২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫
`

শিক্ষক লাঞ্ছনার শেষ কোথায়

-

শিক্ষক হলেন জাতি গড়ার কারিগর। তাই সবাই শিক্ষকদের পথপ্রদর্শক হিসেবে সম্মান করেন।
সংবিধানের ৩১ ও ৩২ ধারায় মানুষের জীবন ও ব্যক্তিস্বাধীনতার অধিকারের স্বীকৃতি দেয়া হয়েছে। কিন্তু তার মানে এই নয় যে, নিয়ম শুধু অন্যের জন্য, আমি নিয়মের ব্যতিক্রম; বরং এমন ধারণা সঙ্ঘবদ্ধ সমাজে বিশৃঙ্খলা তৈরি করবে। অথচ সংবিধানের এ ধারা অপব্যবহার করে আজ জাতি গড়ার কারিগর শিক্ষকদের বিভিন্নভাবে লাঞ্ছিত করছে একদল হায়েনা। তাদের জন্য কখনোই আইন কার্যকর হয় না। তারই জ্বলন্ত উদাহরণ ছাত্রের হাতে শিক্ষক হত্যার ঘটনা।
বর্তমানে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে নৈতিকতাও শৃঙ্খলা ফেরাতে গিয়ে প্রশাসন কর্তৃক যেমনি শিক্ষক লাঞ্ছনা বাড়ছে, তেমনি প্রতিষ্ঠানের পরিচালক, প্রশাসনিক কর্মকর্তা, ম্যানেজিং কমিটির সভাপতি এবং ছাত্রদের হাতে হামেশাই লাঞ্ছিত হচ্ছেন এ দেশের শিক্ষকরা। পত্রপত্রিকা খুললে প্রায়ই দেখা যায়, প্রতিষ্ঠান সভাপতি, শিক্ষা কর্মকর্তা, প্রশাসনিক কর্মকর্তা, ছাত্র অথবা অভিভাবকের হাতে লাঞ্ছিত হয়েছেন প্রতিষ্ঠান প্রধান কিংবা শিক্ষক।
অথচ একটা সময় আর্থিক নিরাপত্তা না থাকলেও শিক্ষকরা কতই না সম্মান পেতেন। আজ আর্থিক নিরাপত্তা অনেকখানি বাড়লেও শিক্ষকরা পদে পদে অপমানিত। প্রায় ১৯০ বছরের ব্রিটিশ শাসনামলে এবং প্রায় ২৪ বছরের পাকিস্তানি শাসনকালে শিক্ষকের মর্যাদার তেমন উচ্চাসীন হয়নি বললেই চলে। স্বাধীনতার পর থেকে আজ অবধি গত ৫১ বছরে বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থা ও শিক্ষকের মর্যাদা অনেকটাই উচ্চাসীন। বাংলাদেশে একসময় শিক্ষকদের কোনো বেতনই ছিল না। ওই সময় শিক্ষক বলতে বোঝাত অতিশয় ভদ্র, চোখে ভাঙা চশমা, পরনে কম দামি কুঁচকানো পাজামা-পাঞ্জাবি কিংবা লুঙ্গি, পায়ে সাধারণ জুতা কিংবা স্যান্ডেল, হাতে সাধারণ ছাতা কিংবা তালি দেয়া ছাতা। ১৯৪৪ সালে ব্রিটিশ সরকার শিক্ষকদের জন্য মাসিক পাঁচ টাকা ভাতা চালু করে। সেই থেকে শিক্ষকদের বেতন-ভাতা শুরু। স্বাধীনতা-পরবর্তী শেখ মুজিবুর রহমান সরকার একসাথে ৩৬ হাজার প্রাথমিক বিদ্যালয়ের এক লাখ ৬২ হাজার শিক্ষকের চাকরি জাতীয়করণ করেছিলেন। ব্যস, তখন থেকেই শুরু। তার পর সরকারীকরণ, জাতীয়করণ, এমপিওভুক্তির কার্যক্রম। বিশাল পথ অতিক্রম করে শিক্ষাব্যবস্থায় ব্যাপক পরিবর্তন হলেও শিক্ষকদের অধিকার, কর্তব্য ও সম্মানের প্রশ্নসহ শিক্ষাব্যবস্থা আজো বহুবিধ সমস্যা ভারাক্রান্ত। এখনই প্রতিরোধ না করলে কিংবা যথাযথ ব্যবস্থা না নিলে সে লাঞ্ছনা অব্যাহত থাকবে এবং সমস্যাগুলো জটিলতর হবে।


গত কয়েক বছরের পরিসংখ্যানে দেখা যায়, গত ২৫ জুন ২০২২, শনিবার বেলা ২টার দিকে আশুলিয়ার চিত্রশাইল এলাকায় হাজী ইউনুস আলী স্কুল অ্যান্ড কলেজের মাঠ প্রাঙ্গণেই দশম শ্রেণীর এক শিক্ষার্থীর অতর্কিত হামলায় নিহত হন সেই বিদ্যালয়ের পৌরনীতি ও সুশাসন বিষয়ের শিক্ষক ও শৃঙ্খলা কমিটির প্রধান উৎপল কুমার সরকার।
গত ৭ জুন ২০২২ চাঁদপুরের ফরিদগঞ্জ উপজেলার বালিথুবা শামসুল ওদুদিয়া দাখিল মাদরাসার ইংরেজি বিষয়ের সহকারী শিক্ষক হযরত আলীকে মাদরাসা ম্যানেজিং কমিটির প্রথম সভায় অনিয়ম কেন্দ্র করে গুরুতরভাবে আহত করা হয়।
লক্ষ্মীপুরে ১৬ জুলাই ২০১৯ মাছিমপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ম্যানেজিং কমিটির সভাপতি মো: কামাল হোসেন প্রকাশ পিচ্চি কামালের হাতে ওই বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক আমির হোসেন লাঞ্ছিত হন।
১৮ আগস্ট ২০১৯ নওগাঁয় বিদ্যালয় সভাপতি কর্তৃক প্রধান শিক্ষক লাঞ্ছিত হন। ২৫ এপ্রিল ২০১৮ বাগেরহাটের মোল্লাহাটের শহীদ হেমায়েত উদ্দিন মাধ্যমিক বালিকা বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক আম্বিয়া জামানকে বিদ্যালয়ের সভাপতি হারুন শিকদার লাঞ্ছিত করেন। বগুড়ার নন্দীগ্রামে কোশাস উচ্চবিদ্যালয়ের ম্যানেজিং কমিটির সভাপতি শামিম হোসেনের ঘুষিতে ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক সাজ্জাদুল ইসলামের দাঁত ভেঙে যায়, গত ৭ অক্টোবর ২০২১। একজন এসিল্যান্ড করোনাকালে পিটিয়ে হাত ভেঙে দিয়েছিল একজন কলেজ প্রভাষকের। গত ৯ অক্টোবর গোপালগঞ্জে উন্নয়নের টাকায় ভাগ না দেয়ায় প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মনোজ কান্তি বিশ্বাসকে মারধর করেন উপজেলা সহকারী শিক্ষা কর্মকর্তা এবং ম্যানেজিং কমিটির সভাপতির লোকজন। এ দিকে ছাত্রদের শৃঙ্খলায় আনতে, নিয়মানুবর্তিতা শেখাতে, নৈতিকতা কমিটির রুটিনমাফিক কাজ বাস্তবায়ন করতে এবং প্রাতিষ্ঠানিক শৃঙ্খলা রক্ষা করতে ২৬ সেপ্টেম্বর ২০২১, ১৪ ছাত্রের চুল কাঁচি দিয়ে কেটে দেয়ায় সাময়িক বরখাস্ত হয়েছেন এবং চাকরি হারিয়েছেন সিরাজগঞ্জের শাহজাদপুরের রবীন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি বিভাগের চেয়ারম্যান ও বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী প্রক্টর ফারহানা ইয়াসমিন।
শিক্ষার্থীকে চড় মারায় ১০ অক্টোবর ২০২১ রাজধানীর রমনার খ্যাতনামা উইলস লিটল ফ্লাওয়ার স্কুল অ্যান্ড কলেজের সহকারী প্রধান শিক্ষক নাসির উদ্দিনকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে।

অন্য দিকে ৬ সেপ্টেম্বর লক্ষ্মীপুরে ছয় মাদরাসাছাত্রের চুল কেটে দিয়ে পুলিশের হাতে গ্রেফতার হয়েছেন হামছাদী কাজীর দিঘিরপাড় আলিম মাদরাসার সিনিয়র শিক্ষক মঞ্জুরুল কবির।
২০০৮ সালে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহারে ঘোষণা করা হয় যে, ২০২১ সালে স্বাধীনতার ৫০ বছরে বাংলাদেশ ‘ডিজিটাল বাংলাদেশে’ পরিণত হবে। সেটি হয়েছেও অনেক ক্ষেত্রে। ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর সংখ্যা ১০ লাখ থেকে ১০ কোটি হয়েছে। শিক্ষার হার এই সময় দ্বিগুণ হয়েছে। কিন্তু সাম্প্রতিক বাজেট ২০২২-২৩ থেকে স্পষ্ট হয় যে, শিক্ষকদের অর্থনৈতিক মুক্তি হয়নি এবং সামাজিক মর্যাদা প্রতিষ্ঠা হয়নি। প্রতিদিনই শিক্ষক লাঞ্ছনার খবর ভেসে আসে।
অশিক্ষিত, আধা শিক্ষিত, অযোগ্য লোকের কমিটি দিয়ে চলছে দেশের বেশির ভাগ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। অথচ দেশে স্নাতকধারী শিক্ষিত বেকারের অভাব নেই।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর সর্বশেষ প্রতিবেদন অনুযায়ী, দেশে বর্তমানে শিক্ষিত বেকারের সংখ্যা প্রায় ২৪ লাখ। কয়েক বছর আগে ইকোনমিক ইনটেলিজেন্স ইউনিটের জরিপে বলা হয়েছিল, বিশ্বে বাংলাদেশেই শিক্ষিত বেকারের হার সর্বোচ্চ। প্রতিবেদন বলছে, দেশে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর পাস করা বেকার যুবকের সংখ্যা চার লাখ ১০ হাজারের বেশি। এক দিকে স্নাতক ডিগ্রিধারী লাখো যুবক বেকারত্বের গ্লানি বহন করছে, অন্য দিকে অষ্টম শ্রেণী পাস, এসএসসি পাস প্রায় অশিক্ষিত লোকেরা এখনো শিক্ষকদের পরিচালনা করছে। এটিই কি শিক্ষাক্ষেত্রে বাংলাদেশের অর্জন? ২০১৯ সালে দেশের সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোতে ন্যূনতম শিক্ষাগত যোগ্যতা ছাড়া সভাপতি হওয়া যাবে না বলে প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়। প্রাথমিক বিদ্যালয়ে এই বিধান চালু হলো। কিন্তু সরকারি ও বেসরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের ম্যানেজিং কমিটির ন্যূনতম শিক্ষাগত যোগ্যতা নির্ধারণ করা হয়নি। এখন শোনা যাচ্ছে প্রতিষ্ঠান পরিচালনা পর্ষদের সভাপতির যোগ্যতা এসএসসি করার পরিকল্পনা করছে সরকার। শিক্ষা ক্ষেত্রে সরকারের এহেন ভুল ভাবনা আমাদের চরমভাবে ভাবিয়ে তুলছে।
পরিশেষে বলতে চাই, শিক্ষকের লাঞ্ছনা দূর করতে, ছাত্র, প্রশাসন, পুলিশ ও ম্যানেজিং কমিটির হাতে শিক্ষক নিপীড়ন বন্ধ করতে, শিক্ষার গুণগতমান নিশ্চিত করতে, শিক্ষকদের পেশার সম্মান ফিরিয়ে আনতে, অভিভাবকদের উৎকণ্ঠা দূর করতে এখনই অপরাধীদের বিরুদ্ধে আইন প্রয়োগ করে শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে। এটি আজ সময়ের দাবি। একই সাথে নৈতিকতা প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে শিক্ষকদের ওপর শাস্তি, হয়রানিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ ও শিক্ষক লাঞ্ছনা যেকোনো মূল্যে বন্ধ করতে হবে। তা না হলে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে নৈতিকতার লেশমাত্র থাকবে না এবং জাতি ক্রমেই আরো অন্ধকারের দিকেই ধাবিত হবে।
লেখক : শিক্ষক, কলামিস্ট
ই-মেল: alamferoz4525@gmail.com


আরো সংবাদ



premium cement