১৯ এপ্রিল ২০২৪, ০৬ বৈশাখ ১৪৩১, ০৯ শাওয়াল ১৪৪৫
`

করোনার টিকাবিজ্ঞানীরা এবারো পাননি নোবেল পুরস্কার

-

করোনার টিকাবিজ্ঞানীরা এবারো নোবেল পুরস্কার পাননি। যুগান্তকারী ‘এমআরএনএ প্রযুক্তি’ এবং এ প্রযুক্তি ব্যবহার করে উদ্ভাবিত টিকা বিশ্বের কোটি কোটি মানুষকে সুরক্ষা দিয়েছে প্রাণ বাঁচিয়েছে। ফলে বিজ্ঞান জগতে নোবেল পুরস্কারের জন্য এ বিষয়টিই বেশি আলোচিত ছিল। কিন্তু বিজ্ঞানের কোনো শাখাতে এ পুরস্কার এবার দেয়া হয়নি। সাংবাদিকরা এ নিয়ে সুইডেনে নোবেল পুরস্কার কমিটির দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিলেন। তারা বলেছেন, এমআরএনএ প্রযুক্তির সফলতা বিজ্ঞান জগতে একটি সাফল্যের গল্প। তেমনি এমআরএনএ ও ডিএনএ-ভিত্তিক নেক্সটজেন টিকার উদ্বাবনও যুগান্তকারী ঘটনা। তবে এ বিষয়ে তারা আরো সময় নিচ্ছেন।

বিজ্ঞানে নোবেল পুরস্কার
বিজ্ঞানে ২০২২ সালের নোবেল পুরস্কার ঘোষণা করা হয়েছে। আজ বৃহস্পতিবার সাহিত্যে, আগামীকাল শুক্রবার শান্তিতে এবং এরপর সোমবার অর্থনীতিতে ঘোষিত হবে নোবেল পুরস্কার। বিজ্ঞানের তিনটি শাখা চিকিৎসা, পদার্থ ও রসায়নে চমৎকার বিষয়ে যুগান্তকারী গবেষণায় এবার নোবেল পুরস্কার দেয়া হয়েছে।
চিকিৎসাবিজ্ঞানে নোবেল পুরস্কার লাভ করেছেন সুইডিশ জিনবিজ্ঞানী ড. সভান্তে পাবো। বিলুপ্ত হোমিনিনদের জিনোম ও মানুষের বিবর্তনের বিষয়ে মৌলিক গবেষণার জন্য তিনি এ পুরস্কার পান। সভান্তের বাবা বায়োকেমিস্ট সুন্যা বারিস্ট্রামও ১৯৮২ সালে চিকিৎসাবিজ্ঞানে নোবেল পুরস্কার পেয়েছিলেন।
সভান্তে পাবোর গবেষণাটি খুব চমৎকার। নোবেল কমিটি তাদের ওয়েবসাইটে উল্লেখ করেছেন যে, হোমিনিন হলো হোমিনিন ‘ট্রাইব’ ভুক্ত সব প্রাণী। ‘হোমো’গণ অর্থাৎ আধুনিক মানুষ যেমন এর অন্তর্ভুক্ত, মেনি নিয়ান্ডার্থাল, অস্ট্রালোপিথিকাসহ অন্যান্য অনেক বিলুপ্ত গণও এর অন্তর্গত। এ বিলুপ্ত হোমিনিনদের সাথে আমাদের সম্পর্ক কী? আমরা, হোমো স্যাপিয়েন্স, বাকি হোমিনিনদের থেকে ঠিক কিভাবে আলাদা? এসব প্রশ্নের জবাব বের করার একটি উপায় খুঁজে বের করেছেন এ নোবেলজয়ী বিজ্ঞানী। তিনি গবেষণা করে অসম্ভবকে সম্ভব করেছেন।
ড. সভান্তে পাবো নিয়ান্ডার্থলদের জিনোম সিকোয়েন্স করেছেন। একইসাথে আবিষ্কার করেছেন নতুন এক হোমিনিনসহ গণ, যার নাম ‘ডেনিসোভা’। গবেষণায় তিনি দেখান এ বিলুপ্ত হোমিনিনদের সাথে হোমো স্যাপিয়েন্সের জিন বিনিময় হয়েছিল প্রায় ৭০ হাজার বছর আগে। এ জিন বিনিময়ের প্রমাণ এখনো রয়ে গেছে আমাদের শরীরে-কম অক্সিজেনে মানিয়ে নেয়ার জিন কিংবা জীবাণু থেকে আমাদের শরীরে কিভাবে নিজেকে রক্ষা করে, সেই প্রক্রিয়ার মধ্যে। তার গবেষণায় বিজ্ঞানের নতুন এক শাখার সূচনা হয়েছে- ‘প্যালিওজিনোমিক্স’ বর্তমান মানুষের সাথে আদিম মানুষ বা বন মানুষ যা বিলুপ্ত হোমিনিনদের জিনের পার্থক্য বের করার পথে তার আবিষ্কার আমাদের অনেকটা এগিয়ে নিয়েছে। বিজ্ঞানীদের ধারণা, আধুনিক মানুষ অর্থাৎ হোমো স্যাপিয়েন্সের উৎপত্তি আফ্রিকায়, প্রায় তিন লাখ বছর আগে। আর মানুষের সবচেয়ে কাছের নিয়ান্ডার্থালদের উৎপত্তি সাত লাখ বছর আগে। প্রায় ৩০ হাজার বছর আগে তারা বিলুপ্ত হয়। বিশ শতকের একদম শেষে এসে আধুনিক মানুষের জিনোম সিকোয়েন্স করা হয়।
বিজ্ঞানী সভান্তে পাবোর বয়স যখন ১৩ বছর, তখন তার মা তাকে মিসরে নিয়ে গিয়েছিলেন ছুটি কাটাতে। প্রাচীন মিসরের মমি এবং পিরামিড দেখার পর তার আগ্রহ তৈরি হয় মানুষের বিবর্তনের ব্যাপারে। ১৯৯০-এর দশকের শেষের দিকে জার্মানির লাইপজিগের ম্যাক্স প্ল্যাঙ্ক ইনস্টিটিউট ফর ইভোল্যুশনারি অ্যানথ্রোপলজি বিভাগে চাকরি নেন। সেখানে নিয়ান্ডার্থালদের মাইটোকন্ড্রিয়াল ডিএনএ নিয়ে কাজ করেছিলেন। তিনি সেখানে ডিএনএ নিউক্লিয়াসের গঠন সম্পর্কে গবেষণার গুরুত্ব দেন। অবশেষে তিনি ও তার দল পুরাতন হাড় থেকে ডিএনএকে আলাদা করেন এবং সেগুলো বিশ্লেষণ করার পদ্ধতি ক্রগামত ডেভেলপ করতে থাকেন এবং জিনবিন্যাসকে সুদক্ষ করে তুলেন। ড. সভান্তে পাবো তার গবেষণার মাধ্যমে শুধু নিয়াল্ডার্থালদের ডিএনএর বিন্যাস আবিষ্কার করেননি, এর জিনোম এবং আধুনিক মানুষের মধ্যে সংযোগও খুঁজে পান। তিনি প্রমাণ পান যে, হোমো স্যাপিয়েন্সের সাথে নিয়ান্ডার্থলদের যৌন সম্পর্কও ছিল এবং নিয়াল্ডার্থালদের মাধ্যমে বংশবৃদ্ধি ঘটেছিল। তার আবিষ্কৃত ডেনিসোভান এশিয়ায় বাস করতো। এসব আবিষ্কারের স্বীকৃতি ড. সভান্তের নোবেল পুরস্কার।
আলবার্ট আইনস্টাইন যাকে বলেছিলেন ‘দূর থেকে ভুতুড়ে কাণ্ড-কারখানা’, তাই জিতে নিলো এবার ফিজিক্সে নোবেল পুরস্কার। নোবেলজয়ী অস্ট্রিয়ার বিজ্ঞানী আরউইন শ্রয়েডিঙ্গার যাকে বলেছিলেন কোয়ান্টাম মেকানিক্সের একমাত্র বৈশিষ্ট্য, তা-ই জিতে নিলো এবারের নোবেল। নোবেলজয়ী বিজ্ঞানীরা কোয়ান্টাম মেকানিক্সের গবেষক। এরা এন্ট্যাঙ্গল্ড পার্টিকেল (অদ্ভুতুড়ে গাঁটছড়াবদ্ধ কণা) নিয়ে কাজ করেন।
বেল ইনইকুয়ালিটি বা বেলে অপ্রতিসমতা ভঙ্গের পরীক্ষালব্ধ প্রমাণ এবং কোয়ান্টাম ইনফরমেশন সায়েন্সের (কোয়ান্টাম তথ্যবিজ্ঞান) অগ্রদূত হিসেবে তিন বিজ্ঞানী ফরাসি ড. অ্যালান আসপেক্ট, মার্কিন জন ক্লাউসার এবং অস্ট্রীয় অ্যান্টন জেইলিঙ্গার এবার পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন।
কোয়ান্টাম বলবিদ্যার অন্যতম বিস্ময়কর বিষয় হলো কোয়ান্টাম অ্যান্টেঙ্গেলমেন্ট। এটি ছিল কোয়ান্টাম বলবিজ্ঞানের বিরুদ্ধে আইনস্টাইনের সবচেয়ে বড় অভিযোগ। দুই বা ততোধিক কণা বা সিস্টেম আলাদা হলেও একই তথ্য বহন করে।
১৯৭২ সালে ক্লাউসার ও ফ্রিডম্যান বেলের কাচের ওপর ভিত্তি করে প্রথম পরীক্ষালব্ধ প্রমাণ হাজির করেন। ১৯৮০-৮২ সালে বিজ্ঞানী জন ক্লাউসারের সেটআপের কিছু ত্রুটি দূর করে আরো শক্ত প্রমাণ দেন অ্যালান আসপেক্ট। ১৯৯৮ সালে অ্যান্টন জেইলিঙ্গর তার পরীক্ষায় কোয়ান্টাম অ্যান্টেঙ্গেলমেন্ট ব্যবহার করে কোয়ান্টাম স্টেট আরেকটি দূরের সিস্টেমে পাঠাতে সক্ষম হন। আধুনিক সময়ের কোয়ান্টাম ইনফরমেশন দাঁড়িয়ে আছে কোয়ান্টাম সিস্টেমের এ অ্যান্টেঙ্গেলমেন্ট ধর্মের ওপর। তাই তাদের এই কাজ যুগান্তকারী বলে বিবেচিত হয়েছে। অনেক বছর ধরেই ওই চার বিজ্ঞানী নোবেল পুরস্কারের জন্য বিবেচিত ছিলেন। তাদের মধ্যে ফ্রিডমান ২০১২ সালে মারা যান। বাকি তিনজনকে তাই এ পুরস্কারে মনোনীত করা হয় বলে উল্লেখ করেছে নোবেল কমিটি।
ক্লিক রসায়ন এবং বায়োঅর্থোগোনাল রসায়নে অবদান রাখার জন্য যুক্তরাষ্ট্রের স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ক্যারোলিন আর বার্তোজ্জি, ডেনমার্কের ইউনিভার্সিটি অব কোপেন হেগেনের অধ্যাপক মর্টেন মেলডাল ও যুক্তরাষ্ট্রের স্ক্রিপস রিসার্চের গবেষক কে ব্যারি শার্পলেসকে এবার রসায়নে নোবেল পুরস্কার দেয়া হয়েছে। কে ব্যারি শার্পলেস এর আগে ২০০১ সালেও রসায়নে নোবেল পুরস্কার পেয়েছিলেন।

টিকায় হার মানল করোনা মহামারী
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মহাসচিব তেদরোস আধানোম গেব্রেয়াসুস গত ১৫ সেপ্টেম্বর বিশ্ববাসীকে একটি সুসংবাদ জানিয়েছেন। সুসংবাদটি হচ্ছে করোনা মহামারীর শেষ দেখা যাচ্ছে। বিশ্বব্যাপী করোনার নতুন নিশ্চিত সংক্রমণের সংখ্যা নাটকীয়ভাবে কমে গেছে। তাই এ মহামারী শেষ করার সুযোগটি কাজে লাগাতে হবে। তিনি বলেন, যদি আমরা এ সুযোগ না নেই, তাহলে বিশ্বের বিভিন্ন দেশকে করোনার আরো ধরন, আরো মৃত্যু আরো বাধাবিঘœ এবং আরো অনিশ্চয়তার ঝুঁকিতে পড়তে হতে পারে। এজন্য করোনার সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ জনগোষ্ঠীর সব সদস্যকে টিকা দিতে দেশগুলোকে বিনিয়োগ অব্যাহত রাখতে হবে।
২০১৯ সালের শেষ দিকে চীনের উহানে প্রথম নোবেল করোনাভাইরাস শনাক্ত হয়। পরে তা মহামারী আকারে সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে। যুক্তরাষ্ট্রের জনস হপকিন্স বিশ্ববিদ্যালয় ও ওয়াল্ডোমিটার্সের হিসাব অনুযায়ী, ৬৫ লাখ ৫০ হাজার ৪৭৬ জন মানুষ (২ অক্টোবর, ২০২২ পর্যন্ত) মারা গেছেন। সংক্রমিত হয়েছেন ৬১ কোটি ৮০ লাখ মানুষ। যদিও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলেছে, বিশ্বে করোনায় প্রকৃত মৃত্যু দেড় কোটিরও বেশি। বিশেষ মডেলিংয়ের মাধমে ইকোনমিস্টের করা হিসাব অনুযায়ী, বিশ্বে করোনায় মৃতের সংখ্যা আনুমানিক এক কোটি ২০ লাখ।
সে যাই হোক, সুখবর হচ্ছে ২০২০ সালের মার্চ থেকে বিশ্ব যে আতঙ্ক ও হতাশার মধ্যে ডুবেছিল, সেটা এখন আর নেই। এর প্রধান কারণ করোনাভাইরাসের টিকা আবিষ্কার। মহামারী শুরু হওয়ার মাত্র এক বছরের মাথায় টিকা আবিষ্কার হয়ে যায়। তাও কার্যকর নেক্সটজেন কয়েকটি টিকা। এই কার্যকর টিকার সংখ্যা এক ডজনেরও বেশি। শুধু তাই নয়, টিকা আবিষ্কারে এবার সম্পূর্ণ নতুন প্রযুক্তি ব্যবহৃত হয়েছে। এটা হচ্ছে ‘এমআরএনএ’ বা মেসেঞ্জার আরএনএ প্রযুক্তি। বিজ্ঞানীরা বলেছেন এমআরএনএ টিকা আবিষ্কার একটি দুর্দান্ত সাফল্যের গল্প, যা মানবজাতির জন্য ব্যাপক অবদান রেখেছে। আগে শুধু ডিএনএ-ভিত্তিক টিকা হয়েছে। প্রচলিত পদ্ধতিতে এগুলো তৈরি হয়েছে ভাইরাল ভেক্টর প্রযুক্তি ব্যবহার করে।
প্রসঙ্গত আরো একটি বিষয় বলা প্রয়োজন যে, দ্রুত টিকা আবিষ্কারের ক্ষেত্রে চীনা বিজ্ঞানীদের কোভিড-১৯ ভাইরাসের জিনোম বের করে উন্মুক্ত করে দেয়াও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। করোনাভাইরাসের জেনেটিক সিকোয়েন্স প্রকাশিত হওয়ামাত্র বিজ্ঞানীরা নাওয়া-খাওয়া ভুলে ল্যাবে কোভিড-১৯ এর জিন সিকোয়েন্স পুঙ্খানুপুঙ্খ বিশ্লেষণ করেন। কেউ গবেষণা শুরু করেন প্রচলিত ডিএনএ-ভিত্তিক ভাইরাল ভেক্টর প্রযুক্তি নিয়ে, কেউ নতুন প্রযুক্তি এমআরএনএ নিয়ে।
করোনাভাইরাসের গায়ে সুচালো ফলার মতো লাগানো থাকে। এগুলো ‘এস প্রোটিন’ বা স্পাইক প্রোটিন। বিজ্ঞানীরা চিন্তা করলেন কোভিড-১৯ এর জিনোম পরীক্ষা করে যদি স্পাইক প্রোটিন তৈরির সঙ্কেত ধরা যায়, তাহলে শরীরের মধ্যে গোটা ভাইরাসটি না ঢুকিয়ে সিনথেটিক (ল্যাবে তৈরি করা) ‘মেসেঞ্জার আরএনএ’ এর সাহায্যে শুধু স্পাইক প্রোটিনটিকে কোষের মধ্যে তৈরি করা যেতে পারে। এটা করতে পারলেই সফলতা। শরীরের কোষ ধরে নেবে যে দেহের ভেতর আসল ভাইরাস ঢুকে পড়েছে। যথারীতি শরীর করোনাভাইরাসের সাথে লড়াই করতে প্রয়োজনীয় অ্যান্টিবডি তৈরি করতে থাকবে। এভাবে বিজ্ঞানীরা কম্পিউটারে কয়েকটি আরএনএ ভ্যাকসিন ডিজাইন করেন, যেগুলো মানুষের শরীরে কোষের মধ্যে গিয়ে স্পাইক প্রোটিন তৈরি করার সঙ্কেত দিতে পারে। এভাবে নতুন প্রযুক্তি ব্যবহার করে টিকার যুগান্তকারী আবিষ্কার হয়ে যায়।
আরএনএ এবং ডিএনএ-ভিত্তিক আবিষ্কৃত ভ্যাকসিনগুলো শরীরকে প্রয়োজনীয় জিনগত কোড দেয়, যা আমাদের রোগ-প্রতিরোধ ব্যবস্থা বা ইমিউন সিস্টেমকে নিজ থেকে ‘অ্যান্টিজেন’ তৈরি করতে সহায়তা করে। সবগুলো টিকার সাহায্যে দেহকে ‘ মেমরি’ টি-লিম্ফোসাইট’ সরবরাহ করা হয়, যা কিভাবে ভবিষ্যতে সেই ভাইরাসের বিরুদ্ধে লড়াই করতে পারে তা মনে রাখবে। টিকা দেয়ার পর ‘টি-লিম্ফোসাইট’ ও ‘বি-লিম্ফোসাইট’গুলো তৈরি হতে কয়েক সপ্তাহ লাগে। আর এভাবেই টিকাটি ভাইরাসকে পরাজিত করে।
আবিষ্কৃত এ টিকা করোনাভাইরাস মহামারী দমনে বিশেষ ভূমিকা রেখেছে। বিশ্ব ইতিহাসে এক বছরে সর্বোচ্চ সংখ্যক টিকা প্রয়োগের ক্ষেত্রে করোনাভাইরাস টিকা প্রয়োগ এক যুগান্তকারী ঘটনা। এ পর্যন্ত ১৮৪ দেশে এক বছরের মধ্যে ১২.৭ বিলিয়ন (১ বিলিয়নে ১০০ কোটি) ডোজ টিকা প্রয়োগ করা হয়েছে। ব্লুবমার্গের হিসাব অনুযায়ী প্রতিদিন ৭০.০৭ মিলিয়ন ডোজ টিকা দেয়া হয়েছে। এখন পর্যন্ত বিশ্বের ৬৮ শতাংশ জনগোষ্ঠীকে এক ডোজ টিকার আওতায় আনা হয়েছে। যুক্তরাজ্যের ইমপিরিয়াল কলেজের এক গবেষণায় বলা হয়েছে, করোনার টিকা দেয়ার ফলে বিশ্বের প্রায় ১ কোটি ৪৪ লাখ মানুষের মৃত্যু ঠেকানো সম্ভব হয়েছে। টিকা না হলে এ সময়ে মৃত্যুর যে রেকর্ড হয়েছে তার সাথে এ সংখ্যা যোগ হতো।

হার না মানা বিজ্ঞানী কারিকোর গল্প
হার না মানা এক বিজ্ঞানী কাটালিন কারিকো। তার অসামান্য গবেষণা ও আবিষ্কার মহামারীর মধ্যে লাখো জীবন বাঁচিয়েছে। কারিকো ছিলেন একজন হাঙ্গেরীয় শরণার্থী। তার সম্পর্কে ২০১৩ সালে চিকিৎসাবিজ্ঞানে নোবেলজয়ী অধ্যাপক র‌্যান্ডি শেকম্যান এক সমাবর্তন বক্তৃতায় বলেন, কারিকো বড় হয়েছেন ফ্রিজ, টেলিভিশন, এমনকি পরিষ্কার পানিবিহীন এক বাড়িতে। তার কাছে ছিল শুধু ইউনিভার্সিটি অব জাগ্রেবের বায়োমেডিক্যাল সায়েন্সের একটি পোস্ট-গ্র্যাজুয়েট ডিগ্রি আর ঝুড়িভরা স্বপ্ন। বিদেশ পাড়ি জমান তার স্বামী, ছোট্ট মেয়ে এবং তার টেডি বিয়ারটাকে নিয়ে। সেই টেডি বিয়ারের ভেতরে লুকিয়ে রাখেন নিজের গাড়ি বিক্রি করা কষ্টের টাকা যা বিদেশে গিয়ে প্রয়োজনে খরচ করতে পারেন। যুক্তরাষ্ট্রে এসে যাযাবরের মতো এক বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আরেক বিশ্ববিদ্যালয়ে উড়ে বেড়ান বেশ কয়েক দিন। অবশেষে ঠাঁই হয় পেনসিলভানিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে।
তখন থেকে তার লক্ষ্য ছিল নিজের এমআরএনএ (মেসেঞ্জার আরএনএ) বিষয়ক গবেষণা এগিয়ে নেয়া। অনেক বছরের সাধনার পরও গবেষণায় সার্থক না হওয়ায় সেই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তাকে বের করে দেয়া হয়। ড্রিউ ওয়াইজম্যান নামের এক সহকর্মী তাকে নিজের ল্যাবের একটা বেঞ্চে কাজ করার জায়গা করে দেন। সেই সহকর্মীর সাহায্যে কারিকো নিজের গবেষণার ভুলগুলো শুধরাতে সক্ষম হন। যুগান্তকারী একটি আবিষ্কার করার পরও যুক্তরাষ্ট্রের কোনো সুপরিচিত জার্নালে তার কাজ প্রকাশিত হয়নি। আবার ইউরোপে ফিরে যোগদান করেন বায়োএনটেক কোম্পানিতে, যা ফাইজারের আর্থিক সাহায্য পেয়ে যুক্তরাষ্ট্রে মডার্নার সমতুল্য টিকা তৈরি করেছে।
ফাইজার-বায়োএনটেক ও মডার্নার কোভিড টিকা দু’টি মেসেঞ্জার আরএনএ টিকা। এমআরএনএ হচ্ছে একটি অণু, যাতে প্রোটিন তৈরির নীলনকশা বা ব্লু-প্রিন্ট দেয়া থাকে। ৩০ বছরেরও বেশি সময় ধরে এ প্রযুক্তির ওপর গবেষণা হয়েছে। শুরুতে এমআরএনএ প্রযুক্তিকে কেউ গুরুত্ব দেননি। নিরাপদে শরীরের ইমিউন সিস্টেমকে শান্ত রেখে এমআরএনএ পদ্ধতি ব্যবহার করার অন্যতম পথিকৃৎ হলেন হাঙ্গেরীয় বংশোদ্ভূত এই বিজ্ঞানী ড. ক্যাটালিন কারিকো। ড. ড্রিউ ওয়াইজম্যানের সহযোগিতা নিয়ে তার আবিষ্কৃত ‘এমআরএনএ প্রযুক্তি’ ব্যবহার করেই তৈরি হয়েছে করোনার খুবই কার্যকর টিকা।

লেখক: সিনিয়র সাংবাদিক, জাতীয় প্রেস ক্লাবের সাবেক সাধারণ সম্পাদক
ই-মেইল: abdal62@gmail.com


আরো সংবাদ



premium cement