২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫
`

বাঙালির নয়ন বাঙালি খোঁজে

-

‘বিদেশে বাঙালি সজ্জন’, বহুল প্রচলিত এ উক্তির প্রমাণ দেশের বাইরে না গেলে টের পাওয়া যাবে না। ১০ এপ্রিল ২০২২। টার্কিশ এয়ারে লন্ডনের যাত্রী হই। নির্ধারিত সময়ের অনেক আগেই বিমানবন্দর পৌঁছে যাই। কারণ ইস্তাম্বুল চার ঘণ্টা ট্রানজিট। ইস্তাম্বুল বড় বন্দর, বড় বন্দরে থাকে শতাধিক গেট। কোনো কোনো গেটে পৌঁছাতে ডান-বামে হাঁটা ছাড়াও চলাসহ উপরে-নিচে ওঠানামায় রয়েছে এস্কেলেটর ও লিফট। গেট নম্বর জানানো হয় বিমান উড্ডয়নের কিছুক্ষণ আগে, যাত্রীকে কখনো কখনো গোলকধাঁধায় পড়তে হয়। এ অবস্থায় মাথা এলোমেলো হয়ে যাওয়াসহ গোলকধাঁধা আমার নিত্যসঙ্গী। তাই সাহায্যের জন্য সহযাত্রী খুঁজছিলাম। বাঙালি বাঙালি চেহারা দেখলেই জানতে চাইতাম, লন্ডনের যাত্রী কি না। কারো উত্তর শুনে মনে হয়েছিল, বাংলায় প্রশ্ন করাটাই যেন দোষের। তারা যেন ভিন্নগ্রহের লোক। বাংলায় কথা বলাসহ পরিচয়টাই প্রকাশ করতে চান না অনেকে। বিদেশে পৌঁছালেই পাল্টে যায় এ অহমিকা। আদর-আপ্যায়নসহ পথে বের হলেই বাঙালির নয়ন বাঙালি খোঁজে; শ্রবণেন্দ্রিয় উদগ্রীব হয়ে পড়ে বাংলা শব্দ শুনতে। বিদেশে এরকম অসংখ্য ঘটনার মধ্যে কয়েকটি স্মরণযোগ্য।


দেশে আসার আগের দিন গিয়েছিলাম বাঙালি শপে। বাসার কাছেই ৪১-৪৩ হাই রোড চাডওয়েল হেয়াথ। দোকানের নাম ‘বাংলা বাজার’। দূর থেকেই বাংলায় লেখা ‘দেশী তাজা শাকসবজি এবং মাছ-মাংসের বাজার’ শব্দ ক’টির ওপর নজর পড়ে। আমার পরিচয় পেয়েই মালিক করমর্দনের জন্য সহাস্যে বাড়িয়ে দেন হাত, মেলে ধরেন পানের বাটা। সিলেটের মাসুম চৌধুরী করমর্দন করতে করতে বলেন, ‘দেশ থেকে কেউ এলে প্রথমেই আপ্যায়ন করি পান দিয়ে’।
১৮ মে। এক ব্যক্তি বাসায় প্রবেশ করেন। বয়স অনুমান করা কঠিন। আমাকে একটি হাতঘড়ি উপহার দিতে চান। কারণ জানতে চাইলেই বলেন, আমার লেখা পড়তে তার ভালো লাগে। বিস্মিত হয়ে প্রশ্ন করি-
-কোথায় পড়েছেন আমার লেখা?
-আমার পরিবার নয়া দিগন্ত পত্রিকা পড়ে। অনলাইনে আমিও পড়ি নয়া দিগন্ত। ‘বই পড়ার কেউ থাকবে না’ লেখাটি পড়ে অনেক কষ্ট পেয়েছি। আপনার ‘বিলেতের পথে পথে’ গ্রন্থে ঘড়ির গল্পটিও পড়েছিলাম। ঘড়ি নিয়ে আপনার সমস্যার অন্ত ছিল না। যখন জানতে পারলাম, আপনি লন্ডন এসেছেন তখনই ঠিক করেছি, আপনাকে একটা ঘড়ি দেবো, হাতঘড়ি। শর্ত, আমার নাম-পরিচয় গোপন রাখবেন।
এরকম আবদারে বলেছিলাম, “তুমি একজন বুদ্ধিমান ও অদ্ভুত মানুষ। ‘বুদ্ধিমান’ এ কারণে যে, দিনে কমসে কম সাত-আটবার সময় দেখতে হয়। যতবার সময় দেখব, ততবারই তোমার ছবি আমার মনের ক্যামেরায় ভাসবে। অদ্ভুত এ কারণে যে, মানুষ নিজকে প্রকাশ করতে কত রকম ফন্দি-ফিকির করে। আর তমি নিজকে গোপন রাখাতে আমাকে অনুরোধ করছো।”


১৬ মে এক মেয়ের বাসায় দাওয়াত খেয়েছি। মেয়েটির ফেসবুক আঙ্কেল আমি। আমাকে বাবার মতো শ্রদ্ধা-সম্মান করতে দেখে লিখেছিলাম, ‘লন্ডন এসে আরো একজন মেয়ে পেয়ে গেলাম। সাথে দুই নাতনীসহ সুন্দর একজন জামাই। সবার ঘরে যেন তোমার মতো মেয়ে হয়।’ মেয়েটি লন্ডন আসার পরপরই তার বাসায় নিতে চেয়েছিল। আমার পছন্দের খাবার আগেই তার জানা ছিল। বাদ পড়েনি গুঁড়ো মাছের চড়চড়িসহ বাংলাদেশের নরম মাছের মর্জলাও। ভর্তা, করলা, টক, ইলিশ পটোল, শুঁটকি, সবজিসহ নাম না জানা আরো তিন-চার প্রকারের ব্যঞ্জন। চামচের মাথায় নিয়ে সব সবজির স্বাদ চেখে দেখতে দেখতেই আমার ভোজনপর্ব শেষ। ড্রইংরুমে বসতে না বসতেই ফল। কেটে নিয়ে আসে পাকা আম। ছোট ছেলের মতো নিজ হাতে মুখে তুলে খাওয়ায়। চা-পর্ব শেষে দেখাতে নিয়ে যায় টেমস নদীর পাড়ে সিটি এয়ারপোর্ট। যতক্ষণ বেলা ছিল ততক্ষণ নদীর পাড়ে দাঁড়িয়ে বিমানের ওঠানামার দৃশ্য দেখেছি। আসার পথে জোর করে পকেটে ঢুকিয়ে দেয় একটি খাম। আমার পাশে দুই মেয়েকে বসিয়ে বলে-
-কাকা, আমার দুই মেয়ে ও এক ছেলে।
-দুই মেয়ে দেখছি, ছেলেকে তো দেখছি না?
-ছেলে আমেরিকা।
-আমেরিকা! কী করে তোমার ছেলে?
-ছেলে আপনার বন্ধু, নাম সৈয়দ আবদুল মতিন (বীর মুক্তিযোদ্ধা)
পলকে মনে পড়ে গেল শৈশব স্মৃতি। মতিন ভাই আমার এক ক্লাস সিনিয়র। দু’জনের জন্ম অনুন্নত ও অবহেলিত পাড়াগাঁয়ে। দেশের মূল ভূখণ্ড থেকে মেঘনা ও এর শাখা-প্রশাখা দিয়ে গঠিত বিচ্ছিন্ন পাড়াগাঁয়ে সরকারি উন্নয়নের ছিটেফোঁটাও লাগেনি। তখন মতিন ভাই সভাপতি ও আমি সাধারণ সম্পাদক হয়ে ‘চন্দনপুর ইউনিয়ন সমাজকল্যাণ সংস্থা’ গঠন করেছিলাম। এলাকার উন্নয়নে পত্রপত্রিকায় অনেক লেখালেখিও করেছি। মুক্তিযুদ্ধে যাওয়ার পর পরিচয় আরো বেড়ে যায়। মতিন ভাইয়ের ছেলে নেই, সব মেয়ে। এক মেয়ের সাথে বর্তমানে আমেরিকা থাকেন। দেশে এলে মাঝে মধ্যে দেখা হয়। ২০২১ সালে স্থানীয় টেলিভিশনের এক টকশোতে আমার প্রতিপক্ষ ছিলেন মতিন ভাই। আলোচনাকালে প্রতিপক্ষ না থেকে দু’জন এক হয়ে গিয়েছিলাম।


সাউথ অ্যান্ড অন সি লন্ডন দেখতে গিয়ে সাগর থেকে বড়শি দিয়ে মাছ ধরতে দেখেছি। আমারও ইচ্ছা হয়েছিল। হেনার (বড় মেয়ে) বান্ধবী রফিকা বেগম। বাড়ি সিলেট। রফিকাদের বাসায় ছিপ আছে। ১৩ মে রিচমন্ড পার্ক থেকে ফেরার পথে রফিকা বেগমের বাসায় উঠেছিল। আমার বিষয় হেনার কাছে আগেই শুনেছিল। বাসায় প্রবেশ করতে না করতেই ডাক পড়ে ডাইনিং টেবিলে। ডাইনিং ভর্তি সব আমার পছন্দের খাবার। আসার পথে পকেটে একটি পারসেল।
ফ্রান্সে স্মরণীয় ছিল মাটির চুলায় রান্না। ফ্রান্সের বাঙালি সম্প্রদায় মাঝে মধ্যেই এই আয়োজন করে থাকে। আয়োজনে আপ্যায়িত আমিও। অনুষ্ঠানের প্রধান আকর্ষণ- ১. মাটির চুলায় লাকড়ির আগুনে রান্না; ২. চাটগাঁয়ের মেজবানির আদলে গরুর গোশত; ৩. সবুজ প্রকৃতি জঙ্গলের পাশে কোলাহলমুক্ত গাছতলায় খানাপিনা; ৪. পাশের জঙ্গল থেকে মুফতে পাওয়া লাকড়ি; ৫. গোশত ছাড়াও যার যার বাড়ি থেকে নিজের ইচ্ছামতো রান্না (যেকোনো এক প্রকার); ৬. শিশুদের খেলাধুলার সুব্যবস্থা; ৭. খাওয়া, যার যত মন চায়; ৮. স্বাদ, এক কথায় কালের কবলে হারিয়ে যাওয়া গ্রামবাংলার মেজবানির স্বাদ যেন প্যারিসের জঙ্গলে এসে খুঁজে পেয়েছি। প্রমাণস্বরূপ, আমি গরুর গোশত সামান্য খাই- তার পরও সে দিন আমার প্লেটে যা দিয়েছিল চেটেপুটে সব খেয়েছি। মেহমান হিসেবে আমাকে পেয়ে সবাই খুশি। মনে হয়েছিল, বৃহত্তর ফ্রান্সের ভেতর ক্ষুদ্র এক বাংলাদেশ।
আমি যখন সুইডেন তখন রমজান মাস। ১৮ ঘণ্টা রোজা। ভ্যাক্সজোতে বাঙালি পরিবার কম। যে ক’টি পরিবার সবাই সবার পরিচিত। প্রায় প্রতিদিনই ইফতারের দাওয়াত। শরিক হতে না পারলে ইফতার বাসায় নিয়ে আসে। ২৫ রমজান ইফতার নিয়ে আসেন নাবিল। টাঙ্গাইলের ছেলে নাবিল। সুন্দর বক্সে করে সেমাই, পায়েশ, মোরগ পোলাও, ছোলা, শিক কাবাবসহ ঘরে বানানো মিষ্টি। সব ইফতার ঘরে বানানো। দুই দিন পর অনুরূপ ইফতার পার্টি ছিল মল্লিকার। অনেকের ইফতার বাসায় বাসায় পৌঁছে দিয়েছিল। বিশিষ্ট ব্যক্তির মধ্যে মল্লিকার ইফতার অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন খোকন ভাই।


ঈদের দাওয়াত সাইফুল্লাহ-জান্নাত পরিবারে। সাইফুল্লাহ-জান্নাত বরিশালের লোক। সেখানে গিয়েও পাই ‘খোকন ভাইকে’। ভ্যাক্সজোর বাঙালি সম্প্রদায়ের সুপরিচিত খোকন ভাই মুন্সীগঞ্জের লোক। এখানে বাঙালি পরিবার ছাড়া বাঙালির দর্শন দুষ্কর। কান পেতে রাখলেও কানে আসে না বাংলা শব্দ। একবার বাসে বাংলায় কথোপকথন কানে আসে। পুলকিত মনে তাকাতেই দেখি, দুই বাঙালি যুবক। ভ্যাক্সজোর শপিং কমপ্লেক্স এলাকায় যেতেই নামতে শুরু করে যুবকদ্বয়। আমরাও (আমি ও মল্লিকা) নামী। কাছে গিয়ে, ‘তোমরা বাংলাদেশী?’ ‘জি, আমরা বাংলাদেশী’, পরিচয়পর্ব শেষ হওয়ার আগেই একজন দৌড় দেয়, অপরজন ফোন নম্বর দিয়ে দ্রুত অনুসরণ করে প্রথমজনকে। কারণ জানতে চাইলে মল্লিকার কাছে জানতে পারি, ‘দুইজনই এই শপিং কমপ্লেক্সে জব করে’। জবের খরচ দিয়ে লেখাপড়া করে। এখানে গণপরিবহন থেকে শুরু করে সব কিছু চলে ঘড়ির কাঁটা ধরে। এখনই হয়তো তাদের কাজে যোগদানের সময়, তাই দৌড় দিয়েছে। সাইফুল্লাহ-জান্নাত পরিবারের দাওয়াতে উপস্থিত পাই ওই দুই বাঙালি যুবককেও। সেখানে খাবারের সাথে ছিল অবাঙালি খাবারও। ডাইনিং টেবিল ভর্তি খাবারে। যার মধ্যে পোলাও, রোস্ট, মোরগ-ডাল, গরুর গোশত, সেমাই, মালাই চপ, ফুচকা, কাবাব, কোক, ডিমভুনা, বাকলাভা (অ্যারাবিয়ান ডেসার্টা)। এত লোকের এত আয়োজন; নিশ্চয়ই বাবুর্চি ভাড়া করতে হয়েছে। অসাধারণ স্বাদ খাবারের। বাবুর্চির খোঁজ নিতে গিয়ে জানা গেল, সব খাবারই ঘরে তৈরি- সাইফুল্লাহ-জান্নাত পরিবারের নিজেদের হাতের রান্না। সেখানেই পরিচয় হয় খোকন ভাইয়ের সাথে। পূর্ণাঙ্গ পরিচয় শেখ আলী আহমেদ, সিনিয়র লেকচারার, ডিপার্টমেন্ট অব ফরেস্ট্রি অ্যান্ড উড টেকনলোজি, লিনায়াস ইউনিভার্সিটি। শেখ আলী আহমেদ নিরহঙ্কার সাদাসিধা একজন মানুষ। পদ-পদবির অহঙ্কারের লেশমাত্র নেই। আমার ভিজিটিং কার্ডের দিকে তাকিয়ে-
-আমি নয়া দিগন্ত পত্রিকায় আপনার ছবি দেখেছি। আপনার লেখাও পড়ি। নয়া দিগন্ত পত্রিকায় প্রকাশিত ভ্রমণ কাহিনী ‘সেকালের বিমান ভ্রমণ’ আমি পড়েছি।
-আপনারা হাজার হাজার মাইল দূরে বসে বাংলাদেশের পত্রিকা পড়েন শুনে খুশি লাগছে। খুশি লাগছে বাঙালি সম্প্রদায়ের মিল-মহব্বত, সুখ-স্বস্তি, হাসি-খুশি ও ভ্রাতৃত্ববন্ধন দেখে। আপনারা বিশ্বের হাসিখুশি দেশে আছেন। এখান থেকে হাসিখুশির বীজ নিয়ে রোপণ করবেন নিজের দেশের মাটিতে, এর বদলে কেউ যেন আবার নিজের দেশের দলাদলির বীজ এনে এ দেশের মাটিতে রোপণ না করেন।
-নিজের দেশের দলাদলির বীজ মানে? মানে- বিদেশে বাঙালি মানেই সজ্জন, এ কথা যেমন সত্যি, তেমনি বাঙালি বিদেশে গিয়েও দলাদলি ভুলতে পারে না, সেটিও সত্যি।’
লেখক : আইনজীবী ও কথাসাহিত্যিক
E-mail : adv.zainulabedin@gmail.com

 


আরো সংবাদ



premium cement