২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫
`

অরক্ষিত রেলক্রসিংয়ে প্রাণহানি, দায় কার

-

রেল দেশের পরিবহন ব্যবস্থার অন্যতম প্রধান যাতায়াতমাধ্যম। নিরাপদ, সাশ্রয়ী ও আরামদায়ক বাহন হিসেবে যাত্রীরা রেলকে ভ্রমণের জন্য বাছাই করে থাকে। কিন্তু রেলভ্রমণ ক্রমে ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠছে। দেশজুড়ে রেলক্রসিং অরক্ষিত থাকায় দুর্ঘটনা ও প্রাণহানি নৈমিত্তিক ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। রেলক্রসিংগুলোর অনেক জায়গায় পর্যাপ্ত প্রতিবন্ধক, সিগন্যাল বাতি ও গেটম্যান নেই। গত ২৯ জুলাই চট্টগ্রামের মিরসরাইয়ে খৈয়াছড়া ঝরনা লেভেলক্রসিংয়ের ভয়াবহ ও মর্মান্তিক দুর্ঘটনায় ঘটনাস্থলেই ১১ জন তরুণের মৃত্যু হয়। উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার মতে, ওই সময় কোনো গেটম্যান ছিল না। এ ঘটনার মধ্য দিয়ে দায়িত্ব পালনে সংশ্লিষ্টদের উদাসীনতার বিষয়টি আবারও স্পষ্ট হয়েছে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে রেলওয়ের অব্যবস্থাপনা, দায়িত্বে অবহেলা, পথচারীদের অসতর্কতা, কোথাও চালকদের উদাসীনতা দুর্ঘটনার প্রধান কারণ। এতদসত্ত্বেও লেভেলক্রসিংয়ে দুর্ঘটনা রোধে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষগুলোর সমন্বিত পদক্ষেপ চোখে পড়ছে না। লেভেলক্রসিং এখন মৃত্যুফাঁদে পরিণত হয়েছে। গত এক বছরে রেলক্রসিংয়ে ৩৩টি দুর্ঘটনায় ৭৪ জন নিহত হয়েছেন।
বাংলাদেশে রেল লেভেলক্রসিংয়ে মৃত্যুর ভয়াবহ পরিসংখ্যান রয়েছে। দুর্ঘটনা রোধে লেভেলক্রসিংগুলিতে নিরাপত্তাব্যবস্থা বাড়ানোর জন্য কর্তৃপক্ষ বারবার আশ্বাস দেয়া সত্ত্বেও বহু বছর ধরে বাংলাদেশে সমস্যাটি অনিয়ন্ত্রিতভাবে অব্যাহত রয়েছে। ডেইলি স্টার জানিয়েছে, গত ১৩ বছরে বাংলাদেশে রেলক্রসিংয়ে দুর্ঘটনায় ৭৩৯ জন প্রাণ হারিয়েছেন। ট্রেন দুর্ঘটনার বিভিন্ন ধরন রয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে : লাইনচ্যুতি, ট্রেন-ট্রেনে সংঘর্ষ, ট্রেন-গাড়ির সংঘর্ষ, ট্রেন-সাইকেল সংঘর্ষ, ট্রেন-পথচারী সংঘর্ষ। বাংলাদেশে গত ১৫ বছরে বৈধ ও বেআইনিভাবে বিভিন্ন লেভেলক্রসিংয়ে সংঘটিত প্রায় চার হাজার ৯১৪টি ট্রেন দুর্ঘটনায় অন্তত ৪১৯ জন নিহত এবং দুই হাজারেরও বেশি আহত হয়েছেন। তা ছাড়া, দেশে প্রায় এক হাজার ৩৬১টি অবৈধ রেলক্রসিং রয়েছে যেগুলো আরও বেশি অরক্ষিত এবং ব্যবহারের ক্ষেত্রে অনিরাপদ। রেলওয়ের কর্মকর্তা ও বিশেষজ্ঞদের মতে, গেটম্যানের স্বল্পতা, গেটম্যানের অবহেলা, অপরিকল্পিত লেভেলক্রসিং, রেললাইনে পথচারীদের বেআইনি চলাচল এবং চালকদের (লোকোমোটিভ ও যানবাহনের চালক উভয়ই) অবহেলা এই ধরনের দুর্ঘটনার প্রধান কারণ। গত বছরের ১৪ জুলাই সিরাজগঞ্জে মর্মান্তিক ট্রেন দুর্ঘটনায় রেলওয়েকে ব্যাপক সমালোচনার মুখে পড়তে হয়। জেলার উল্লাপাড়া উপজেলার লেভেলক্রসিংয়ে ঢাকাগামী পদ্মা এক্সপ্রেসের সাথে মাইক্রোবাসের সংঘর্ষে নবদম্পতিসহ মোট ১০ জন নিহত ও বেশ কয়েকজন তখন আহত হন।

বিভিন্ন পরিসংখ্যানে জানা যায়, সারা দেশে দুই হাজার ৮৭৭ কিলোমিটার রেলপথে বৈধ ক্রসিংয়ের সংখ্যা এক হাজার ৪১২টি; এর মধ্যে ৯৪৬টিতে, অর্থাৎ ৬৭ শতাংশে কোনো গেট নেই! এমনকি নেই যান নিয়ন্ত্রণের কোনো কর্মীও। নেই সঙ্কেতবাতি। এ ছাড়া রেললাইনের ওপর দিয়ে স্থানীয় লোকজন অবৈধ স্থাপনা, হাটবাজার, রাস্তা নির্মাণসহ বিভিন্ন সংস্থার কাজে সমন্বয়হীনতার কারণে হিসেবের বাইরেও আরো বিপুলসংখ্যক মরণফাঁদ তৈরি হয়েছে, যা রেলের সার্বিক নিরাপত্তা ও পুরো পরিস্থিতিকে আরো ভয়াবহতার দিকে ধাবিত করছে। দেশে ৮২ শতাংশ রেলক্রসিং অনিরাপদ। রেলওয়ের তথ্য অনুসারে, সারা দেশে অনুমোদনহীন রেলক্রসিংয়ের বেশির ভাগই স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদফতরের (এলজিইডি) সড়কে। আরো আছে পৌরসভা, ইউনিয়ন পরিষদ, সিটি করপোরেশন এবং সড়ক ও জনপথ বিভাগের (সওজ) সড়ক। সরকারের কমবেশি পাঁচটি সংস্থা রেললাইনের ওপর সড়ক নির্মাণ করার কারণে রেলক্রসিং সৃষ্টি হয়েছে। এই সংস্থাগুলোর মধ্যে সমন্বয়ের অভাব রয়েছে। তারা একে অপরের ওপর দোষ চাপিয়ে দায়িত্ব এড়াতে চায়।
রেলওয়ের মতে, স্থানীয় সরকার প্রকৌশল বিভাগ (এলজিইডি), পৌরসভা এবং ইউনিয়ন পরিষদ অবৈধ লেভেলক্রসিংয়ের জন্য বেশির ভাগই দায়ী। অবৈধ লেভেলক্রসিং ব্যবহার ও সুরক্ষার পেছনে স্থানীয় রাজনীতিবিদদের হাত থাকায় রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ সেগুলো অপসারণ করতে পারছে না বলে অভিযোগ রেল কর্মকর্তাদের। রেলওয়ে আইন ১৮৯০ অনুসারে, কেউ রেললাইনে হাঁটতে পারে না কারণ এটি একটি শাস্তিযোগ্য অপরাধ (সর্বোচ্চ শাস্তি : দুই বছরের জেল)। তবে পথচারীরা রেললাইনকে হাঁটার রাস্তা হিসেবে ব্যবহার করতে দেখা যায় এবং এতে দুর্ঘটনার সংখ্যা বেড়েছে। সম্ভবত বাংলাদেশ ছাড়া খুব কম দেশই তাদের লেভেলক্রসিংগুলোকে মৃত্যুফাঁদে পরিণত করেছে। লেভেলক্রসিংগুলোকে গেটম্যানবিহীন অবস্থায় ফেলে রাখার রেওয়াজ অন্যান্য দেশে নেই। রেল আসার পূর্বমুহূর্তে মোটরযান চলাচলে বাধা দেয়ার জন্য লেভেলক্রসিং বার দিয়ে যখন প্রতিবন্ধকতা তৈরি করা হয় তখন মোটরচালকদের একটি অংশ রেলওয়ে ট্র্যাক অতিক্রম করার প্রবণতা লক্ষ করা যায়। এটা অবচেতনভাবে আত্মহত্যার শামিল। এসব ড্রাইভারদের সম্ভবত তাদের জাগতিক কার্যভারের চেয়ে জীবনের মূল্য কম। রেলক্রসিংয়ের প্রায় প্রতিটি দুর্ঘটনায় চালকের নেয়া একক সিদ্ধান্তের খেসারত দিতে হয়েছে যাত্রীদের।

পরিবহন বিশেষজ্ঞ ও বাংলাদেশ প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের অধ্যাপক শামসুল হক বলেন, ‘প্রথমত এবং সর্বাগ্রে, রেলওয়ে কর্তৃপক্ষকে আরও অবৈধ লেভেলক্রসিং স্থাপন বন্ধ করার জন্য জোরালো পদক্ষেপ নেয়া উচিত, কারণ এটি শুধুমাত্র একটি বড় কারণ নয়; মারাত্মক দুর্ঘটনার জন্য কিন্তু নিয়মিত ট্রেনের গতিও ব্যাহত হয়। দ্বিতীয়ত, দেশের বিল্ট-আপ এলাকায় প্রধান লেভেলক্রসিংয়ে ওভারপাস নির্মাণ করতে হবে এবং যেখানে ওভারপাস নির্মাণ করা সম্ভব নয়, সেক্ষেত্রে গেটম্যানদের অধিকতর সতর্কতা অবলম্বনের নির্দেশনা দিতে হবে। তৃতীয়ত, সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ এখন অপারেশনের চেয়ে উন্নয়নের দিকে বেশি মনোযোগী। কিন্তু অপারেশন এবং রক্ষণাবেক্ষণ একটি নিরাপদ যাত্রার মূল উপাদান। তাই অপারেশনাল কার্যক্রমকে অগ্রাধিকার দিতে হবে। রেলমন্ত্রী মো: নুরুল ইসলাম সুজন সাংবাদিকদের বলেন, ‘আমরা শিগগিরই লেভেলক্রসিংগুলোর উন্নয়নে ব্যাপক উদ্যোগ নেবো। অনেক বিভাগ ও স্টেকহোল্ডার এই প্রক্রিয়ার সাথে জড়িত; তাই আমরা সমন্বিতভাবে সমস্যা সমাধানের চেষ্টা করছি’ (ঢাকা ট্রিবিউন ডট কম/ আর্কাইভ)।
২০০৬ সালের ১১ জুলাই জয়পুরহাটের আক্কেলপুর মহিলা কলেজসংলগ্ন রেলক্রসিংয়ে বাস-ট্রেন সংঘর্ষে ৩৬ জন বাস যাত্রী প্রাণ হারান। পরে রেল বিভাগ ওই রেলক্রসিংটি অনুমোদন দিয়ে গেটম্যান নিয়োগ দেন। চলতি বছরের ২১ জানুয়ারি উপজেলার জামালগঞ্জ রেলস্টেশনের আউটার সিগন্যালের কাছে অরক্ষিত রেলক্রসিংয়ে রাজশাহী থেকে ছেড়ে আসা চিলাহাটিগামী আন্তঃনগর তিতুমীর এক্সপ্রেস ট্রেনের ধাক্কায় কলাবাহী ভটভটি দুমড়েমুচড়ে যায় এবং ঘটনাস্থলেই চালক মোখলেছুর রহমান (৩৬) নিহত হন। রেলওয়ে সূত্রে জানা গেছে, জয়পুরহাটের আক্কেলপুর উপজেলায় প্রায় সাড়ে ১৮ কিলোমিটার রেল পথ রয়েছে। এই রেলপথে মোট ১০টি রেলক্রসিং থাকলেও অনুমোদিত পাঁচটি লেভেলক্রসিংয়ে গেট এবং গেটম্যান রয়েছে। বাকি পাঁচটি অনুমোদনহীন অরক্ষিত রেলক্রসিং। এই রেলক্রসিংগুলোতে ঝুঁকি নিয়ে চলাচল করছে যানবাহন। এতে বাড়ছে দুর্ঘটনা; সেইসাথে বাড়ছে মৃত্যু (ইনকিলাব, ঢাকা, ৩ জানুয়ারি, ২০২১)।
১৯৮৯ সালের ১৫ জানুয়ারি গাজীপুর জেলায় উত্তরগামী একটি মেইল ট্রেনের সাথে একটি চট্টগ্রামগামী এক্সপ্রেস ট্রেনের সংঘর্ষ হয়। টঙ্গীতে বিশ্ব ইজতেমা উপলক্ষে উভয় ট্রেনে মোট ২০০০ এরও অধিক যাত্রী ছিল, যাদের অনেকেই ছাদে বা কোচের মধ্যবর্তী স্থানে ভ্রমণ করছিল। এ দুর্ঘটনায় অন্তত ১৭০ জন নিহত ও ৪০০ জন আহত হন। রেলওয়ে পুলিশের তথ্য মতে, চলতি বছরের ৯ জানুয়ারি থেকে ৩১ জুলাই পর্যন্ত টঙ্গী, জয়দেবপুর, মির্জাপুর, কালিয়াকৈর, শ্রীপুর ও পূবাইলে ট্রেনে কাটা পড়ে ৪৯ জনের মৃত্যু হয়েছে। কালিয়াকৈর, ভান্নারা, রতনপুর, ভাওয়াল মির্জাপুর, টঙ্গীর আরিচপুর বউ বাজার, মধুমতি রেলগেট, বনমালা রেলগেট, হায়দ্রাবাদ এলাকায় বেশির ভাগ অরক্ষিত রেলক্রসিং। এসব ক্রসিং দিয়ে ঝুঁকি নিয়েই মানুষ পারাপার হচ্ছেন।

মানুষের ব্যর্থতার কারণে দুর্ঘটনা দূর করতে এবং পুরনো যান্ত্রিক সিস্টেম প্রতিস্থাপনের জন্য পয়েন্ট এবং সিগন্যালের কেন্দ্রীভূত অপারেশনসহ বৈদ্যুতিক/ইলেকট্রনিক ইন্টারলকিং সিস্টেম চালু করা যেতে পারে। মানব উপাদানের পরিবর্তে বৈদ্যুতিক উপায়ে ট্র্যাক দখল যাচাইয়ের জন্য, নিরাপত্তা বাড়ানোর জন্য স্টেশনগুলোতে ট্র্যাক সার্কিটিং বসানো যেতে পারে। দুর্ঘটনা এড়ানোর জন্য ভারতীয় রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ বেশ কিছু পদক্ষেপ নিয়েছে। এর মধ্যে Train Collision Avoidance System (TCAS) ব্যবস্থা অন্যতম। TCAS হল একটি স্বয়ংক্রিয় ট্রেন সুরক্ষা (ATP) সিস্টেম যা ৩টি ভারতীয় নির্মাতার সহযোগিতায় তৈরি করা হয়েছে। সিস্টেমটি দক্ষিণ মধ্য রেলওয়ের লিঙ্গামপল্লী-ভিকারাবাদ-ওয়াদি, ভিকারাবাদ-বিদার সেকশনে (২৫০ RKMs) ইনস্টল করা হয়েছে। ইনডিপেনডেন্ট সেফটি অ্যাসেসর (ISA) দ্বারা সেফটি ইন্টিগ্রিটি লেভেল ৪ (SIL-4) এ সিস্টেমের ব্যাপক ফিল্ড ট্রায়াল এবং নিরাপত্তার বৈধতা সম্পন্ন হয়েছে। সম্পূর্ণ ব্লক বিভাগে ১১০ Kmph গতির জন্য উন্নয়নমূলক আদেশের জন্য RDSO দ্বারা সব সংস্থার পণ্য অনুমোদিত হয়েছে।
যাহোক, দেশে এক হাজার ৩৬১টি অবৈধ রেলপথ ক্রসিং রয়েছে যা সরকার কর্তৃক বৈধ এবং সঠিকভাবে পরিচালনা করা উচিত বা জননিরাপত্তা বিবেচনা করে স্থায়ীভাবে বন্ধ করা উচিত। কোনো অবস্থাতেই, সরকারের একার পক্ষে জনগণের সম্পূর্ণ নিরাপত্তা নিশ্চিত করা সম্ভব নয়। জনগণেরও তাদের কমনসেন্স ব্যবহার করতে, তাদের নিজেদের জীবন রক্ষা করতে এবং কর্তৃপক্ষীয় আদেশ পালনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে হবে। সরকারের ঊর্ধ্বতন মহল এসব অব্যবস্থা সম্পর্কে সম্যক অবগত আছেন। তারা এটাও জানেন যে, এই দুর্ঘটনাগুলো শেষ পর্যন্ত বাংলাদেশ রেলওয়ের অপারেশনাল ক্ষমতাকে ব্যাহত করে ও সুনাম ক্ষুণœ করে। অনিয়মে জর্জরিত হওয়া ছাড়াও রেলওয়ের অনেক সীমাবদ্ধতা রয়েছে। কিন্তু বিরক্তিকর এবং এড়ানো যায় এমন বাধার সম্মুখীন না হয়ে, এটিকে সংস্কার করার অনুমতি দিতে হবে। প্রয়োজনে নলখোলচে খুলে ‘পুনরায় টাইট’ দিতে হবে। হ
লেখক : অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক ও গবেষক
drkhalid09@gmail.com


আরো সংবাদ



premium cement