১৯ এপ্রিল ২০২৪, ০৬ বৈশাখ ১৪৩১, ০৯ শাওয়াল ১৪৪৫
`

সত্যিই দেশে দুর্ভিক্ষ এলে করণীয় কী?

-

দেশের অর্থনীতিতে দুর্ভিক্ষ ধেয়ে আসছে বলে বারবার সতর্কবাণী আসছে সরকারের উচ্চ মহল থেকে। বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থাও বলছে, ২০২৩ সালের মাঝামাঝি থেকেই দুর্ভিক্ষ আসছে এবং সেটা বিশ্বব্যাপী। তার চেয়েও খারাপ খবর হলো, এই সঙ্কট শিগগিরই কেটে যাওয়ার কোনো সম্ভাবনাই নেই। প্রশ্ন হলো, সত্যিই কি ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ আসতে যাচ্ছে? যদি আসে তো বাংলাদেশেও আসছে? একান্তই যদি দুর্ভিক্ষ আসেই তাহলে সম্ভাব্য কারণগুলো কী এবং করণীয়ই বা কি?
বিশ্বব্যাংকের অক্টোবর মাসের রিপোর্ট অনুযায়ী কেবল বাংলাদেশেই নয়, বিশ্বের ৪৫টি দেশে তীব্র খাদ্য ঘাটতি দেখা দিতে পারে। এসব দেশের মধ্যে আফ্রিকা এবং এশিয়া মহাদেশের বিভিন্ন দেশের সাথে বাংলাদেশের খাদ্য নিরাপত্তা আশঙ্কাজনক। এই দেশগুলোর ২০ কোটি মানুষ অত্যন্ত ভয়াবহ পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে পারে। উল্লেখ্য, বিশ্বের অনেক দেশেই দুর্ভিক্ষের আলামত ইতোমধ্যে দেখা যাচ্ছে। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির কারণে বাংলাদেশসহ বহু দেশের মানুষ প্রয়োজনীয় খাদ্য কিনতে পারছে না। বিশেষ করে দেশের বাজারে চাল, আটা ও ভুট্টার দামে রেকর্ড। মাত্র ছয় মাসের ব্যবধানে এসব খাদ্যপণ্যের মূল্য বেড়ে প্রায় দ্বিগুণ হয়েছে। সামগ্রিকভাবে দেশের মূল্যস্ফীতি ৯ দশমিক ৫ শতাংশ; সাধারণ ক্রেতাদের মতে বাস্তব অবস্থা আরো অনেক বেশি। দুর্ভিক্ষ আসার প্রধান কারণগুলো চিহ্নিত করা এবং কিভাবে উত্তরণ পাওয়া যায় সেই বিষয়েই আলোচনা করব।

বিশ্বব্যাপী খাদ্য উৎপাদন কমে যাওয়া
খাদ্যের উৎপাদন বিশ্বব্যাপী কমে যাচ্ছে এবং আরো কমার আশঙ্কা দেখা দিচ্ছে। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ, জলবায়ু পরিবর্তন, করোনা মহামারীর প্রভাব এবং দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি তার অন্যতম কারণ। সমগ্র বিশ্বের প্রায় তিন ভাগের এক ভাগ গম এবং বার্লি উৎপাদিত হয় রাশিয়া এবং ইউক্রেনে। বৈশ্বিক চাহিদার ৭০ ভাগ সূর্যমুখী তেল আসে এই অঞ্চল থেকে। ইউক্রেন একাই বিশ্বের ৪০ ভাগ সূর্যমুখী এবং ১৬ ভাগ ভুট্টা উৎপাদন করে। যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকে এই অঞ্চলের কৃষি ব্যবস্থা সম্পূর্ণ ভেঙে পড়েছে, ফলে সমগ্র বিশ্বের খাদ্য উৎপাদনে ঘাটতি তৈরি হচ্ছে।
পৃথিবীর প্রায় ২৫ শতাংশ সার উৎপাদন করে রাশিয়া। ইউক্রেনেও অনেক ধরনের রাসায়নিক সারের কারখানা রয়েছে। যুদ্ধের শুরু থেকে এই অঞ্চলের সার রফতানি নেই বললেই চলে। গ্যাসের দাম বেড়ে যাওয়ায় বিশ্বের অন্যান্য অঞ্চলেও সার উৎপাদন খরচ অনেক বেড়ে গেছে। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের প্রতিবেদন অনুযায়ী, খাদ্য এবং সারের দাম বেড়ে যাওয়ায় পৃথিবীর সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত ৪৮টি দেশকে অতিরিক্ত ৯ বিলিয়ন ডলার খরচ করতে হবে। সারের দাম বৃদ্ধিই নয়, আশঙ্কা করা হচ্ছে আগামী বছর হয়তো সার পাওয়া যাবে না। পৃথিবীতে যত মানুষ খাদ্য সঙ্কটে ভুগছে তার মধ্যে ৬০ শতাংশ বসবাস করে যুদ্ধ-বিগ্রহকবলিত এলাকাগুলোতে। যুদ্ধ চলতে থাকলে সামনের দিনগুলোতে পরিস্থিতির আরো অবনতি হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। আফ্রিকান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক বলেছে, আফ্রিকার বিভিন্ন দেশে সারের ব্যাপক সঙ্কট সৃষ্টি হয়েছে। এ অবস্থা অব্যাহত থাকলে আফ্রিকা মহাদেশের খাদ্য উৎপাদন ২০ ভাগ কমে যাবে।
জলবায়ু পরিবর্তনের কারণেও বিশ্বের খাদ্য উৎপাদন কঠিন হয়ে পড়েছে। পৃথিবীর কোথাও অতিবন্যা এবং কোথাও খরায় ভুগছে। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোর ১২০ কোটির বেশি লোক সরাসরি ঝুঁকির মধ্যে বাস করছে। এর মধ্যে শুধু চীন এবং ভারতের প্রায় ৮০ কোটি লোক ভয়াবহ বন্যার ঝুঁকিতে রয়েছে। ক’মাস আগে বাংলাদেশেও অসময়ের বন্যায় বিপুল পরিমাণ শস্যের ক্ষতি হয়েছে। শুধু এশিয়া নয়; অস্ট্রেলিয়া থেকে নাইজেরিয়া, ভেনিজুয়েলা থেকে ক্যালিফোর্নিয়া পৃথিবীর কোনো অঞ্চল বন্যার প্রকোপ মুক্ত নয়। অন্য দিকে, বহু উর্বর অঞ্চলে পানির অভাবে ব্যাপক খরা দেখা দিচ্ছে। অস্ট্রেলিয়া বন্যার পাশাপাশি খরার দিক থেকেও শীর্ষে রয়েছে। দক্ষিণ আমেরিকার খাদ্য রফতানিকারক দেশগুলোতে বিগত এক হাজার বছরের মধ্যে সবচেয়ে ভয়াবহ খরা হয়েছে। ব্রাজিল আর্জেন্টিনা বলিভিয়াসহ বেশ কিছু দেশে খরার কারণে ভুট্টা, সয়াবিন, কফি, চিনি এবং তুলার মতো চাহিদাসম্পন্ন শস্যের ঘাটতি সৃষ্টি হয়েছে।
কিছুটা আশঙ্কার কথা হলো, বাংলাদেশের বৃষ্টিপাত কম হওয়ায় আমন ধানের ফলন কম হতে পারে। এ ছাড়াও ডিজেলের দাম বৃদ্ধি এবং ফলে বিদ্যুতের লোডশেডিংয়ে সেচের ব্যাঘাত এবং সারের দাম বৃদ্ধির ফলে বোরো ধান উৎপাদন ব্যাহত হতে পারে। ফলে অভ্যন্তরীণ উৎপাদন ২৫ লাখ টন কম হবে বলে আশঙ্কা করছেন বিজ্ঞানীরা। এক দিকে মূল্যস্ফীতি, অন্য দিকে দেশীয় এবং আন্তর্জাতিক বাজারে খাদ্যপণ্যের সঙ্কট বাংলাদেশকে কিছুটা নাজুক পরিস্থিতির দিকে নিয়ে যেতে পারে। পৃথিবীর বহু দেশ এখন থেকেই খাদ্য রফতানি বন্ধ অথবা নিরুৎসাহিত করার জন্য বাড়তি শুল্ক আরোপ করছে। খাদ্য সঙ্কট দেখা দিলে অনেক দেশ খাদ্য রফতানির ওপর নিষেধাজ্ঞাও দিতে পারে। তাই আগামী দিনগুলোতে খাদ্যশস্যের জন্য আন্তর্জাতিক বাজারের ওপর নির্ভরশীল হওয়া মোটেও ঠিক হবে না।

আন্তর্জাতিক ও দেশীয় বাজারে পণ্যের দাম বৃদ্ধি
আগামী বছর বিশ্ব খাদ্য সংকটে পড়লে লাগাম ছাড়া মূল্যস্ফীতির কারণে বাংলাদেশও রেহাই পাবে না। বাংলাদেশের শুধু মূল্যস্ফীতি নয়, ডলার সঙ্কট, জ্বালানি সঙ্কট এবং জলবায়ু পরিবর্তনজনিত সমস্যা রয়েছে। বিশ্বব্যাংক বলেছে, ইউরোপের বাজারে এলএনজির দাম বেড়ে যাওয়ায় বাংলাদেশ স্পট মার্কেট থেকে এ জ্বালানি কিনতে পারছে না। ফলে বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে এবং ব্যাপক লোডশেডিং করতে হচ্ছে। সরবরাহ ব্যবস্থা বিঘিœত হওয়ায় জ্বালানি পণ্যের বাজারে অস্থিরতা দেখা দিয়েছে। জ্বালানির দাম প্রত্যাশার চেয়ে বেশি বেড়ে গেলে তা খাদ্যপণ্যের নিরাপত্তাকে চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলতে পারে।
বিশ্বব্যাংক বলছে, নিজ নিজ দেশের মুদ্রার মান অবমূল্যায়নের কারণে উন্নয়নশীল দেশগুলোতে খাদ্যপণ্য ও জ্বালানি তেলের দাম বাড়ছে। ক্রুড অয়েলের দাম ইদানীং ৯ শতাংশ কমেছে। তার পরও স্থানীয় মুদ্রার মান অবমূল্যায়নের কারণে প্রায় ৬০ শতাংশ তেল আমদানিকারক দেশ স্থানীয় বাজারে জ্বালানি তেলের দাম বাড়িয়েছে। ফলে কৃষি উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে, যা খাদ্যপণ্যের দাম বাড়িয়ে দিচ্ছে। চলতি বছরের তিন প্রান্তিকে দক্ষিণ এশিয়ায় খাদ্যপণ্যে মূল্যস্ফীতি হয়েছে ২০ শতাংশ। ইউরোপসহ প্রায় সারা বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলে খাদ্য মূল্যস্ফীতির হার প্রায় ১৫ শতাংশ। এই মূল্যস্ফীতি আগামী বছর আরো বৃদ্ধি পেয়ে দীর্ঘায়িত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। বহু নিত্যপণ্যের দাম বর্তমানে সর্বোচ্চ পর্যায়ে আছে। এ অবস্থায় যদি আবারও খাদ্যপণ্যের দাম বাড়ে, তাহলে উন্নয়নশীল দেশগুলোর খাদ্যনিরাপত্তা চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে পারে। এ জন্য সরবরাহ ব্যবস্থা, বিতরণ, আয় বাড়ানোসহ বিভিন্ন খাতে দ্রুত প্রয়োজনীয় নীতি গ্রহণ করা প্রয়োজন।
কিছুটা স্বস্তির বিষয় হলো, বিশ্বের বিভিন্ন দেশ জ্বালানি পণ্যের দাম কমার অপেক্ষায় রয়েছে। জ্বালানি পণ্যের দাম এ বছর প্রায় ৬০ শতাংশ বাড়ার পর ২০২৩ সালে তা গড়ে ১১ শতাংশ কমবে। তবে এর পরেও গত পাঁচ বছরের গড় দামের চেয়ে ৭৫ শতাংশ উপরে থাকবে। বিশ্বব্যাংক আরো বলছে, ২০২৩ সালে ক্রুড অয়েলের গড় দাম ব্যারেলপ্রতি ৯২ ডলার হতে পারে যা গত পাঁচ বছর ছিল প্রতি ব্যারেল ৬০ ডলার। প্রাকৃতিক গ্যাস ও কয়লার দাম ২০২২ সালে রেকর্ড পরিমাণ বেড়েছিল। আগামী বছর কিছুটা কমেও অস্ট্রেলিয়ার কয়লা ও যুক্তরাষ্ট্রের প্রাকৃতিক গ্যাসের দাম গত পাঁচ বছরের গড় দামের চেয়ে দ্বিগুণ থাকবে। ‘বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি’ বলেছে, ২০১৯ সালের তুলনায় এখন তাদের পরিচালনা ব্যয় যে পরিমাণ বেড়েছে তা দিয়ে প্রতি মাসে আরো ৪০ লাখ বেশি মানুষকে খাওয়াতে পারে। তবে যদি ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ বন্ধ হয় তো, ২০২৩ সালে কৃষিপণ্যের দাম ৫ শতাংশ এমনকি আরো বেশি কমতে পারে; কারণ তখন গমের, চালের উৎপাদন ও সরবরাহ বৃদ্ধি পাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।

সঙ্কট মোকাবেলায় অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা
সঙ্কট মোকাবেলায় ডলার ব্যবস্থাপনা : খোলাবাজারের এত ডলার যাচ্ছে কোথায় সেই প্রশ্ন বাজারসংশ্লিষ্টদের। সরকার বলছে, স্পট মার্কেট থেকে গ্যাস কেনার জন্য রিজার্ভে পর্যাপ্ত অর্থ নেই। অথচ বাংলাদেশ ব্যাংক প্রতিদিন এক থেকে দেড়শ’ মিলিয়ন ডলার বাজারে ছাড়ছে। অর্থবছরের প্রথম তিন মাস ২০ দিনের মধ্যেই ৪৬০ কোটি ডলার রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোকে দেয়া হয়েছে। অথচ গত অর্থবছরের পুরো সময়ে বাংলাদেশ ব্যাংক খোলাবাজারে বিক্রি করেছিল মাত্র ৭০৭ কোটি ডলার। এবার চার মাসেরও কম সময়ে বিক্রি করা হয়েছে গত বছরের পুরো সময়ের ৬০ শতাংশের উপরে। অথচ বর্তমানে দেশের ২০টি ব্যাংকের কাছে দায় মেটানোর মতো ডলার নেই।
এই সঙ্কটের সময়েও ডলার খরচে রয়েছে ব্যাপক অনিয়ম। তৈরী পোশাক খাতের সুতা, তুলা, অ্যাক্সেসরিজ এগুলোতে তো ব্যাক টু ব্যাক এলসির মাধ্যমে তাদের আয় থেকেই অর্থ পরিশোধ হয়ে যায়। সেখানে বাজার থেকে ডলার কেনার প্রয়োজন হয় না। বাণিজ্যিক আমদানির ক্ষেত্রে খোলাবাজার থেকে ডলার কেনার দরকার হয়। কিন্তু সেখানে এলসি মার্জিন বাড়ানো হয়েছে। এছাড়া শুল্ক-কর বাড়িয়ে আমদানি নিরুৎসাহিত করা হয়েছে। কাজেই সেখানে তেমন ডলার প্রয়োজন হচ্ছে না। সুতরাং বাজারে ছাড়া এত ডলার কোথায় যায়, সে প্রশ্ন অনেকেরই। যে পরিমাণ ডলার বাজারে ছাড়া হয়ে, তা যদি সার, ডিজেল বা গ্যাস কেনার ক্ষেত্রে ব্যয় হতো, তাহলে বিদ্যুতের এই পরিস্থিতি হতো না। সরকারের দায়িত্বশীল ব্যক্তিরা ডলার সঙ্কটের যে কথা বলছেন, তার সঙ্গে বাস্তবতা মিলছে না।
বৈদেশিক বিনিময় হার ব্যবস্থাপনায় একটি বড় ধরনের ত্রুটি দেখা দিয়েছে। ফলে রেমিট্যান্সে ধস নেমেছে। অবস্থাদৃষ্টে মনে হয়, আইএমএফ থেকে সাড়ে চার বিলিয়ন ডলার পেলেও সেটা মাত্র তিন মাসেই খরচ হয়ে যাবে। বর্তমান বিনিময় হারের মাধ্যমে রেমিট্যান্স ও রফতানি আয় দু’টিকেই নিরুৎসাহিত করা হচ্ছে। বৈদেশিক মুদ্রার স্থিতিশীলতার জন্য একক বিনিময় হার নিশ্চিত করা জরুরি। দু’দিন আগে নেট ইন্টারন্যাশনাল রিজার্ভ (এনআইআর) ছিল ৩২ বিলিয়ন ডলার। এই মাসে দুই বিলিয়ন ডলারের উপরে ‘আকু’ পেমেন্ট দিতে হবে। সেটার পাশাপাশি ইডিএফ ও আইডিএফ তহবিলসহ অন্যান্য খাতে রিজার্ভ থেকে যে অর্থ দেয়া হয়েছে, তা যদি বাদ দেয়া হয় তাহলে রিজার্ভ ২৫ থেকে ২৬ বিলিয়ন ডলারে দাঁড়াবে।

সঙ্কট মোকাবেলায় বলিষ্ঠ নেতৃত্ব
দেশের সর্বোচ্চ মহল থেকে দুর্ভিক্ষের আতঙ্ক সৃষ্টি করা হচ্ছে। দেশে অর্থনীতিতে সঙ্কট অথচ অর্থমন্ত্রীর খবর নেই যদিও এসব সঙ্কট মোকাবেলা এবং কথা বলার দায়িত্ব অর্থমন্ত্রী ও অর্থ মন্ত্রণালয়ের। কিন্তু এখন একেকজন একেকরকম কথা বলছেন। সঙ্কটটা কী এবং কতটা গভীর, কিভাবে সঙ্কট মোকাবেলা করা হবে, সে বিষয়েও কেউ কিছু বলছেন না। রিজার্ভ কমতে না দেয়ার বিষয় জরুরি পদক্ষেপ নেয়া প্রয়োজন। আইএমএফের সঙ্গে দরকষাকষি করার দায়িত্ব বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর বা অর্থ সচিবের নয়, রাজনৈতিক নেতাদের। জরুরি ভিত্তিতে বিদ্যুৎ উৎপাদন এবং সরবরাহ,এমনকি প্রয়োজনে আমদানি করা প্রয়োজন। পায়রা বিদ্যুৎকেন্দ্রের সঞ্চালন লাইনের ব্যবস্থা করে উৎপাদন সক্ষমতা কাজে লাগানো প্রয়োজন। ব্যবসায়ীরা গ্যাস-বিদ্যুতের বাড়তি মূল্য পরিশোধের জন্যও প্রস্তুত। কাজেই তাদের উৎপাদন ঠিক রাখতে জ্বালানি সরবরাহ নিশ্চিত করা দরকার।

সঙ্কট মোকাবেলায় রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা
দেশে রাজনৈতিক অস্থিরতা বিরাজ করছে অনেক দিন যাবত। সবাই যেন এখন ২০২৪ সালের নির্বাচন নিয়ে ব্যস্ত। সরকারি দল ক্ষমতা ধরে রাখার এবং বিরোধীরা সরকারকে হটানো নিয়ে ব্যস্ত। বিশ্বে এমনকি দেশে এত বড় সঙ্কট ধেয়ে আসছে; সে বিষয়ে ভাবার যেন কেউ নেই। সরকারের ভেতরে সমন্বয় বলে কিছু নেই, যে কারণে বাস্তবের চেয়ে অনেক বাড়িয়ে কথা বলছেন অনেকে। সমস্যা পুরোটাই বৈশ্বিক বলে চালিয়ে দিতে চাচ্ছেন সরকার। একের দোষ অন্যের ওপর দিচ্ছেন। অনেকেই আবার দেশে কোনো সমস্যাই নেই, বলছেন। দুর্ভিক্ষের পাশাপাশি বিদ্যুতের খরা দেখা দেবে, এমন কথাও বলছেন অনেকেই। অথচ এগুলো মোকাবেলা করার জন্য মধ্যমেয়াদি কিছু পদক্ষেপ প্রয়োজন, সে বিষয়ে কোনো উদ্যোগ নেই। এখন বাজেটের কাঠামো এবং অষ্টম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার কোনো প্রাসঙ্গিকতা নেই। দুর্ভিক্ষ মোকাবেলার জন্য একটি মধ্যমেয়াদি পরিকল্পনা দরকার।
অন্য দিকে বিরোধী মত সব দোষ সরকারের ওপর চাপিয়ে দিয়ে সরকার-পতন চাচ্ছে। তাদের মতে, সমস্যা বৈশ্বিক নয় বরং স্বৈরশাসন, লুটপাট, বিদেশে টাকা পাচার, অব্যবস্থা, অদক্ষতা ইত্যাদিই বর্তমান অর্থনৈতিক সঙ্কটের জন্য দায়ী। এমনকি সরকারের ব্যর্থতা প্রমাণের জন্য দেশে দুর্ভিক্ষ যদি লাগেও তাতেও যেন তাদের কিছু আসে যায় না। কোনো ধরনের সমন্বিত পদক্ষেপ নেই ক্রাইসিস মোকাবেলার জন্য। এ ধরনের অবস্থার কারণে বাজারব্যবস্থা আস্থাহীন এবং নিয়ন্ত্রণহীন হয়ে পড়ছে। ফলে সরবরাহ, বিশেষ করে দেশীয় পণ্যের সরবরাহ স্বাভাবিক থাকার পরও দাম বাড়ছে লাফিয়ে লাফিয়ে। একেক সময় একেকটি পণ্য নিয়ে কারসাজি করে ব্যবসা করছে অসাধু ব্যবসায়ীরা। এই আস্থাহীনতা চলতে থাকলে সঞ্চয়ের ক্ষেত্রে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে, বিদেশি বিনিয়োগ হ্রাস পাবে। এতে যারা বাজার নিয়ে কারসাজি করে তারা সুযোগ পায় এবং মূল্যস্ফীতি বৃদ্ধি পাওয়ার সুযোগ সৃষ্টি হয়। এই মুহূর্তে রাজনৈতিক সমঝোতা প্রয়োজন।

দুর্ভিক্ষ মোকাবেলায় সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি
দুর্যোগ বা উচ্চ মূল্যস্ফীতির সময় মধ্যবিত্ত এবং নিন্মমধ্যবিত্ত মানুষেরা সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। তারা কারো কাছে হাত পাততে পারে না, আবার লাইনে দাঁড়িয়ে স্বল্পমূল্যের নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য কিনতেও তাদের আত্মসম্মানে লাগে। দুর্যোগের সময় তাদের কষ্ট কেউ দেখে না। দেশের প্রায় ২৫ শতাংশ মানুষ অরক্ষিত। তারা যেকোনো চাপে দারিদ্র্যসীমার নিচে চলে যেতে পারে। সেজন্য সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির আওতায় ৫৫-৬০ শতাংশ মানুষকে নিয়ে আসা উচিত। পাশাপাশি, পেনশন, বেকারত্ব বীমা বা স্বাস্থ্য বীমার মতো সুরক্ষা মানুষ নিতে পারে এবং দুর্যোগের সময় সেখান থেকে ঋণ নিতে পারে, সেরকম ব্যবস্থা থাকতে হবে।
উল্লেখ্য, সরকার সামাজিক নিরাপত্তা খাতে, পেনশন বাদে, জিডিপির ১ দশমিক ৫ থেকে ১ দশমিক ৭ শতাংশ বরাদ্দ রেখেছে। এটা যেমন অনেক কম, তেমনি এর সুবিধাভোগী নির্বাচনেও রয়েছে নানা ধরনের সমস্যা। সামাজিক সুরক্ষা ৭১ শতাংশ ভুল মানুষকে দেয়া হয়। শহরাঞ্চলের চেয়ে গ্রাম অঞ্চলের দরিদ্ররা কম সুরক্ষা পায়। ফলে সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচি অতটা কার্যকর হচ্ছে না। অনানুষ্ঠানিক খাতের শ্রমিকদেরও সামাজিক সুরক্ষা খাতের আওতায় নিয়ে আসা প্রয়োজন। সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির সংস্কারের জন্য রাজনৈতিক ইচ্ছা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। কেউ যেন পিছিয়ে না থাকে, তা নিশ্চিত করতে এর বিকল্প নেই।
সবশেষে বলতে হয়, খাদ্য ঘাটতির কারণে বাংলাদেশে দুর্ভিক্ষ হওয়ার সুযোগ তুলনামূলকভাবে কম। কারণ দেশে খাদ্যশস্যের চাহিদার প্রায় ৯৫ শতাংশই স্থানীয় পর্যায়ে উৎপাদিত হয়। অর্থাৎ ঘাটতি হলে বড়জোর ৫ শতাংশ খাদ্য ঘাটতি হবে; তাতে খাদ্য ঘাটতিজনিত দুর্ভিক্ষ হওয়ার তেমন কারণ নেই। সতর্কতার জন্য সরকার অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে খাদ্য সংগ্রহের পরিবর্তে বিদেশ থেকে আমদানি করে বাফার স্টক করতে পারে। আমরা ২০০৮-০৯ এর বৈশ্বিক মন্দার সময়ও দেখেছি, কৃষিসহ রিয়েল ইকোনমিতে অর্থায়নের কৌশল অবলম্বন করে দেশের অর্থনীতির চাকা সচল রাখতে সক্ষম হয়েছিল। করোনা অতিমারি-সময়ও কৃষি দেশকে অর্থনৈতিক সুরক্ষা দিয়েছিল। সুতরাং চলমান অর্থনৈতিক সঙ্কটের সময় কৃষিই হতে পারে দেশের অর্থনীতির রক্ষাকবচ। এতদসত্ত্বেও অসাধু ব্যবসায়ীরা মজুদ করে কৃত্রিম খাদ্য সঙ্কট সৃষ্টি করতে পারে। এতে দাম বেড়ে খাদ্যদ্রব্যাদি মধ্যবিত্ত ও নি¤œমধ্যবিত্তের ক্রয়ক্ষমতার বাইরে চলে যেতে পারে। এ জন্য সরকারকে বাজার তদারকি এবং নিয়ন্ত্রণ ঠিক রাখতে হবে; অপচয় রোধ করতে হবে। সামাজিক সুরক্ষা দিতে হবে। পাশাপাশি দেশের উৎপাদন ব্যবস্থা ঠিক রাখা, সার ও পানি সরবরাহ নিশ্চিত করা, পণ্যের সঠিক মূল্যসহ সরবরাহ নিশ্চিত করা, কৃষির যান্ত্রিকীকরণ ও গবেষণায় আরো নজর দেয়া ইত্যাদিসহ একটি ভারসাম্যপূর্ণ স্বল্পকালীন অর্থনৈতিক কৌশল নিতে হবে। দেশে খাদ্যপণ্যের সর্বোচ্চ মজুদ গড়ে তুলতে হবে। দুর্ভিক্ষের বিষয়ে এত বেশি বক্তব্য অনেকটাই রাজনৈতিক; এতে জনগণের মধ্যে আতঙ্ক সৃষ্টি হয়; মজুদদাররা মজুদে উদ্বুদ্ধ হয়। সরকার কেন দুর্ভিক্ষের কথা বলছে, তা অনেকের কাছেই বোধগম্য নয়। তবে, নিজেদের দুর্নীতি এবং অব্যবস্থা বিশ্বের ঘাড়ে চাপিয়ে নিজেরা পার পাওয়ার জন্য প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা হিসেবে আগাম দুর্ভিক্ষের কথা বলছে হয়তো, যেন সত্যিই দুর্ভিক্ষ হলে নিজেরা দায়মুক্ত থাকতে পারে। আসুন, রাজনৈতিক সমঝোতায় আসি। আতঙ্ক না ছড়িয়ে সবাই মিলে সঙ্কট মোকাবেলার উপায় খুঁজে বের করি এবং পাশাপাশি আল্লাহর সাহায্য কামনা করি; যিনি প্রকৃত অর্থে রিজিকের মালিক।
লেখক : অর্থনীতিবিদ, গবেষক ও কলামিস্ট
ইমেইল : mizan12bd@yahoo.com


আরো সংবাদ



premium cement