২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫
`

পাচারকৃত অর্থ ফিরিয়ে আনার দায়মুক্তি গ্রহণযোগ্য নয়

-

কালো টাকা সাদা করা ও দায়মুক্তি দিয়ে বিদেশে পাচারকৃত অর্থ ফিরিয়ে আনার আর্থিক, নৈতিক এবং ধর্মীয়- এই তিনটি দিক বিশ্লেষণ করে দেখব, আসলে এর উপকারিতা কী। তার আগে কালো টাকা কী এবং পাচারকৃত অর্থই বা কী সে সম্পর্কে সংক্ষিপ্ত আলোচনা করব।
ঘুষ, দুর্নীতি, লুটের মাধ্যমে অর্জিত অর্থ ও অন্যায় উপায় ব্যবহার করে সঞ্চয় করা অর্থকে কালো টাকা বলে। যদিও সরকার বলে, বৈধভাবে অর্জিত অর্থের কর না দেয়াই মূলত টাকা কালো হওয়ার কারণ। এ ধরনের অর্থের ওপর আয় ও বিক্রয় কর পরিশোধ না হওয়ায় এই অর্থ বৈধ নয়। মূলত কালো টাকা অপ্রদর্শিত থাকে, তা উপার্জনকারীর দখলে থাকে ও এগুলো উৎপাদনের উদ্দেশ্যে পুনঃবিনিয়োগ হয় না। বাংলাদেশে স্বাধীনতার পর থেকে দুর্নীতিবাজ, রাজনীতিবিদ ও আমলারা কালো টাকা উপার্জন করে আসছেন এবং এই রোগটি সমাজের সব অংশে এতটাই ছড়িয়ে পড়েছে যে, এটি বাংলাদেশকে বিশ্বের অন্যতম দুর্নীতিগ্রস্ত দেশে পরিণত করেছে।
এই লেখায় আমরা প্রথমে কালো টাকা সাদা করা ও পাচারকৃত টাকা ফিরিয়ে আনার অর্থনৈতিক দিক বিশ্লেষণ করব। কালো টাকা বা অপ্রদর্শিত অর্থ সাদা করা নিয়ে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) একটি ম্যানুয়াল তৈরি হয়েছে যা ভলান্টারি ডিসক্লোজার প্রোগ্রাম (ভিডিপি) নামে পরিচিত; অনেকে এটিকে ট্যাক্স অ্যামনেস্টিও বলে থাকেন। শুরুতে এই কর্মসূচির আওতায় দেশের মধ্যে থাকা অপ্রদর্শিত অর্থ সাদা করার সুযোগ দেয়া হতো। এখন পাচার করা অর্থ বৈধ করার সুযোগও দিচ্ছে বিভিন্ন দেশ।
উল্লেখ্য, বিশ্বে ৫০টির বেশি দেশ কালো টাকা সাদা বা অপ্রদর্শিত অর্থ বৈধ করার সুযোগ দিয়েছে। তবে বেশির ভাগ দেশ এই সুযোগ দিয়েছে অল্প কয়েকবার ও কম সময়ের জন্য। যেসব দেশ ব্যাপক প্রস্তুতি নিয়ে অর্থ বৈধ করার সুযোগ দিয়েছে, মূলত তারাই বেশি সাফল্য পেয়েছে। বাংলাদেশ এ যাবত সরাসরি ২১ বার, এ ছাড়াও ৫০ বছরের মধ্যে অন্তত ৪০ বছরই কোনো না কোনোভাবে কালো টাকা সাদা করার সুযোগ দিয়েছিল। অসংখ্যবার দেয়া হলেও যারা সুযোগ নিয়ে কালো টাকা সাদা করেনি, তাদের বিরুদ্ধে কখনোই ব্যবস্থা নেয়নি কোনো সরকার। অথচ আইএমএফ সাদা করার সীমিত ও স্বল্প সময়ের জন্য সুযোগ দিতে বলেছেন, যাতে সামনে আরো সুযোগ আসবে এই আশায় কালো টাকার মালিকরা তাদের অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড চালিয়ে যেতে না পারে। অথচ, আসছে অর্থবছরের বাজেটে এক ধাপ বাড়িয়ে বিদেশে পাচারকৃত অর্থ ফেরত আনার জন্য দায়মুক্তি ঘোষণা দেয়া হয়েছে।
অপ্রদর্শিত অর্থের স্বেচ্ছা ঘোষণা নিয়ে ৩৮টি দেশের সংস্থা অর্গানাইজেশন ফর ইকোনমিক কো-অপারেশন অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (ওইসিডি) তাদের ‘ভলান্টারি ডিসক্লোজার প্রোগ্রাম’ এ জাতীয় কর্মসূচি বারবার না দেয়া ও কম সময়ের মধ্য দিয়েই কঠোরভাবে আইনের প্রয়োগ করার কথা বলেছে।


আইএমএফের প্রতিবেদন অনুযায়ী অপ্রদর্শিত অর্থ সাদা করার সুযোগ দানকারী ২০টি দেশের মধ্যে নেদারল্যান্ডস সর্বোচ্চ পাঁচবার ও অন্যরা এক থেকে সর্বোচ্চ তিনবার সুযোগ দিয়েছে। তবে, ইন্দোনেশিয়ার পাদজাদজারান ইউনিভার্সিটির চার শিক্ষকের গবেষণায় দেখানো হয়েছে, এশিয়ার ৯টি দেশের মধ্যে সবচেয়ে বেশি সুযোগ দিয়েছে বাংলাদেশ, ২১ বার। এর পরই ভারত ও শ্রীলঙ্কা ১১ বার, ফিলিপাইন ১০ বার ও ইন্দোনেশিয়া চারবার। ভারত ১১ বার এই সুযোগ দিলেও এর পাঁচবারই দেয়া হয়েছে পঞ্চাশ ও ষাটের দশকে, সত্তর ও আশির দশকে দেয়া হয় আরো তিনবার। কোনোবারই সাফল্য পায়নি ভারত। অপ্রদর্শিত অর্থ সাদা করার ক্ষেত্রে অন্যতম সফল দেশ হিসেবে ইন্দোনেশিয়ার কথা বলা হয়।
আগেই বলেছি, বাংলাদেশ ঘোষণা দিয়ে কালো টাকা সাদা করার সুযোগ দিয়েছে ২১ বার, যার মধ্যে এই সুযোগ গ্রহণ না করলে কঠোর ব্যবস্থা নেয়ার হুমকি ছিল মাত্র দু’বার। প্রথমবার ১৯৭৬ সালে, সামরিক শাসনের সময়ে। পরের বার ২০০৭ সালে, সেনা-সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময়। দু’বার হুমকি দেয়া হলেও ২০০৭ সালেই কেবল উল্লেøখযোগ্য পরিমাণে অর্থ সাদা হয়েছিল। তবে সুযোগ না নেয়ায় কখনোই কালো টাকার মালিকদের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নেয়নি কোনো সরকার, বরং নতুন করে আবার সুযোগ দিয়েছে। ফলে সবচেয়ে বেশি সুযোগ দেয়া সত্ত্বেও কার্যত এটি বাংলাদেশের জন্য ব্যর্থ কর্মসূচি হিসেবেই রয়ে গেছে। স্বাধীনতার পর এখন পর্যন্ত ৫০ বছরে কালো টাকা মাত্র ৪৫ হাজার ৫২২ কোটি ৮৩ লাখ টাকা। আর এ থেকে সরকার রাজস্ব পেয়েছে মাত্র চার হাজার ৬৪১ কোটি ৩৪ লাখ টাকা। তবে সেনা-সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় ও কোভিডের এক অর্থবছর বাদ দিলে সাদা হয়েছে মাত্র ১৫ হাজার ২৩৯ কোটি ৮৪ লাখ টাকা, এতে সরকার রাজস্ব পেয়েছে মাত্র এক হাজার ৬৬৬ কোটি ৩৪ লাখ টাকা।
অস্ট্রিয়ার অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক ফ্রেডারিক স্নাইডার, বিশ্ব ব্যাংক, ইন্টারন্যাশনাল ফাইন্যান্স করপোরেশন (আইএফসি) ও আইএমএফের সমীক্ষা অনুযায়ী, বাংলাদেশে ২৭ বছরের কালো টাকার গড় হার মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) ৩৩ দশমিক ১ শতাংশ। টাকার অঙ্কে তা ১০ লাখ পাঁচ হাজার ৯৯৯ কোটি ৩৬ লাখ টাকা। নতুন ২০২২-২৩ অর্থবছরের জন্য অর্থমন্ত্রী ছয় লাখ ৭৮ হাজার ৬৪ কোটি টাকার বাজেট দিয়েছেন। সুতরাং দেখা যাচ্ছে, দেশে কালো টাকার পরিমাণ দেড় বছরের বেশি বাজেটের সমান। আর সে তুলনায় সাদা হয়েছে অতি সামান্য অর্থ।
বাংলাদেশ ২০২২-২৩ অর্থবছরের বাজেটে প্রথমবারের মতো, পাচার করা অর্থ বৈধ করার সুযোগ দিয়েছে ইন্দোনেশিয়ার উদাহরণ টেনে। উল্লেøখ্য, ইন্দোনেশিয়া ২০১৬ সালের জুন থেকে ২০১৭ সালের মার্চ পর্যন্ত সময়ে অপ্রদর্শিত সম্পদ ঘোষণা দিয়ে বৈধ করার সুযোগ দিয়ে ৩৪ হাজার ৮০০ কোটি ডলারের সমান সম্পদ বৈধ করতে পেরেছিল যা দেশটির জিডিপির ৪০ শতাংশ। তবে পাচার হওয়া তেমন কোনো সম্পদ ফেরত আসেনি। গ্রিস ২০১৬ সালে একই ধরনের সুযোগ দিয়ে সফল হয়েছিল মূলত তারা দেশব্যাপী ব্যাপক প্রচার চালিয়ে, আর সুযোগ না দেয়ার কথা বলে এবং সুযোগ না নিলে কঠোর ব্যবস্থা নেয়ার ঘোষণা দিয়ে। গ্রিস তারও প্রমাণ দিয়েছিল।
বাংলাদেশ কোনো প্রস্তুতি, পূর্বশর্ত, শাস্তির বিধান না রেখে বছরের পর বছর সুযোগ দেয় বলে কালো টাকা খুব বেশি সাদা হয় না। অর্থাৎ অর্থনৈতিকভাবে কালো টাকা সাদা করার প্রচেষ্টা মোটেই সফল নয়।
এখন আসি কালো টাকা সাদা করার নৈতিক দিক বর্ণনায়। ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) মতে, ২০২২-২৩ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটের আয়কর অধ্যাদেশে বিনা প্রশ্নে বিদেশে পাচার করা অর্থ দেশে আনার নতুন বিধান সংযোজনের সিদ্ধান্ত অভূতপূর্ব অনৈতিক ও বৈষম্যমূলক। তারা সরকারের এই সিদ্ধান্তকে সম্পূর্ণরূপে অসাংবিধানিক, সংশ্লিষ্ট আইনের সাথে সাংঘর্ষিক ও বৈষম্যমূলক এবং অর্থপাচারের মতো ঘৃণিত অপরাধের রাষ্ট্রীয় সুরক্ষার নামান্তর বলেছে। এমনকি এই প্রস্তাবটি বাতিলের আহ্বানও জানিয়েছে টিআইবি।
অর্থপাচার রোধ আইন ২০১২ এবং সংশ্লিষ্ট আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী অর্থপাচার গুরুতর অপরাধ। দেশের আইন অনুযায়ী যার শাস্তি পাচারকৃত অর্থ বাজেয়াপ্ত করা ও তার দ্বিগুণ জরিমানা এবং ১২ বছর পর্যন্ত কারাদণ্ড নির্ধারিত রয়েছে। সুতরাং, এই পাচারকৃত অর্থ ফিরিয়ে আনার সুযোগ সংবিধান পরিপন্থী ও প্রধানমন্ত্রীর ‘দুর্নীতির বিরুদ্ধে শূন্য সহনশীলতা’ ঘোষণার জন্য অবমাননাকর। অন্যদিকে, বৈধ উপার্জননির্ভর করদাতাদের জন্য এই প্রস্তাব প্রকটভাবে বৈষম্যমূলক, কারণ তারা ৭ শতাংশের কমপক্ষে তিনগুণ হারে কর দিয়ে থাকেন। এই ঘোষণা একদিকে পাচার হওয়া অর্থ ফেরত আনার সুযোগ দিয়ে পাচার করাকে উৎসাহিত করা, অন্যদিকে বিশ্বব্যাপী পাচারকারীদের অর্থ ফ্রিজ হওয়ার আশঙ্কায় পাচারকারীকে সুরক্ষা দেয়া হয়। পাচারকারীদের আইনের আওতায় কঠোর শাস্তি নিশ্চিত করা ছাড়া কোনোভাবেই কোনো বিকল্প নেই। কারণ যারা অর্থ পাচার করেছেন তারা এ ধরনের প্রণোদনায় উৎসাহিত হয়ে পাচারকৃত অর্থ ফেরত নিয়ে আসবেন, এরকম দিবাস্বপ্নের কোনো ভিত্তি নেই।


একদিকে মানুষ সৎপথে আয় করতে যুদ্ধ করছে, অন্যদিকে লুটপাট করে যারা টাকা বিদেশে পাঠিয়েছে, তারা সামান্য কিছু কর দিয়ে টাকা ফিরিয়ে আনবে। দেখা যাবে, চোরেরা হয়ে যাবে শ্রেষ্ঠ করদাতা। যারা বিদেশে টাকা পাচার করেছে, তারা যদি সৎ হতো তাহলে টাকা দেশেই রাখত। চোর ‘ধর্মের কথা শোনে না’, এটি মাথায় রাখা উচিত।
এখন আমরা দেখব এ বিষয়ে ইসলাম কী বলে। ইসলাম মানুষের আমানত রক্ষার প্রতি যেমন গুরুত্ব দিয়েছে তেমনি যে আমানত রক্ষা করে না, মানুষের সাথে প্রতারণা করে, অপরের হক আত্মসাৎ করে, তার জন্য ঘোষণা করা হয়েছে মারাত্মক ও কঠিন শাস্তি।
প্রিয় নবী সা: ছোটবেলা থেকেই আমানতদার ছিলেন। ইহুদি আর খ্রিষ্টানসহ সব মতবাদের লোকই তাকে বিশ্বাস করত ও তার কাছে অতি মূল্যবান আসবাবপত্র গচ্ছিত রাখত। নবীজীর এমন বিশ্বস্ততার কারণেই সবাই তাকে আল-আমিন বলে ডাকত। মোমিন বান্দার অন্যতম বৈশিষ্ট্যই হলো সে বিশ্বস্ত ও আমানতদার হবে। নবী-রাসূলরা যেমন এগুণে গুণান্বিত ছিলেন, তেমনি ছিলেন তাঁর সাহাবিরাও।
পবিত্র কোরআনে সূরা আন-নিসা, আয়াত-৫৮, সূরা আল-বাকারা, আয়াত-১৮৮, সূরা আল-মুমিনুন, আয়াত-৮ সহ অনেক আয়াতে বারবার নির্দেশনা দেয়া হয়েছে আমানত রক্ষার প্রতি। আল্লাহ তায়ালা বলেন, তোমরা নিজেদের মধ্যে একে অন্যের অর্থ-সম্পদ অন্যায়ভাবে গ্রাস করো না এবং ধন-সম্পদের কিয়দংশ জেনে-শুনে অন্যায়ভাবে গ্রাস করার উদ্দেশ্যে তা বিচারকের কাছে পেশ করো না।
এ বিষয়ে অগণিত হাদিসও রয়েছে যেমন- ‘যে ব্যক্তি তোমার কাছে আমানত রেখেছে, তার আমানত তাকে ফেরত দাও। আর যে ব্যক্তি তোমার আমানত আত্মসাৎ করে, তুমি তার আমানত আত্মসাৎ করো না।’ আল্লাহর রাসূল সা: বলেছেন, ‘যার চরিত্রে আমানতদারি নেই, তার ঈমান নেই। আর যে অঙ্গীকার রক্ষা করে না তার দ্বীন নেই।’ (মুসনাদে আহমাদ)
রাষ্ট্রীয় দায়িত্বও একটি আমানত। এরও যথাযথ হিফাজত করতে হবে। মানুষের প্রাপ্য মানুষের কাছে পৌঁছে দিতে হবে। এখানে খেয়ানত করলেও আল্লাহ তায়ালার কঠিন আজাবে পাকড়াও হতে হবে। সাহাবায়ে কেরাম আমাদের আদর্শ; সত্যের মাপকাঠি। আমাদের উচিত, তাদের আদর্শে আদর্শবান হওয়া। জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে তাদের অনুসরণ ও অনুকরণ করা। তাহলেই সম্ভব সুন্দর, সুশৃঙ্খল ও শান্তির একটি সমাজ বিনির্মাণ করা।
আলোচনা থেকে পরিষ্কার যে, কালো টাকা সাদা করা ও বিদেশে পাচার করা টাকা ফিরিয়ে আনার যে পদ্ধতি বাজেটে ঘোষণা করা হয়েছে তা অর্থনৈতিকভাবে যেমন সফল নয় তেমনি নৈতিক নয়; এমনকি আইনত গ্রহণযোগ্য নয়। ধর্মীয় মানদণ্ডে বৈধ তো নয়ই বরং পরকালে কঠিন শাস্তি ও দুনিয়াতে রয়েছে লাঞ্ছনা। সুতরাং যেকোনোভাবে সরকারকে এই সিদ্ধান্ত থেকে ফিরে আসতে হবে, এমনকি পাচারকারীদের শাস্তির আওতায় আনতে হবে।
লেখক : অর্থনীতিবিদ ও গবেষক
ই-মেইল : mizan12bd@gmail.com

 

 


আরো সংবাদ



premium cement