ট শিরক ও আল্লাহর ওপর মিথ্যা অপবাদ আরোপ করা।
অন্যত্র আল্লাহ স্বয়ং তার স্বর্গীয় পরিকল্পনার অংশরূপেই কম আনুকূল্যপ্রাপ্ত ক্রীতদাসদের চেয়ে কিছু মানুষকে বেশি আশীর্বাদপুষ্ট করেছেন বলে দাবি করেন। তিনি মুসলিমদের সতর্ক করে দিয়েছেন যাতে তারা ক্রীতদাসদের তাঁর দেয়া উপহার বা প্রতিদানে সমান অংশীদার না করে। আল্লাহ বলেন, ‘জীবনধারণের নিমিত্তে আল্লাহ তোমাদের কারো কারো ওপর অন্যদের তুলনায় অধিক মুক্তহস্তে তাঁর উপহার বা প্রতিদান বর্ষণ করেছেন। অধিক আনুকূল্যপ্রাপ্তরা তাদের দেওয়া সে উপহার তাদের দক্ষিণহস্তে ধারণকৃত দাসদের ওপর বর্ষণ করবে না, যাতে তারা এ ক্ষেত্রে সমপর্যায়ের হতে পারে। তারা কি আল্লাহর আনুকূল্য অস্বীকার করবে’ (সূরা আন-নাহল, আয়াত ৭১)?
এই আয়াতে আল্লাহ বলেন, যখন তোমরা নিজ দাসদের এত সম্পদ ও জীবনোপকরণ দাও না, যাতে তারা তোমাদের সমান হয়ে যায়, তখন আল্লাহ কিভাবে পছন্দ করতে পারেন যে, তাঁরই কিছু দাসকে তাঁর শরিক করে তাঁর সমতুল্য করে দাও।


ইসলাম ও দাসপ্রথা
বলতে হয় দাসপ্রথা ইসলামের আবিষ্কার নয় রাসূল সা:-এর এবং খোলাফায়ে রাশেদার জমানায় দাসপ্রথা এতটা বর্বর ও ঘৃণিত ছিল না যতটা পঞ্চদশ শতাব্দীতে কুখ্যাত ‘ট্রান্স আটলান্টিক দাস ব্যবসা’য় দেখা যায়; ওই সময় দাস বানিয়ে ধরে আনা হয়েছিল আফ্রিকার প্রায় দুই কোটির মতো নারী, পুরুষ ও শিশুকে, যাদের প্রায় তিন ভাগের এক ভাগ মারা পড়েছিল ক্ষুধা-পিপাসা ও রোগ-শোকে। আমেরিকা মহাদেশ এবং ইউরোপের বিভিন্ন দেশে কাজ করানো হয় নির্মম, নিষ্ঠুর ও বর্বরভাবে বাকিদের। সেই থেকে প্রায় সাড়ে চারশ’ বছর এই বর্বর দাসপ্রথা দেখে মানুষের মনে ধারণা হয়, দাসপ্রথা অত্যন্ত অমানবিক। সুতরাং ইসলামবিদ্বেষীরা ও ইসলামের সমালোচনাকারীরা অভিযোগ করে এসেছে, ইসলাম যদি শান্তির ধর্মই হয় তবে দাসপ্রথা উচ্ছেদ করল না কেন?
আমরা আগেই বলেছি, দাসপ্রথা নবীজীর জন্মের পূর্বেই ছিল এমনকি রাসূল সা:-এর পিতা আব্দুল্লাহ তাঁর জন্মের পূর্বেই মা আমিনার জন্য একজন দাস ক্রয় করেছিলেন বাজার থেকে। ছোট্ট নয় বছরের কালো আফ্রিকান আবিসিনিয়ান মেয়েটিকে আবদুল্লাহ ও আমিনা দু’জনই খুব ভালোবাসতেন। তাঁরা দু’জন মিলে আদর করে মেয়েটির নাম রাখলেন ‘বারাকাহ্’। শিশু মুহাম্মদ সা:-কে সর্বপ্রথম স্পর্শ করেছিলেন বারাকাহ্ নামের আফ্রিকার সেই কৃষ্ণকায় দাসীটি। একটু বড় হয়ে কৈশোর বেলাতেই রাসূল সা: বারাকাহকে মুক্ত করে দিয়ে বললেন, ‘আপনি স্বাধীন, আপনি মুক্ত।’ এ যেন, শিশুকাল থেকেই রাসূল সা: ক্রীতদাস প্রথাকে দূর করতে চাইছিলেন। চাইছিলেন, মানুষ মানুষের দাসত্ব থেকে মুক্ত হোক। কিন্তু মা বারাকাহ নবীকে ছেড়ে যেতে রাজি হননি। থেকে গিয়েছিলেন মায়ের ছায়া হয়ে, আজীবন নবীজীর পাশে।


নবীজী সা:-এর সময় এবং তার পর বহু শতাব্দী ধরে বহু দেশ বিজয়ের ফলে মুসলমানরা অসংখ্য দাস-দাসীর মালিক হয়েছিল। তখন যুদ্ধবন্দী-বন্দিনীদের গোত্রীয়-রাষ্ট্রীয়ভাবে বিনিময়ের ব্যবস্থা ছিল না, ছিল না তাদের পুনর্বাসন করার মতো কোনো ব্যবস্থা। ফলে দাস হিসেবে ওইসব বন্দীদের সাহাবিদের মধ্যে বণ্টন করে তাদের কাজে লাগানো এবং অর্থনীতিতে ভূমিকা রাখার ব্যবস্থা করা হয়েছিল। বন্দিনীদের শুধু তাদের মনিবদের সাথে যৌন সম্ভোগ করার অনুমতি না থাকলে তারা ব্যভিচারে জড়িয়ে পড়ত। সমাজব্যবস্থা এবং অর্থব্যবস্থা ভেঙে পড়ত। তবে কুরআন প্রথমে দাসদের সাথে দুর্ব্যবহার করা বন্ধ করেছে। কিছু অধিকার দিয়ে জনগণের মন-মানসে দাসরাও মানুষ; এই ভাবমর্যাদা প্রতিষ্ঠা করেছে, তাদের মুক্তির ব্যবস্থা করেছে এবং সবশেষে দাসপ্রথার শেকড় কেটে দিয়ে পুরো উচ্ছেদের বিধান দিয়েছে। মাত্র সাতজন সাহাবি মুক্ত করেছিলেন ৩৯ হাজার ২৫৯ জন দাস-দাসীকে। হাকিম বিন হাজাম একাই মুক্ত করেছিলেন ২০০ জনকে। কিন্তু এই শতাব্দী-প্রাচীন কুপ্রথাকে কুরআন হঠাৎ একদিন বিপ্লব করে উচ্ছেদ করলে ভেঙে পড়ত ফ্রি-শ্রমভিত্তিক অর্থনীতি, জনগণ হয়ে পড়ত বিভ্রান্ত আর অসংখ্য দাস-দাসী হয়ে পড়ত নিরাশ্রয়, অন্নহীন। কারণ জনগণ যদি মনের দিক থেকে তৈরি না হয় তবে যেকোনো ভালো জিনিসও জোর করে চাপিয়ে দিলে ফল খারাপ হতে বাধ্য। সে জন্য বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই বিপ্লবের চেয়ে বিবর্তনই ভালো, অতীত-বর্তমানে এর বহু উদাহরণ আছে।


কুরআন যদি দাসপ্রথার পক্ষে থাকত তবে দাসের ওপর অত্যাচার নিয়েই সন্তুষ্ট থাকত। কিন্তু আমরা দাসপ্রথার বিরুদ্ধে এক উদ্বিগ্ন কুরআনকে দেখতে পাই যে কি না বিভিন্ন কারণে দাসমুক্তির জন্য উৎসাহিত করেছে এবং সওয়াবের ঘোষণা দিয়েছে। যেমন- সূর্য বা চন্দ্রগ্রহণ হলে; রমজানে রোজা না রাখলে বা রোজা রাখার প্রতিজ্ঞা ভাঙলে; রোজা অবস্থায় হঠাৎ আল্লাহ-রাসূলের প্রতি খারাপ কথা মুখ দিয়ে বের হয়ে গেলে; জাকাতের পয়সা দিয়ে দাস-দাসী কিনে তাদের মুক্তি; কোনো গর্ভবতীকে আঘাত করে কেউ গর্ভপাত ঘটানো ইত্যাদি বিভিন্ন কারণে দাসমুক্তির বিধান করা হয়েছে। এ ছাড়াও ক্রীতদাসদের বলা হয়েছে ভাই ও দাসীরা বোন। একই খাবার-পোশাক দিতে বলেছেন নবীজী সা:, সাধ্যাতীত কাজ দিতে নিষেধ করেছেন; দাসীদের মুক্ত করে বিয়ে করতে চাপও দিয়ে একেবারে দ্বিগুণ সওয়াবের কথা বলে উদ্বুদ্ধ করেছেন। এমনকি মৃত্যুশয্যায় সাহাবিদের প্রতি দাসদের জন্য নবীজীর সা: উৎকণ্ঠিত নির্দেশ অত্যন্ত হৃদয়গ্রাহী।


সব মিলিয়ে দাসদেরই মুক্ত করে মানবাধিকার প্রতিষ্ঠায় ১৪০০ বছর আগে এ এক অসাধারণ বিপ্লব। এতসব পদক্ষেপ নেয়ার পর গণমানসে যখন দাসদের ভাবমর্যাদা ধীরে ধীরে ‘হুকুম পালনকারী পশু’ থেকে ‘হুকুম পালনকারী মানুষ’ এ উন্নীত হলো তখন দাসপ্রথার একেবারে শেকড় কেটে দিলো পবিত্র কুরআন। ১৪০০ বছর আগের আরবভূমি; চার দিকে শুধু গোত্র আর গোত্র; পরস্পরের সাথে লড়াই ঝগড়া লেগেই থাকত। কেউ স্বগোত্রের কাউকে হারাতে চাইত না। কারণ সদস্য সংখ্যাই গোত্রের শক্তি। তাই সাধারণভাবে স্বগোত্রের কাউকে দাস বানাবার সামাজিক সংস্কৃতিও ছিল না। দাসের একমাত্র উৎস যুদ্ধবন্দী। এই পরিস্থিতিতে কুরআন দাস মুক্ত করার আয়াত নাজিল করেছে। পবিত্র কুরআনে আল্লাহ বলেন, ‘যখন তাদেরকে পূর্ণরূপে পরাভূত করো তখন তাদের শক্ত করে বেঁধে ফেল। অতঃপর, হয় তাদের প্রতি অনুগ্রহ করো, না হয় তাদের নিকট হতে মুক্তিপণ নাও (সূরা মুহাম্মদ, আয়াত ৪)।’ পরিষ্কার আদেশ, যুদ্ধবন্দীদের মুক্তি দিতে হবে মুক্তিপণ নিয়ে বা না নিয়ে। মদিনায় অবতীর্ণ এই আয়াতের মাধ্যমে আল্লাহ যুদ্ধবন্দীদের মুক্তি দেয়ার কথা বলেছেন।
বলাবাহুল্য, মাত্র দুই-আড়াই শ’ বছর আগেও পশ্চিমা অনেক দেশ আইন করে এটা বন্ধ করার আগে তারা এই বর্বর প্রথা চালু রেখেছিল, এমনকি গির্জাগুলো পর্যন্ত দাস-ব্যবসা করত। অথচ কুরআন শরিফ সেই ১৪০০ বছর আগেই দাসপ্রথা শেকড় থেকে উচ্ছেদ করেছিল। পরে মুসলিম নামধারী রাজারা ইসলামের নামেই নানা রকম শরিয়াহ আইন ও হাদিস বানিয়ে ধূর্তভাবে দাসপ্রথাকে আবার প্রতিষ্ঠিত করেছিল।


কুরআন নাজিল হওয়া শেষ হওয়ার এবং রাসূল সা:-এর ওফাতের পরে, দুর্ভাগ্যক্রমে ইসলামের এই মানবাধিকারকে সম্পূর্ণ উল্টে দেয়া হলো। দাস-দাসীর ওপর এমন অনেক হাদিস আছে যেগুলো উপরে দেখানো মানবিক সূত্রগুলোর বিরোধী, স্বভাবতই সেগুলো স্বার্থের জন্য বানানো। কথিত শরিয়া আইন বানানো হয়েছে- ‘যুদ্ধবন্দিনী হওয়া মাত্র নারীদের পূর্বের বিবাহ বাতিল হইবে’। বিজয়ী সৈন্যরা বলছে, ‘আমরা যুদ্ধের গণিমত হিসেবে প্রাপ্ত রমণীদের সাথে আজল করতাম।’ এমন বানানো হাদিসও আছে- কিছু সৈন্য বন্দিনীদের স্বামীদের সামনেই তাদের ধর্ষণ করত, কিছু সৈন্য ‘তাহা পছন্দ করত না’। এই ধরনের হাদিসগুলো জাল। এসংক্রান্ত ভিন্ন হাদিসও রয়েছে সহি মুসলিম শরিফে।
এখানে উল্লেখ্য, শরিয়া আইন প্রণীত হয়েছে হাদিস সঙ্কলনের আগে, সে জন্যই আমরা ভুল আইনগুলোর সমর্থনে ‘জাল হাদিস’ দেখতে পাই। এমনকি কিছু জাল হাদিস রয়েছে যাতে বলা হয়েছে, দাসীদের একসাথে কয়েকজন মনিবের মালিকানা রয়েছে এবং মনিবদের অধিকার ছিল তাদের পারস্পরিক সম্মতিতে ওই দাসীদের সাথে যৌনমিলনের; এসব হাদিস পুরুষতন্ত্রের স্বার্থে পরে বানানো হয়েছে। বরং আল্লাহর নবী সা: বলেছেন, ‘যদি কেউ কোনো যৌথ মালিকানার দাস-দাসী থাকে তাহলে তাদের নিজ অংশ থেকে মুক্ত করে দেয়া উচিত। যদি তার কাছে পুরো মুক্তি দেয়ার মতো যথেষ্ট অর্থ থাকে তাহলে তার উচিত কোনো ন্যায়পরায়ণ লোক দ্বারা সেই দাস-দাসীর উপযুক্ত মূল্য নির্ধারণ করা এবং তার অংশীদারদের তাদের অংশের মূল্য দিয়ে সেই দাস-দাসীকে মুক্ত করে দেয়া। তা না হলে সে শুধু সেই দাস-দাসীকে আংশিক মুক্ত করল।’


পরিশেষে বলতে হয়, কুরআনের কিছু হুকুম শুধু মুসলিমের জন্য, কিছু সারা মানবজাতির জন্য, কিছু পুরুষের ও কিছু নারীর জন্য, কিছু সেই সমাজের জন্য ও কিছু চিরকালের। পরিস্থিতির পরিবর্তন হওয়ার ফলে কিছু হুকুম নবীজী সা:-এর জীবদ্দশাতেই পরিবর্তন করা হয়েছে। সামাজিক পারিবারিক শান্তি প্রতিষ্ঠার পদ্ধতি কুরআনে পুরোপুরিভাবে রয়েছে, সমস্যা হয় যখন আমরা কুরআনের হুকুমগুলোর গতিময়তা উপেক্ষা করে সেই সমাজের তাৎক্ষণিক হুকুমকে শাশ্বত মনে করে বর্তমানে প্রয়োগ করি।
সর্বোপরি ইসলামে দাসপ্রথা অনেক আগেই বিলুপ্ত হলেও আধুনিক পাশ্চাত্য সভ্যতায় রাষ্ট্রীয়ভাবে দাস প্রথা সর্বপ্রথম বিলুপ্ত ঘোষণা করে ইংল্যান্ড ১৮০৭ সালে; তার পর একে একে ইউরোপ ও দক্ষিণ আমেরিকা এবং সর্বশেষ ব্রাজিলে নিষিদ্ধ হয় ১৮৩০ সালে। তবে ১৮৬১ সালের আমেরিকার গৃহযুদ্ধের সাথে দাসপ্রথা গভীরভাবে সম্পর্কযুক্ত। দাসপ্রথা আনুষ্ঠানিকভাবে বিলুপ্ত হলেও বাস্তবে এখনো বিভিন্নরূপে মানুষকে ক্রীতদাস হিসেবে ব্যবহৃত হতে করা হচ্ছে বাধ্য। ক্রীতদাস প্রথার যে আধুনিক রূপান্তর, তার থেকে মুক্তির উপায় বের করা দরকার। মানব-সভ্যতা এগিয়ে যাচ্ছে। বিশ্বের সুসভ্য জাতিগুলোর সাথে পাল্লা দিয়ে। বাংলাদেশের মতো তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোও সেই অগ্রযাত্রায় পিছিয়ে নেই। এ প্রেক্ষাপটে যেকোনো ধরনের দাসপ্রথাই যাতে জাতির সেই অগ্রযাত্রার পথকে কলঙ্কিত না করতে পারে, প্রত্যাশা হোক এমনটাই।
লেখক : অর্থনীতিবিদ ও গবেষক
ইমেইল : mizan12bd@gmail.com

 

 

 


আরো সংবাদ



premium cement
গফরগাঁওয়ে পানিতে ডুবে শিশুর মৃত্যু দ্রব্যমূল্য ঊর্ধ্বগতিতে সাধারণ মানুষ দিশেহারা : আমিনুল লিবিয়ায় নিয়ে সালথার যুবককে নির্যাতনের ঘটনায় মামলা, গ্রেফতার ১ মনুষ্য চামড়ায় তৈরি বইয়ের মলাট সরানো হলো হার্ভাড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আওয়ামী লীগকে বর্জন করতে হবে : ডা: ইরান আমরা একটা পরাধীন জাতিতে পরিণত হয়েছি : মেজর হাফিজ তরুণীর লাশ উদ্ধারের পর প্রেমিকসহ ৪ জনের বিরুদ্ধে মামলা ভিয়েনায় মুসলিম বিশ্বের রাষ্ট্রদূতদের ইফতারে ইসলামিক রিলিজিয়াস অথোরিটি আমন্ত্রিত এবার বাজারে এলো শাওমির তৈরি বৈদ্যুতিক গাড়ি সকল কাজের জন্য আল্লাহর কাছে জবাবদিহিতার অনুভূতি থাকতে হবে : মাওলানা হালিম বিএনপি জনগণের ভাগ্য পরিবর্তনের জন্য রাজনীতি করে : ড. মঈন খান

সকল