২০ এপ্রিল ২০২৪, ০৭ বৈশাখ ১৪৩১, ১০ শাওয়াল ১৪৪৫
`

দ্রব্যমূল্যের পাগলাঘোড়া ও পররাষ্ট্রমন্ত্রীর বেহেশত

-

আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের দলের নেতা ও মন্ত্রীদের সতর্ক হওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন। তিনি বলেন, ‘এই সময়ে দায়িত্বজ্ঞানহীন কোনো কথা বলা ও ক্ষমতার দাপট দেখানো সমীচীন নয়। ঠাণ্ডা মাথায় মানুষের পাশে দাঁড়াতে হবে, এটিই আজকে আমাদের সমচেয়ে বড় মেসেজ। আমাদের নেতাকর্মীদের বলব, প্রত্যেককে কথাবার্তায়, আচার-আচরণে দায়িত্বশীল হতে হবে।’
‘বাংলাদেশের মানুষ বেহেশতে আছেন, সুখে আছেন’- পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেনের এ বক্তব্য নিয়ে সর্বত্র যে প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়েছে তার পরিপ্রেক্ষিতেই ওবায়দুল কাদের দলের নেতাকর্মী ও মন্ত্রীদের সতর্ক করলেন। গত শুক্রবার দুপুরে সিলেটে এক মতবিনিময় সভায় পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওই বক্তব্য দিয়েছিলেন। তার ওই বক্তব্য গণমাধ্যমে প্রচারিত হওয়ার পর থেকেই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমসহ ‘রাজনৈতিক ও বুদ্ধিজীবী মহলে সমালোচনা শুরু হয়। অনেকেই মন্ত্রীর এ বক্তব্যকে ‘কাটা ঘায়ে নুনের ছিটা’ হিসেবে উল্লেøখ করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক সেলিম রায়হান ফেসবুকে লিখেন, ‘দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তিরা দায়িত্বপূর্ণ কথা বলবেন, এ প্রত্যাশা কি আসলেই বেশি? তা না হলে অনেক কথাই তো কাটা ঘায়ে নুনের ছিটার মতো মনে হতে পারে।’
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় অর্থনীতির অধ্যাপক ড. আনু মুহাম্মদ ফেসবুকে লিখেন, ‘কথা তো সবই সত্য! এই লোকেরা তো আসলেই বেহেশতে আছে। গায়ে কাপড়? তাদের একটি দু’টি নয়- কাপড়ের বোঝা থাকে যার জন্য তাদের সারাক্ষণ এসির মধ্যে থাকতে হয়। না খেয়ে মরা? না, এরা কখনোই না খেয়ে মরবে না, মরবে বেশি খেতে খেতে! তাই তো লুট-দখল-দুর্নীতি-জনগণের পকেট কাটা টাকা পয়সার স্রোত যে কত দিক থেকে আসে আর কোথায় যায় তার হিসাব রাখাই এদের জন্য মুশকিল। বাংলাদেশ ব্যাংকের টাকার হদিস এখনো মেলেনি। জ্বালানি তেল থেকে মুনাফার ২৫ হাজার কোটি টাকা রাখা আছে বেশির ভাগ ভাঙাচোরা ব্যাংকে তাদের লোকজনদের হেফাজতে, এই টাকা কোথায় যাবে কে বলতে পারে? ব্যাংকগুলো তো আছেই জনগণের টাকা জড়ো করে তা মেরে তাদের সুখ বাড়ানোর জন্য। খেলাপি ঋণের পাহাড় তো এদের মেদের মতোই বাড়ছে শুধু। ফুলছে অন্য দেশে। সুখের কি কোনো সীমা আছে এদের? সুখের সীমা না থাকলেই তো বেহেশত হয়’!
পররাষ্ট্রমন্ত্রীর বেহেশত প্রসঙ্গে সংবাদ ব্রিফিংয়ে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, ওনারা জনগণের সাথে তামাশা শুরু করেছেন। জনদুর্ভোগের এই সময়ে পররাষ্ট্রমন্ত্রীর এ রকম পরিহাস করার কোনো অধিকার নেই। তিনি আরো বলেন, দেশের মানুষ যখন প্রতি মুহূর্তে কষ্ট করছে, হিমশিম খাচ্ছে এবং তাদের জীবন দুর্বিষহ হচ্ছে, সেই সময়ে পররাষ্ট্রমন্ত্রী বললেন, মানুষ বেহেশতে আছে। আসলে যে লুটপাট হচ্ছে, তারা যে লুটপাট করছেন সে জন্যই তারা জনগণের সাথে পরিহাস, তামাশা শুরু করেছেন।
শুধু পররাষ্ট্রমন্ত্রীই নন, অন্যরাও কম যাচ্ছেন না। কয়েকদিন আগে এলজিআরডি মন্ত্রী তাজুল ইসলাম বলেছেন, ‘গ্রামগঞ্জে কোনো মানুষ না খেয়ে নেই। প্রত্যেক মানুষের গায়ে জামাকাপড় আছে। আমি মনে করি না আমরা খুব খারাপ অবস্থায় আছি।’ বক্তব্যের সমর্থনে একই মন্ত্রী শনিবার বলেন, ‘অনেক ভালো আছি, তা কি বলতে পারব না? আগে তো খেতে পায়নি, এখন তো খেতে পায়। তখন তো একটি শাড়িই কিনতে পারতেন না’!
ধর্ম প্রতিমন্ত্রী ফরিদুল হক গত ৩১ জুলাই বৈদেশিক মুদ্রা সাশ্রয়ের জন্য গম আমদানি কমাতে আটার রুটির বদলে চালের রুটি খাওয়ার পরামর্শ দিয়েছিলেন।
গত ৬ আগস্ট কুমিল্লায় এক কর্মশালায় কৃষিমন্ত্রী মো: আব্দুর রাজ্জাক দেশের মানুষকে কম খাওয়ার পরামর্শ দিয়েছিলেন। তিনি বলেছিলেন, ‘এখন তো বিপুল পরিমাণ ভর্তুকি দিলে রিজার্ভ একদম কমে যাবে। এতে দেশ হুমকির মুখে পড়ে যাবে। তার চেয়ে বরং এখনই কিছুটা কষ্ট করে আমরা সাবধান হই। তেল কম খরচ করেন, বিদ্যুৎ কম খরচ করেন, আমরা একটু সাশ্রয় করি, একটু কম খাই।’ কিন্তু দুর্নীতি ও লুটপাট যে দেশের একটি আলোচনার বিষয় সেদিকে মন্ত্রির নসিহত নেই। বিদেশে টাকা পাচার হচ্ছে দেদার। এ নিয়েও কথা নেই। সুইস রাষ্ট্রদূত বলেছেন, তাদের দেশের ব্যাংকে যে টাকা গচ্ছিত হচ্ছে সে ব্যাপারে সরকারের পক্ষ থেকে কখনো জানতে চাওয়া হয়নি। খুব সত্য কথা। যত নসিহত সবই সাধারণ মানুষের উদ্দেশে। তাদের কম খেতে হবে। বিদ্যুৎ কম খরচ করতে হবে। বেশি বেশি ট্যাক্স দিতে হবে।
দেশে গত জুনে মূল্যস্ফীতি ৯ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ পর্যায়ে ওঠে। এই হিসাব বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস)। যদিও অর্থনীতিবিদরা মনে করেন, মূল্যস্ফীতি বাস্তবে আরো অনেক বেশি। কারণ বিবিএসের হিসাবে গরমিল আছে। পুরো চিত্র আসেনি।
চালের দামের কথাই ধরা যাক। টিসিবির হিসাবেই ২০২০ সালের জানুয়ারি মাসে ঢাকায় মোটা চালের দাম ছিল কেজিপ্রতি সর্বানিম্ন ৩০ টাকা। গত শুক্রবার ওই দাম দাঁড়ায় ৫০ টাকায়। এর অর্থ হলো- নি¤œ আয়ের মানুষকে চাল কিনতে প্রায় ৬৭ শতাংশ বেশি ব্যয় করতে হচ্ছে। শুধু চাল নয়, ব্যাপকভাবে বেড়েছে ভোজ্যতেল, ডাল, আটা, চিনি, দুধ ও মাছ-গোশতসহ প্রায় সব নিত্যপণ্যের দাম। সাবান, টুথপেস্ট, শ্যাম্পু, খাতা-কলমসহ নিত্যব্যবহার্য পণ্য ও শিক্ষা উপকরণের দাম। শনিবার পত্রিকায় রিপোর্ট হয়েছে- একটি ডিম এখন সাড়ে ১২ টাকা। রোববার গিন্নি পলাশী বাজার থেকে ডিম কিনে এনেছেন এক হালি ৫৫ টাকায়।

জ্বালানি তেলের দাম এক লাফে ৪২ থেকে ৫১ শতাংশ বাড়ানোর নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে জনজীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে। পরিবহন ও শিল্প খাতে এর প্রভাব পড়ায় ব্যাপক সমালোচনা হচ্ছে। কৃষি নিয়ে এখনো কথা উঠেনি। তবে জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধির প্রভাব সবচেয়ে বেশি পড়তে যাচ্ছে কৃষিতে। কয়েক দিনের ব্যবধানে ইউরিয়া সার ও ডিজেলের দাম বেড়ে যাওয়ায় আমনের ভরা মৌসুমে খরচ মেটাতে হিমশিম খাচ্ছে কৃষক। এবার বৃষ্টি কম হওয়ায় আমন ধানে সেচ বেশি লাগছে। এত খরচ করে উৎপাদিত ফসল বিক্রি করে খরচ আদৌ উঠবে কি না এ নিয়ে কৃষকরা দুশ্চিন্তাগ্রস্ত। সার-ডিজেলের দাম বেড়ে যাওয়ায় কৃষকই কেবল চাপে পড়ছে না, খাদ্যনিরাপত্তাও হুমকির মুখে পড়েছে। কৃষিপণ্য উৎপাদনের ব্যয় বাড়লে বাজারে কৃষিপণ্যের দামও বেড়ে যায়। উভয় সঙ্কটে পড়েছেন কৃষকরা।
মানুষ কতটা কষ্টে আছে রোববার পত্রিকায় প্রকাশিত একটি রিপোর্টে এর করুণ বিবরণ রয়েছে। বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের একজন কর্মকর্তার উদ্ধৃতি দিয়ে এতে বল হয়, সেই কর্মকর্তা তাদের দুই সন্তানের পাতে তাদের পছন্দের খাবার তুলে দিতে পারছেন না। কারণ নিত্যপণ্যের দাম এতটাই বেড়েছে যে, সংসারের ব্যয় সামলাতে তাকে হিমশিম খেতে হচ্ছে। মাছ-গোশত কিনা তিনি একেবারেই কমিয়ে দিয়েছেন। ভাজি ভর্তা ও ডাল দিয়ে দুপুর-রাতের খাবার খেতে হচ্ছে। সন্তানদের জন্য নিয়ম করে প্রতিদিন দু’টি ডিম রাখতেন। এখন সপ্তাহে তিন দিনের বেশি ডিম খেতে দিতে পারছেন না। বাড়তি ব্যয় সামাল দিতে ব্যয় কাটছাঁট করতে বাধ্য হয়েছেন তিনি।

রিপোর্টটিতে আরো বলা হয়, রাজধানীসহ আটটি বিভাগীয় শহরের ৪০টি পরিবারের সাথে কথা বলে জানা গেছে, গত দুই বছরে তাদের আয় যে হারে বেড়েছে, তার চেয়ে খরচ বেড়েছে অনেক বেশি হারে। ছোট চাকরিজীবীরাই বেশি কষ্টে আছেন। ঢাকায় খোলা আটার দাম গত বছর ছিল ২৮ থেকে ৩২ টাকা। এখন সেই আটার কেজি ৪৮ থেকে ৫০ টাকা। এক বছরে দাম বেড়েছে ৬৩ শতাংশ। ব্রয়লার মুরগি গত বছর ছিল ১৫০ টাকা কেজি, এখন সেটি ২০০ টাকা। কোনো কোনো পরিবারে মাছ, গোশত ও দুধ বাবদ ব্যয় বাদ দেয়া হয়েছে কিংবা কমানো হয়েছে। বাইরে খাওয়া, ঘুরতে যাওয়া, কাজের ফাঁকে হালকা নাশতা বা খাওয়া সবই বাদ দিতে হয়েছে। সন্তানদের শিক্ষার পেছনে ব্যয় কমাতেও বাধ্য হচ্ছেন মা-বাবারা। একেবারে অসহ্য পর্যায়ে না গেলে রোগ নিয়ে চিকিৎসকের কাছে যাওয়া বন্ধ করে দিয়েছেন অনেকে। এভাবেই ব্যয় কমিয়ে টিকে থাকার চেষ্টা করছে মানুষ।
এ অবস্থায় পররাষ্ট্রমন্ত্রীর বেহেশতে থাকার বক্তব্য তাদের প্রতি পরিহাস ছাড়া আর কী? সরকারি দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের মূল্যবৃদ্ধির পাগলাঘোড়ার দাপট আঁচ করতে পেরেছেন মনে হয়। তাই তিনি সতর্ক করলেন দলের নেতা ও মন্ত্রীদের। তাদের দায়িত্বশীল হওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন। হ
লেখক : সিনিয়র সাংবাদিক, সাবেক সাধারণ সম্পাদক, জাতীয় প্রেস ক্লাব
Email: abdal62@gmail.com


আরো সংবাদ



premium cement