২০ এপ্রিল ২০২৪, ০৭ বৈশাখ ১৪৩১, ১০ শাওয়াল ১৪৪৫
`

আইন, মানবাধিকার ও মানবিক আচরণ

সময়-অসময়
-

সভ্যতা যতই এগিয়ে যাচ্ছে আইন প্রণয়ন ও আইন প্রয়োগের পরিধি ততই বাড়ছে। শুধু বাড়ছেই না বরং কঠিন থেকে কঠিনতর হচ্ছে। তবে ন্যায়পরায়ণতার সাথে আইনের সঙ্ঘাত রয়েছে। আইন ও ন্যায় পরস্পরের সম্পূরক হলেও ন্যায় প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যেই আইন প্রণয়ন হওয়া বাঞ্ছনীয়, কিন্তু সর্বক্ষেত্রে আইন প্রয়োগ ‘ন্যায়ের’ বার্তা বহন করে না। আইন প্রয়োগ হয় ক্ষেত্রমতে বিশেষভাবে। ক্ষমতাসীনরা আইনকে ব্যবহার ও উপভোগ করে। সাধারণ জনগণ প্রায়ই আইন আদালতের দ্বারা ভিকটিম হয়।

আইন বলতে কি বোঝায়? যদি বলি, আইন হচ্ছে শাসনকর্তার ইচ্ছা ও চাহিদা মোতাবেক তাদের মতো করে প্রজা বা নাগরিকদের একটি নিয়ন্ত্রিত ফ্রেমে বন্দী রাখার ব্যবস্থা! কারণ আমার মতে, আইন প্রস্তুত করেন সংশ্লিষ্ট ভূ-খণ্ডের শাসনকর্তা এবং শাসনকর্তার ইচ্ছার বহিঃপ্রকাশই হলো ‘আইন’। আইনের সঠিক ব্যাখ্যা এই হতে পারে যে, ‘Law is command of the sovereignty’ অথবা ‘Law is a product of Politices’। রাজনৈতিকভাবে যারা ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত তাদের ধ্যান ধারণার প্রতিচ্ছবিই আইন। কিন্তু ‘ন্যায়’ সে কথা বলে না। ‘ন্যায়’ হলো সে বিষয় যা রাজা, প্রজা, শাসক, শাসিত, ধর্ম, বর্ণ, জাতপাত নির্বিশেষে সবার জন্য যা একই ধরনের পদ্ধতি বা সিদ্ধান্ত প্রদান। ন্যায় প্রতিষ্ঠা করার জন্যই আইনের সৃষ্টি হওয়া বাঞ্ছনীয়। কিন্তু ক্ষমতা ও কর্তৃত্ব ধরে রাখার বিষয়টি মাথায় রেখে প্রণীত হয় আইন। ‘ন্যায়’-এর চেহারা ও রং সর্বক্ষেত্রে এক ও অভিন্ন। অথচ আইনের প্রয়োগ হয় ব্যক্তি ও ক্ষেত্র বিশেষ বিবেচনায়। আইনের ত্রাণকর্তা পুলিশ (!) ক্ষমতাসীনদের সাথে একরকম আচরণ করে, সাধারণ নাগরিকদের সাথে করে তার উল্টো।

বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিকোণ থেকে পজিটিভ ও নেগেটিভ এ দুয়ের সমন্বয়েই পৃথিবীর সৃষ্টি। প্রতিটি ক্ষেত্রেই পজিটিভ ও নেগেটিভের সমন্বয় রয়েছে। শাসক শাসিতের সমন্বয়েই গঠিত হয় রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাপনা। রাজাশাসিত রাজ্য এবং গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাপনার মধ্যে কোনো তারতম্য থাকে না, যদি না সংশ্লিষ্ট রাষ্ট্র কল্যাণমূলক হয়! আমাদের ধারণা, ওয়েলফেয়ার স্টেট বা কল্যাণমূলক রাষ্ট্রের সংজ্ঞা মোটা দাগে এক কথায় হতে পারে, ‘জনগণের চাহিদা মোতাবেক যে রাষ্ট্রের ক্ষমতা পরিবর্তন হয় সেটাই।’ এ ব্যাখ্যা সবার কাছে গ্রহণযোগ্য না হতে পারে। তবে এটা স্বীকার্য যে, জনসমর্থন না থাকলেও যে শাসকগোষ্ঠী ক্ষমতা আঁকড়ে রাখতে বদ্ধপরিকর হয় তারাই স্বৈরশাসক। তারাই ক্ষমতাকে কুক্ষিগত রাখার জন্য অমানবিক আচরণসহ মানবাধিকার পরিপন্থী কর্মকাণ্ডে লিপ্ত হয়ে আইনের ছদ্মাবরণে বেআইনি কর্মের বৈধতা খোঁজে এবং এজন্যই গণতন্ত্রের বাতাবরণে পার্লামেন্টকে কঠিন আইন প্রণয়নের ফ্যাক্টরিতে পরিণত করে। উপমহাদেশে ভারত ছদ্ম সাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র হলেও সেখানে ক্ষমতার পালাবদলে জনগণের চাহিদাই প্রাধান্য পেয়ে আসছে।

বাংলাদেশের সংবিধানের ২৭ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, যে আইন প্রতিটি নাগরিকের জন্য সমানভাবে প্রযোজ্য এবং সমভাবে আইনের প্রটেকশন পাওয়ার অধিকারী। কিন্তু বাস্তবে সংবিধানের উক্ত নির্দেশনার কোনো প্রকার বাস্তবায়ন নেই। এ ক্ষেত্রে কোনো কোনো বিষয়ে সর্বোচ্চ আদালত নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করছেন।
আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত প্রতিটি মানুষের অধিকার রয়েছে, যথা- ১. মৌলিক অধিকার ২. নাগরিক অধিকার ৩. মানবাধিকার ৪. রাষ্ট্রের কাছ থেকে মানবিক আচরণ পাওয়ার অধিকার এবং ৫. ভয়ভীতির ঊর্ধ্বে থেকে অধিকার ভোগ করার অধিকার প্রভৃতি। মৌলিক অধিকার বা নাগরিক অধিকার বলতে সেটাই বোঝায় যেটুকু অধিকার সংশ্লিষ্ট রাষ্ট্রের সংবিধান বা শাসনকর্তা তার নাগরিকদের প্রদান করে। মানবাধিকার ও রাষ্ট্রের কাছ থেকে মানবিক আচরণ পাওয়ার অধিকার জন্মগতভাবে একজন মানুষের রয়েছে এবং দল, মত, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে যে কোনো ব্যক্তি সে অধিকার পাওয়ার অধিকারী। এ অধিকার প্রতিটি নাগরিক, নাগরিক নয় এমন ব্যক্তি, শরণার্থী (রিফিউজি), তৃতীয় লিঙ্গ, টেররিস্ট, রাষ্ট্রহীন যার জাতীয় কোনো পরিচয় নেই এমন ব্যক্তিও ওই অধিকার ভোগ করার হকদার। ১৮১২ সালে সম্পাদিত Magna Carta চুক্তি মোতাবেক ‘প্রতিটি মানুষ স্বাধীনভাবে জন্মগ্রহণ করে’, ফলে ক্ষেত্র বিশেষে ব্যতিক্রম ছাড়া কারো স্বাধীন জীবনযাপনের ওপর অন্যজনের খবরদারি করার অধিকার নেই।

মানবাধিকার ও মানবিক আচরণপ্রাপ্তির অধিকার, এ দুটো বিষয় এক না হলেও একটি অপরটির সম্পূরক। মানবিক আচরণের বিষয়টি শুধু রাষ্ট্রযন্ত্রের সাথে সম্পর্কিত নয়, বরং তা একজন প্রভাবশালী মানুষের কাছ থেকে সাধারণ মানুষের পাওয়ায় অধিকার, হোক সে শাসক বা প্রভাবশালী কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান। ধনী-গরিবের ভারসাম্য রক্ষা করতে পারে একমাত্র একে অপরের প্রতি মানবিক আচরণ। বাস্তবতা পর্যালোচনা করলে এটাই প্রতীয়মান হয় যে, হিং¯্র প্রাণীর মধ্যে ‘মানুষই’ সবচেয়ে বেশি হিং¯্র। স্বার্থের প্রশ্নে মানুষ এতই হিং¯্র হতে পারে, যা অন্যান্য প্রাণীর মধ্যে পাওয়া যায় না। পশুরা আঘাতপ্রাপ্ত হলে হিং¯্র হয়, নতুবা খাদ্যের প্রয়োজনে। কিন্তু মানুষ হিং¯্র হয়ে ওঠে লোভে বা অধিকতর পাওয়ার আশায়। মানুষই একমাত্র প্রাণী যার আশা আশাক্সক্ষার শেষ নাই। মানুষ তার প্রাপ্তির চেয়ে বেশি প্রাপ্তির পরও আরো পেতে চায়, ফলে যত সে পেতে চায় তার হিং¯্রতা ততই বাড়ে। মানুষের প্রাপ্তির শেষ নেই বা যা পেয়েছে তার জন্য সৃষ্টিকর্তার প্রতি কৃতজ্ঞতা নেই। সৃষ্টিকর্তা নিজেই বলেছেন যে, মানুষ বড়ই অকৃতজ্ঞ।

আদিম যুগে মানুষ মানুষকে হত্যা করত পাথর দিয়ে আঘাত করে, এখন আঘাত করার হাতিয়ার আণবিক বোমা। আণবিক বোমা তৈরিতে সংশ্লিষ্ট রাষ্ট্রে যে অর্থ খরচ হয়, সমপরিমাণ অর্থ দিয়ে একটি রাষ্ট্রের দরিদ্রতা দূর করা যায়, দূর করা যায় বিশ্বব্যাপী বেকারত্ব, এর পরও বলতে ও শুনতে হয়, মানুষ সৃষ্টির সেরা প্রাণী। মানুষ শুধু লোভী নয়, তাদের চাহিদা আকাশচুম্বী, অধিকন্তু মানুষ অত্যন্ত দাম্ভিক ও অহঙ্কারী। মানুষ মানুষকে নির্যাতন করতে ভালোবাসে, অহঙ্কার দেখাতে অত্যন্ত পছন্দ করে, যারা এর ব্যতিক্রম তারাই মানুষকে সৃষ্টির সেরা জীব বানানোর জন্য একের পর এক উদাহরণ সৃষ্টি করে যাচ্ছেন, কিন্তু সফল হতে পারছেন না।
এই পৃথিবীতে একশ্রেণীর মানুষ টিকে থাকার জন্য আপ্রাণ লড়াই করে যাচ্ছে, অন্য দিকে আরেকটি শ্রেণী সাধারণ গণমানুষকে শাসন শোষণ করে নিজেদের ভাগ্য আকাশচুম্বী করেও তৃপ্তি লাভ করতে পারছে না। বাংলাদেশের আমলাতান্ত্রিক রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাপনা ব্রিটিশ সিস্টেম অনুসরণ করে তৈরি। দেশটি স্বাধীন হলো দুইবার (১৯৪৭ এবং ১৯৭১)। কিন্তু আমলাতান্ত্রিক মনোভাবের উন্নতি হয়েছে বলে পরখ করে বলা যাচ্ছে না। বাংলাদেশে এখনো জনমুখী প্রশাসন তৈরি হয়নি। পক্ষান্তরে জেলা প্রশাসকদের আচরণ সম্পর্কে সম্প্রতি হাইকোর্ট একটি মন্তব্য করতে গিয়ে বলেন যে, জেলা প্রশাসকদের অফিস পর্দা ঘেরা থাকায় সাধারণ মানুষ তাদের কাছে যেতে পারে না। ডিসিদের অফিস পর্দামুক্ত করার বিষয়েও হাইকোর্ট মন্তব্য করেছেন।
চিকিৎসা খাতে বাংলাদেশের অনেক অর্থ ভারত, সিঙ্গাপুর ও থাইল্যান্ড চলে যায়। আমাদের দেশ থেকে বহু মানুষ চিকিৎসার জন্য ওইসব দেশে যান। এর অন্যতম কারণ চিকিৎসকদের আচরণ। ওইসব দেশের চিকিৎসকরা রোগীদের সাথে মানবিক আচরণ করেন। বাংলাদেশে চিকিৎসকের ফি ও ওষুধের মূল্য, উভয়ই খেটে খাওয়া মানুষের নাগালের বাইরে।

বাংলাদেশ একটি স্বাধীন রাষ্ট্র। পৃথিবীর অন্য কোনো স্বাধীন রাষ্ট্রে বিরোধী দলের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর মিছিলে পাখির মতো গুলি করে মানুষ হত্যা করা হয় না। দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির প্রতিবাদে মিছিলে ভোলা ও নারায়ণগঞ্জে এমন কোনো ঘটনা ঘটেনি যাতে পুলিশকে গুলি করে মানুষ হত্যা করতে হবে! নারায়ণগঞ্জ আদালতে পুলিশের বিরুদ্ধে দায়ের করা হত্যা মামলা আদালত গ্রহণ করেনি। সংবিধানের ২২ অনুচ্ছেদ মোতাবেক বিচার বিভাগকে শাসন বিভাগ থেকে আলাদা করে সম্পূর্ণ স্বাধীন করে দেয়া হয়েছে। অধিকন্তু সংবিধানের ১১৬ক অনুচ্ছেদ মোতাবেক ম্যাজিস্ট্রেটসহ বিচার বিভাগের কর্মরত সব বিচারক বিচারিক দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে স্বাধীন। কিন্তু ম্যাজিস্ট্রেট ও বিচারকরা সরকারের আনুকূল্যে থাকতে বেশি আগ্রহী এবং সে কারণেই নারায়ণগঞ্জ ম্যাজিস্ট্রেট আদালত শাওন প্রধান হত্যা মামলা গ্রহণ করে নাই। বিচার বিভাগের স্বাধীনতা রয়েছে এ কথা প্রমাণের জন্য হলেও মামলাটি গ্রহণ করা উচিত ছিল, ন্যূনতম পক্ষে মামলাটির একটি তদন্ত হতে পারত। নারায়ণগঞ্জের জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট কর্তৃক মামলাটি গ্রহণ করলে বিচার বিভাগের স্বাধীনতা রয়েছে বলে জনগণ মনে করত।

সরকার জানে, তাদের জনসমর্থন নেই, পুলিশই একমাত্র ভরসা। ফলে এটাই প্রতীয়মান হয় যে, সরকারের নির্দেশেই নারায়ণগঞ্জ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট কোর্ট পুলিশের বিরুদ্ধে শাওন প্রধান হত্যা মামলা গ্রহণ করেনি বা তদন্তের নির্দেশ দেয়নি। এটাই একটি স্বাধীন গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের নাগরিকদের সংবিধানের মৌলিক অধিকার নামক তামাশার বহিঃপ্রকাশ ছাড়াও ‘স্বাধীনতার চেতনা’ নামক তত্ত্বটির ভাগ্যের নির্মম পরিহাস ভয়ভীতির ঊর্ধ্বে রেখে জনগণকে জীবনযাপনের নিশ্চয়তা প্রদান করা রাষ্ট্রের অন্যতম দায়িত্ব। কিন্তু পরিতাপের বিষয় এই যে, রাষ্ট্র তার কর্মচারীদের দিয়ে নিজেই জনগণের ওপর স্টিম রোলার চালায়, বেআইনি কার্যকলাপকে আইনি বলে চালিয়ে দেয়। ১৯৭২ Stockholm আন্তর্জাতিক সম্মেলনে নিম্নবর্ণিত সিদ্ধান্তকে নীতিমালা হিসাবে গৃহীত হয়। ‘Man has the fundamental right to freedom, Equality and adequate condition of life, in an environment of a quality that permits a life of dignity and well-being and he bears a solemn responsibility to protect and improve the environment for present and future generations..’

রাষ্ট্র পরিচালনায় সংবিধান একটি চলমান শক্তিশালী হাতিয়ার। কিন্তু বর্তমানে শাসক দলের একনায়কতন্ত্রের কাছে পরাজিত হতে হতে সংবিধানটি জড় বস্তুতে পরিণত হয়ে নিজস্ব চালিকাশক্তি হারিয়ে ফেলে একটি বোবা কান্নায় পরিণত হয়েছে। বাংলাদেশে আমলারাই শাসকগোষ্ঠীর প্রতিনিধিত্ব করছে। জনগণের প্রতিটি বিষয়ে সমাধানের দৃষ্টিভঙ্গিতে বিচার বিশ্লেষণ ও বিবেচনা না করে সমস্যার দৃষ্টিতে আমলারা মূল্যায়ন করে বিধায় জনদুর্ভোগ আরো বাড়ছে। লাল ফিতার দৌরাত্ম্যে অসহায় গণমানুষ এখনো নির্যাতিত ও নিষ্পেষিত। যার তদবির করার শক্তি আছে তার ভাগ্যের চাকা ঘুরতে থাকে উন্নতির পথে, অন্যদিকে যার নেই সে চাতক পাখির মতো আশা নিরাশায় ঘূর্ণিপাকে ডুবতে থাকে। হ
লেখক : রাজনীতিক, কলামিস্ট ও আইনজীবী
(অ্যাপিলেট ডিভিশন)
E-mail: taimuralamkhandaker@gmail.com


আরো সংবাদ



premium cement