২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫
`

আসছে বাজেট, বৈশাখী ঝড়

-

মনে কোনো স্বস্তি নেই। কেন নেই সবাই জানেন। দ্রব্যমূল্য লাগামছাড়া। সেই লাগাম টেনে ধরার সঠিক পদক্ষেপ কোন পথে হবে, সেটা যেন রাষ্ট্র পরিচালকরা বুঝতেই পারছেন না। নাকি তারা ইচ্ছে করেই লাগামটা টেনে না ধরে যারা এর সুবিধাভোগী, তাদের স্বার্থ রক্ষা করছেন? আর যারা ভুক্তভোগী, তাদের নীরব কান্না দেখতে পাচ্ছেন না চোখে রঙিন চশমা থাকায়! সুনামগঞ্জ ও সিলেটের হাওরাঞ্চলের বোরো ধান নষ্ট হয়ে গেছে উজানের ঢলে। বাঁধ ভেঙে হাওরে ঢলের পানি ঢুকে পড়ায় কোটি কোটি টাকার ধান নষ্ট হয়েছে। সরকারের নেতৃস্থানীয় মানুষেরা এই ক্ষতিকে বলেছেন সামান্য ক্ষতি। রবীন্দ্রনাথের সামান্য ক্ষতি কবিতার মতোই যেন। এই সামান্য ক্ষতির পরিমাণ মাত্র এক হাজার ১৮০ কোটি টাকারও বেশি। কারো কারো মতে, বোরোর ৬৫ শতাংশ কৃষক তুলেছেন। তার পরিমাণ নাকি এক কোটি ২৫ লাখ টন। একজন বোরোচাষি যখন নিঃস্ব হয়ে যান প্রাকৃতিক ঢলে, তখন তার সামান্য ক্ষতি যে তার গলা পর্যন্ত ডুবে যাওয়া সেটা বিত্তবান নীতিনির্ধারকরা উপলব্ধি করতে পারবেন না। তারা দেশ চালান বলে, তাদের চিন্তাভাবনার বিষয়গুলো গোটা দেশ নিয়ে। সামান্য ক্ষতির কৃষক নিয়ে, তাদের অসহায়ত্ব নিয়ে, তাদের সঙ্কট নিয়ে ভাববার সময় নীতিনির্ধারকদের নেই। তারা জাতির উন্নয়নের রশি ধরে আছেন, মুদ্রাস্ফীতি আর নানামুখী আন্তর্জাতিক সঙ্কটের চাপে তাদের এমনিতেই দিশেহারা অবস্থা। সেখানে কৃষকের সামান্য ক্ষতির পেছনে (বিত্তবানরা বলেন কৃষি নাকি জিডিপিতে মাত্র ১৫ শতাংশ অবদান রাখে। হাসব না কাঁদব বুঝতে পারছি না) ব্যয় করার মতো সময় নেই তাদের। তারা এখন আলোচনায় বসেছেন কি করে বৈদেশিক মুদ্রা দেশে আনা যায় সেই আলোচনায়।

২.
কেবল দ্রব্যমূল্যই লাগামছাড়া হয়ে ছুটছে না, তার সাথে পাল্লা দিচ্ছে বৈদেশিক মুদ্রার দামও। ডলারের ব্যাংক-রেট বহুদিন ধরেই ৮৫.৬৫ বা ততধিক চলছিল। ইউক্রেনে রাশিয়ার বিশেষ অভিযানের পর থেকেই দামের লাগামটি হাতছাড়া হয়ে উপরের দিকে ছুটছে। সরকারের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ যথেষ্ট পূর্ণ এমনটাই দাবি করে আসছিলেন মন্ত্রী-রাজনীতিকরা। কিন্তু অর্থনীতিবিদরা এখন বলছেন, সরকারের আমদানি ব্যয় যে হারে বেড়েছে, (প্রায় ১০ হাজার কোটি টাকা) উন্নয়ন ব্যয়ের চাপে তার অবস্থার নাকাল হওয়ার জোগাড়। তারা বলছেন, যে পরিমাণ রিজার্ভ আছে তাতে পাঁচ মাসের আমদানি ব্যয় সামলানো যাবে। তার পর কী হবে?
কি করবেন, তার একটি উঁকি-পথ দেখালেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। তিনি সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে বললেন, মার্কিন ডলারের সঙ্কটের কারণেই দেশ থেকে বিদেশে পাচার হওয়া অর্থ ফিরিয়ে আনার উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে।
১৯ মের তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ চার হাজার ২৩০ কোটি ডলার। অথচ ৯ মাস আগেও তা ছিল চার হাজার ৮১০ কোটি ডলার। ডলার সাশ্রয় করতে অত্যাবশ্যকীয় নয় এমন ১৩৫টি পণ্য আমদানি নিরুৎসাহিত করতে গত সোমবার নিয়ন্ত্রণমূলক শুল্ক কয়েকগুণ বাড়িয়ে প্রজ্ঞাপন জারি করেছে সরকার। তার আগে সরকারি কর্মকর্তা, ব্যাংক কর্মকর্তা, স্বায়ত্তশাসিত সংস্থার কর্মকর্তাদের বিদেশ সফরের ওপর সাময়িক নিষেধাজ্ঞাও আরোপ করা হয়েছে । (প্রথম আলো, ২৬ মে, ২০২২)


নিউজের এইটুকু পড়লেই বোঝা যায় ডলার সঙ্কট কতটা হলে অর্থমন্ত্রী পাচার হয়ে যাওয়া টাকা ফেরতের উদ্যোগ নিচ্ছেন। কানাডার টরন্টোর বেগমপাড়া আমেরিকার বিভিন্ন স্টেটে লুকিয়ে থাকা লুটেরা সম্প্রদায়ের সদস্যরা, ইংল্যান্ড, মালয়েশিয়া এবং ভারতে পি কে হালদার গংদের পাচার হয়ে যাওয়া টাকা উদ্ধার করে আনতে অচিরেই সরকারের তরফে ঘোষণা আসছে। এতদিন যত মন্ত্রী মহোদয় তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিচ্ছিলেন ডলার সঙ্কটের বিষয়টি, তাদের চোখে ধূলি মেরে দিয়েছে অর্থমন্ত্রীর এই বক্তব্য। রেমিট্যান্স কমে যাওয়া ও ঋণাত্মক রফতানি আয় সরকারের হার্টবিট বাড়াচ্ছিল, তারই প্রকাশ্য ধ্বনি শোনা গেল অর্থমন্ত্রীর মুখে। আর সেই সাথে আমদানি নিয়ন্ত্রণের কিছু পদক্ষেপ। সরকারের এ ধরনের উদ্বেগাক্রান্ত পদক্ষেপকে সাধুবাদ জানাই এ কারণে যে, তারা এই ব্যবস্থাটি নিচ্ছেন বা নিয়েছেন জনগণপ্রীতি ও অর্থনৈতিক ধস ঠেকানোর চিন্তা থেকে।
কিন্তু আরেকটি বিষয়ে আমরা খুবই শঙ্কার চিত্র দেখা পাচ্ছি। ২০২২-২৩ অর্থবছরের বাজেট ঘোষণা করতে যাচ্ছেন অর্থমন্ত্রী, সেখানেই প্রকাশ্যে লুকিয়ে আছে সরকারের নীতি ও আদর্শ।
বাজেটে ব্যয় যা করার তো করতেই হবে। যেমন সরকারি কর্মচারীদের বেতন-ভাতা দিতেই হবে। তাদের জন্য ব্যয় হবে প্রায় ৭৭ হাজার কোটি টাকা। এ যাবত দেশী-বিদেশী যত ঋণ নেয়া হয়েছে, তার বিপরীতে সুদ পরিশোধ করতে হবে ৮০ হাজার কোটি টাকা। বিদ্যুৎ, সার ও রফতানি ভর্তুকি, প্রণোদনা এবং নগদ ঋণের হাত ধরে ব্যয় হবে আরো পৌনে দুই লাখ কোটি টাকা।
আগামী অর্থবছরটি চালাতে সরকার এ ছাড়া ঋণ নেবে এবার বেশি। তা-ও প্রায় আড়াই লাখ কোটি টাকা। আর সরকার আশা করছে, আগামী অর্থবছরে মোট রাজস্ব পাওয়া যাবে চার লাখ ৩৩ হাজার কোটি টাকা, যার মধ্যে এনবিআরের দায়িত্ব থাকবে তিন লাখ ৭০ হাজার কোটি টাকা সংগ্রহের। চলতি অর্থবছরে এনবিআরের লক্ষ্য ছিল তিন লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকা সংগ্রহ করার। গত ৯ মাসে সংগ্রহের প্রবণতা বিবেচনায় নিয়ে এনবিআরের কর্মকর্তারা আশা করছেন, অন্তত দুই লাখ ৯০ হাজার কোটি টাকা সংগ্রহ করা সম্ভব হবে।
অর্থমন্ত্রী এ ব্যাপারে প্রথম আলোকে বলেন, আগামী বাজেটে বড় ঘাটতিই থাকবে। ঋণও করা হবে ভালোই। কারণ, সবার চাহিদা মেটাতে গিয়ে তা করতে হবে। (প্রথম আলো, ২৬ মে ২০২২)


এই রিপোর্টের তথ্য যদি সঠিক হয়, আমার ধারণা সঠিক বা কাছাকাছি, তাহলে আমাদের অবস্থা বাকিতে ঘি-খাওয়া ক্রেতার মতো। সারা বছর বাকিতে পণ্য নিয়ে বছর শেষে তা পরিশোধ যারা করেন, সেই রকম ক্রেতার মতোই আমাদের সরকারের অবস্থা। অর্থমন্ত্রীর ভাষ্য যদি সঠিক বলে ধরি, তাহলে ঘাটতি বাজেটের চাপটি কত বিশাল হয়ে আসবে, তা সহজেই বোঝা যায়। আসছে যে বাজেট, সেখানে বলা হবে সরকার সবার চাহিদা মেটাতে ঋণ নেবে আড়াই লাখ কোটি টাকা। ঋণ কোথা থেকে নেবে? দেশের ব্যাংক ও আর্থিক সংস্থাগুলো থেকে? সেই টাকার সুদ তো গুণতে হবে সরকারকে। আড়াই লাখ কোটি টাকার এক বছরের সুদ কত হতে পারে? আমি/আমরা জানি না। অর্থনীতিবিদরা ভালো বলতে পারবেন। তবে আমরা এটুকু বুঝি, সরকারের তহবিল ভালো অবস্থানে নেই। লাগামছাড়া উন্নয়নের মেগাপ্রজেক্টের জন্য নেয়া ঋণের সুদ (সর্বসাকুল্যে) যদি ৮০ হাজার কোটি টাকা তাহলে উন্নয়নের জন্য, জনগণের জন্য সুযোগ-সুবিধা করে জনজীবনে প্রশান্তি আনার লক্ষ্যে ওই যে অচিহ্নিত ঋণের চাপ যে হিমালয়ান ওজন, তা কি বলতে হবে? কেবল সুদ হিসেবে ৮০ হাজার কোটি টাকা পরিশোধের পর আসল কত দেবেন?
বেতন-ভাতার ৭৭ হাজার কোটি টাকা+ঋণের সুদ ৮০ হাজার কোটি টাকা+বিদ্যুৎ, সার ও রফতানি ভর্তুকি, প্রণোদনা ও নগদ ঋণে আরো পৌনে দুই লাখ কোটি টাকা মিলে ব্যয় সরাসরি দাঁড়াবে তিন লাখ ৩২ হাজার কোটি টাকা। আসছে বাজেটে ঘোষিত হতে যাচ্ছে ছয় লাখ ৭৭ হাজার কোটি টাকা বা সামান্য কয়েক হাজার কোটি টাকা কম। ওই ঘোষিতব্য বাজেট থেকে ৩৩২ হাজার টাকা মাইনাস করলে হাতে থাকবে ৩৪৫ হাজার কোটি টাকা। সরকারের আশা, আগামী অর্থবছরে মোট রাজস্ব পাওয়া যাবে চার লাখ ৩৩ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে এনবিআরের দায়িত্ব তিন লাখ ৭০ হাজার কোটি টাকা। কিন্তু ওই সংস্থাটি ওই লক্ষ্যে যেতে পারবে না বলে মনে করছে সরকার। গত ৯ মাসের প্রবণতাই বলে দিচ্ছে তাদের দুই লাখ ৯০ হাজার কোটি টাকার বেশি সংগ্রহ করা সম্ভব নয়। জনান্তিকে বলে রাখি, এনবিআরের একটি শাখা হচ্ছে কাস্টমস। মূসক বা ভ্যাট আদায়ে তারা সিদ্ধহস্ত এবং তারা সিদ্ধহস্ত ভ্যাট ফাঁকি দেয়ার পথ দেখিয়ে ব্যবসায়ীদের ছাড় দিতেও। আর সেই সুযোগে বছরে তিন-চার লাখ না হোক এক-দুই লাখ কোটি টাকা হাতিয়ে নেন ঘুষ হিসেবে। সরকারের টপ থেকে বটম পর্যন্ত সবাই জানে এই ঘুষ-দুর্নীতির কথা। সরকারের রোজগারের মেইন খাতটি এতটাই দুর্নীতির খাদে পড়ে আছে, সরকার সেই অসুখ সারাই করে না। কারণ ওই খাতে বসে আছে তাদেরই রাজনৈতিক খাদেম বরকন্দাজরা। তাদের হয়রানি করলে সরকারকে কোনো রাজস্বই তারা দেবে না।


আমরা বলব না যে, আমাদের অবস্থা খাদে পড়ার মতো জায়গায় গেছে। কারণ আমাদের চেয়ে সরকারই ভালো জানে, তার আর্থিক অবস্থা কতটা খারাপ বা কতটা ভালো। একজন মানুষ অসুস্থ হলে তিনিই সবার আগে তা জানতে পারেন। তারপর ঘনিষ্ঠজনরা, তারপর পাড়াপ্রতিবেশীরা জানতে পারে। আমরা চাই, পাড়াপ্রতিবেশীরা জানার আগেই সরকার যেন নিজের আর্থিক সঙ্কট কাটিয়ে উঠতে কার্যকর পদক্ষেপ নেয়। ওই কার্যকর পদক্ষেপগুলোর অন্যতম হলো- দুর্নীতি প্রতিরোধ। সরকারি অফিসের দুর্নীতিই কেবল নয়, বেসরকারি অনেক খাত আছে সেখানকার দুর্নীতির টুঁটি চেপে ধরতে হবে। অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে হলে নিজেদের ইউটোপীয় প্রকল্পগুলোও বন্ধ রাখতে হবে। এমনিতেই বছরের পর বছর কিছু প্রকল্প বাস্তবায়নে বিপুল অর্থ ব্যয় হচ্ছে এবং বাড়ছে প্রাক্কলিত ব্যয়ের কয়েকগুণ বেশি। অতি জরুরি ছাড়া কোনো রকম প্রকল্পে যেন বরাদ্দ না দেয়া হয়। উন্নয়ন যথেষ্ট হয়েছে, সেই সব উন্নয়নের ধকলে জনজীবন এমনিতেই দিশেহারা। কৃষি খাত ছাড়া অন্য কোনো খাতে আপাতত উন্নয়নের দরোজা শাটডাউন রাখার আবেদন জানাই।

 

 

 


আরো সংবাদ



premium cement