১৮ এপ্রিল ২০২৪, ০৫ বৈশাখ ১৪৩১, ০৮ শাওয়াল ১৪৪৫
`

অর্থমন্ত্রীর সাক্ষাৎকার

-


গ্রামদেশে একটি শব্দ চালু আছে ‘ভাঙরি’ দেয়া; মানে বিয়ে ভাঙরি দেয়া বা বিয়ে ভেঙে দেয়া। এর মানে, গ্রামের কোনো দুই পরিবারে হয়তো বিয়ে ঠিক হয়েছে; প্রস্তুতি চলছে। কিন্তু সব গ্রামে কিছু লোক থাকে যাদের কাজ হলো, বিয়ে ভাঙরি দেওয়া। হতে পারে, তাদের বেশির ভাগ নিজের জীবন নিয়ে প্রচণ্ড হতাশ। হতে পারে তারা অবিবাহিত বা চিরকুমার ধরনের যাদের বিয়ের বয়স পার হয়ে গেছে, তাই হতাশ। এরা ছেলের পরিবারে গিয়ে রটায় মেয়ের চরিত্র খারাপ অথবা মেয়ের পরিবারে গিয়ে বলে, ছেলের আগে একবার বিয়ে হতে গিয়েছিল বা হয়েছিল, এ ধরনের গল্প-গুজব ছড়ায়!


ভারতের এখনকার অবস্থা এই হতাশ ভাঙরি দেয়া মানুষের মতো। উঠেপড়ে লেগেছে ‘চীন কত খারাপ’- সত্য-মিথ্যা যেভাবে পারে, তা দিয়ে বাংলাদেশ সরকারের কান ভারী করতে। আবার আমাদের সরকারও সময়ে প্রলোভনে পড়ে ভারতের প্রপাগান্ডা শুনতে চাওয়ার ভান করতে গেছে ‘যদি কিছু লাইগা যায়’ ভেবে। মূলত ডলার পাচারে যে চরম অস্থির-অনিশ্চয়তা আমাদের অর্থনীতিতে দেখা দিয়েছে; তাতে অসহায় হয়ে সরকার যেন কোথায় কী পাওয়া যায় সব উলটা দেখতে চাইছে; অথচ আগেই জানে ওখানে কিছু পাওয়া যাবে না।
ঘটনা হলো, আমাদের সরকারের অর্থমন্ত্রী এ এইচ এম মুস্তফা কামাল কথিত এক সাাৎকার দিয়েছেন লন্ডন থেকে প্রকাশিত ফাইনান্সিল টাইমস (এফটি) পত্রিকাকে। সেখানে তিনি চীনা ঋণ কত খারাপ ও কেন বিপজ্জনক, তা বর্ণনা করেছেন বলে দাবি করেছে পত্রিকাটা। এফটি-এর গত ৯ আগস্ট প্রকাশিত ওই রিপোর্টের শিরোনাম হলো, ‘বাংলাদেশের অর্থমন্ত্রী চীনা বেল্ট ও রোড ঋণ নেয়ার ব্যাপারে সতর্ক করেছেন’। এটি মনে করার ‘যথেষ্ট’ কারণ আছে যে, এই কথিত রিপোর্টের সাথে ভারতের ইন্টেলিজেন্সের সংশ্লিষ্টতা আছে। কারণ পরের দু’দিন ধরে ভারত এটিকে দিয়ে তার চীনবিরোধী প্রপাগান্ডা চালিয়েছে। ভারতে অন্তত দশটা পত্রিকায় একই এফটি এর বরাতে ছাপা হয়েছে যদিও সেসবের ভাষ্য, নতুন আরো শব্দ ঢুকানো বা লেখার ভলিউম ছোটবড় করা অথবা শিরোনাম আলাদা করা ইত্যাদি করেছে- যার মূলকথা হলো, রিপোর্টটা স্পষ্ট করে চীন কত খারাপ, চীন বিভিন্ন দেশকে ‘ঋণের ফাঁদে’ ফেলে আয় করে চলা একটি দেশ, শ্রীলঙ্কার বর্তমান অর্থনৈতিক সঙ্কটে চীন দায়ী- এসব অর্থ করে এভাবে সাজিয়ে লেখা। এভাবে পরবর্তীতে ভাষ্যগুলোর লিড আসে হিন্দুস্তান টাইমস থেকে। ওখানে শিরোনাম একটু বদলে দিয়ে আগের শিরোনামের সাথে এবার যোগ করা হয়, ‘শ্রীলঙ্কার উদাহরণের পরিপ্রেক্ষিত’- এ বাড়তি শব্দগুলো। আর দশ তারিখ বিকালে বাংলাদেশের ‘মানবজমিন’ পত্রিকা হিন্দুস্তান টাইমসের ভাষ্যটার বাংলা অনুবাদ করে ছাপে।
এফটি-এর রিপোর্ট ছাপার পরে, প্রায় ৪৮ ঘণ্টা পেরোনোর পরে অর্থমন্ত্রী ও তার মন্ত্রণালয় এবার এক রিজয়েন্ডার বা প্রতিবাদলিপি পাঠান ১১ আগস্ট সন্ধ্যার পরে। কিন্তু সেই প্রতিবাদলিপির ভাষ্যটা কী তা কেবল বাংলাদেশের ফাইন্যান্সিয়াল একপ্রেস পত্রিকা একটি সংপ্তি ভাষ্য ছিল। ফাইন্যান্সিয়াল একপ্রেস ওই রিপোর্টে জানায়, মন্ত্রী এক প্রতিবাদ দিয়েছেন যা তারা জেনেছে, ‘এক অফিস-কর্তার (অনুমান করছি অর্থ মন্ত্রণালয়ের কাউকে বুঝিয়েছে) কাছ থেকে যে বিষয়টা সম্পর্কে ওয়াকিবহাল।’
এর পরের দিন ১২ আগস্ট ভোরবেলা বাংলাদেশ সময় ভোর ৫টার একটু আগে, অর্থমন্ত্রীর ওই প্রতিবাদলিপির মূল ভাষ্য এফটি প্রকাশ করে যদিও তা সত্ত্বেও ১২ আগস্ট সারা দিন ভারতীয় পত্রিকাগুলো যারা এফটি-এর বরাতের নামে খবর ছেপেছিল এ প্রতিবাদলিপির কথা তারা সবাই চেপে গিয়েছে। এমনকি প্রভাবশালী দ্য প্রিন্ট; যার প্রধান সম্পাদক শেখর গুপ্ত যিনি নিজে নিয়মিত কলাম লিখে থাকেন আর সাথে ওই লেখার এক ভিডিও কিপ-ভাষ্য তিনি নিজে তৈরি করে ইউটিউবে প্রচার করে থাকেন। তিনিও এফটি বরাতে কিন্তু হিন্দুস্তান টাইমসের ভাষ্যটার ওপর ভিত্তি করে তার ভিডিও কিপ প্রকাশ করেছেন, সেটা চালিয়ে গেলেন প্রতিবাদ আসার পরেও; যা একটি খাসা চীনবিরোধী দেশপ্রেমিক ভারতের প্রপাগান্ডা হয়েছে অবশ্য। অর্থমন্ত্রীর প্রতিবাদলিপিটা ছাপানোর বদলে শেখর গুপ্ত বরং তার প্রপাগান্ডা কিপটাই ১২ আগস্ট সারা দিন প্রচার করে গিয়েছেন।

কী ছিল প্রতিবাদলিপিতে
সার কথায় তিনি লিখেছেন, এ রিপোর্টে ‘মন্ত্রীর প্রকৃত অবস্থানের প্রতিফলন ঘটেনি’। কিন্তু মন্ত্রীর ‘প্রকৃত’ অবস্থানটা কী ছিল তাহলে? পরের প্যারায় তিনি লিখছেন, ‘দ্য রিপোর্ট মেনশনড শ্রীলঙ্কা’ বলছেন তিনি। এরপর উল্লেখ করেছেন- যে (মূলত) সভরেন লোন নেয়ার কারণে মে মাসে ডিফল্টার হয়ে গেছে এবং পরে আইএমএফ এর সাথে চুক্তিতে গিয়েছে।’ মন্ত্রীর এই দাবিটা সত্য। কিন্তু মন্ত্রী তাই বলছেন, রিপোর্ট লিখেছে, বিআরআই (চীনা বেল্ট রোড ইনিশিয়েটিভ লোন) লোনের কারণে শ্রীলঙ্কার অর্থনৈতিক সঙ্কট চরম খারাপ হয়ে গেছে’- এটি তিনি বলেন নাই। অর্থাৎ চীনা লোনের কারণে শ্রীলঙ্কা ডিফল্টার হয়েছে এটা বলেন নাই; বরং আসলে ‘সভরেন ঋণের কারণে সমস্যা হয়েছে’।
পরের প্যারায় বলছেন, ‘তিনি চীনা লোন নেওয়ার ব্যাপারে (কাউকে) সতর্ক করেন নাই।’ এ ছাড়া সবশেষে তিনি একটি তথ্যের প্রসঙ্গ তুলে বলেন, ‘২০২১ সালের হিসেবে আমাদের মোট বিদেশী ঋণ ৫১ বিলিয়নের মধ্যে মাত্র ৪ বিলিয়ন হচ্ছে চীনা লোন।’
অর্থাৎ তিনি বলতে চাইছেন, বাংলাদেশের কোনো অর্থনৈতিক ক্রাইসিস চীনা লোনের কারণে নয়।


কিন্তু মন্ত্রীর এ প্রতিবাদলিপি যেসব প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে
১. প্রথমত এ প্রতিবাদলিপিতে এটি পরিষ্কার যে, মন্ত্রী এফটি-এর সাথে কথা বলেছেন যেটাকে তারা ইন্টারভিউ বলছে।
২. কিন্তু কোনো দেশের মন্ত্রী সাাৎকারে বা সাংবাদিকের সাথে আলাপে কোনো একাডেমিক বা ইন্টেলেকচুয়াল আলাপ কথোপকথনে লিপ্ত হন না, হওয়ার কথা না। এটি তার সাবজেক্ট না, এখতিয়ারও না। ফলে শ্রীলঙ্কা কেন সঙ্কটে ডুবেছে এ প্রসঙ্গে তিনি কথা বলবেন কেন? মন্ত্রী বড়জোর বাংলাদেশের অর্থনৈতিক অবস্থা সম্পর্কে কথা বলবেন। এটি তার এখতিয়ার। বাংলাদেশে চীনা লোন নিয়েও কথা বলবেন যতটুকু একটি বিদেশী মিডিয়াকে দেয়ার মন্ত্রী হিসাবে তার এখতিয়ার। তবে সেটাও- শ্রীলঙ্কা চীনের লোনে ডুবেছে কিনা- এ বিষয়ে কোনো জবাব না দিয়ে, এড়িয়ে। শ্রীলঙ্কায় কার জন্য কী হয়েছে, এটির ব্যাখ্যা দেয়ার কাজ আমাদের মন্ত্রীর নয়। কোনো বিদেশী সাংবাদিক তাকে তবু যদি শ্রীলঙ্কা চীনের লোনে ডুবেছে কিনা- বলে মন্তব্য জানতে চায় তাহলে, অর্থমন্ত্রীর উচিত হবে, ঠাণ্ডা মাথায় ভদ্রভাবে ওই সাংবাদিককে বিদায় করে দেয়া। আর সাংবাদিককে মনে করিয়ে দেয়া যেতে পারে যে, ওই মন্ত্রীগণ বাংলাদেশের কোনো পাবলিক ইন্টেলিকচুয়াল না, তিনি অর্থমন্ত্রী; তাই প্রাসঙ্গিক প্রশ্ন না করতে পারলে বা না থাকলে তিনি কথোপকথন শেষ করবেন। কিন্তু জানা যাচ্ছে, মন্ত্রী সেটা করেননি, সাংবাদিকের সাথে মেতেছিলেন।
৩. বাংলাদেশের চলতি সরকারের একটি নিয়মিত সমস্যা দেখা গিয়েছে যে, কেন সে চীনের সাথে সম্পর্ক রাখছে তা ভারতকে ব্যাখ্যা করতে যাওয়া। তবু এটি যদি সরকার টু সরকার পর্যায়ে হয় যেখানে ফরমাল-ইনফরমাল বহু আলাপ হয়ে থাকে যা স্বাভাবিক, সেখানে কিছু হতে পারে। কিন্তু পাবলিকলি বা প্রকাশ্যে মিডিয়া-সাংবাদিকতায় এটি কাম্য নয়। তাহলে এর অর্থ দাঁড়াবে, ভারতকে ট্যাক্স দিয়ে আমাদের যেন চলতে হয়।
ভারতও প্রায়ই এমন দাবি করে থাকে যে, তার পড়শি দেশগুলো যেন ভারতের নিজ বাসার পিছনের বাগানবাড়ি সে দেশগুলো যেখানে ভারত ইচ্ছামতো হাত ঢুকাতে পারে, ফুল তুলে আনতে পারে ইত্যাদি। এই ধারণার আদিগুরু হলেন জওয়াহের লাল নেহরু। তিনি মনে করতেন মানে ভাব করতেন, ১৯৪৭ সালে ব্রিটিশরা ভারত ছেড়ে ফিরে গেলেও ওর বদলে তখন থেকে নেহরু হলেন রানীর ‘ভাইসরয়’ প্রতিনিধি। ফলে ভারতের পড়শি দেশ যারাও ব্রিটিশ কলোনির অংশ ছিল, কিন্তু এখন এসব স্বাধীন দেশ হলেও সেই সূত্রে নেহরুর অধীনস্থতা তাদের মানতে হবে।
ভারত এ কথাগুলো রিপিট করা শুরু করেছিল যখন চীনা অর্থনৈতিক সমতা বেড়ে যাওয়াতে আফ্রিকার মতো ভারতের পড়শি দেশগুলোর উপরও চীনা প্রভাব স্বাভাবিকভাবে বাড়ছিল। কিন্তু ভারত চীনের মতো অর্থনৈতিক সমতা দিয়ে না, যে মুরোদ তার এখনো হয় নাই তাই, বরং নেহরুর সামন্ত-কলোনি স্টাইল দিয়ে কিছু করার চেষ্টা করে যাচ্ছে। আর আমাদের সরকারের নিজ দুর্বলতার কারণে বিদেশী সাংবাদিক বা ভারতীয় সাংবাদিক পেলে তাকে তোষামোদ করতে চেষ্টা করা থেকে এসব সমস্যা তৈরি হয় বলে অনেকে অনুমান করে।
৪. কোন সূত্রে এফটির প্রতিনিধি অর্থমন্ত্রী পর্যন্ত পৌঁছাতে অ্যাকসেস বা প্রবেশ-অনুমতি পায় ও কথা বলতে পেরেছিল সেটা এক বিরাট কৌতূহল ও রহস্য। অবশ্যই। কারণ তিনি এই সাংবাদিকের সাথেই চীন কেমন, শ্রীলঙ্কার সঙ্কটে চীনা ঋণের স্বভাব খাসলত কেমন যেন এটি তাদের আলাপের সাবজেক্ট ছিল, মন্ত্রী সে আলাপ প্রত্য-পরোক্ষো করেছেন! আর এমন বিশেষ আগ্রহ বিচার করলে এটি ভারতের পলিসি যে, চীনকে এক দানব বলে তুলে ধরতে চায়। এ ছাড়া যেন এই চীন এমন যে, যার বাসার ভাত চড়ে ‘ঋণের ফাঁদে ফেলে; বিভিন্ন দেশ থেকে লুটে আনা পয়সায়’!
কাজেই অর্থমন্ত্রীর এফটির সাথে সাক্ষাৎ দেয়ার পেছনের ঘটনার সাথে ভারত আছে, তার ইন্টেলিজেন্স আছে এমন অনুমান প্রবল। বিশেষ করে, অর্থমন্ত্রীর মুখ দিয়ে চীনা ঋণের বিরুদ্ধে বলানো, আর এরপর সেটাকে আরেক দফায় ভারতের আরো দশটা পত্রিকায় আরো কঠোর চীনবিরোধী প্রপাগান্ডা ভাষ্য হিসাবে দ্রুত উপস্থাপন যেখানে আবার সেন্ট্রাল রোলে হিন্দুস্তান টাইমসকে রাখা- এ এক বিরাট খবর ম্যানিপুলেশন, প্রপাগান্ডা-হিন্দুত্বের জাতিবাদী চীনবিরোধী জোশ তৈরি করে ভারতের এক মহা-প্রপাগান্ডা তৎপরতা! সেটা ভারত করলে করুক যা ভারত আর চীনের ব্যাপার; কিন্তু ভারত এই প্রপাগান্ডা করেছে আমাদের অর্থমন্ত্রীর কাঁধে বন্ধুক রেখে। যেটা অবশ্যই আমাদের সবার জন্য বদারিং পয়েন্ট! তাতে এখন দাঁড়িয়েছে এমন যে, তিনি চীনা ঋণের নিন্দা করেন আর নাই করেন তার চেয়ে বড় ঘটনা হলো, তিনি ভারতের হাতে ব্যবহৃত হয়ে গেছেন।
৫. এফটির রিপোর্টের শিরোনামে একটি শব্দ হলো, ‘বিআরআই’ লোন মানে বেল্ট-রোড প্রকল্পের লোন। অর্থাৎ এখানে ধরে নেয়া হয়েছে চীনা লোন মানে যেন তা বিআরআই! না, একেবারেই না। এটি ভারতীয় অনুমান এবং এটি মিথ্যা। এর কারণ সম্ভবত যখন বেল্ট-রোড প্রকল্প, আগে কয়েক বছর তা চলার পরে বিআরআই নাম দিয়ে সম্মেলন ডাকা হয় কেবল তখনি ভারত বিআরআই প্রকল্পের প্রকাশ্য বিরোধিতায় নেমেছিল।
আরেক মজার দিক হলো, এখন ভারতে কি চীনা অবকাঠামো ঋণ নেই? অবশ্যই আছে; মোদির প্রথম পাঁচ বছরে এ সখ্যতা ছিল ঘোরতর। ভারতের রেলওয়ে আধুনিকায়ন, স্টাফ ট্রেনিংসহ, এ ছাড়া অন্তত পাঁচটা শহর আধুনিক অবকাঠামো নতুন করে গড়ে দেয়াসহ আরো অনেক কিছু সেখানে ছিল। কিন্তু বিআরআই বিরোধিতার পর থেকে ভারতে চীনা ঋণ বিষয়ে সব পাবলিক ইনফরমেশন সরিয়ে ফেলা হয়েছে। তবে সার কথা হলো, চীনা ঋণ মানে বিআরআই নয়। বাংলাদেশের বেশির ভাগ লোন বরং নন-বিআরআই যদিও কোনো নন-বিআরআই লোন পরে বিআরআই হিসাবে উভয়প মেনে নিয়েছে এমনো হয়েছে। আবার পদ্মা সেতু বিআরআই বলে দেখাতে রাজি হননি হাসিনা।
আবার চার দেশীয় চীনের কুনমিং-বার্মা-(কক্সবাজার) ঢাকা-কলকাতা যে রেলপথ পরিকল্পনা ছিল সেটি এখন পরিত্যক্ত। তবে কুনমিং-বার্মা-(কক্সবাজার) ঢাকা কাজ চলছে। তাতে ভারত সরে গেছে মানে ঢাকা-কলকাতা পদ্মার রেলপথ হলে সেটি দিয়ে কানেক্ট করার কথা ছিল; তা শুধু ঢাকা-কলকাতা হয়ে আছে। ফলে চার দেশীয় এটি ছিল সত্যিকার বিআরআই। কারণ যেকোনো অবকাঠামো যা ইউরোপ থেকে সেন্ট্রাল এশিয়া হয়ে চীন হয়ে (সাথে অবশ্য সমুদ্রপথে আফ্রিকা যুক্ত) এশিয়ায় ছড়িয়ে বিভিন্ন দেশে, এটি মূল বিআরআই। এমন মূল বিআরআইয়ে যুক্ত নয় তেমন চীনা প্রকল্পও বাংলাদেশে আছে। কাজেই চীনা ঋণ না বলে বিআরআই বলার মানে হলো একমাত্র যার ভারত সুনির্দিষ্ট করে বিরোধিতা করে।


কেন এ সময়ে বাংলাদেশবিরোধী প্রপাগান্ডা
আগে যেমনই হোক, গত প্রায় দুই মাস ধরে ভারত বাংলাদেশবিরোধী প্রপাগান্ডা অনেক বাড়িয়েছে। এর প্রধান দুটা কারণের প্রথমটি, গত এক দেড় বছর ধরে বাংলাদেশের মাথাপিছু আয় ভারতের চেয়ে বেশি; এটি আইএমএফ-বিশ্বব্যাংকের ডাটা থেকে প্রতিষ্ঠিত। এই ফিগার নিয়ে ভারতে মোদিবিরোধীরা মোদির অর্থনীতি খারাপ, ফেল করেছে এটি প্রমাণের পাবলিক পর্যায়ের সমালোচনা হিসেবে তুলে ধরে এসেছে। সেটা ভোটে প্রভাব ফেলেছে বা আরো ফেলবে বলে মোদির আশঙ্কা ছিল। কিন্তু এখন বাংলাদেশ ডলার সঙ্কটে বা আইএমএফের কাছে হাত পেতেছে- এ তথ্য ব্যবহার করে মোদি তার অভ্যন্তরীণ ভোট-কাটা বিরোধীদের সোজা বা শায়েস্তা করতে চান, এ কারণে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক সঙ্কট নিয়ে ভারত ব্যাপক প্রপাগান্ডা করে তুলে ধরছে।
দ্বিতীয় কারণটিও ভারত এর সাথে যুক্ত করেছে। সেটি হলো, বাংলাদেশের অর্থনৈতিক দুর্দশার কারণ হলো চীনা ঋণ- এই প্রপাগান্ডা দিয়ে সব কাজ সারতে চায় ভারত।
এদিকে আমাদের সরকার চাচ্ছে, সে আমেরিকান অবরোধের চাপে ডলার-অর্থনীতির সঙ্কটে পড়েছে, এখানে ভারত তাকে সহায়তা করুক। চাইছে গত ২০১৩-১৪ সালের মতো, বাংলাদেশের ওপর আমেরিকান চাপ ভারত সামলে দিক। কিন্তু কঠিন বাস্তবতাটা হলো ভারত আর আমেরিকা বা বাইডেনের সেই প্রিয়পাত্র নেই। আসলে আমেরিকা আর ভারত, এদের উভয়ের স্বার্থ উভয়ের বিরোধী হয়ে গেছে; কিন্তু তাই বলে এখনই সম্পর্কচ্যুতির ঘোষণা দিলে তা আরো তিকর হবে, তাই এটি রুটিন সম্পর্ক হয়ে আছে; যদিও মূল ফ্যাক্টর ভারত যতই রাশিয়ার সাথে অর্থনৈতিক সম্পর্ক বাড়াতে যাবে তত দ্রুত ভারত-আমেরিকা সম্পর্ক সব ভেঙে পড়বে। এ অবস্থায় ২০১৩-১৪ সালের সুখস্মৃতিতে ফিরে যাওয়া অসম্ভব। কিন্তু সব জেনেও এ বাস্তবতা মানতে সরকারের মন সাই দেয় না। বিশেষ করে তার ভয়, সে একেবারে একা হয়ে যাচ্ছে। তাই বারবার হাত বাড়ায় আর একটি করে ভারতের ঝাপ্টা খাচ্ছে।
বাংলাদেশের এ আকাক্সাকে ন্যূনতম কোনো বাস্তব রূপ দিতে ভারত অম বটে কিন্তু বাংলাদেশকে লুটে খাওয়া, অপব্যবহার করা এটি এখন ভারতের একটি কাজে দাঁড়িয়ে গেছে।


তাহলে অপর কাজটা কী?
চীন-আমেরিকার সম্পর্ক ২০১০ সালের পর থেকে তিতা হতে শুরু করেছিল। অন্যভাবে বললে, ওবামা যতই এটি টের পাচ্ছিলেন, ততই বেশি বাণিজ্যিক সুবিধায় ছাড় দিতে হবে ওবামার এ দাবিকে জায়গা করে দিয়ে চীন আমেরিকাকে ম্যানেজ করছিল। কিন্তু এটিও অকার্যকর হতে শুরু করে পরে ট্রাম্পের দ্বিতীয় বছর থেকে। তবু চীন যেটা মেইন্টেন করেছে, সে দ্বিপাকি ডায়লগের রাস্তা শক্ত মনোযোগে খোলা রেখে চলেছে। কিন্তু চলতি মাসের প্রথম সপ্তাহে তাইওয়ান উত্তেজনা সব ওলট-পালট করে দিয়েছে। তাতে চীন এখন বাইডেনের ওপর এত ক্ষুব্ধ যে, পাবলিক ভাষায় বললে, চীন আমেরিকার ফোন ধরছে না। সোভিয়েত ইউনিয়ন-আমেরিকাও, সেকালে কখনো দু’প এমন ফোনের নাগালের বাইরে থাকেনি। কারণ এমন বাইরে থাকা মানে তাতে সামরিক সঙ্ঘাত যেকোনো সময় টার্ন নিতে পারে, যখন দু’পরে হাতেই কঠিন মারণাস্ত্র মজুদ!
এদিকে এ পরিস্থিতিতে চীনের একটি হাই-টেক ট্র্যাকিং জাহাজ হাম্বানটোটা বন্দরের দিকে আগাচ্ছিল বন্দর থেকে রিফুয়েলিং ইত্যাদি রুটিন সুবিধা নেয়ার জন্য। কিন্তু ভারত ততই হয়তো আমেরিকার মনোযোগ আকর্ষণে এ নিয়ে তীব্র আপত্তি হইচই ভারতের অভ্যন্তরীণ মিডিয়ায় তুলেছিল; যদিও ভারতের শেষ ল্য এসবের কোনো কিছু নয়। শ্রীলঙ্কায় সঙ্কটে ভারত নিজের ুদ্র সমতার ব্যবহার করে (নগদ বৈদেশিক মুদ্রায় লোন নয়); তবে ভারতের ভেতরের বাজার থেকে যা যা রুপিতে কেনা যায় এমন প্রায় পাঁচ বিলিয়ন ডলার মূল্যের চাল-গম ধরনের খাদ্য আর তেল-গ্যাস জ্বালানি ইত্যাদি লোন হিসাবে শ্রীলঙ্কাকে পাঠিয়েছিল। এখন শ্রীলঙ্কায় আপাতত চীনের এন্ট্রি নেই, আমেরিকা একা মাতবরি করছে সেই খুশিতে ভারত এগিয়েছিল। কিন্তু রনিল নয়া রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হয়ে গেলে ভারতের ভাগে অন্তত সমতুল্য কর্তৃত্ব-প্রভাব কিছুই আসেনি। এটিই সে আশা করছে। এজন্য আমেরিকার চেয়েও উচ্চৈঃস্বরে চীনা জাহাজের এ সফরের বিরোধিতা ও আপত্তি দায়ের করেছিল শ্রীলঙ্কার কাছে। ফলাফলে গতকাল সকালেও ভারতের মিডিয়া ভারত কত শক্তিশালী আর চীন কত দুর্বিনীত তার ঢাক পিটাচ্ছিল যে, ভারত চীনকে ঠেকিয়ে দিয়েছে আর পারলে সে চীনা জাহাজ আর বন্দরের মাঝে গিয়ে দাঁড়িয়ে চীনকে ভাগিয়ে দেয়।
আসলে গত তিন দিন ধরে চীনবিরোধী ‘দেশপ্রেম’ আর মোদি সরকার দেশের কত স্বার্থসচেতন এরই মহিমা প্রদর্শিত হচ্ছিল এতদিন। এজন্য বাংলাদেশের মন্ত্রীকে ব্যবহার করে ‘চীন কত খারাপ’, তা তুলে ধরছিল।
কিন্তু হায়! ভারতের এক পত্রিকা ওয়াইর গত সন্ধ্যায় লিখেছে, শ্রীলঙ্কা সরকার চীন জাহাজকে বন্দরে ভিড়তে অনুমতি দিয়েছে। কারণ, চীন ও আমেরিকার এ বিরোধিতা কেন তারা করছে এর স্বপে যুক্তিগ্রাহ্য যথেষ্ট কারণ তারা দেখাতে পারেনি।


সাংবাদিক না দেশপ্রেমিক, কেবল একটি বেছে নিতে পারেন
সবশেষে একটি ‘হেদায়েত’; কী হতে চান, সাংবাদিক না দেশপ্রেমিক? তার মানে হলো যেকোনো একটি হতে হবে। দুটো এক সাথে হওয়া যাবে না। হ্যাঁ, ঠিক তাই। কিন্তু জাতিরাষ্ট্রবাদী দেশপ্রেমিকরা হিন্দুত্ববাদীদের মতো ব্যাপারটা বুঝতে নারাজ। আসুন, করি, তা নিয়ে আলাপ। সাংবাদিকতার প্রথম শর্ত হলো, ফ্যাক্টস। একেবারে আন-ডিস্টোর্টেড বা এদিক-সেদিক মানে করা নয় বা ইঙ্গিত করে বলিয়েছেন, ফেবার করেছেন ইত্যাদি, এমন করা যাবে না। ফ্যাক্টের ওপর দাঁড়িয়ে কাজ করতে হবে।
এখন এভাবে চললে এর অনেক কিছু আপনার দেশের স্বার্থের বিপে যেতে পারে। তাহলে আপনি কী চান? যদি সাংবাদিকতা চান তাহলে দেশপ্রেম তা হোক না-হোক তা পাশে রেখে সাংবাদিকতা বা সাংবাদিক স্বার্থকে উপরে তুলে ধরতে হবে। জার্নালিজমকে জায়গা দিতে হবে।
বাংলাদেশের এই মন্ত্রী-উপাখ্যান নিয়ে ভারতের শেখর গুপ্ত তার নির্মিত ভিডিও কিপে দেশপ্রেমিক সেজেছেন। অথচ তিনি ভারতের পাঁচজন সিনিয়র সাংবাদিকের নাম নিলে নিজে একজন হবেন। সাংবাদিকতার চিপায় ফেলে দেশপ্রেমিকের মিথ্যা প্রপাগান্ডায় নেমেছেন তিনি!
সবশেষের কথা হলো, বাংলাদেশের আইএমএফের কাছে চাওয়া ঋণ পেলেও আমাদের আরো ঋণ লাগবে যার সম্ভাব্য দাতা এক চীন ছাড়া সরকার কারো কথা ভাবতে পারছে না। এমনকি আইএমএফ দেরি করলেও এ ঋণ প্রয়োজনীয় বেশি। কিন্তু এ ঋণ অনুমোদনের ক্ষেত্রে সম্ভবত চীনের শর্ত হতে যাচ্ছে, যেসব চীনা প্রকল্প আগে ভারতের আপত্তিতে বাদ পড়েছে বা ঠেকিয়ে রাখা আছে- সেসব এবার আমাদের সরকারকে অনুমোদন দিতে হবে। ভারত সম্ভবত সেজন্য এমন আগ্রাসী। এর মানে, অর্থমন্ত্রী কী বুঝে এই সাক্ষাৎকার দিয়েছেন?
লেখক : রাজনৈতিক বিশ্লেষক
goutamdas1958@hotmail.com

 

 

 


আরো সংবাদ



premium cement
অধ্যাপক মাযহারুল ইসলামের বাসভবনে অধ্যাপক মুজিবুর রহমান ইউক্রেনের ২০টি ড্রোন, ২টি ক্ষেপণাস্ত্র নিষ্কিৃয় করল রাশিয়া তালেবানকে আফগান মাটি অন্যদের ব্যবহারের সুযোগ না দেয়ার আহ্বান যুক্তরাষ্ট্রের। গত দুই দিনের রেকর্ডের পর চুয়াডাঙ্গায় আজও বইছে তীব্র তাপদাহ বগুড়ায় শিশুকে গলা কেটে হত্যা, নানা আটক নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে প্রথম ম্যাচে পাকিস্তানের সম্ভাব্য একাদশ তালতলীতে ইউপি চেয়ারম্যানের নগ্ন ও আপত্তিকর ভিডিও ক্লিপ ভাইরাল ভারতের নির্দেশের পর পোস্ট ব্লক করল এক্স ‘দেশের কল্যাণে সুষ্ঠু গণতান্ত্রিক ধারার বিকল্প নেই’ রংপুরে বিএনপির প্রতিবাদ সমাবেশ ও মানববন্ধন সপ্তাহের শেষে তাপমাত্রা বাড়ার আভাস

সকল