২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫
`

ন্যাটোর সাথে দীর্ঘস্থায়ী সঙ্ঘাতে রাশিয়া

অবলোকন
-

ক্রাইমিয়া স্টাইলে ইউক্রেনের চারটি অঞ্চলকে সামরিক দখলদারিত্বের মাধ্যমে রাশিয়ার মানচিত্রভুক্ত করার উদ্যোগ নিয়ে রুশ প্রেসিডেন্ট ভøাদিমির পুতিন ন্যাটো ও ইউরোপের সাথে দীর্ঘস্থায়ী সঙ্ঘাতে প্রবেশ করলেন। ইউরোপকে জ্বালানি, অস্ত্র ও যুদ্ধ ব্যয়ের ভয়ে ভীত করে রাশিয়ার সাথে সমঝোতায় বাধ্য করার মস্কোর যে কৌশল তা এখন কাজ করবে বলে মনে হচ্ছে না। পুতিনের প্রতিবেশী দেশের ভূখণ্ড দখলের এই কৌশল বিশ্ব স্বীকৃতি অর্জনের যেমন সম্ভাবনা নেই, তেমনিভাবে এটি বিদ্যমান বিশ্বব্যবস্থাকে স্থায়ী বিভাজনের দিকে নিয়ে যেতে পারে। আর পুতিনের সম্প্রসারণ কৌশল সফল হলেও বিশ্বের ভারসাম্য আগের অবস্থায় ফিরে আসবে বলে মনে হয় না। সে ক্ষেত্রে পুতিন সাবেক সোভিয়েত প্রজাতন্ত্রগুলোকে নিজ কর্তৃত্বে নিয়ে আসার চেষ্টা করবেন। আর এটি সফল করতে পাশ্চাত্যের নিয়ন্ত্রণের বাইরে গিয়ে পুতিন বিকল্প অর্থনৈতিক ব্যবস্থা তৈরির প্রচেষ্টা চালাতে পারেন সম্ভাব্য মিত্রদের সাথে নিয়ে।

নতুন পর্বে সঙ্ঘাত
২৩ থেকে ২৭ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত পাঁচ দিনব্যাপী গণভোটের ফলাফল এই কলাম প্রকাশের দিন পর্যন্ত চূড়ান্ত হবে না। তবে এর ফলাফল কী হবে সেটি যে কেউ এখনই বলে দিতে পারে। ক্রাইমিয়ার মতো ৯৭ শতাংশ লোক হয়তো বলবে যে আমরা রাশিয়ার অংশ হতে চাই। রাশিয়া এরপর তার ভূখণ্ডকে গণভোট করা অঞ্চল পর্যন্ত বিস্তৃত করবে। পশ্চিমারা আগে থেকেই বলেছে, এই ধরনের গণভোট অনুষ্ঠান অবৈধ এবং তারা কোনো সময়ই এর স্বীকৃতি দেবে না। এ কারণে গত বৃহস্পতিবার, জি-৭ পররাষ্ট্রমন্ত্রীরা একটি বৈঠকে আবার রাশিয়ার নিন্দা করেছেন এবং অতিরিক্ত নিষেধাজ্ঞা দেয়ার অঙ্গীকার করেছেন।
ইউক্রেন যুদ্ধকে কেন্দ্র করে যে বৈশ্বিক মেরুকরণ ঘটেছে তার একটি গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য হলো এই লড়াইয়ে রাশিয়ার অনেক ঐতিহ্যগত মিত্র সরাসরি মস্কোকে সমর্থন করছে না। বড় দেশগুলোর মধ্যে রাশিয়ার দুই মিত্র হলো চীন ও ভারত। চীন প্রকাশ্যে ইউক্রেনে সামরিক অভিযানে সমর্থন দেয়নি, যদিও দেশটি এই অভিযানের কারণে রাশিয়ার ওপর অর্থনৈতিক অবরোধ আরোপকেও সমর্থন করেনি। সোভিয়েত আমল থেকেই মস্কোর কৌশলগত মিত্র ভারত রাশিয়ার ইউক্রেন অভিযানে কার্যত নিরপেক্ষ ভূমিকা পালন করেছে। রাশিয়ার অভিযানকে দিল্লি সমর্থনও করেনি, আবার নিন্দাও করেনি। তবে দুই দেশই ব্রিকস ও সাংহাই সহযোগিতা সংস্থার সম্মেলনে রাশিয়ার সাথে একসাথে কাজ করছে। বৈশ্বিক মুদ্রা হিসেবে ডলার ও আন্তর্জাতিক বাণিজ্য তথ্য পরিষেবা ‘সুইফট’ এর বিকল্প উদ্ভাবনেও একসাথে কাজ করছে বলে মনে হয়।
রাশিয়া ইউক্রেন অভিযানে এককথায় সহযোগী হিসেবে পেয়েছে চারটি দেশকে, যার মধ্যে রয়েছে বেলারুশ, সিরিয়া, ইরান ও উত্তর কোরিয়া। মিয়ানমারও সম্প্রতি এই টিমে যোগ দিয়েছে। মূলত নিরপেক্ষ অবস্থানে থাকা চীন ভারত ও তুরস্ক এবং এ ধরনের অন্য কয়েকটি দেশের ওপর ভিত্তি করে রাশিয়া তার অর্থনীতি সর্বব্যাপী অবরোধের মুখেও টিকিয়ে রেখেছে। তবে মিত্র দেশগুলোকেও মস্কোর বিপুল রেয়াতি দামে তেল গ্যাস বিক্রি করতে হচ্ছে।
ইউক্রেনের চারটি অঞ্চলের গণভোট প্রসঙ্গে চীনা পর্যবেক্ষকরা বলেছেন, রাশিয়া-ইউক্রেন দ্বন্দ্ব এর মাধ্যমে একটি নতুন পর্যায়ে প্রবেশ করবে। এরপর রাশিয়া প্রাকৃতিক গ্যাস কার্ডের সর্বোচ্চ ব্যবহার করতে পারে। ইস্ট চায়না নর্মাল ইউনিভার্সিটির সেন্টার ফর রাশিয়ান স্টাডিজের সহকারী গবেষক কুই হেং এ প্রসঙ্গে বলেছেন, গণভোটের মাধ্যমে রাশিয়া-ইউক্রেন দ্বন্দ্বের উত্তেজনা এমনভাবে বাড়তে পারে যেটি একটি প্রক্সি দ্বন্দ্ব থেকে আরো বিকাশ লাভ করতে পারে। এতে রাশিয়া ও পশ্চিমারা পরবর্তী পদক্ষেপের জন্য কথার যুদ্ধে লিপ্ত হওয়ার সম্ভাবনা বেশি। আর স্পষ্টতই যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমারা জাতিসঙ্ঘের সাধারণ পরিষদকে রাজনীতিকরণ করেছে, যা এক দেশের জন্য আরেক দেশের মোকাবেলা করার হাতিয়ার হয়ে উঠেছে। এটি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর আন্তর্জাতিক ব্যবস্থা এবং জাতিসঙ্ঘের কর্তৃত্বকে ক্ষুণœ করছে।
রাশিয়ার এই সময়ের কৌশলগত মিত্র চীন রাশিয়ার নতুন উদ্যোগকে সমর্থন না করে বলেছে চীন আঞ্চলিক অখণ্ডতা ও সার্বভৌমত্বকে গুরুত্ব দেয়। গণভোট শুরু হওয়ার এক দিন আগে, চীনের স্টেট কাউন্সিলর এবং পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়াং ই ইউক্রেনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী দিমিত্রো কুলেবার সাথে বৈঠক করেন এবং ইউক্রেন সঙ্কটে চীনের অবস্থান স্পষ্টভাবে জানান। ওয়াং বলেন, চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং উল্লেখ করেছেন, সব দেশের সার্বভৌমত্ব ও আঞ্চলিক অখণ্ডতাকে সম্মান করতে হবে, জাতিসঙ্ঘের সনদের উদ্দেশ্য ও নীতিগুলো সম্পূর্ণরূপে পালন করতে হবে, সমস্ত দেশের বৈধ নিরাপত্তা উদ্বেগকে অবশ্যই গুরুত্ব সহকারে বিবেচনা করতে হবে। আর সমস্ত প্রচেষ্টার জন্য সঙ্কটের শান্তিপূর্ণ নিষ্পত্তির পক্ষে সহায়ক হতে হবে। এটি ইউক্রেন ইস্যুতে চীনের সবচেয়ে কর্তৃত্বপূর্ণ প্রকাশ, আর এটি এই সমস্যাটি দেখার এবং পরিচালনা করার ক্ষেত্রে চীনের মৌলিক নীতিও।

রাশিয়ার যুক্তি গ্রহণের পরিণাম
রুশ গণমাধ্যম তাস স্পুটনিক ও আরটির প্রতিবেদনগুলোতে গণভোটের পক্ষে যেসব যুক্তি দেখানো হচ্ছে তা গ্রহণ করার অর্থ হবে সোভিয়েত ইউনিয়নভুক্ত ও এর আশপাশের যেসব দেশের মানুষ বিশেষত রুশ বংশোদ্ভূত জনগোষ্ঠী রয়েছে সেখানে নিজস্ব সরকারের বিরোধিতা করতে তাদের উসকে দেয়া। আর একপর্যায়ে রুশ সেনাবাহিনী পাঠিয়ে তা দখল করা। দখলদারিত্বের মধ্যেই গণভোট অনুষ্ঠান হবে। এরপর তা রাশিয়ার অংশে পরিণত করা হবে। ভøাদিমির পুতিন এই ফর্মুলা ব্যবহার করে এ সময়ের ‘পিটার দ্য গ্রেট’ হতে চাইছেন বলেই মনে হয়।
ভøাদিমির পুতিন রাশিয়ার এমন একজন একনায়ক, যিনি অনেকটা হিটলারের মতো গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত। এরপর তিনি রাশিয়ার গণতান্ত্রিক পদ্ধতির ওপর এমনভাবে নিয়ন্ত্রণ এনেছেন যেখানে স্থানীয় ও জাতীয় পর্যায়ে ভোট হয় কিন্তু এই ভোটের ফলাফল সবসময় এক প্রকার নির্ধারিত থাকে। রুশ জনমতের ভেতরের অবস্থা এখন কেমন সেটি জানা কঠিন হলেও দৃশ্যত পুতিন এখনো রাশিয়ার জনপ্রিয় রাষ্ট্রনায়ক। তবে মুক্ত বিশ্ব থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে একনায়কপ্রবণ শক্তিগুলোকে সাথে নিয়ে পুতিন দেশটির জনগণকে মধ্য বা দীর্ঘমেয়াদে কতটা শান্তি ও স্বস্তি দিতে পারবেন তা নিয়ে সন্দেহ রয়েছে।
পুতিন দনবাস ও সন্নিহিত অঞ্চলে গণভোট দেয়ার প্রাক্কালে আংশিক রিজার্ভ কল করেছেন যার আওতায় তিন লাখ যুদ্ধসক্ষম নাগরিককে তিনি তলব করেছেন ইউক্রেনে যুদ্ধে গিয়ে রাশিয়াকে রক্ষা করার জন্য। পুতিন একই সাথে পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহারের হুমকিও দিয়েছেন। শক্তি প্রয়োগের ভয় দেখিয়ে দখল প্রতিষ্ঠার প্রচেষ্টা ইউক্রেনের সর্বশেষ ক্রিমিয়া যুদ্ধে সফল হয়েছিল। কিন্তু ইউক্রেনে এবারের সেনা অভিযানে সেই প্রচেষ্টা বড় ধরনের চ্যালেঞ্জে পড়েছে। পুতিন কিয়েভ দখলে ব্যর্থ হয়ে ব্যাপক সেনাক্ষয়ের মুখে পড়েছেন। এতে কৌশল পাল্টে ডনবাস দখলে মনোনিবেশ করলেও এখনো এই অঞ্চল পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে আনতে পারেননি। সর্বশেষ পরিস্থিতি অনুসারে খারকিভের বিশাল অঞ্চল ও খেরসনের কিছু এলাকা রাশিয়ার দখল থেকে মুক্ত করে নিয়েছে ইউক্রেন।
কৃষ্ণসাগরে মস্কোভা জাহাজ ডুবিয়ে দেয়া, ক্রাইমিয়ার সেনাঘাঁটিতে আক্রমণ এবং সর্বশেষ রাশিয়ার দখলকৃত অঞ্চল পুনরুদ্ধারের মধ্য দিয়ে ইউক্রেনের ‘বিজয় অর্জন অসম্ভব নয়’ এমন একটি ধারণার সৃষ্টি হয়েছে। সেই সাথে জ্বালানি ও মূল্যবৃদ্ধির দুর্ভোগের চেয়েও ইউরোপের দেশগুলো নিজ নিজ দেশের অখণ্ডতা ও সার্বভৌমত্বকে বেশি মূল্য দিচ্ছে। ফলে মুক্ত পরিবেশের পরও এসব দুর্ভোগের বিরুদ্ধে ইউরোপের কোনো দেশে বিক্ষোভ হওয়ার মতো ঘটনা ঘটেনি।
ইউক্রেনের চার অঞ্চলের রাশিয়ায় যোগদানের কথিত গণভোট ইউক্রেন সঙ্কটে একটি গুণগত পরিবর্তন আনবে। এসব অঞ্চলের রাশিয়ায় যোগদানের ক্ষেত্রে তাদের বিরুদ্ধে ভবিষ্যতের যেকোনো পদক্ষেপ বা আক্রমণ রাশিয়াকে তার সংবিধান ও আইনের ভিত্তিতে সম্ভাব্য সব সামরিক ও রাজনৈতিক উপায় ব্যবহার করতে প্ররোচিত করতে পারে। ইউক্রেন সঙ্কট একটি নতুন পর্যায়ে প্রবেশ করার ব্যাপারে রাশিয়া দুই দিকে প্রস্তুতি নিচ্ছে- ইউরোপীয় দেশ শিগগিরই কঠোর শীতে প্রবেশ করার প্রাক্কালে প্রাকৃতিক গ্যাস চুক্তির কার্ডের ব্যবহার সর্বাধিক করা আর কৌশলগত সমরাস্ত্র ব্যবহার সম্প্রসারণ করে যুদ্ধের পরিধি বাড়ানো।
পুতিন তার সামরিক ব্যর্থতার জন্য তার লড়াই শুধু ইউক্রেনের বিরুদ্ধে নয় বরং ন্যাটোর বিরুদ্ধে- এমন একটি ধারণা দিতে চাইছেন। প্রক্সি লড়াইয়ের তত্ত্ব বিবেচনায় আনা হলে পুতিনের এই বক্তব্য অসত্য নয়। তবে নব পর্যায়ের এই স্নায়ুযুদ্ধ-উত্তর সঙ্ঘাত যেখানেই দেখা দিক না কেন তাতে ছায়াযুদ্ধে দুই প্রতিদ্বন্দ্বী শক্তির সমর্থন মিলবে।

ব্যর্থ হবে রাশিয়া?
২০১৪ সালে বিনা প্রতিরোধে ক্রাইমিয়াকে সংযুক্ত করার পর, প্রক্সি বাহিনী এবং সরাসরি সামরিক হস্তক্ষেপের সমন্বয়ে পূর্ব ও দক্ষিণ ইউক্রেনের বেশির ভাগ অংশ নেয়ার চেষ্টা করেছিলেন পুতিন; কিন্তু ইউক্রেনীয়রা তাদের স্বাধীনতার জন্য দৃঢ প্রতিরক্ষামূলক কাজ করেছে এবং তারা এই বছর আবার তা করছে। গত এপ্রিলেই ক্রেমলিন স্বীকার করতে বাধ্য হয় যে কিয়েভকে দখল করা এবং ইউক্রেনের নেতৃত্বের পতনের প্রচেষ্টা তার ব্যর্থ হয়েছে। আগ্রাসনের দ্বিতীয় পর্যায়ে রাশিয়ান সামরিক নেতারা ইউক্রেনের পূর্ব দনবাস অঞ্চলের পাশাপাশি ওডেসার পূর্বে সমগ্র কৃষ্ণসাগরের উপকূলরেখা নিয়ে গঠিত ডনেটস্ক ও লুহানস্ক জেলাগুলো দখল করার দিকে তাদের দৃষ্টি নিবদ্ধ করে।
গত ছয় মাসে ইউরোপ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর সবচেয়ে তীব্র লড়াইয়ের সাক্ষী হয়েছে। রাশিয়ান আর্টিলারি ইউক্রেনীয় শহর এবং গ্রামগুলোতে আঘাত করেছে। নির্বিচারে আবাসিক এলাকা, হাসপাতাল, কিন্ডারগার্টেন ও পাওয়ার প্লান্টগুলোতে হামলা করেছে। তবুও রাশিয়ার অগ্রগতি প্রত্যাশার চেয়ে অনেক কম ছিল। আধুনিক পশ্চিমা অস্ত্র সরবরাহে ইউক্রেনীয় বাহিনী প্রতিরোধ লাইন ধরে রাখতে সক্ষম হয়েছিল। আর এতে সঙ্ঘাতটি দীর্ঘস্থায়ী যুদ্ধে পরিণত হয়েছে। যদিও এর মধ্যে রাশিয়ার আক্রমণ স্থবির হয়ে পড়েছে। কিন্তু এখন দেখা যাচ্ছে জোয়ার ঘুরে গেছে। ইউক্রেন প্রথমে দক্ষিণে, খেরসনের আশপাশে একটি পাল্টা আক্রমণ শুরু করে এবং তারপরে দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর খারকিভের আশপাশে উত্তর-পূর্বে রাশিয়ার অবস্থানগুলোতে বজ্রপাতের মতো হঠাৎ আক্রমণ চালায়। ইউক্রেনীয় বাহিনীর দ্রুত অগ্রগতির খবর আসতে শুরু করার সাথে সাথে কিয়েভে এখন সবাই বলছে, ‘আমরা বিশ্বকে দেখিয়েছি যে বিজয় সম্ভব’।
মস্কোর মেজাজ এই আনন্দের একবারে বিপরীত। রাশিয়ানরা দ্রুত বুঝতে পেরেছে যে ইউক্রেনের সামরিক বাহিনীকে পরাজিত করা এবং পুতিনের দ্বারা বর্ণিত সমগ্র দেশ দখল করা সম্ভব নয়। তাই ক্রেমলিনপন্থী ব্লগাররা কৌশলগত ভুল এবং সৈন্যদের সরবরাহের অভাব সম্পর্কে অভিযোগ করতে শুরু করে। একজন ভাষ্যকার বলেছেন, ‘আমরা ইতোমধ্যে হেরে গেছি, বাকিটা সময়ের ব্যাপার’। এমনকি সরকারি রাশিয়ান মিডিয়াতেও হতাশার সুর খুঁজে পাওয়া যায়। যদিও কিছু বিশ্লেষক মরিয়া হয়ে পূর্ণ যুদ্ধ ঘোষণা এবং একটি সাধারণ রিজার্ভ তলবের আহ্বানও জানাচ্ছে। অন্যরা যুক্তি দিচ্ছে যে এটি সাহায্য করবে না এবং ইউক্রেনের সাথে রাজনৈতিক আলোচনার সময় এটি। কিন্তু সামগ্রিকভাবে কোনো স্পষ্ট বার্তা মস্কোর নেই। যদিও পুতিন, তার ক্রেমলিন বাঙ্কার থেকে জোর দিয়ে বলে চলেছেন যে সবকিছু পরিকল্পনা অনুযায়ী চলছে।
সামরিক বিজয়ের কোনো বাস্তব সম্ভাবনা ছাড়াই, পুতিন এখন ইউরোপে জ্বালানি সরবরাহ কমিয়ে দিচ্ছেন এই আশায় যে, একটি কঠোর শীত ইউরোপীয়দের ইউক্রেনের প্রতি তাদের সমর্থন ত্যাগ করতে বাধ্য করবে। কিন্তু এটি ক্রেমলিনের আরেকটি ভুল ধারণা বলে মনে হচ্ছে। ইউরোপীয়রা এমন কিছু সম্ভবত করবে না। ইউরোপ মাত্র কয়েক মাসের ব্যবধানে রাশিয়ান গ্যাসের ওপর নির্ভরতা ৪০ শতাংশ থেকে ৯ শতাংশে কমিয়েছে এবং শীতের জন্য গ্যাসের মজুদ ইতোমধ্যে ৮৪ শতাংশ পর্যন্ত পূর্ণ করেছে। জ্বালানি শক্তির ব্ল্যাকমেল ছিল পুতিনের শেষ অস্ত্রগুলোর মধ্যে একটি, আর এটি দিন দিন নিস্তেজ হয়ে উঠছে।
সুইডেনের সাবেক প্রধানমন্ত্রী নিলস ড্যানিয়েল কার্ল বিল্ড্ট বলেছেন, এখন ইউরোপ ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে ইউক্রেনের জন্য তাদের সমর্থন বাড়াতে হবে। ইউক্রেনীয়দের রক্ষার জন্য প্রতি মাসে পাঁচ বিলিয়ন ডলার প্রদান করা দরকার হবে। এটি করতে হলে খরচ করতে হবে ইইউ জিডিপির মাত্র ০.০৩ শতাংশ। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র স্পষ্টতই এখানে নেতৃত্ব দিচ্ছে, তবে ইউরোপকেও তার অংশটি করতে হবে।
কার্ল বিল্ড্ট মনে করেন, পুতিন তার ক্রেমলিন দুর্গে শীতকালে লুকিয়ে থাকবেন এই প্রত্যাশায় যে, ইউরোপের বিরুদ্ধে তার রাজনৈতিক কৌশল সফল হবে। তবে শেষ পর্যন্ত মস্কোতেও এটা পরিষ্কার হয়ে যাবে যে সামরিক ও রাজনৈতিক উভয় কৌশলই ব্যর্থ হয়েছে। সেই সময়ে, একটি নতুন পরিস্থিতির উদ্ভব হবে। রাশিয়া যে জিততে পারবে না তা শুধু সবার কাছেই স্পষ্ট হবে না; এমনও মনে হতে পারে যে পুতিন যে যুদ্ধ শুরু করেছিল তাতে হেরে যাবে। সেই মুহূর্তে, রাশিয়ার কাছে অতীতে পুতিন সরকারের গভীর কৌশলগত ব্যর্থতা কবুল করা ছাড়া আর কোনো উপায় থাকবে না।

নতুন হিসাব-নিকাশ ও সম্ভাবনা
এই অবস্থায় সার্বিক অবস্থা পর্যবেক্ষণে কতগুলো সম্ভাবনা ইউক্রেন যুদ্ধকে সামনে রেখে দেখা যায়।
প্রথমত ইউক্রেনের যে চারটি অঞ্চল নিজ মানচিত্রভুক্ত করে নিচ্ছে সেটিকে পশ্চিমা শক্তির সাথে যুদ্ধ বন্ধের পর দরকষাকষির হাতিয়ার করে একটি সমঝোতায় আসার চেষ্টা করতে পারে রাশিয়া। এ ক্ষেত্রে দু’পক্ষে উইন উইন পরিস্থিতি হতে পারে ক্রাইমিয়াকে ছাড় দিয়ে দনবাসসহ সন্নিহিত অঞ্চলকে ইউক্রেনভুক্ত করে নেয়া।
দ্বিতীয়ত ইউক্রেনের পেছনে ন্যাটো ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন এখন যেভাবে সর্বাত্মক সমর্থন দিয়ে যাচ্ছে সেটিকে অব্যাহত রেখে রাশিয়ার কাছ থেকে অধিকৃত ভূখণ্ড কেড়ে নেয়া। এটি করা মানে হলো রাশিয়ার সাথে ন্যাটোর সর্বাত্মক ছায়াযুদ্ধে জড়িয়ে পড়া, যা একপর্যায়ে পরমাণু অস্ত্র ব্যবহার পর্যন্ত গড়াতে পারে অথবা প্রত্যক্ষ সঙ্ঘাতে রূপ নিতে পারে।
তৃতীয়ত কোনো ধরনের সমঝোতা ছাড়াই রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ চলতে থাকা। রাশিয়াকে একঘরে করার পদক্ষেপ হিসেবে ইউক্রেনীয় প্রেসিডেন্ট নিরাপত্তা পরিষদ থেকে মস্কোকে বের করে দেয়ার যে আহ্বান জানিয়েছে সেটিকে প্রচারণায় আরো সামনে নিয়ে গিয়ে রাশিয়াকে নতি স্বীকারে বাধ্য করা। এতে রাশিয়া ইউক্রেনের অধিকৃত ভূখণ্ড ছেড়ে দিয়ে সমঝোতা করতে বাধ্য হতে পারে। সে সাথে সোভিয়েতভুক্ত অন্য প্রজাতন্ত্রগুলোর সার্বভৌমত্ব নিরাপদ হওয়ার সম্ভাবনা থাকবে।
চতুর্থত. ইউক্রেন যুদ্ধের দ্বিতীয় পর্বে রাশিয়ার জয়ী হওয়া। আর ইউক্রেনের বাকি ভূখণ্ড রক্ষার শর্তে রাশিয়ার সাথে ইউক্রেনের চুক্তিবদ্ধ হওয়া। এটি বাস্তবে ঘটতে পারে যদি ন্যাটো ও ইউরোপ ইউক্রেনকে সমর্থন করা থেকে থেকে পিছু হটে। সেই সম্ভাবনা খুবই কম।
mrkmmb@gmail.com


আরো সংবাদ



premium cement