২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫
`

উপমহাদেশে জাতীয়তাবাদ

-


উপমহাদেশে জাতীয়তাবাদের উন্মেষ ঘটে ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের মধ্য দিয়ে। পাকিস্তান ছিল ব্রিটিশবিরোধিতা এবং ধর্মীয় জাতীয়তার ভিত্তিতে গঠিত জাতিরাষ্ট্র। কিন্তু সমস্যা হলো, ব্রিটিশরা চলে যাওয়ার পর ধর্মীয় আদর্শের একনিষ্ঠ নেতৃত্বের অভাবে এই জাতীয়তাবাদ হারায় চালিকাশক্তি। একই কারণে ভাষা এবং জাতিগত পার্থক্য ঘুচানো সম্ভব হয়নি। ব্যবসা, চাকরিসহ রাষ্ট্রীয় কর্মকাণ্ডে তৈরি হয় বৈষম্য। এই বৈষম্যকে কেন্দ্র করে বাইরের ইন্ধনে তৈরি হয় একাংশের মনে ক্ষোভ এবং ফলাফল জাতিরাষ্ট্রের পতন। পরে স্বাধীন বাংলাদেশে ভাষাভিত্তিক জাতীয়তাবাদ কায়েমের চেষ্টা করা হয়, যার ভিত্তি ছিল বাঙালি বা বাংলাভাষী জাতিরাষ্ট্র, যা বাংলাদেশে বসবাসরত অবাঙালি ও উপজাতীয়দের মধ্যে তৈরি করে বিভেদ। অতঃপর ১৯৭৫ সালের পটপরিবর্তনের পর প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান জাতি-ধর্ম-ভাষা ও বর্ণের সমন্বয়ে ‘বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদের’ কনসেপ্ট প্রবর্তন করেন, যার ভিত্তি হচ্ছে, রাষ্ট্রের সীমারেখার ভেতর বসবাসরত সব ধর্ম-ভাষা ও বর্ণের মানুষ মিলে জাতিরাষ্ট্র। এর ফলে ধর্ম-ভাষা ও বর্ণের ভিত্তিতে কেউ বাদ পড়েনি। সবাই একটা কমন প্লাটফর্ম খুঁজে পায়।
যেহেতু এককেন্দ্রিক জাতীয়তাবাদ রাষ্ট্রের সব নাগরিককে একত্রিত করতে পারে না এবং প্রাকৃতিক বৈষম্য সৃষ্টি করে, তাই বাংলাদেশের মতো একাধিক ধর্ম-ভাষা ও বর্ণের মানুষ অধ্যুষিত দেশে ভূ-খণ্ডকেন্দ্রিক জাতীয়তাবাদই শ্রেষ্ঠ। তাই বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ এ দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের ইতিহাসবোধ ও অনুভূতিকে নাড়া দিয়েছে এবং প্রতিনিয়ত দিচ্ছে। ফলে বাংলাদেশের কোটি কোটি মানুষ বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদের পক্ষে অটল ও অবিচল রয়েছে। কারণ বিশ্বের কোনো দেশই একক কোনো ধর্ম, ভাষা-ভাষী অথবা একক কোনো বর্ণের মানুষের নয়। হিটলার বর্ণের ভিত্তিতে জার্মানি বানাতে চেয়ে ইতিহাসের জঘন্যতম বর্বরতা দেখিয়েছে। ইসরাইল ধর্মের ভিত্তিতে রাষ্ট্র বানাতে চেয়ে বর্তমান বিশ্বের সবচেয়ে বর্বর আগ্রাসন চালাচ্ছে। অন্য দিকে বহু ভাষা, বহু ধর্মের ও বহু বর্ণের হয়েও ভূ-খণ্ডকেন্দ্রিক জাতীয়তাবাদ কায়েম করাই যুক্তরাষ্ট্র হচ্ছে নিজ নাগরিকদের জন্য অন্যতম সেরা একটি রাষ্ট্র।
জিয়াউর রহমান দূরদৃষ্টির মাধ্যমে এটি বুঝতে পেরে বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদের মাধ্যমে ভূ-খণ্ডকেন্দ্রিক জাতীয়তাবাদ কায়েম করে গেছেন। আমাদের সবার উচিত, বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদের উদারতা এবং মর্ম অনুধাবন করে গর্বিত হওয়া এবং এ ব্যাপারে রাষ্ট্রকে সব ধরনের পৃষ্ঠপোষকতা দেয়া।
আত্মনির্ভরশীল একটি দেশ গড়তে হলে সবার আগে প্রয়োজন আত্মমর্যাদাসম্পন্ন একটি জাতিগঠন। আর জাতিগঠনে জাতীয়তাবাদের গুরুত্ব অপরিসীম। আধুনিক বিশ্বের প্রায় সব রাষ্ট্রই জাতিরাষ্ট্র। জাতিরাষ্ট্র মানেই জাতীয়তাবাদী আদর্শ ও ভাবধারার রাজনীতিতে চালিত হয়ে থাকে। বাংলাদেশের রাজনীতিতে জাতীয়তাবাদের দুটি ধারা বিদ্যমান। একটি আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন ভাষাভিত্তিক বাঙালি জাতীয়তাবাদের ধারা, অন্যটি হচ্ছে বিএনপির নেতৃত্বাধীন ভাষা, ধর্ম, সংস্কৃতি ও ভূ-খণ্ডকেন্দ্রিক বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদের ধারা।
ধর্ম, ভাষা, ইতিহাস-ঐতিহ্য, সংস্কৃতি ও অর্থনীতি ইত্যাদির সমন্বয়ে জাতীয়তাবাদ ভূ-খণ্ডকেন্দ্রিকতাই হয়ে থাকে এর প্রধানতম প্রেরণা ও শক্তি। এ কারণেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ফ্রান্স, জার্মনি, রাশিয়া, ভারত, পাকিস্তান, বাংলাদেশ, ও ইরানসহ প্রভৃতি দেশ জাতিরাষ্ট্র। নানা ভাষার, নানা ধর্মের, নানা বর্ণের ও নানা সংস্কৃতির মানুষ এসব দেশে বসবাস করলেও এরা সবাই ভূখণ্ডগতভাবে এক জাতীয়তাবাদী পরিচয়ে পরিচিত হন।


বাংলাদেশে হিন্দু-মুসলমান, বৌদ্ধ-খ্রিষ্টানসহ নানা ধর্মের মানুষ বাস করে। এখানে ভাষারও নানা বৈচিত্র্য আছে। বাংলা, চাকমা, মারমা, উর্দুসহ অনেক ভাষা ও নৃতাত্ত্বিক পরিচয়ের জাতিগোষ্ঠীর মানুষ- এরা সবাই বাংলাদেশ ভূখণ্ডে বসবাস করে। সেই অর্থে এরা সবাই বাংলাদেশী। সুতরাং জাতীয়তাবাদও হবে বাংলাদেশী। এখানেই সবার জাতীয় পরিচয় ও জাতীয় স্বার্থ নিহিত আছে। এর মাধ্যমে আমাদের জাতিসত্তার একটা সুস্পষ্ট কাঠামো প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।
নৃতাত্ত্বিক ও আদর্শিক চেতনা মিশ্র স্বতন্ত্র রূপ ও পরিচয় রাষ্ট্রীয়ভাবে বিশ্বের সামনে তুলে ধরা, বাঙালি মুসলমানদের স্বরূপ অন্বেষার ঐকান্তিক আগ্রহ, ভাষা, ধর্ম, সমাজ, সাহিত্য, রাজনীতি অর্থনীতি- এক বাক্যে বলা যায় জীবনের পরিপূরক প্রতিটি বিষয় ভিন্ন ভিন্ন মতবাদের আলোকে বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদে তুলে ধরা হয়েছে। তাই বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ বাংলাদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের ইতিহাসবোধ, অনুভূতি ও বিশ্বাসকে নাড়া দিয়েছে এবং প্রতিনিয়ত দিচ্ছে। ফলে বাংলাদেশের কোটি কোটি মানুষ ‘বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদের’ পক্ষে অটল-অবিচল রয়েছে। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে সাংগঠনিক দিক দিয়ে অনিবার্যভাবে এটিকে নতুন প্রজন্মের কাছে পরিচিত করা সম্ভব হয়নি। এর জন্য যে মেশিনারির প্রয়োজন- সম্ভব হয়নি তারও বিকাশ ঘটানোর। এই সীমাবদ্ধতাটুকু স্বীকার করতে হবে নির্দ্বিধায়।
দেশকালের পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে মানুষের সামাজিক অবস্থানের পরিবর্তনের সাথে তার নৈতিক এবং ধর্মীয় অনুভূতির পরিবর্তন ঘটে। এই পরিবর্তন মেনে না নেয়া গোঁড়ামি। জিয়াউর রহমান তার বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদের মাধ্যমে ধর্মীয় গোঁড়ামির শৃঙ্খল থেকে মানুষকে মুক্ত করতে চেয়েছিলেন। এই অর্থে তিনি একজন সংস্কারবাদী। তার সমাজভাবনার মূল প্রতিপাদ্য সমাজসংস্কার।
বাঙালি মুসলমান মধ্যবিত্ত শ্রেণীর রাজনৈতিক ক্ষমতা লাভের ত্র“ম পরিবর্তনের কালে জিয়াউর রহমান উপস্থাপন করেছিলেন উদারতন্ত্রের ভাবধারা। তার বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ একটি মধ্যপন্থী রাজনৈতিক দর্শন। এটি ধর্মান্ধও নয় আবার ধর্মহীনও নয়। সব ধর্ম, ভাষা ও জাতিগোষ্ঠীর মানুষের স্বীকৃতি রয়েছে বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদে। যার ফলে একটি সুস্পষ্ট চেতনার মাধ্যমে সব ভেদাভেদ ভুলে সমগ্র জাতি ঐক্যবদ্ধ হয় এবং দেশ গড়ার কাজে ঝাঁপিয়ে পড়ে। শুরু হয় সত্যিকারের উন্নয়ন ও উৎপাদনের রাজনীতি।
‘বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদে’ সন্নিবেশিত আছে সব জাতির পরিচয়, সব ধর্মের পরিচয়, সব ভাষার পরিচয় ও সব সাংস্কৃতির পরিচয় এবং ভৌগোলিক পরিচয়; সর্বোপরি মানুষের অর্থনৈতিক মুক্তি, সম্পদের সমবণ্টন ও সামাজিক ন্যায়বিচারের গ্যারান্টি। এক কথায় সুশৃঙ্খল মধ্যপন্থী জাতিগঠনের সব উপাদানই সন্নিবেশিত আছে বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদে। এর মাধ্যমে একটি জাতি গঠিত হলে সেই জাতি হবে একটি সাম্প্রদায়িকতামুক্ত ও আধুনিক জাতি। যে জাতিকে কোনোভাবেই বিভক্ত করা সম্ভব হবে না। এর মাধ্যমে একটি দেশ গঠিত হলে সে দেশকে জঙ্গি, মৌলবাদী, ব্যর্থ ও অকার্যকর বানানো সম্ভব হবে না।


মতাদর্শের দিক দিয়ে বাংলাদেশে ভিন্ন ভিন্ন মতের সন্ধান অবশ্য পাওয়া যাবে কিন্তু বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ সব ভিন্ন ভিন্ন মতের মানুষকে একটি প্লাটফর্মে একত্রিত করেছে। পাশাপাশি সাম্যবাদ, গণতান্ত্রিক এবং উদারতন্ত্রের চিন্তার বহিঃপ্রকাশ বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদে প্রতিফলিত হয়েছে। যুক্ত হয়েছে বাঙালি মুসলমানদের স্বরূপ অন্বেষার ঐকান্তিক আগ্রহ। সামাজিক, অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিকভাবে পশ্চৎপদ বাঙালি মুসলমান মানসে সম্মিলিত সাহিত্য প্রচেষ্টার সৃষ্টি হয়েছে আমাদের ঐতিহ্যের রূপরেখা। যার ফলে বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ বাংলাদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের হৃদয়কে নাড়া দিয়েছে এবং প্রতিনিয়ত দিচ্ছে।
মূলত ধর্মীয় চেতনা জাগ্রত করার মানসে বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদের উদ্ভব ঘটলেও এই প্রয়াস ধর্মের দিক দিয়ে মধ্যপন্থী, সঙ্ঘবদ্ধ চেতনা সৃষ্টিতে পরিণতি লাভ করেছে। সঙ্ঘবব্ধ সাহিত্যিক প্রচেষ্টা কখনো ধর্মীয় প্রেক্ষাপটে ও স্বাতন্ত্র্যকামী মতবাদে বিশ্বাসী কখনো বা ভাষিক এবং দৈশিক প্রেক্ষাপটে সমন্বয়কামী চেতনার প্রতিফলন ঘটিয়ে জনমত সৃষ্টি করেছে। বাঙালি মুসলমানদের জাতিসত্তা বিকাশে, শিক্ষার প্রসার, সামাজিক অধিকার প্রতিষ্ঠা, মাতৃভাষার পরিচর্যা ও ধর্মীয় পুনরুজ্জীবনের প্রশ্নে একবাক্যে বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদে পরিস্ফুটিত হয়েছে।
ধর্মীয় বিশ্বাস এ দেশের মানুষকে প্রবলভাবে নাড়া দেয়। মুক্ত এবং স্বচ্ছ দৃষ্টিভঙ্গির সাহায্যে ধর্মীয় অনুভূতিকে আঘাত না দিয়ে বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদের মাধ্যমে তুলে ধরা হয়েছে বাঙালি মুসলমানের স্থবির এবং অতীতচারী মানসিকতাকে।
যুক্তি ও বুদ্ধি দিয়ে ব্যাখ্যা করে উপস্থাপিত করা হয়েছে ইসলাম ধর্মের চারিত্র্য ও বৈশিষ্ট্যকে। তাত্ত্বিক আলোচনার ভেতর দিয়ে নয়, বাস্তব সমস্যাকে ঘটনা এবং তথ্যের আলোকে ব্যক্ত করে আমাদের ধর্মীয় চেতনাকে জাগ্রত করেছে বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ। এর মূলে আছে চির পশ্চাৎপদ বাঙালি মুসলমানদের চিত্তের মুক্তি। মুক্তির আকাক্সক্ষা ও আদর্শের প্রতি ঐকান্তিক নিষ্ঠাই বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদের মূল প্রতিপাদ্য।
অতীতচারী মানসিকতা আমাদের জাতিসত্তা বিকাশে মারাত্মক ধারার সৃষ্টি করেছে এবং করছে। বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদের আলোকে আমার জীবনকে পরিচালিত করতে পারেনি। অর্থাৎ এর আলোকে জাতি গঠনসম্ভব হয়নি। এ সীমাবদ্ধতাটুকু স্বীকার করতে হবে অনায়াসে। এমনটি পারলে বাংলাদেশ হয়তো মালয়েশিয়া, কোরিয়া অথবা সিঙ্গাপুুরের সমপর্যায়ে উন্নীত হওয়া অসম্ভব কিছু ছিল না। রাজনৈতিক দলের কর্মী হওয়ার জন্য রয়েছে যুক্তি ও ভিত্তি। আর এ য্ুিক্ত ও ভিত্তিটা হলো অপরাপর বিরোধী রাজনৈতিক দলের দর্শনকে যথাযথভাবে যুক্তি ও কর্মসূচিসহ মোকাবেলা করে, স্বীয় জীবনবোধের আলোকে সমাজ ও জাতিকে গড়ে তোলা। তাতে মানুষের মধ্যে একটি সুষ্ঠু-সুন্দর চেতনাবোধ তৈরি হয়, তৈরি হয় যুগোপযোগী চিন্তাচেতনা। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে বাংলাদেশের একটি প্রজন্ম উগ্রপন্থী রাজনৈতিক ধারায় দীক্ষিত হয়ে গেছে। এর একটা নেতিবাচক ফলও জাতি ভোগ করছে। এখান থেকে বের হয়ে আসার একটা সহজ পথ হলো জাতীয়তাবাদের আলোকে জাতি গঠন।
লেখক : কলামিস্ট ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক
belaYet_1@yahoo.com

 

 

 


আরো সংবাদ



premium cement