২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫
`

মোদি-হাসিনা বৈঠকে দিল্লির নিরাপত্তা উদ্বেগ

-

ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারকরা প্রকাশ্যে দাবি করে থাকেন, ‘ভারত আমাদের শ্রেষ্ঠ রাজনৈতিক বন্ধু আর চীন আমাদের শ্রেষ্ঠ উন্নয়ন অংশীদার।’ ভারত ও চীন এশিয়ার দুই বৈরী আঞ্চলিক পরাশক্তি। তারপরও এ দু’টি দেশের সাথে দীর্ঘ এক যুগ ভারসাম্যপূর্ণ দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক বজায় রেখে চলেছে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরকার। বৈদেশিক নীতিতে এটি অভূতপূর্ব সাফল্য। শেখ হাসিনার এই নীতি একদিকে বর্তমান সরকারের ক্ষমতার ভিত শক্তিশালী করেছে, অন্যদিকে দেশের অর্থনীতিও একটানা ঊচ্চতর প্রবৃদ্ধি অর্জন করেছে। শেখ হাসিনা একসাথে ভারত ও চীন কার্ড খেলে সবাইকে তাক লাগিয়ে দিয়েছেন। যার জ্বলন্ত উদাহরণ হলো বর্তমান সরকার বঙ্গোপসাগরে মোতায়েনের জন্য চীন থেকে দু’টি সাবমেরিন ক্রয় করেছে এবং দিল্লিøকে খুশি করতে একই উপকূলে নজরদারির লক্ষ্যে ভারতের সাথে যৌথ রাডার ব্যবস্থা স্থাপনে সমঝোতা স্মারক সই করেছে। দুই প্রতিদ্বন্দ্বী শক্তির মন জয় করতে শেখ হাসিনার এই অপূর্ব কৌশল সিঙ্গাপুরের সাবেক দীর্ঘস্থায়ী প্রধানমন্ত্রী লি কোয়ানের স্মরণীয় উক্তি- ‘হাতি যখন যুদ্ধ করে ঘাস তখন পিষ্ট হয়, হাতি যখন প্রেম করে ঘাস তখনো পিষ্ট হয়’-কে দৃশ্যত অর্থহীন প্রমাণ করেছে। শেখ হাসিনা দিল্লিøর অকুণ্ঠ রাজনৈতিক সমর্থন আর বেইজিংয়ের উদার অর্থনৈতিক সহযোগিতা লাভ করছেন। এই কৌশল ক্ষমতা টিকিয়ে রাখতে তাকে যথেষ্ট শক্তি জুগিয়েছে।
বাংলাদেশের বিভিন্ন খাতে চীনের ক্রমাগত উপস্থিতি ও প্রভাব ভারতকে মাত্রাতিরিক্ত দুশ্চিন্তাগ্রস্ত করে ফেলেছে। সামনের দিনগুলোতে শেখ হাসিনার কৌশল কতটা কাজে লাগবে তা নিয়ে সন্দেহ ঘনীভূত হচ্ছে। এরই মধ্যে গত ৬ সেপ্টেম্বর দিল্লিøতে অনুষ্ঠিত হয়েছে বাংলাদেশ-ভারত প্রধানমন্ত্রী পর্যায়ের শীর্ষ বৈঠক। আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেøষক ও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সদ্য সমাপ্ত ভারত সফরকে আখ্যায়িত করেছেন নানা অভিধায়। তারা বলেছেন, ‘এটি চাওয়া-পাওয়ার সফর ছিল না। এটি ছিল পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে বৈশ্বিক ও ভূ-রাজনৈতিক চাপ একসাথে সামাল দেয়ার সফর। এটি ছিল ঢাকা-দিল্লিøর কূটনৈতিক ও পারস্পরিক বোঝাপড়ার সফর। অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা ও পশ্চিমা চাপ মোকাবেলায় কৌশল নির্ধারণের সফর।’ কিন্তু শীর্ষ বৈঠকে আলোচ্য বিষয়াবলির যে বিবরণ গণমাধ্যমে প্রকাশ পেয়েছে, তাতে নতুন চাপগুলোকে পাশ কাটিয়ে ভিন্ন একটি বিষয় চ্যালেঞ্জ হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। বিষয়টি হলো- ঢাকা-দিল্লি দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কে ভারতের নিরাপত্তা উদ্বেগ।
বৈঠকে দ্বিপক্ষীয় প্রতিরক্ষা সম্পর্কে দুই প্রধানমন্ত্রী সন্তোষ প্রকাশ করলেও তারা স্বীকার করেছেন যে, প্রতিরক্ষার ব্যাপারে দুই দেশকে সঙ্কীর্ণ দৃষ্টির ধারণা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। তবে রোহিঙ্গা শরণার্থী সংশ্লিøষ্ট বাংলাদেশের বর্তমান প্রধান নিরাপত্তা সমস্যাটি যৌথ ঘোষণায় স্বীকৃতি পায়নি। দশকব্যাপী দুই প্রতিবেশী দেশের ‘সোনালি’ সম্পর্কের নির্বিঘœ অগ্রগতির উচ্ছ্বাসে প্রথমবারের মতো কিছুটা ছেদ পড়তে দেখা গেছে। মধুর সম্পর্কে ছন্দপতনের আভাস পাওয়া গেছে, বৈঠক পরবর্তী যৌথ ঘোষণার প্রতিপাদ্যের সাথে সংবাদ সম্মেলনে প্রদত্ত ভারতের পররাষ্ট্রসচিব বিনয় মোহন কোয়াত্রার বক্তব্যের ফারাক থেকে। যৌথ ঘোষণায় সবকিছু ঠিকঠাক থাকার আভাস দেয়া হলেও পররাষ্ট্রসচিবের বক্তব্যে নানা বিষয়ে দিল্লিøর উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা প্রকাশ পেয়েছে। তবে ঢাকার মধ্যপন্থায় দিল্লিø আশ্বস্ত শিরোনামে বাংলাদেশের গণমাধ্যমে একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হলেও তাতে ভারতের খোশমেজাজের কোনো চিহ্নই খুঁজে পাওয়া যায়নি।
আস্থার ঘাটতি ও স্বার্থের সঙ্ঘাত নানা মাত্রায় উঁকি দিয়েছে। ঘোষিত সব আবহাওয়ায় বন্ধুত্বের সম্পর্কটি এখন কৌশলগত সম্পর্কে রূপান্তরের দিকে যাচ্ছে। নতুুন উচ্চতায় সমাসীন সম্পর্কের স্বরূপ উন্মোচিত হচ্ছে ভিন্নভাবে। বাস্তবতা সম্পূর্ণ ভিন্ন বলেই প্রতিভাত হচ্ছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির দ্বিপক্ষীয় শীর্ষ বৈঠকে ভারত নানা বিষয়ে তার উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা, আস্থার ঘাটতি, আগ্রহ ও স্বার্থের প্রতিকূলতার কথা জোরালোভাবেই প্রকাশ করেছে।
এবারের বৈঠকে ভারত সুনির্দিষ্টভাবে বঙ্গোপসাগরে চীনের উপস্থিতিতে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। আঞ্চলিক নিরাপত্তায় চীনের ভূমিকায় উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। সীমান্ত অপরাধ জঙ্গিবাদ ও সামরিক নিরাপত্তা নিয়েও উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। দ্বিপক্ষীয় সামরিক খাতে উদ্বেগের কথাও বাংলাদেশকে জানিয়ে দিয়েছে। বাংলাদেশে চীনের ক্রমাগত প্রভাব বৃদ্ধিকে মোটেও ভালো চোখে দেখছে না ভারত। চীনের উপস্থিতি ভারতের জন্য হুমকি বিবেচনায় নিয়ে, দুই প্রধানমন্ত্রী সামরিক সুরক্ষা, দুই দেশের সামরিক কল্যাণ, ভারতের কল্যাণ, ভারতের আগ্রহ ও উদ্বেগ নিয়ে বিস্তারিত আলোচনাও করেছেন। আঞ্চলিক অর্থনৈতিক খাতে চীনের ক্রমবর্ধমান প্রভাবে সৃষ্ট অস্থিরতা ও হুমকির ব্যাপারে দিল্লিøর উদ্বেগের কথাও জানিয়ে দেয়া হয়েছে ঢাকাকে। শ্রীলঙ্কার উদাহরণ টেনে অর্থনৈতিক অব্যবস্থাপনার হুমকি সম্পর্কে গুরুত্বারোপ করা হয়েছে।
এ অঞ্চলে চীনের কর্মকাণ্ড বিশেষ করে বেইজিংয়ের আন্তঃমহাদেশীয় সংযুক্তি মহাপ্রকল্প ‘বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ (বিআরআই)’ কৌশলে বাংলাদেশের অংশগ্রহণ ভারতের জন্য গলার কাঁটা হয়ে দাঁড়িয়েছে। ভারত চীনের বিআরআই কৌশলকে তার স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব পরিপন্থী এবং নিরাপত্তার জন্য হুমকি বলে গণ্য করে। দিল্লিø এটিও মনে করে, বাংলাদেশে অবকাঠামো খাতে চীনের বিশাল বিনিয়োগ ও বড় প্রকল্পগুলো তার নিরাপত্তার জন্য বিপজ্জনক হয়ে দাঁড়াচ্ছে। চীনের টাকায় বন্দর, সেতু, নদীর তলদেশে সংযুক্তি টানেল, রেলপথ ও বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ, মেট্রোরেল স্থাপনের ব্যাপারে ঘোর আপত্তি রয়েছে দিল্লিøøর। তা ছাড়া, চীন বাংলাদেশের সর্ববৃহৎ সামরিক সরঞ্জাম রফতানিকারক দেশ। চীনই একমাত্র দেশ যার সাথে বাংলাদেশের রয়েছে প্রতিরক্ষা সহযোগিতা চুক্তি। বাংলাদেশের সশস্ত্র বাহিনী চীনে তৈরি অস্ত্রশস্ত্র বিশেষ করে ট্যাংক, ক্ষেপণাস্ত্র, যুদ্ধবিমান ও অন্যান্য প্রতিরক্ষা ব্যবস্থায় সজ্জিত। ভারত এটিকে নিজের সামরিক নিরাপত্তার জন্য হুমকি মনে করে। দ্বিপক্ষীয় বৈঠকে এ বিষয়টি যথাযথভাবে তুলে ধরেছে দিল্লিø।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দিল্লিø সফরের প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তি পাশ কাটিয়ে যা ভারতকে উদ্বিগ্ন করে তুলেছে তা হলো, বাংলাদেশে চীনের ক্রমবর্ধমান উপস্থিতি ও প্রভাব। দিল্লিø মনে করে, বাংলাদেশে ব্যবসায়-বাণিজ্য, সংযুক্তিসহ অসামরিক ও সামরিক খাতে চীনের অধিক হারে অংশগ্রহণ ভারতের আঞ্চলিক ও সামরিক নিরাপত্তা বিঘিœত করতে পারে। এসব উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার কথাই বৈঠকে জোরালোভাবে তুলে ধরেছে নরেন্দ্র মোদি সরকার। তবে প্রতিবেশীর প্রতিটি উদ্বেগ নিরসনে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ ও সচেষ্ট থাকতে ঢাকা দিল্লিকে পূর্ণ আশ্বাস দিয়েছে। ভারতের জন্য নতুন কোনো আশঙ্কা তৈরি করতে পারে এমন পদক্ষেপ না নেয়ার প্রতিশ্রুতিও দিয়েছে ঢাকা। বৈঠকে বাংলাদেশ চীনের ত্রমবর্ধমান আঞ্চলিক প্রভাবের ব্যাপারে ভারতের দুশ্চিন্তার উপশম ভালোভাবেই ঘটিয়েছে মধ্যপন্থা অবলম্বনের মাধ্যমে।
দ্বিপক্ষীয় বৈঠক সম্পর্কে সাংবাদিকদের অবহিত করতে গিয়ে ভারতের পররাষ্ট্রসচিব বলেছেন, চীন বাংলাদেশের যেসব খাতে নিজেদের উপস্থিতি নিশ্চিত করে ফেলেছে, ভারতও সেসব জায়গায় নিজেদের সক্রিয় অংশগ্রহণ প্রত্যাশা করে। বঙ্গোপসাগরে চীনের উপস্থিতিতে ভারতের উদ্বেগ দূর করার জন্য চাপ দেয়া হয়েছে বাংলাদেশের ওপর। কোয়াত্রা বলেন, চীন থেকে বাংলাদেশের সাবমেরিন ক্রয় ও সাবমেরিন পরিচালনায় সামরিক প্রশিক্ষণের জন্য বঙ্গোপসাগরে চীনাদের উপস্থিতি ভারতের আরেকটি বড় উদ্বেগ।
চীনের দেয়া সাবমেরিনের ওপর নজরদারি করতে ভারত-বাংলাদেশ যৌথ উপকূলীয় রাডার ব্যবস্থাপনা সমঝোতার দ্রুত বাস্তবায়ন চায় দিল্লি। নিরাপত্তা ও সামরিক খাতে সহযোগিতা আরো বাড়াতে চায় ভারত। এবারের সফরে প্রতিরক্ষা ও নিরাপত্তা সহযোগিতার ওপর সবিশেষ গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। ঋণচুক্তির অধীন ভারতের ৫০ কোটি ডলার ব্যয়ে গৃহীত প্রকল্পগুলো দ্রুত সম্পন্ন করার ব্যাপারে সম্মত হয়েছেন দুই দেশের প্রধানমন্ত্রী। তিনি আরো বলেন, প্রতিরক্ষা খাতের ঋণচুক্তির আওতায় প্রথম লিখিত দলিল এ সপ্তাহের শুরুতে সই হয়েছে। এ ক্ষেত্রে টাকার পরিমাণ কম হলেও এটিকে প্রথম গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ বলা যায়। ঋণের আওতায় ভারত থেকে কিছু সামরিক সরঞ্জাম ক্রয়ে বাংলাদেশের আগ্রহকে কৌশলগত নিরাপত্তা ও সুরক্ষার জন্য খুবই জরুরি বলে অভিমত ব্যক্ত করে সামরিক খাতে সহযোগিতা বাড়ানোর আশ্বাস দেয়া হয়েছে দ্বিপক্ষীয় বৈঠকে।
উল্লেøখ্য, বাংলাদেশ ২০১৬ সালে চীন থেকে দু’টি সাবমেরিন কেনার পর ভারতে তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়। খুব অল্প সময়ের ব্যবধানে ভারতের তদানীন্তন প্রতিরক্ষামন্ত্রী মনোহর পারিকর ও সেনাবাহিনীপ্রধান জেনারেল বিপিন রাওয়াত ঢাকা সফর করে দিল্লিøর মনোভাব জানিয়ে দিয়েছিলেন। বিশ্লেষকদের ধারণা, দিল্লিøর প্রতিক্রিয়ার জের ধরে, ২০১৭ সালের এপ্রিল মাসে মোদি-হাসিনা বৈঠকে প্রতিরক্ষা সহযোগিতা সমঝোতা স্মারক সই হয়। তার অধীন ৫০ কোটি ডলার ঋণ দেয়ার সিদ্ধান্ত হয়। বঙ্গোপসাগরে সামুদ্রিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে ২০১৯ সালে দুই দেশ একটি সমঝোতা স্মারক সই করে। ঢাকা-দিল্লি যৌথ উপকূলীয় রাডার ব্যবস্থা চালুর সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। এ ব্যবস্থা যৌথভাবে উপকূলীয় নজরদারির পথ সুগম করবে। ভারত এই সমঝোতা স্মারকটি দ্রুত বাস্তবায়নের তাগিদ দিচ্ছে। এ ব্যাপারে সাবেক পররাষ্ট্রসচিব মো: তৌহিদ হোসেন গণমাধ্যমকে বলেছেন, যেহেতু উপকূলে নজরদারির বিষয়ে সমঝোতা স্মারক সই হয়েছে কয়েক বছর আগে, ভারত এটি বাস্তবায়নের তাগিদ দিতেই পারে। তবে নজরদারির মাধ্যমে প্রাপ্ত তথ্যে বাংলাদেশের সার্বভৌম অধিকার নিশ্চিত হবে কি না সেটিই গুরুত্বপূর্ণ।


আরো সংবাদ



premium cement