১৯ মার্চ ২০২৪, ০৫ চৈত্র ১৪২৯, ০৮ রমজান ১৪৪৫
`

যত দোষ নন্দ ঘোষ

-

লোকালয়ে হাতির আক্রমণে বছরের পর বছর যুগের পর যুগ গ্রামবাসী হাতির উৎপাতের শিকার। তাদের ক্ষেতের ফসল হাতি খেয়ে যায়, নষ্ট করে, এমনকি মানুষকেও আক্রমণ করে থাকে, হাতির পায়ে মানুষ প্রাণও হারায়।
অন্য দিকে, হাতির ক্ষতির হাত থেকে ফসল রক্ষা, জীবন রক্ষার জন্য গ্রামবাসীর কত না আকুতি। যথাযথ কর্তৃপক্ষ যেন মাটির পুতুল। যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ তো দূরের কথা, কানেও তোলে না আকুতি। কারণ তারা এসব ক্ষেত্রে কিছু ব্যবস্থা নিতে অপারগ, কেননা তাদের কোনো না কোনো সূত্রের যে আঁতাত রয়েছে দুর্বৃত্তদের সাথে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে তারা ভয়েও মুখ খোলে না । মুখ খুললে খবর আছে। এ সব দুর্বৃত্ত তো একদিনে ভয়াবহ রূপ ধারণ করেনি; সুযোগ পেয়েছে, সমর্থন পেয়েছে অদৃশ্য শক্তিধারী প্রভাবশালীদের কাছ থেকে। এ সব দুর্বৃত্ত তো তেলে ঝোলে প্রভাবশালীদের দিন দিন হৃষ্টপুষ্ট করে যাচ্ছে। বিনিময়ে প্রভাবশালীরা দুর্বৃত্তদের আপন সন্তানের মতো লালন পালন করে যাচ্ছে।
গ্রামবাসী যে, শুধু বছরের পর বছর ফসলে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে তা নয়, তারা শত শত একর জমিতে ফসল বোনা থেকে বিরত থাকছে। ফসল বুনে লাভ কী? হাতি বিনষ্ট করে দেয়। গ্রামবাসী বা কোনো কৃষক হাতির আবাস বিনষ্ট করেছে বলে আমার জানা নেই। তারা হয়তো রান্নার জন্য কিছু জ্বালানির জোগাড়ে বন-জঙ্গলের আশপাশে গিয়ে থাকে, কখনো কখনো ভেতরেও যায়। যদি হাতির আবাস তারা বিনষ্ট করেই থাকে তা দেখার দায়িত্ব কার? তারা কি তাদের দায়িত্ব পালন করেছে? যদি তারা তাদের দায়িত্ব পালন করতে ব্যর্থ হয়ে থাকে তাহলে তাদের জন্য শাস্তি নেই কেন? ‘চোরে চোরে মাসতুতো ভাই’। গ্রামবাসীকে কি প্রশিক্ষণের মাধ্যমে বোঝানো হয়েছে যে, যেসব ফসল হাতি খায় না, অথচ মানুষের জন্য অতীব প্রয়োজন, সে সব ফসল একরের পর একর জমি হাতির বিনষ্টির ভয়ে ফেলে না রেখে সেখানে ফলানো যেতে পারে যাতে তারা ক্ষতি পুষিয়ে নিতে পারে। ইলেকট্রিক তারের ব্যবহারের বিষয়েও তাদের সম্যক শিক্ষা দেয়াও কি প্রয়োজন ছিল না? তাহলে কি মারাত্মক ঘটনাগুলো ঘটতে পারত? বর্তমানে কৃষকের জন্য ক্ষতিপূরণের আশ^াস প্রচার করা হয়েছে। কোনো ক্ষতিই পূরণ হয়নি, জীবনের ক্ষতি তো নয়ই।
প্রতিটি পূর্ণবয়স্ক হাতির প্রতিদিন খাদ্যের প্রয়োজন প্রায় ১০০ কেজি। একটি স্বাস্থ্যবান বনের পক্ষেই সম্ভব তার জোগান দেয়া। ওই সব বনে-জঙ্গলে প্রচুর বাঁশ ও অন্যান্য গাছপালার আধিক্য থাকে প্রাকৃতিকভাবেই। প্রাকৃতিক উপায়েই থাকে কলাগাছের প্রাচুর্য, যে সব কলাগাছে ছোট ছোট এক প্রকার বুনো কলার প্রাচুর্য ছিল এবং এ কলাগাছের কোনো অন্ত ছিল না হাতির আবাসে। হাতি কলা খায়, কলাগাছও খায়, তারপরও এ সব কলাগাছের অভাব কখনো দেখিনি পাহাড়ি এলাকায়। পার্বত্য চট্টগ্রামের বনে বাঁশের ঝাড়ের প্রাচুর্য। আমাদের দেশে ২৮ প্রজাতির বাঁশের মধ্যে বেশ এক বড় সংখ্যক বাঁশের প্রজাতির অস্তিত্ব রয়েছে এ সব এলাকায়। ঘন বাঁশঝাড়ের প্রাচুর্য এখন কোথায়? এ জন্য জবাবদিহিতা কার? হাতির আবাস ধ্বংস করল কারা? বন-জঙ্গল কেটে নিঃশেষ করে প্রভাবশালীদের ছত্রছায়ায় উপার্জন করেছে কারা প্রচুর টাকা? এ সব টাকার ভাগ কি গ্রামবাসী পায়?
অন্য দিকে, চোরাকারবারিদের হাতে হাতির নেই নিস্তার। হাতির দাঁতের মূল্য বিচারে স্বর্ণতুল্য, কখনো কখনো তার চেয়েও বেশি। হাতির দাঁত দিয়ে তৈরি হচ্ছে গহনা, বিলাসের সরঞ্জাম, শোপিস ও অন্যান্য কত কী! হাতির দাঁতের এসব জিনিসের শিল্পে চীন অগ্রগামী। তাদের ব্যবসার জন্য সুদূর ১০০ বছরের কথা চিন্তা করে তারা হাতির দাঁত ক্রয় করছে, গুদামজাতও করছে। এসবের কোনো কিছুর সাথেই গ্রামবাসী কোনোভাবেই জড়িত থাকে বলে আমার জানা নেই।


হাতির আবাস সংরক্ষণের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্তৃপক্ষ প্রভাবশালীদের, চোরাকারবারিদের ও ভাগীদারদের কারো বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করছে না বা করতে পারছে না। অথচ গ্রামবাসীর বিরুদ্ধে মামলা দায়ের চলছে। নিরপরাধ গ্রামবাসী তথা কৃষকরা ফসলের ক্ষতি, জীবনের ক্ষতি মাথায় করে আছে। আবার মামলাও মাথায় নিতে হচ্ছে। বাড়ির যা কিছু হারায় গিন্নি বলেন ‘ওই কেষ্ট বেটাই চোর’। যথাযথ চোরের ওপর কর্তৃত্ব খাটান- এটিই আশা করছি, কেষ্টর ওপরে নয়। ‘যত দোষ নন্দ ঘোষ’; তাই নয় কি?
আরেকটি উদাহরণ হলো- এদের আবাসে যেখানে সুপেয় পানির অভাব সেখানে এরা তাদের শুঁড় দিয়ে খোঁড়ল করে গভীর জলাশয় তৈরি করে ফেলে। গাছের ছাল চিবিয়ে চিবিয়ে এই জলাশয়ে ফেলে ও কিছু বালু ছিটিয়ে দিয়ে রাখে যাতে পানি সহজেই বাষ্প হয়ে উড়ে না যায়। এহেন জ্ঞানী প্রাণীর অবলুপ্তি মানে তো প্রকৃত জ্ঞানীর অবলুপ্তি, যার ঘাটতি আমাদের মানব সমাজে প্রকট।
ছোট একটি দেশ বাংলাদেশ। এখানে রক্ষকই ভক্ষক। তারপরও এ দেশে এখনো হাতির অস্তিত্ব টিকে আছে। এটিই কি যথেষ্ট নয়? এক সময় বাংলাদেশের সর্বত্রই হাতি বিরাজমান ছিল। এই যে ঢাকা শহরে হাতিরঝিল, হাতিরপুল, এলিফ্যান্ট রোড- এ সবই এক সময়ের হাতির অস্তিত্বের কথা জানান দেয় আজো। রক্ষকদের আগ্রাসন তথা চোরাকারবারিদের সাথে জড়িত থাকা ও যথাযথ কর্তব্য পালন না করার জন্যই হাতির অস্তিত্ব বিলীন প্রায় এবং যত দুর্ঘটনা! হাতির অস্তিত্ব বিলীন হতে হতে হাতি শেষ পর্যন্ত পাহাড়ি এলাকায় দুর্গমন; নিজের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার চেষ্টায় ব্যাপৃত থেকেও রেহাই পাচ্ছে না। চুনতি অভয়ারণ্যে এক সময় আমার কিছু কাজ করার সুযোগ হয়েছিল। বর্তমানে ওখানকার অবস্থা সম্পর্কে জানা যায়- চারটি পালে মোট ১৮টি হাতি রয়েছে। প্রজনন হার খুবই কম। এই চুনতি ফরেস্টে প্রচুর কলাগাছ ছিল, ছোট্ট ছোট্ট কলা, মানুষ এগুলো খেত না। এগুলোকে আমরা বলতাম, হাতির কলা। এখন সে কলাগাছের একটিও নেই বলে জানা যায়। রক্ষা করা হয়নি। নতুন করে লাগানোও হয়নি। চুনতি অভয়ারণ্যে হাতির ওপরে এমফিল পর্যায়ের ছাত্র তাপস কুমার চক্রবর্তীকে নিয়ে কাজ করেছিলাম ১৯৯৭ থেকে ২০০১ সাল নাগাদ। সর্বমোট হাতি রেকর্ড করা হয় প্রায় ৩০টি যার প্রায় ১৫ শতাংশ শিশু-কিশোর। পুরুষ-স্ত্রীর অনুপাত ছিল ৪ : ৫। ওই অভয়ারণ্যের প্রায় ২০ শতাংশ হাতির আবাস হিসেবে ব্যবহৃত হতো। হাতির আবাসের ৫০ শতাংশেরও বেশি বড়, মাঝারি ও ছোট গাছে আবৃত ছিল। প্রায় ৫০ প্রজাতির গাছের পাতা ও ডালপালা হাতি খাদ্য হিসেবে গ্রহণ করত। তখন দেখা গেছে, বছরে ১ শতাংশ হাতির আবাস বিনষ্ট হতো দুর্বৃত্তদের হাতে। গাছপালা ও প্রচুর বাঁশের ঝাড় ছিল। হাতির আবাসের গাছ ও বাঁশ উজাড় হতো উল্লেখযোগ্য পরিমাণে। মানুষ ও হাতির মধ্যে কোন্দলের প্রধান কারণ হিসেবে রেকর্ড করা হয় কৃষকের ফসল বিনষ্টকরণ- যার পরিমাণ রেকর্ড করা গেছে মোট ফসলের প্রায় ১.৫ শতাংশ। তবে হাতি মানুষ মেরে ফেলেছে কিংবা মানুষ হাতি মেরে ফেলেছে- এমন কিছু রেকর্ড করা যায় নি। তবে ওই অভয়ারণ্যের বাইরে অন্যান্য বনে এ সব ঘটনা ঘটেছে বলে জানা গেছে। ৫০ শতাংশেরও বেশি জনগণ প্রত্যাশা করে- হাতির সুস্থ সংরক্ষণ। ৩৫ শতাংশ মানুষ সংরক্ষণের পক্ষে-বিপক্ষে কথা বলেনি। ১৫ শতাংশ মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখায়।


কক্সবাজার এলাকার হাতি তো রোহিঙ্গাদের কারণে প্রায় শেষ। কোনো প্রাণীর আবাস শেষ তো প্রাণী শেষ।
বর্তমানে ডুলাহাজরা সাফারি পার্কের পাশে এক পাল হাতি আছে বলে জানা যায়। ময়মনসিংহ, শেরপুর, জামালপুর, নেত্রকোনা এলাকায় কিছু হাতি ভারতের বর্ডার পার হয়ে আসে এবং আটকা পড়ে যায়। অন্য যেসব এলাকায় হাতি রয়েছে তাদের সংখ্যাসহ সব মিলিয়ে বাংলাদেশ এখন আসলে মোট কতগুলো হাতির অস্তিত্ব বিরাজমান তা খুব সুস্পষ্ট নয়। মুটামোটি ১২০-১৫০টি হাতি আছে বলে জানা যায়। তবে তাদের কোথায় কয়টা, প্রতি পালে কয়টা রয়েছে তার তেমন কোনো রেকর্ড নেই। নেই সঠিক পুরুষ-স্ত্রীর অনুপাত কিংবা প্রাপ্তবয়স্ক ও শিশু-কিশোর অনুপাত যা জানা থাকা দরকার অবশ্য সংরক্ষণের জন্য।
আসলে আমাদের দেশে বন্যপ্রাণী ও তার পরিবেশ সংরক্ষণের ভার আমরা পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের বন অধিদফতরের কাছে দিয়ে রেখেছি। তাদের নিজেদের লোকবল ও অন্যান্য সুযোগ-সুবিধায় প্রচণ্ড টানাপড়েন। অথচ এ দেশে বন্যপ্রাণী বিশেষজ্ঞের অভাব নেই। সেই ১৯৬৯ সাল থেকে প্রতি বছর এক বিশেষ সংখ্যক বিশেষজ্ঞ বেরুচ্ছে এ দেশের বিশ^বিদ্যালয়গুলো থেকে- যারা যথাযথ কাজে না লাগতে পারায় ব্যাংক ও অন্যান্য সংস্থাগুলোতে কাজ করতে বাধ্য হচ্ছে। এটি কি জাতীয় অপচয় নয়? কেন যথাযথ মন্ত্রণালয়ে ‘বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ ও ব্যবস্থাপনা অধিদফতর’ সৃষ্টি হচ্ছে না? জেনে আসছি, জন্ম থেকে নিজের পায়ে কুড়াল মেরে অন্যের যাত্রা ভঙ্গ করে দুষ্ট ও নির্বোধরা। এ ক্ষেত্রে নিজের পায়ে কুড়াল মেরে নিজের অর্থাৎ জাতির যাত্রা ভঙ্গ নয় কি?
একটি হাতির প্রতিদিনে খাবার প্রায় ১০০ কেজি, পানি প্রায় ১০০ লিটার- এর সংস্থান কতটা রয়েছে এ বিষয়ে কী করণীয়, তা কি দায়িত্বপ্রাপ্তরা দেখতে পারছেন? একটি হাতির home range কত বর্গকিলোমিটার? হাতির আবাস এতটাই বিস্তৃত যে, বনের একপ্রান্ত থেকে আরেক প্রান্ত পর্যন্ত চলাচলের সুবিধা প্রয়োজন এবং এ জন্য এরা রাস্তা খুঁজে বের করে যাকে বলে করিডোর। সে আর এক যন্ত্রণা মানে- সেখানে মানুষের আনাগোনা অর্থাৎ elephant human conflict যার নিয়ন্ত্রণের জন্য যথাযথ ব্যবস্থাপনা প্রয়োজন। তার প্রতিও কি যথাযথ নজর রয়েছে?
হাতির দাঁত, চামড়া, হাড় প্রভৃতির চোরাকারবারি ঠেকানোর জন্য জানা প্রয়োজন এগুলো কেন হচ্ছে, কিভাবে হচ্ছে, কোন দেশগুলো অর্থাৎ ব্যবসায়ীদের সাথে কারা জড়িত। বন বিভাগ কতটা কী করবে? তারও তো দায়িত্ব রয়েছে। দেশের বনাঞ্চল ধ্বংস হতে হতে এখন সুন্দরবন ফোকলা, দেশের উত্তরাঞ্চল মরুভূমি, এখন তো সর্বত্রই মরুয়ায়ন চলছে। বন বিভাগ কী করবে, শ্যাম রক্ষা করবে না কুল? সুতরাং যার দায় তারই বহন করতে হবে। যথাযথ বিশেষজ্ঞদের হাতে দায়িত্ব দিতে হবে। আজ হোক কাল হোক এ পথে আসতেই হবে। উল্লেখ্য, মন্ত্রণালয়ের অধীনে যেমন ‘বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ ও ব্যবস্থাপনা অধিদফতর’ সৃষ্টি হতে হবে, তেমনি যথাযথ বিশেষজ্ঞদের হাতে এ দায়িত্ব তুলে দিতে হবে। অনেক ক্ষতি হয়ে গেছে। আর নয়। সারা পৃথিবীতে এশিয়ান হাতির অস্তিত্বে ১৩টি দেশের একটি বাংলাদেশ। এখান থেকে বাংলাদেশের নাম মুছে যেতে আর বেশি দেরি নেই। সুতরাং সময় এখনই যথাযথ পদক্ষেপ নেয়ার।


হাতিদের বলা হয় বাস্তুতন্ত্র প্রকৌশলী, বনের স্থপতি। হাতি আছে তো বন তথা পরিবেশ সুস্থ স্বাভাবিক আছে। ঘাস জাতীয় উদ্ভিদ ও বড় গাছের ডালপালা খেয়ে এরা বীজ ছড়ায়। বনের সুস্থতা বাড়ায়। একটি হাতির বিচরণের জন্য প্রায় এক হাজার বর্গকিলোমিটার পরিসরের প্রয়োজন। অতএব আমরা যতই অভয়ারণ্য প্রচারণার মাধ্যমে হাতি রক্ষা ব্যবস্থা করি না কেন, হাতি সংরক্ষিত হবে না। বনটা পুরোই সংরক্ষণ করতে হবে এবং দিনে দিনে বৈজ্ঞানিক উপায়ে বন বিশেষজ্ঞ ও বন্যপ্রাণী বিশেষজ্ঞদের যথাযথ দায়িত্ব পালনের সমন্বয় ঘটিয়ে বনের স্বাস্থ্য হাতির সুরক্ষার উপায় খুঁজে বের করতে হবে। হাতি রক্ষায় দ্রুত পদক্ষেপ নেয়া অবশ্যই বাঞ্ছনীয়। কেননা, একটি নির্দিষ্ট সংখ্যকের নিচে এদের সংখ্যা নেমে গেলে এবং পুরুষ-স্ত্রী অনুপাত ঠিক না থাকলে, এমনকি প্রাপ্তবয়স্ক ও শিশুর অনুপাত ঠিক না থাকলে তাদের প্রজনন হার অবশ্য নিচে নেমে যাবে, সেখান থেকে আর রক্ষা করার পর্যায়ে আনা যাবে না। শুধু তাই-ই নয়, মনে রাখতে হবে- হাতি একবারে একটি বাচ্চা দেয়, প্রতি চার-পাঁচ বছরে বাচ্চা দেয়। আরো উল্লেখ্য, একটি স্ত্রী হাতি তার জীবনে মাত্র তিন-চারটি বাচ্চা প্রসব করে থাকে এবং প্রকৃতিতে তার বেঁচে থাকার হার খুবই নগণ্য। উপরন্তু, হাতি হত্যা তো চলছেই।
মজার ব্যাপার হলো- একটি শিশুহাতিকে তার মা ও খালারা অর্থাৎ অন্যান্য স্ত্রী হাতি মিলে পালের মাঝখানে রেখে যাতায়াত করে। এদের নেতৃত্ব দেয় সবচেয়ে বয়স্ক স্ত্রী হাতি। এহেন নারী নেতৃত্ব প্রকৃতিতে বিরল, মানবসমাজে তো বটেই। নারী স্বাধীনতা ও মর্যাদার প্রতীক হাতি। হাতির অস্তিত্ব নানা কারণেই জিইয়ে রাখা অত্যন্ত জরুরি। এদের বলা হয় Flagship species. অর্থাৎ- এদের অস্তিত্ব বলে দেয় বনের স্বাস্থ্য কেমন।
উল্লেখ করার বিষয় হলো- হাতি অত্যন্ত বুদ্ধিমান প্রাণী। এরা মানুষের পরই যে কয়টি প্রাণী বুদ্ধিমত্তার দিক থেকে উন্নত তাদের সমতুল্য, যেমন- শিম্পাঞ্জি, ডলফিন প্রভৃতি। হাতিকে এমনো দেখা গেছে, ইলেকট্রিক তার দিয়ে ফসল রক্ষার ব্যবস্থা পর্যালোচনা করার ক্ষমতা ধারণ করে থাকে। যেমন হাতি তার শুঁড় দিয়ে বড় বড় পাথরের টুকরা ইলেকট্রিক তারের উপর ছুঁড়ে ছুঁড়ে ইলেকট্রিসিটি বিচ্ছিন্ন করে নির্বিঘ্নে ক্ষেতের ফসল খায়। তবে এটি তারা তখনই করে থাকে যখন তাদের আবাসের সুস্থতায় বিঘ্ন ঘটে এবং খাদ্যের প্রচণ্ড অভাব দেখা দেয়। স্বাভাবিক জীবন যাপনে বিঘ্ন না ঘটলে হাতি কখনোই লোকালয়ে আসে না এবং এসব ঝুঁকি নেয় না, মানুষকে ভয় পায়।
সুতরাং এমন একটি প্রাণীকে কোনো দেশ থেকে বিলুপ্তির মুখে ঠেলে দিলে সে দেশের নানান দিক থেকে যে ক্ষতি হবে তা আর পুনরুদ্ধার করা সম্ভব নয়। অতএব হাতি রক্ষার জন্য যেমন আইনের যথাযথ প্রয়োগ প্রয়োজন, তেমনি বন্যপ্রাণিবিদ ও বন বিশেষজ্ঞের সমন্বয়ে ব্যবস্থাপনা প্রয়োজন; যদিও বর্তমানে প্রায় ৫০ জন বন্যপ্রাণীবিদ তথা কিছু বন্যপ্রাণীবিদ বন বিভাগের অধীনে বন্যপ্রাণী সংরক্ষণে যথাসাধ্য চেষ্টা করে যাচ্ছেন, তবে অবশ্যই তা যথেষ্ট নয়। প্রয়োজন গবেষণাভিত্তিক, বন্যপ্রাণীর আবাস উন্নয়নের মহাপ্রকল্প। অতএব, প্রয়োজন বন বিভাগের মতোই আরেকটি বিভাগ ‘বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ ও ব্যবস্থাপনা’ বিভাগ এবং তা যত দ্রুত সম্ভব।
লেখক : বন্যপ্রাণী ও পরিবেশ বিশেষজ্ঞ, প্রফেসর ও সাবেক চেয়ারম্যান
প্রাণিবিদ্যা বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

 


আরো সংবাদ



premium cement