১৯ মার্চ ২০২৪, ০৫ চৈত্র ১৪২৯, ০৮ রমজান ১৪৪৫
`

জ্ঞানপ্রদীপ প্রফেসর মোহাম্মদ আলী

-

১৯৭৬-৭৭ শিক্ষাবর্ষে চট্টগ্রাম বিশ^বিদ্যালয়ে ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগে অনার্সে ভর্তি হয়ে যখন পড়ালেখা শুরু করি, তখন যেসব কিংবদন্তিতুল্য শিক্ষককে শিক্ষার্থীরা অত্যন্ত সম্মান ও সমীহ করত তাদের মধ্যে ইংরেজি বিভাগের প্রফেসর মোহাম্মদ আলী স্যার অন্যতম। বহুদিন পর গবেষণা বৃত্তি নিয়ে আবারও চট্টগ্রাম বিশ^বিদ্যালয়ে পিএইচডি কোর্সে ভর্তি হই তখনো আলী স্যার বিশ^বিদ্যালয়ে কর্মরত ছিলেন। ২০০৬ সালে চট্টগ্রাম বিশ^বিদ্যালয় সিন্ডিকেট আমাকে পিএইচডি ডিগ্রি প্রদান করে। চট্টগ্রাম বিশ^বিদ্যালয় এবং বিশ^বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের নিয়ে আমরা রীতিমতো গর্ববোধ করতে পারি। কোলাহলমুক্ত ক্যাম্পাস, শিক্ষার অনুকূল পরিবেশ এবং এক হাজার ৭৫৩ একর ঘন সবুজ অরণ্যঘেরা পরিবেশ-প্রতিবেশ চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়কে বিশিষ্টতা দিয়েছে। এ বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান শিক্ষার্থীর সংখ্যা ২৪ হাজার এবং শিক্ষক এক হাজারেরও বেশি। প্রধান বিচারপতি, মন্ত্রী, বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর, নির্বাচন কমিশনার, সাংবাদিক, বিচারক, রাষ্ট্রদূত, সংসদ সদস্য, সচিব, বিভিন্ন ক্যাডারের সদস্য, পুলিশ ও সেনা কর্মকর্তা, প্রফেসরসহ অনেক সামরিক বেসামরিক কর্মকর্তা এ বিশ^বিদ্যালয়ের ছাত্র।
আমাদের যুগে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় যেসব তীক্ষ্ণ-ধীসম্পন্ন প্রফেসর ক্যাম্পাসকে সজীব ও জীবন্ত রেখেছিলেন তাদের কাছে থেকে দেখেছি ও বক্তব্য শুনেছি। তাদের অবদান ও কর্মযজ্ঞ এখনো স্মৃতিতে উজ্জ্বল। অনেকে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে ব্যাপক খ্যাতি ও সুনাম অর্জন করেন। তাদের মধ্যে ইতিহাস বিভাগের প্রফেসর ড. আবদুল করিম ও প্রফেসর ড. আলমগীর মোহাম্মদ সিরাজুদ্দীন, বাংলা বিভাগের প্রফেসর ড. সৈয়দ আলী আহসান, ড. আনিসুজ্জামান, ড. আবু হেনা মোস্তফা কামাল, ড. আলাউদ্দিন আল আজাদ, প্রফেসর মনিরুজ্জামান, প্রফেসর ভূঁইয়া ইকবাল, প্রফেসর ময়ূখ চৌধুরী, ড. হুমায়ুন আজাদ, অর্থনীতি বিভাগের ড. মুহাম্মদ ইউনূস, আরবি বিভাগের ড. আবদুল গফুর, ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগের ড. মুঈনউদ্দিন আহমদ খান, গণিত বিভাগের ড. জামাল নজরুল ইসলাম, রাজনীতি বিজ্ঞান বিভাগের ড. আর আই চৌধুরী ও প্রফেসর মুহাম্মদ ইয়াহ্ইয়া আখতার, সমাজবিজ্ঞান বিভাগের ড. অনুপম সেন, অর্থনীতি বিভাগের ড. মইনুল ইসলাম, পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের প্রফেসর হামিদা বানু, চারুকলা বিভাগের প্রফেসর মুর্তজা বশীর ও প্রফেসর সৈয়দ আবদুল্লাহ খালিদ, উদ্ভিদবিজ্ঞান বিভাগের ড. এমএ আজিজ খান, আইন বিভাগের প্রফেসর ড. শাহ আলম ও ড. আবদুল্লাহ আল-ফারুকের নাম সবিশেষ উল্লেখযোগ্য। উল্লিখিত শিক্ষকদের মধ্যে ড. মুহাম্মদ ইউনূস নোবেল পুরস্কার লাভ করেন। প্রফেসর মুহাম্মদ আলী, ড. আবদুল করিম, ড. এমএ আজিজ খান, ড. আলমগীর মোহাম্মদ সিরাজুদ্দীন, ড. আর আই চৌধুরী চট্টগ্রাম বিশ^বিদ্যালয়ের উপাচার্য নিযুক্ত হন। ড. মুহাম্মদ ইনাম উল হক কুষ্টিয়া ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে, ড. মুঈনউদ্দিন আহমদ খান সাদার্ন বিশ^বিদ্যালয়ে ও ড. অনুপম সেন প্রিমিয়ার বিশ^বিদ্যালয়ে উপাচার্যের দায়িত্ব পালন করেন। এ বিশ্ববিদ্যালয়ের ১১ জন শিক্ষক বিভিন্ন সময়ে একুশে পদক পেয়েছেন।

ইংরেজি সাহিত্যের কিংবদন্তি হিসেবে খ্যাত এই শিক্ষাগুরু ৮৫ বছরের বর্ণাঢ্য জীবনের পরিক্রমণ শেষে পৃথিবী থেকে বিদায় নেন। প্রফেসর মোহাম্মদ আলীর মৃত্যুতে দেশ ও জাতি একজন মেধাবী ও প্রজ্ঞাবান শিক্ষাবিদকে হারিয়েছে। শিক্ষাজীবনের সর্বত্র তিনি সৃজনশীল মেধার স্বাক্ষর রাখতে সক্ষম হন। বহুমাত্রিক মেধা, অকপট গাম্ভীর্য, ভাষাদক্ষতা ও প্রশাসনিক অন্তর্দৃষ্টি তাকে অনন্য উচ্চতায় অভিষিক্ত করে। অক্সফোর্ড স্কলার প্রফেসর মোহাম্মদ আলী ইংরেজি ভাষা ও সাহিত্যের বিদগ্ধ পণ্ডিত ও শিক্ষাবিদরূপে প্রসিদ্ধি লাভ করেন। তার একাডেমিক গবেষণামূলক গ্রন্থ ও নিবন্ধ সব মহলে প্রশংসিত হয়েছে। ক্লাসে নির্ধারিত বিষয়ে তার জ্ঞানদীপ্ত লেকচার শোনার জন্য শিক্ষার্থীরা উন্মুখ হয়ে থাকত। তিনি বাংলা বলার মাঝখানে ইংরেজি বলতেন না আবার ইংরেজি ভাষায় বক্তৃতার সময় বাংলা বলতেন না। বিষয় নির্বাচন, বাক্য বিন্যাস, শব্দ উচ্চারণ, বর্ণনাশৈলী ও প্রকাশভঙ্গি ছিল আকর্ষণীয়। চট্টগ্রামসহ দেশের বর্তমান উল্লেখযোগ্য সংখ্যক ইংরেজি ডিসিপ্লিনের গুণী ব্যক্তিই তার ছাত্র। তিনি কেবলমাত্র শিক্ষক ছিলেন না বরং ছিলেন শিক্ষা প্রশাসক।
উইলিয়াম শেকসপিয়ার, জন ডান, অ্যান্ড্রু মারভেল, টমাস গ্রে, উইলিয়াম ওয়ার্ডসওয়ার্থ, স্যামুয়েল টেইলার কোলরিজ, জন কীটস, পার্সি বিশে শেলী, লর্ড আলফ্রেড টেনিসন, রবার্ট ব্রাউনিং, ম্যাথু আরনল্ড, দান্তে গ্যাব্রিয়েল রোসেটি, ক্রিস্টিনা রোসেটি, টমাস স্টার্নস এলিয়ট, স্টিফেন স্পেন্ডার, জন মিল্টন, স্পেন্সার, চসারও আলেকজান্ডার পোপসহ ইংরেজ কবি ও লেখকদের রচনা ও কবিতায় জীবনদৃষ্টি, শিল্পচেতনা, নিসর্গের স্নিগ্ধসৌন্দর্য, অধ্যাত্মবোধ, ক্লাসিক রূপকল্প, রোমান্টিকতা, বর্ণনার রূপময়তা ও দার্শনিক ভাবের গভীরতা যেভাবে মূর্ত হয়েছে তা বিশ্ব সাহিত্যের মানদণ্ডে অমূল্য সম্পদ। পৃথিবীর বহু সাহিত্যে, কবিতায়, নাটক-সনেটে উপরিউক্ত কালজয়ী লেখকদের মৌলিকত্ব ও বৈদগ্ধের অপ্রতিহত প্রভাব লক্ষণীয়। ইংরেজি সাহিত্যের এসব কবি ও লেখকদের রচনাকে শিক্ষার্থী ও সাহিত্যপিপাসুদের সামনে মার্জিত ও বোধগম্য ভাষায় উপস্থাপন করে প্রফেসর মোহাম্মদ আলী কৃতিত্বের দৃষ্টান্ত স্থাপন করেন।


প্রফেসর মোহাম্মদ আলী তার বর্ণাঢ্য অ্যাকাডেমিক ক্যারিয়ারে অনেক গুরুত্বপূর্ণ পদে আসীন ছিলেন এবং দক্ষতার সাথে অর্পিত দায়িত্ব আঞ্জাম দিতে সক্ষমতার পরিচয় দেন। তিনি ছিলেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান, কলা ও মানববিদ্যা অনুষদের ডিন, সিনেট ও সিন্ডিকেট সদস্য এবং উপাচার্য। তিনি দেশের চারটি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভাইস চ্যান্সেলরের দায়িত্ব পালন করেন অত্যন্ত দক্ষতার সাথে। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অবসরে যাওয়ার পর তিনি চট্টগ্রাম আন্তর্জাতিক ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, নর্দার্ন বিশ^বিদ্যালয় এবং সর্বশেষ সাদার্ন বিশ^বিদ্যালয়ের ভিসির দায়িত্ব পালন করেন। চট্টগ্রাম বিশ^বিদ্যালয়ে যোগ দেয়ার আগে তিনি রাজশাহী বিশ^বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করেন। তিনি বিশ^বিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের সদস্য হিসেবেও গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখেন। এতে তার প্রজ্ঞা, দক্ষতা ও গ্রহণযোগ্যতার প্রমাণ পাওয়া যায়। প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান হিসেবে তিনি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ইংরেজি বিভাগকে ঢেলে সাজান এবং সিলেবাস প্রণয়নে বিজ্ঞতার পরিচয় দেন।
চট্টগ্রাম ওমর গণি এমইএস কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ, প্রিন্সিপাল এ এ রেজাউল করিম চৌধুরী ছিলেন প্রফেসর মোহাম্মদ আলীর শিক্ষক। আমি ২০০৩-২০০৫ সালে দিনের একটি নির্ধারিত সময় প্রিন্সিপাল রেজাউল করিম সাহেবের চট্টগ্রাম দেওয়ান বাজারস্থ বাসায় গিয়ে ইংরেজি ভাষায় রচিত আমার ডক্টোরাল থিসিসের খসড়া কপি ওনাকে পড়ে শোনাতাম। তিনি বিভিন্ন স্থানে প্রয়োজনীয় সংশোধনী দিতেন। প্রসঙ্গক্রমে অনেকবার তিনি তার প্রিয় ছাত্র প্রফেসর মোহাম্মদ আলীর জ্ঞান গরিমার প্রশংসা করতেন। এসব কথা এখনো আমার স্মৃতিতে জমা আছে। প্রিন্সিপাল রেজাউল করিম চৌধুরীর মূল্যায়ন করতে গিয়ে প্রফেসর মোহাম্মদ আলী বলেন, ‘১৯৬৬ সালের ১৮ নভেম্বর চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন হয়। সেদিন আমরা যারা এই বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে জড়িত ছিলাম আমরা অধ্যক্ষ এ এ রেজাউল করিম চৌধুরীকেই পবিত্র কুরআন হতে তেলাওয়াত করতে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলাম এবং তিনি সাগ্রহে তা গ্রহণ করেছিলেন। তার সতেজ কণ্ঠের সেই আবৃত্তি ও তরজমা আজো আমার স্মৃতিতে উজ্জ্বল’(প্রফেসর মোহাম্মদ আলী, চট্টগ্রামের দুই কৃতী সন্তানের স্মরণে, স্যুভেনির, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় ট্রাস্ট, চট্টগ্রাম, ০৭ জুলাই, ২০০১, পৃ. ০৪)।
প্রফেসর মোহাম্মদ আলী ছিলেন সৎ, ন্যায়নিষ্ঠ ও আকর্ষণীয় ব্যক্তিত্বসম্পন্ন। কোনো চাপের মুখে তিনি কোনো দিন অন্যায্য সিদ্ধান্ত নেননি। অত্যন্ত রুচিশীল, প্রখর মেধাবী, বিনয়ী, সদালাপী, অমায়িক, সর্বোপরি একজন শিক্ষার্থীবান্ধব শিক্ষক ছিলেন। শিক্ষা ক্ষেত্রে অসামান্য অবদানের জন্য এ শিক্ষাবিদকে দেশ-জাতি চিরদিন শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ রাখবে। তিনি তার কর্মপ্রয়াস ও শিক্ষার্থীদের মাঝে বেঁচে থাকবেন বহুকাল। আল্লাহ তায়ালা এ বিদগ্ধ মনীষীকে জান্নাতুল ফিরদাউস নসিব করুন। আমিন।
লেখক : অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক ও গবেষক
drkhalid09@gmail.com

 


আরো সংবাদ



premium cement