১৯ মার্চ ২০২৪, ০৫ চৈত্র ১৪২৯, ০৮ রমজান ১৪৪৫
`

জনগণের নাভিশ্বাস

দেশ জাতি রাষ্ট্র
-

সাম্প্রতিক কালের অর্থনৈতিক অরাজকতা, রাজনৈতিক সঙ্কট, দ্রব্যমূল্যের বেহাল গতি ও অবশেষে জ্বালানির অসম্ভব মূল্যবৃদ্ধিতে জনগণের নাভিশ^াস শুরু হয়েছে। গত শুক্রবার ‘মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা’য়ের মতো এই অযৌক্তিক এবং অসহনীয় মূল্যবৃদ্ধি জনগণের ক্ষোভ ও অসন্তোষকে কয়েকগুণ বাড়িয়ে দিয়েছে। এমনিতেই ক্ষমতাসীন সরকারের জনপ্রিয়তা বিগত বছরে ক্রমহ্রাসমান উপযোগবিধির মতো কেবলই নিম্নগামী হয়েছে। রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের ধারণা- তা এখন হিমাঙ্কে পৌঁছেছে। স্বাধীনতার পর তারা অসম্ভব জনপ্রিয়তা নিয়ে ক্ষমতাসীন হয়। দু-এক বছরের মধ্যে তাদের লোভ-লালসা ও দুর্নীতিতে জনগণ এতটাই প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে যে, বাকশাল দিয়ে অবশেষে তাদের শাসন করতে হয়।
ইতিহাসের শিক্ষা হলো এই- কেউ ইতিহাস থেকে শিক্ষা নেয় না। ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি তাই একই ধারায় বারবার ঘটে। আওয়ামী লীগের শাসনের পুরনো ধারার আরেকটি কার্বন কপি সময়কাল এখন। ১৯৯৬ সালে ২১ বছর পর ক্ষমতাসীন হলে তারা প্রাথমিক সতর্কতা অবলম্বন করার কিছুটা চেষ্টা করলেও শিগগিরই তাদের থলের বিড়াল বেরিয়ে পড়ে। এবারে ২০০৯ সাল থেকে তারা এমনসব ছলা-বলা-কলাকৌশল অবলম্বন করে, জনগণকে সম্মতির পরিবর্তে শক্তি প্রয়োগ করে শাসন করে আসছে। এমনকি এখন তারা জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধির মিছিলেও গুলি করছে। তেলের এই মূল্যবৃদ্ধি মানুষের মনে আগুন ধরিয়ে দিয়েছে। সে ধূমায়িত আগুনের ফুলকি যেকোনো সময়ে সব কিছু জ্বালিয়ে পুড়িয়ে ছারখার করে দিতে পারে।
বর্তমান অর্থনৈতিক সঙ্কটের শুরুতে সরকার জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধির ইঙ্গিত দিয়েছিল। তারা বলেছিল, সে বৃদ্ধির মাত্রা হবে যৌক্তিক ও সহনীয়। অর্থনৈতিক সঙ্কটে সরকারের বিভিন্ন সহায়তা ও বিধিব্যবস্থা নিয়ে আশান্বিত ছিল মানুষ, তখন এই আকস্মিক মূল্যবৃদ্ধি তাদের হকচকিত করেছে। গণমাধ্যম বলছে এই মূল্যবৃদ্ধি বাংলাদেশের ইতিহাসে রেকর্ড সৃষ্টি করেছে। মূল্যবৃদ্ধির হারের দিক থেকে তা যেমন রেকর্ড, ঠিক তেমনি দুঃশাসনের ক্ষেত্রেও একটি উদাহরণ। আগে ডিজেলের দাম ছিল লিটারে ৬৪ টাকা। মাঝপথে তা বৃদ্ধি হয়ে ৮০ টাকায় দাঁড়িয়েছিল। এখন তা ১১৪ টাকা। কেরোসিন এই কিছু দিন আগেও ছিল ৮০ টাকা, এখন তা ১১৪ টাকা। পেট্রলের দামের ব্যাপারে উল্লম্ফন ঘটেছে। আগে লিটার প্রতি এর দাম ছিল ৮৬ টাকা, সদ্য ঘোষিত দাম ১৩০ টাকা। অকটেনের ক্ষেত্রেও একই অবস্থা, আগে দাম ছিল ৮৯ টাকা, এখন তা ১৩৫ টাকা। ডিজেল ও কেরোসিনের ক্ষেত্রে লিটার প্রতি দাম বেড়েছে ৩৪ টাকা। পেট্রলে বেড়েছে ৪৪ টাকা। অকটেনে ৪৬ টাকা।

দাম বৃদ্ধির পর দেশের সর্বত্র অসন্তোষের প্রকাশ ঘটে। মূল্যবৃদ্ধির আগে সরকার কোনো চিন্তাভাবনা ও জনগণের শক্তি-সামর্থ্য বিবেচনা করেনি। রাতের আঁধারে তারা ডাকাতের মতো দাম বাড়িয়েছে। সংশ্লিøষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, দাম বৃদ্ধির ফলে সরকারের ভর্তুকির পরিমাণ ব্যাপকভাবে হ্রাস পাবে। উল্লেøখ্য, উপচেপড়া অর্থনীতির দাবিদার বর্তমান সরকার আইএমএফের কাছ থেকে ৪৫০ মার্কিন ডলার ঋণ নেয়ার চেষ্টা করছে। আইএমএফের ঋণের শর্তের মধ্যে একটি হলো- জ্বালানি খাতে ভর্তুকি প্রত্যাহার। অর্থনৈতিক দুরবস্থা কাটানোর জন্য সরকার আইএমএফের এই শর্ত অসম্ভব মূল্যবৃদ্ধির মাধ্যমে তামিল করছে। যদিও আইএমএফ ঠিক এ বিপুল মূল্যবৃদ্ধির প্রস্তাব করেছে কি না তা নিশ্চিত বলা যাচ্ছে না। এর যৌক্তিকতা ব্যাখ্যা করতে গিয়ে সরকার বলেছে, বর্তমান বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের দাম বাংলাদেশের তুলনায় অনেক বেশি। ‘জনবান্ধব আওয়ামী লীগ সরকার সবসময় আমজনতার স্বস্তি ও স্বাচ্ছন্দ্য বিবেচনা করে সিদ্ধান্ত নেয়’। জ্বালানি প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদের এ মন্তব্যের পর বাস্তবে হয়েছে তার উল্টোটি। জনগণের জন্য নসরুল হামিদরা অস্বস্তি ও অসহায়ত্ব আমদানি করেছেন মাত্র। মূল্যবৃদ্ধির আরো যৌক্তিকতা দেখিয়ে বলা হয়, ভারতের কলকাতায় ডিজেলের দাম লিটার-প্রতি বাংলাদেশী মুদ্রায় ১১৪ টাকা। পেট্রলের দাম ১৩০। দেশে দাম কম থাকায় পাচার হওয়ার আশঙ্কা থেকেও জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানো নাকি সময়ের দাবি- সরকারের ভাষ্য এরকম।
জ্বালানি মন্ত্রণালয়ের ভাষ্যে আরো বলা হয়, বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশন-বিপিসি গত ছয় মাসে তেল বিক্রি করে আট হাজার ১৪ কোটি ৫১ লাখ টাকা লোকসান দিয়েছে। বিস্ময়ের ব্যাপার- সরকার যখন এই অসম্ভব মূল্যবৃদ্ধির সিদ্ধান্ত নিয়েছে, ঠিক তখন বিশ^বাজারে জ্বালানি তেলের দাম কমতির দিকে। এ বিষয়ে জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ম. তামিম এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, ডিজেলের দাম বিশ্ববাজারে ১৭০ ডলার থেকে ১৩০ ডলারে নেমেছে। অপরিশোধিত জ্বালানি তেলের দাম ১০০ ডলারের সহনীয় পর্যায়ে রয়েছে। এই দাম এ বছর ৭০ থেকে ৮০ ডলারে নামতে পারে বলে পূর্বাভাস রয়েছে। এমন সময় হুট করেই এত বেশি দাম বাড়ানোর চাপ চলমান ভঙ্গুর অর্থনীতি ধারণ করতে পারবে কি না তা নিয়ে সন্দেহ রয়েছে। তামিম আরো বলেন, ভারতের সাথে দামের পার্থক্য সবসময় ছিল। এখন পাচারের প্রশ্ন তোলা কোনোভাবেই যৌক্তিক নয়। তার ভাষায়- যতটা দাম বাড়ানো হয়েছে, তা জনগণের দুর্দশা বাড়াবে।


স্বাভাবিকভাবেই বোঝা যায়, এই মূল্যবৃদ্ধির পরিপ্রেক্ষিতে ডিজেল ও কেরোসিনের দাম বৃদ্ধির অজুহাতে পরিবহন ব্যয় বৃদ্ধি পাবে। যাত্রী ভাড়া আগের মতোই লাগাম ছাড়াই চলবে। স্মরণ করা যেতে পারে, সরকার এর আগে গত নভেম্বরে ডিজেল ও কেরোসিনের দাম এক লাফে ১৫ টাকা বাড়িয়েছিল। তখন দাম নির্ধারণ করা হয়েছিল ৮০ টাকা লিটারে। ডিজেলে দাম বাড়ানোর পর বাস, ট্রেন ও লঞ্চে ভাড়া বাড়ানো হয় ২৭ শতাংশ। তেলের দাম বৃদ্ধির হারের ক্ষেত্রে এই পরিবহন ব্যয় বৃদ্ধি তখনই ছিল অযৌক্তিক। এখন এটি সমস্ত বিবেককে দারুণভাবে আহত করেছে। প্রতিটি পরিবহনের ক্ষেত্রে অরাজকতা লক্ষ করা যায়। পরিবহন ভাড়া বৃদ্ধি নিয়ে যাত্রী সাধারণের মধ্যে ঝগড়াঝাঁটি এখন নিত্যদিনের ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। কোনো ক্ষেত্রেই মালিকপক্ষের লোভের রশি টেনে ধরতে পারছে না বিপিসি। সব মিলিয়ে বছরে বিপিসির বিক্রি করা মোট জ্বালানি তেলের ৬৫ শতাংশ ব্যবহার করে পরিবহন খাত। ১৬ শতাংশ ব্যবহার কৃষি খাতে। শিল্প খাত ৭ শতাংশ ও বিদ্যুৎ খাত ১০ শতাংশ তেল ব্যবহার করে। এসব খাতে এখন কী পরিমাণ ব্যয় বৃদ্ধি পাবে, তা সহজেই অনুমেয়।
জ্বালানির দাম বৃদ্ধি পেলে পরিবহন মালিকরা অমানবিকভাবে ভাড়া বৃদ্ধি করেন। আলটিমেটলি এই ভাড়া বৃদ্ধির ফলে সাধারণ মানুষ সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। সরকার আর মালিকপক্ষ ক্ষতিগ্রস্ত হয় না। সব কিছু প্রকারান্তরে জনগণের ঘাড়ে গিয়ে বর্তায়। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, জনগণের জন্য ন্যূনতম দায়বোধ থাকলে সরকার জ্বালানি তেলের দাম এমনভাবে বাড়াত না। সরকারের শক্তিমদমত্ততা ও জনমতকে বেপরোয়াভাবে লঙ্ঘন করার ফলেই জনগণের নাভিশ^াস ঘটেছে। এখন আরো বাজারে গুজব আছে, বিদ্যুতেরও দাম বৃদ্ধি করবে। বাজারের নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের মূল্যবৃদ্ধি অস্বাভাবিক ও অসহনীয়। এরপরও যদি বিদ্যুতের আরেক দফা মূল্যবৃদ্ধি ঘটে- তা জনগণকে বিক্ষুব্ধ করবে। এদিকে ডলারের দাম হু হু করে বাড়ছে। সর্বশেষ খবর অনুযায়ী, প্রতি ডলারের বিপরীতে বাংলাদেশের মুদ্রার মান ১১৫ টাকায় দাঁড়িয়েছে। ভোক্তা অধিকার সংগঠন-ক্যাব বলেছে, আইএমএফের ঋণ পাওয়ার শর্ত ছিল ঘাটতি সমন্বয়। দাম বাড়িয়ে ঘাটতি সমন্বয় করতে গিয়ে জনগণের ওপর যে আঘাত হানা হয়েছে তা সিডর ও আইলার মতো ঘূর্ণিঝড়কে হার মানায়। ওদিকে পরিবহন সচিবের মন্তব্য- এ ভাড়া নাকি যৌক্তিক ও সহনীয়। অবশ্য এর আগে ক্ষমতাসীন এক মন্ত্রী বলেছিলেন, জনগণের হাতে টাকা আছে। হ্যাঁ, টাকা আছে যাদের হাতে তারা ক্ষমতাসীন দলের লোক। সংশ্লিষ্ট মন্ত্রী দাবি করেছেন, দাম না বাড়ালে আমদানি করার টাকা পকেটে থাকবে না। এতদিন ধরে ধার করে ঘি খাওয়ার ঐতিহ্য সৃষ্টিকারী সরকার এখন কৃচ্ছ্্রতার কথা বলছে। এ কথা শুনলে ‘ভূতের মুখে রাম নাম’ শোনার মতোই আজগুবি শোনায়।


এদিকে এক গভীর বিশ্লেষণে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, জ্বালানি তেলের দাম বিপিসি বা আইএমএফের পরামর্শে বাড়েনি। বিশ^ব্যাংকের সাবেক বাংলাদেশ প্রধান ইকোনমিস্ট ড. জায়িদ হোসেন বলেছেন, আইএমএফের সাথে এখনো আলোচনা শুরু হয়নি। যদি আইএমএফের কারণে হতো তাহলে সরকারের পক্ষ থেকে মূল্যবৃদ্ধির বিষয়টি দরকষাকষির অংশ হিসেবে রেখে দেয়ার কথা। আগেই দাম বাড়িয়ে ফেলার কথা নয়। আর বিপিসির আর্থিক প্রতিবেদনে দেখা যায়, প্রতিষ্ঠানটি দীর্ঘ দিন ধরে লাভজনক অবস্থায় রয়েছে। তাদের প্রদত্ত পরিসংখ্যান অনুযায়ী- প্রতিষ্ঠানটি ২০২১-২২ অর্থবছরের ২৩ মে পর্যন্ত এক হাজার ২৬৩ কোটি ৭৮ লাখ টাকা নিট মুনাফা করেছে। প্রতিবেদনে প্রকাশ পেয়েছে, দেশের সবচেয়ে ধনী ব্যাংক গ্রাহক প্রতিষ্ঠান হচ্ছে বিপিসি।
এই অর্থনৈতিক অবয়বে জনগণের নাভিশ্বাস উঠেছে তা কাউকে বলে বোঝানোর দরকার নেই। সরকার যে কায়দায় নিপীড়নের মাধ্যমে রাজনীতির মোকাবেলা করছে, তদ্রুপ জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধির প্রতিবাদে আহূত বিক্ষোভ সমাবেশে পুলিশ লাঠিপেটা করছে। রাজনৈতিক দলগুলো যে কর্মসূচি ঘোষণা করছে, তার সব কিছুতে সরকার বাধা দিচ্ছে। দেশের বিশিষ্ট ব্যক্তিরা জ্বালানি তেলের এভাবে মূল্যবৃদ্ধির সিদ্ধান্ত জনজীবনে চরম বিপর্যয় ডেকে আনবে বলে মনে করছেন। বৈশি^ক মহামারীর কারণে এমনিতেই দেশে উৎপাদন বন্ধ, বেকারত্ব চরম আকার ধারণ করেছে। ইউক্রেন-রাশিয়ার যুদ্ধ পরিস্থিতিতে বিশ্বব্যাপী জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধি, খাদ্য সঙ্কটসহ নানা জটিল পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। আমাদের দেশেও অর্থনৈতিক মন্দার প্রভাবে মানুষ নানা সঙ্কটে নিপীড়িত। এই সঙ্কটময় অবস্থায় জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধি অযৌক্তিক। রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক মহল মনে করে, এই মূল্যবৃদ্ধির সিদ্ধান্ত সরকারের জন্য মারাত্মক বিপদের কারণ ডেকে আনতে পারে। সারা দেশ যখন অস্বস্তি, অস্থিতিশীলতা ও অপরাধপ্রবণতার মধ্য দিয়ে দিন অতিবাহিত করছে, তখন যেকোনো ইস্যু যেকোনো সময় বারুদ আধারে বিস্ফোরণ ঘটাতে পারে।
লেখক : অধ্যাপক, সরকার ও রাজনীতি বিভাগ
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
Mal55ju@yahoo.com

 


আরো সংবাদ



premium cement