২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০, ১৭ রমজান ১৪৪৫
`

রাজনীতি নেতৃত্ব ও দেশপ্রেম

-

স্যামুয়েল জনসন বলেছেন, ‘দেশপ্রেম দুষ্ট লোকের শেষ অবলম্বন’। বক্তব্যটির মূল্যায়ন করা যাক, যদি স্যামুয়েল জনসনের বক্তব্যকে আক্ষরিক সত্য হিসেবে ধরে নিই, তবে জর্জ ওয়াশিংটন, চার্চিল, লিঙ্কন, গান্ধী, জিন্নাহ, সোহরাওয়ার্দী, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব, ভাসানী ও জিয়া- সবাই দুষ্টলোক ছিলেন। কিন্তু বাস্তবতা এটাই যে, এরা প্রকৃতই দেশপ্রেমিক ছিলেন। আসল ব্যাপার হলো- অসৎ লোকেরা গায়ে দেশপ্রেমের পোশাক চাপালে সেটিই হলো ভণ্ডামি, আদৌ দেশপ্রেম নয়।
আমার দেশ তোমার দেশের চেয়ে শ্রেষ্ঠতর এমন অভিব্যক্তির মাধ্যমে দেশপ্রেম প্রকাশ করাটা জরুরি নয়। এটি অত্যন্ত সঙ্কীর্ণ ও বিকৃত অভিব্যক্তি। যে দেশপ্রেম অন্য জাতিকে হেয় করে তা উগ্র স্বাদেশিকতা এবং বিশৃঙ্খলার কারণ। জাপানিদের উন্নয়নের একটি প্রধান কারণ হলো তাদের দেশপ্রেম জাতীয় অহঙ্কারের বিষয়। দায়িত্বপূর্ণ আচরণ জাপানি দেশপ্রেমের নিদর্শন। কারণ দায়িত্বহীন আচরণ দেশপ্রেম হিসেবে বিবেচিত হয় না।
রাজনীতি মানুষের ভাগ্য পরিবর্তনের মাধ্যম, তাই সৃষ্টির শুরু থেকেই রাজনীতির প্রতি মানুষের আগ্রহ। রাজনীতির গতি-প্রকৃতি কোন দিকে যায় তার প্রতি মানুষের তীক্ষè দৃষ্টি থাকে। রাজনীতি নিয়ন্ত্রিত হয় রাজনৈতিক নেতৃত্বের মাধ্যমে। নেতৃত্ব কলুষিত হলে রাজনীতি মানুষের ভাগ্য পরিবর্তনের নিয়ামক হওয়ার পরিবর্তে হয়ে ওঠে অবধারিত দুর্ভাগ্যের কারণ।
বাংলাদেশে রাজনীতি আর রাজনীতিবিদদের হাতে নেই। এখানে রাজনীতি নিয়ন্ত্রণ করেন ব্যবসায়ী ও টাকাওয়ালারা। রাজনীতিবিদরা এই টাকাওয়ালাদের কাছে এক প্রকার জিম্মি। সারা জীবন যিনি রাজনীতির জন্য জীবনের মূল্যবান সময় ব্যয় করলেন, জীবন উৎসর্গ করে পরিবারের সদস্যদের সময় না দিয়ে রাজনীতির মাঠ তৈরি করলেন, তৈরি করলেন অগণিত নেতাকর্মী ও শুভাকাক্সক্ষী- দেখা গেল একজন টাকাওয়ালা ব্যক্তি এসে হঠাৎ তার স্থান দখল করে নেয়। শুধু টাকার জোরে রাজনীতিবিদদের দল থেকে বহিষ্কার পর্যন্ত করতে সমর্থ হন ব্যবসায়ী টাকাওয়ালারা। রাজনীতির নামে এখানে এটাই চলছে। তাতে অবাক হওয়ার কিছু নেই!
এটিই বর্তমানে বাংলাদেশের প্রকৃত রাজনীতির চেহারা। এখানে প্রতিষ্ঠিত রাজনীতিবিদরা পরিহাসের পাত্র; রাষ্ট্রীয় কোনো নীতিনির্ধারণী কাজে তাদের মেধা কাজে লাগছে না। এই রাজনীতি মানুষের কী কল্যাণ করবে? এই রাজনীতি তো মানুষের কোনো উপকারে আসছে না! হাজার কোটি, লাখ কোটি টাকার বাজেট ঘোষণা করেও মানুষের কোনো সমস্যার সমাধান হচ্ছে না! মানুষের সামনে শুধু সমস্যার পাহাড় তৈরি হচ্ছে! যিনি রাজনীতিতে টাকা বিনিয়োগ করেন তিনি তো ব্যবসার উদ্দেশ্য নিয়েই তা করেন, জনসেবা তো তার মুখ্য উদ্দেশ্য নয়। তিনি তো নেতা নন, রাজনীতিতে তার কোনো দায়বদ্ধতা নেই।
যে রাজনীতি মানুষের কোনো কল্যাণে আসে না, সে রাজনীতি তাসের ঘরের মতো ধসে পড়তে বাধ্য; আজ হোক কাল হোক এ রাজনীতি ধসে পড়বেই।
দেশের অভ্যন্তরে বা বাইরে নাগরিকদের প্রতিটি কাজে, সিদ্ধান্তে ও আচরণে জাতীয় গর্বের প্রতিফলন ঘটতে হবে। কেবল দেশের অভ্যন্তরে পারস্পরিক আচরণেই নয়, দেশে-বিদেশে যখন যেখানে থাকেন সেখানেই দেশীয় অহঙ্কার জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে প্রতিফলিত হতে হবে।
প্রত্যেক দেশে দু’ধরনের নাগরিক বাস করে, দেশপ্রেমিক ও প্রতারক। দেশপ্রেমিকরা দেশের সম্পদ ও প্রতারকরা দায়। দেশপ্রেমিকও দুই প্রকার, যথা- সময়সাপেক্ষ দেশপ্রেমিক, সত্যিকারের দেশপ্রেমিক।
ঝাঁসির রানী লক্ষ্মী বাঈ একজন সুশাসক ছিলেন এবং একজন যোদ্ধা হিসেবে ব্রিটিশদের হুকুম তামিলে অস্বীকার করেছিলেন। স্থানীয় রাজাদের সাথে একটি সুসজ্জিত বাহিনীর নেতৃত্ব দেন তিনি এবং অপরাজেয় ব্রিটিশ সেনাবাহিনীকে পরাজিত করেন। ১৮৫৭ সালের মার্চে প্রায় চার হাজার ব্রিটিশ সেনা ঝাঁসি অবরোধ করেন। রানী লক্ষ্মী বাঈ তার শিশুপুত্রকে পিঠে বেঁধে যুদ্ধে গিয়েছিলেন। যুদ্ধচলাকালীন তিনি মারাত্মকভাবে আহত হন ও পরে মৃত্যুবরণ করেন। তখন তার বয়স ছিল মাত্র ২২ বছর, তার শত্রু ব্রিটিশ বাহিনী পর্যন্ত তার দুর্দান্ত সাহস, রাজ্যরক্ষার প্রতিজ্ঞা ও দেশপ্রেমের কাছে মাতা নত করে।


প্রত্যেক প্রজন্মেই একজন দেশপ্রেমিক থাকেন, যিনি ভিন্ন কিছু করেন। চেষ্টা না করার চেয়ে ঝুঁকি নিয়ে হেরে যাওয়া অনেক ভালো; ১৭৭৫ সালের মার্চে প্যাট্রিক হেনরি যুক্তরাষ্ট্রে একটি ঐতিহাসিক ভাষণ দিয়েছিলেন। তিনি বলেছিলেন, আমরা যদি স্বাধীন হতে চাই তবে আমাদের লড়তে হবে। দ্বিধা ও নিষ্ক্রিয়তার মাধ্যমে কখনো শক্তি অর্জন করা যায় না। জীবন কি এতই প্রিয় কিংবা শান্তি কি এতই মধুর যে, শিকল ও দাসত্বের বিনিময়ে তা ক্রয় করতে হবে?
পক্ষপাতিত্ব ও প্রত্যয়ের মধ্যে পার্থক্য রয়েছে। পক্ষপাতিত্ব হস্তান্তরযোগ্য। প্রত্যয় তা নয়। অবস্থার চাপে স্বজনপ্রীতি দুর্বল হতে থাকে আর প্রত্যয় হয় দৃঢ়। প্রশ্ন হলো, জনগণ স্থিতিশীল নয় কেন? তারা তা নয়, কারণ তা অসুবিধাজনক। নাগরিক যখন প্রত্যয়ের চেয়ে সুবিধাকে বেছে নেয়, তখন দেশে অবনতি ঘটে। যে সব নাগরিক নীতির ঊর্ধ্বে সুবিধাকে স্থান দেয়, তারা উভয়কেই হারায়। সুনাগরিকের জন্য দেশপ্রেম জীবনের একটি পন্থা।
উৎসর্গ মানে সবসময় হারানো নয়, বরঞ্চ বেছে নেয়ার চেয়ে বেশি কিছু। এর অর্থ হলো বৃহত্তর অর্জনের জন ক্ষুদ্রতর বিসর্জন। মহৎ নেতৃত্ব স্বেচ্ছায় উৎসর্গ করেন। দেশের বৃহত্তর স্বার্থের জন্য ক্ষুদ্র স্বার্থ ত্যাগ করতে পারলে দেশ উন্নতির পথে অগ্রসর হয়। যারা দেশের জন্য মৃত্যুবরণ করেন, তারা জীবিতদের মধ্যে জীবনের স্ফুলিঙ্গ ছড়িয়ে দেন। পরিবার ও জাতির জন্য ত্যাগের মধ্যে পার্থক্য রয়েছে। কোনো ব্যক্তি যখন পরিবারের জন্য ত্যাগ করে তখন সে পরিবার লাভবান হয়। কোনো ব্যক্তি যখন জাতির জন্য কিছু করে তখন সে জাতি চিরতরে কিছু অর্জন করে, যদিও সে ব্যক্তির পরিবার চিরদিনের জন্য হারায়। আত্মস্বার্থ ও উৎসর্গের মধ্যে সঙ্ঘাতের সৃষ্টি হলে দ্বিতীয়টিকে প্রাধান্য দিতে হবে। ইতিহাসের বিখ্যাত নেতারা ব্যক্তিগত কর্মসূচিকে জাতীয় কর্মসূচির অন্তর্ভুক্ত করে নিতেন। জীবনের কোনো নিশ্চয়তা নেই। সফলতার কোনো সহজ, নির্বিঘœ দ্রুত উপায় নেই।
আশ্চর্য হওয়ার কিছু নেই যে, প্রতি বছর আমাদের অগণিত তরুণ অন্য দেশে পাড়ি জমায়। কারণ যে ব্যবস্থা সৎলোকের সাজা ও অসৎদের পুরস্কৃত করে, সেখানে তারা থাকতে চায় না। একেই কি জাতীয় লজ্জা বলে না? আমাদের যুবকরা হয় সুন্দর জীবনের জন্য বাংলাদেশ ত্যাগ করে প্রবাসে পাড়ি জমাচ্ছে, নয়তো অবিশ্বাসী কিংবা দূষিত হয়ে পড়ছে। আগে সবাই ফিরে আসার জন্য বিদেশে যেত। এখন স্থায়ীভাবে থাকার জন্যই যায়। এর মানে কি তারা তাদের দেশকে আর ভালোবাসে না?
আমরা নৈতিক রক্তাল্পতা ও আত্মিক ক্যান্সারে ভুগছি। সৎ ও ন্যয়বান লোকেরা দুর্নীতি ও আর্থিক অপুষ্টির মধ্যখানে পরিহাসের পাত্রে পরিণত হয়েছেন।
ঘরের শত্রু সবসময় সমাজকে ধ্বংস করে দেয়। বিশ্বাসঘাতক দুুই প্রকারের হয়, সক্রিয় বিশ্বাসঘাতক ও নিষ্ক্রিয় বিশ্বাসঘাতক। সক্রিয় বিশ্বাসঘাতক নিজের লাভের জন্য মাতৃভূমিকে বাজারে বিক্রি করে দেয়। আর নিষ্ক্রিয় বিশ্বাসঘাতক মাতৃভূমিকে বিক্রি করা দেখেও নীরব থাকে। দ্বিতীয় শ্রেণীর বিশ্বাসঘাতক প্রথম শ্রেণীর চেয়ে নিকৃষ্ট। কারণ প্রথম শ্রেণীটি জালিয়াত কিন্তু দ্বিতীয় শ্রেণীটি শুধু জালিয়াতই নয়, কাপুরুষও। শঠতার বিভিন্ন রকম অবয়ব থাকে। ব্রিটিশরা ২০০ বছরে যা করতে পারেনি, এ দেশের পাজি, বিশ্বাসঘাতক ও প্রতারক লোকেরা ৫০ বছরেই তা করে ফেলেছে। বিশ্বাসঘাতকরা লজ্জাজনক অধ্যায় রেখে যায়।
প্রায় তিন হাজার বছর আগে গ্রিক সভ্যতার উজ্জ্বলতম জ্যোতিষ্ক ও দার্শনিকরা (আদর্শ রাষ্ট্রে) বিধান দিয়েছিলেন, দার্শনিক রাজার না থাকবে কোনো পরিবার, না থাকবে কোনো ব্যক্তিগত সম্পদ। পরিবার না থাকলে আত্মীয়স্বজন বা সন্তান-সন্ততির প্রতি তার কোনো সময় দুর্বলতা জন্মাবে না। কেন ব্যক্তিগত সম্পদে অধিকার না থাকলে রাষ্ট্রীয় সম্পদের সঠিক ব্যবহারে তিনি নিজে-নিজেই উদ্বুদ্ধ হবেন।


রাজনৈতিক নেতৃত্বের প্রকৃতি হতে হবে উদার। রাজনৈতিক নেতাদের ব্যক্তিত্ব হতে হবে সৃজনমুখী, সংবেদনশীল। রাষ্ট্রীয় ক্ষমতাকে জনগণের আমানত হিসেবে গণ্য করতে হবে। রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা নিজেদের প্রভাব, বৈভব বা প্রতিপত্তি অর্জনের মাধ্যম হতে পারে না। লালসা ও বিলাসিতার জন্য জাতির সর্বনাশ করার মতো প্রতারক ও বিশ্বাসঘাতক প্রত্যেক সমাজে রয়েছে। ওই ধরনের লোকেরা হীনম্মন্যতাবোধ ও অহংবোধের প্রভাবে যেকোনো মূল্যে ক্ষমতা, সম্পদ ও মর্যাদা পেতে চায়। বেনেডিক্ট আরনল্ড ছিলেন এমনই এক বিশ্বাসঘাতক। আমেরিকার স্বাধীনতার যুদ্ধের সময় তিনি গোপনে ব্রিটেনে সেনা পাঠিয়েছিলেন; কিন্তু তার দেশের লোকজন এ ষড়যন্ত্র টের পেয়ে গেলে তিনি ইংল্যান্ড পালিয়ে যেতে সক্ষম হন। যখন তিনি ইংল্যান্ড থাকতেন, কেউ তার সাথে কথা বলত না, এমনকি নিজেদের চার পাশে তাকে দেখতেও চাইত না। তিনি জনগণের সামনে চরমভাবে অপমানিত হতেন। এমনো হয়েছে যে, কিছু লোক তার মুখের উপর থুথু ছিটিয়ে দিত। তিনি যেখানে যেতেন, বিশ্বাসঘাতকতার কলঙ্ক তাকে অনুসরণ করত, তাকে সবাই ‘বিশ্বাসঘাতক’ বলে ডাকত।
বর্তমানে আমাদের রাজনীতিবিদরাও কি এমন আচরণ করেন না? সবসময়ই আমরা অতীতের ভুলের পুনরাবৃত্তি ঘটাই। মাশুল দিই উত্তরোত্তর। ইতিহাস আমাদের যে শিক্ষা দেয়, তা হলো আমরা আদৌ কিছু শিখিনি। মীরজাফর কিভাবে মাতৃভূমির সাথে বেঈমানি করে তা বিদেশী দখলদারের হাতে তুলে দেয় সে ঘটনা আমরা সবাই জানি। লোভই বিশ্বাসঘাতকদের একমাত্র ধর্ম। ব্যক্তিগত লাভের জন্য সে শয়তানের সাথে একপাত্রে চুমুক দিতে পারে।
আমরা প্রায়ই শুনি, ক্ষমতা দূষিত করে এবং ক্ষমতা সম্পূর্ণ দূষণ সম্পন্ন করে। এ কথা সত্য নয়, ক্ষমতা তাদেরই দূষিত করতে পারে; যারা দূষণযোগ্য। ক্ষমতা কেবল অন্তরালকে সামনে এনে দেয়। ক্ষমতা নিরপেক্ষ। সৎ লোকের হাতে ক্ষমতা আশীর্বাদস্বরূপ, আর অধার্মিকের হাতে তা অভিশাপ; অনেকটা বৃষ্টি হলে আগাছা আর ফুল উভয়েই যেমন বাড়তে থাকে, ক্ষমতালোভী লোকেরা মানসিকভাবে বিপর্যস্ত। ক্ষমতার অপব্যবহার তখনই হয় যখন কারো প্রত্যাশা নোংরা হয়ে যায়। পাজি, বিশ্বাসঘাতক ও প্রতারক লোকরাই ক্ষমতার অপব্যবহার করে কাজের মধ্যে দুর্নীতি ডেকে আনে।
নেতা শুধু বর্তমান বিষয় নিয়ে ভাবেন না, আগামীকাল তথা পরবর্তী সময়ের কথাও ভাবেন। এ ধরনের নেতৃত্ব ইতিহাসের গতি পরিবর্তন করে থাকে। আত্মবিশ্বাস, সাহসিকতা এবং অনমনীয়তার শক্তি বলে যেসব ব্যক্তি নেতৃত্বের পর্যায়ে উন্নীত হন, ইতিহাস তাদের বিশেষ স্থান দিয়েছে।
লেখক : কলামিস্ট
ই মেল : belayet_1@yahoo.com

 

 

 


আরো সংবাদ



premium cement