২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫
`

পরের ইস্যুর চাপে টিস্যুর মতো মিলিয়ে যাচ্ছে আগের ইস্যু

-

মন্ত্রীর আত্মীয়দের টিকিট ছাড়াই ট্রেনে ওঠার পরামর্শ দেন এক কর্মকর্তা! তাদের সম্মান দেখিয়ে আবার এসি কামরায় বসানো হয়। গোল বাঁধান কোথাকার কোন টিটিই! জরিমানা করে বসেন মন্ত্রীর শ্যালকদের! ক্ষুব্ধ হন রেলমন্ত্রীর স্ত্রী। তাৎক্ষণিক বরখাস্ত হন টিকিট পরিদর্শক ওই টিটি!
অথচ রেলমন্ত্রীর আত্মীয়রা বিনা টিকিটে ট্রেনে চড়েন এটি যেমন অপরাধ, সেসব আত্মীয়কে জরিমানা করায় একজন পরিদর্শকের বরখাস্ত হওয়া তার চেয়ে বড় অপরাধ। আবার ঘটনা অস্বীকার করা আরেক ধরনের অপরাধ। এ ঘটনা যেকোনো সভ্য দেশে ঘটলে রেলমন্ত্রীকে পদত্যাগ করতে হতো। আফসোস আমাদের দেশে এটি নজিরবিহীন।
হাজার কোটি টাকা দুর্নীতি করেন, অনিয়ম করেন কোনো সমস্যা নেই, কিন্তু একবার যদি অন্যায়ের বিরুদ্ধে লড়াই করার সামান্যতম চেষ্টাও করেন, তা হলে আর রক্ষা নেই। এমনকি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে যদি কেউ কোনো সরকারি কর্মকর্তার বিরুদ্ধে অনিয়মের অভিযোগ এনে স্ট্যাটাস দেন তা হলেও তার খবর আছে।
এ দেশের সাধারণ মানুষের যত দুর্ভোগ যন্ত্রণাই হোক না কেন, আমাদের নীতিনির্ধারকদের তেমন কিছু যায়-আসে না? আবার তারা যদি হয় অসাধারণ কেউ, মানে মন্ত্রীর আত্মীয় এমনকি দূরের কোন শ্যালক-শ্যালিকাও, তা হলে তো আর কথাই নেই।
অবশ্য স্ত্রীর কাণ্ডে দেশজুড়ে সমালোচনার মুখে পড়া রেলমন্ত্রী নূরুল ইসলাম সুজন বিব্রতবোধ করে সম্প্রতি রেলভবনে সংবাদ সম্মেলনে বলেন, ‘আমি ১১ থেকে ১২ বছর ধরে এমপি, আমার একটা ক্যারিয়ার আছে। আর ৯ মাস হলো নতুন বিয়ে করেছি, শ্বশুরবাড়ির আত্মীয়, এমনকি আমার নতুন স্ত্রী এখনো আমাকে বুঝে উঠতে পারেনি, আমি কী ধরনের মানুষ।’ তাকে না জানিয়ে তার বউয়ের কাজটি করা ‘ঠিক হয়নি’ বলে স্বীকার করেন তিনি।
এ সময় তিনি যারা রেলের দায়িত্ব পালন করেন তাদেরকে যাত্রী সেবার প্রতি আরো মনোযোগী হওয়ার পরামর্শ দিয়ে বরখাস্ত করা সেই টিটিই শফিকুলের বরখাস্তের আদেশ প্রত্যাহার করে নেন।
একজন মন্ত্রী যে বিব্রত হয়েছেন, এটি যা-তা বিষয় নয়। বাংলাদেশের জন্য ‘অনেক কিছু’। সব সম্ভবের দেশ বলা হলেও বাংলাদেশে মন্ত্রী বা ওই পর্যায়ের কারো বিব্রত হওয়ার কথা জানানোর সম্ভাবনা অপ্রচলিত ঘটনা; বরং কেউ তাদের বিব্রত হওয়ার মতো কিছু করলে জনমের শিক্ষা পেতে হয়।
কিঞ্চিত ব্যতিক্রম হয়েছিল সাবেক রেলমন্ত্রী সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের বেলায়। নানান ঘটনার প্যাঁচে শিক্ষা দিতে পারেননি তিনি। আর সোজা হয়েই দাঁড়াতে পারেননি। পরে শয্যাশায়ী ও ইহলোক ত্যাগ। তার পরের জন মুজিবুল হককে বার্ধক্যে মহা আয়োজনে বিয়ে করে যমজ সন্তান জন্ম দিয়ে মিডিয়ায় শিরোনাম হলেও নানান ঘটনা বিশেষ করে তরুণী বধূর কিছু ক্রিয়াকর্মের জেরে নেতিয়ে পড়তে হয়। পরে আর মন্ত্রিত্ব পাননি। আছেন সংসদ সদস্য হিসেবে।
সুজনের বিব্রত হওয়া বা টিটিইর বরখাস্ত আদেশ প্রত্যাহারের ঘটনা শেষ হয়ে যায়নি। তদন্ত বাকি। তত দিন পর্যন্ত সামনে অন্য কোনো ঘটনা আসবে না বা আনা হবে না, বলা যায় না। পরের ইস্যুর চাপে টিস্যুর মতো মিলিয়ে যাবে আগের ইস্যু। অনেক বছর ধরে চলে আসছে এভাবেই। রেলমন্ত্রীর দ্বিতীয় স্ত্রীর স্বজনদের বিনা টিকিটে ট্রেন ভ্রমণে বাধা দেয়ার অপরাধে টিটিইর বরখাস্ত কাণ্ডের তেজে একই সময়ে ঘটা সেতুর টোল চাওয়ায় এমপি পুত্রের মারধর কাণ্ডের খবরটা মিডিয়ায় নিউজভ্যালু আদায় করতে পারেনি। রেলের মতো টোল মন্ত্রণালয় না থাকলেও কাণ্ডকীর্তি বিচারে ঘটনা ছোট নয়। পটুয়াখালীর সংরক্ষিত আসনের এমপি কাজী কানিজ সুলতানা হেলেনের ছেলে মাহিন তালুকদার জয়ও দেখিয়ে দিয়েছেন ক্ষমতা কী জিনিস! পায়রা সেতুতে বিনা টোলে চলে যেতে চেয়েছিলেন তিনি। এতে বাধা দেয়ায় টোল আদায়কারীদের উত্তম-মধ্যম শিক্ষা দিয়েছেন জয় ও সঙ্গীরা। তাও পরপর দুই দফায়। প্রথম দফায় শিক্ষা নিতে না পারায় দ্বিতীয় দফায় শিক্ষা মুখস্থ করে ছাড়া হয়েছে। ট্রেনে মন্ত্রীর শ্বশুরকুলের লোকদের বিনা টিকিট কাণ্ডের তেজে সে সময় অনেকটা ঢাকা পড়ে যায় এমপি পুত্রের ‘বিনা টোলকাণ্ড’।
বর্তমান সরকার দীর্ঘ দিন ক্ষমতায় থাকার কারণে শহর-বন্দর-জনপদে স্ত্রী, পুত্র, কন্যা, ভাই-ভাতিজা মিলিয়ে সরকারি দলের মাননীয়দের স্বজনকাণ্ডের তালিকা দিনকে দিন কেবল দীর্ঘ হচ্ছে। তারা যে যেখানে যা পারছেন অঘটন ঘটিয়ে দিচ্ছেন। সর্দি-কাশি, হাই-হাঁচির মতো মামুলি উপসর্গের আকারে তা হজম করতে হচ্ছে মানুষকে। আবার অবিরাম এত ঘটনার তোড়ে মানুষ তা ভুলেও যাচ্ছে। কোনটা বা কয়টা মনে রাখা যায়?
রাজধানীর নিউ ইস্কাটনে আরেক মাননীয়া পিনু খানের পুত্র রনির এলোপাতাড়ি গুলিতে নিরীহ দুই ব্যক্তি নিহত হওয়ার ঘটনা বিস্মৃত হয়েছিলেন অনেকেই। সাফাই গাইতে গিয়ে তখন বলা হয়েছিল, দোষ রনির নয়। দোষটি ছিল মদের। মদ খাওয়া অবস্থায় রনির মেজাজ ঠিক ছিল না। রিকশার জটে বিরক্ত হয়ে তিনি কালো রঙের আলিশান প্রাডো গাড়ি থেকে বেরিয়ে এলোপাতাড়ি গুলি চালান। তাও মানুষের ওপর নয়, রিকশার জটের ওপর। কিন্তু মরে গেছে মানুষ যদিও তিনি মানুষ মারতে চাননি বলে জানিয়েছেন!
গুলশানের ব্যস্ত সড়কে কার রেসিংয়ে মেতে ডা: ইকবালের ভাতিজা ফারহানের চারজনকে আধমরা করে ফেলার ঘটনাও তামাদি হয়ে গেছে সেই কবেই। কক্সবাজারের টেকনাফে আবদুর রহমান বদির পাঁচ ভাইয়ের সিনেম্যাটিক কাণ্ডকীর্তিও সেই তামাদি খাতায়।
হাজী সেলিম, ঠাকুরগাঁওয়ে দবিরুল ইসলাম বা কুষ্টিয়ায় আফাজ উদ্দীনের পুত্র বা টাঙ্গাইলে আমানুর রহমান খান রানার ভাইদের উৎপাতও বাসি ঘটনা। নতুন গজিয়েছে আরো অনেক। কোনো কোনোটি ঘটনার প্যাঁচে বা বেশি আনকমন হলে প্রচার পায়। বাঁশের চেয়ে বড় হয়ে যাওয়া কঞ্চিগুলোর কর্মকাণ্ড বেজায়গায় না হলে বা আইন প্রয়োগ করার অপরাধে সরকারি কর্মচারীর মতো ঘটনা ভাইরাল না হলে সমস্যা হয় না। মন্ত্রী-এমপি, তাদের পতœী, পুত্র-কন্যা, ভাই-ভাতিজা, শালা-সম্বন্ধী, আক্রান্ত কর্মকর্তা বা ঘটনার শিকার সবার মধ্যে ড্র হয়ে যায়। আলোচনায়ও আসে না। ঘটনা খুঁজে বের করে এগুলোকে ক্ষমতার অপব্যবহারের ‘নির্লজ্জ ও নিকৃষ্টতম’ উদাহরণ মনে করার দরকারই বা কী?
প্রাইভেট কার চাপা দিয়ে পথচারী সেলিম মোল্লার মৃত্যু ঘটিয়ে এমপি পুত্রের গাড়ি নিয়ে ন্যামফ্ল্যাটে ঢুকে পড়লে কারো কিছু বলার থাকে না। আওয়ামী লীগ নেতা দিদারুল আলম চৌধুরীর সাথে না ঘটলে, জাতীয় সংসদের হুইপ শামসুল হক চৌধুরীর দাপুটে পুত্র শারুন চৌধুরীর একে-৪৭ দিয়ে গুলিবর্ষণের ভিডিও বা সামনে দামি মদের বোতল ছড়িয়ে রেখে ছবি তুলে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে দেয়ার ঘটনা সংবাদ মূল্য পেত? বা জুয়ার ১৮০ কোটি টাকা আয়ের অভিযোগ তোলা পুলিশ কর্মকর্তাকে বরখাস্তের খবর দাম্ভিকতার সাথে ছড়ানোর সাহস হতো? এসব প্রশ্নের জবাব তোলাই থেকে যাচ্ছে।
গোলমালটা বাঁধছে ভিন্ন জায়গায়। ক্ষমতাসীন দলের মন্ত্রী-এমপি বা নেতার সন্তান, স্ত্রী বা স্বজনদের ক্ষমতার দাপটের বিরুদ্ধে কঠোর অ্যাকশন আসছে, এদের খুন-খারাবি থেকে শুরু করে সন্ত্রাস, টেন্ডারবাজি, দখলবাজি, নিয়োগ ও বদলিবাণিজ্যসহ নানা অপরাধের তালিকা প্রধানমন্ত্রীর টেবিলে, শিগগিরই কঠোর পদক্ষেপ নিচ্ছে সরকার- এ ধরনের কিছু সংবাদ ফ্যাঁকড়া বাধাচ্ছে। কিছু গণমাধ্যমের এ ধরনের সংবাদে পুলকিত হয়ে মাঠে বোল দেয়া ব্যক্তিরা পড়ছেন বিপদে। তাদের কারো চলে যেতে হয় খরচের খাতায়ও। তারা বুঝে উঠতে পারেন না, দস্যুতার পদ্ধতিতে জনপ্রতিনিধি হয়ে যাওয়াদের পক্ষে দুনিয়ার হেন কোনো কাজ নেই, যা করা অসম্ভব!
নইলে পুলিশকে সামনে রেখে প্রকাশ্য সভায় কিভাবে একজন জনপ্রতিনিধি বলতে পারেন- ‘আমি হুকুম দিয়া দিচ্ছি, এই দুষ্কৃতকারীদের গণপিটুনি দিয়ে মেরে ফেললে কিছু হবে না। আপনারা যদি পারেন, গণপিটুনি দিয়ে মেরে ফেলেন। যদি কেউ আসামি করে, আমি মামলার এক নম্বর আসামি হবো যে, আমি হুকুম দিয়ে গেছি।’ ট্রেন-টোলকাণ্ডের সময়ই নোয়াখালীর এমপি এইচ এম ইব্রাহিম দুষ্কৃতকারীদের গণপিটুনি দিয়ে মেরে ফেলার এ নির্দেশটি দিয়েছিলেন।
তার দেয়া বক্তব্যের ৫৩ সেকেন্ডের ভিডিওটি ছড়িয়ে পড়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে। বক্তব্যের সময় সভাস্থলে উপস্থিত ছিলেন সোনাইমুড়ী থানার ওসি হারুন অর রশিদ। ঘটনা পাশ কাটাতে তিনি গণমাধ্যমকে জানান, তিনি সভার শেষ মুহূর্তে সেখানে গেছেন। এ কারণে এমপির বক্তব্য তিনি শোনেননি। ভিডিওটি এখনো তিনি দেখেননি। আর পুলিশ সুপার শহীদুল ইসলাম বলেছেন, ‘এমপি মহোদয় কোন প্রেক্ষাপটে ওই বক্তব্য রেখেছেন, তার পুরো বক্তব্যের ভিডিও না দেখে এ বিষয়ে কোনো মন্তব্য করা যাবে না।’
যত বড় মাননীয় বা মহাশয়ই হন, গণপিটুনি দিয়ে কাউকে মেরে ফেলার নির্দেশের মধ্যে পুলিশের অস্তিত্বও অস্বীকারের মানসিকতা নিহিত। ‘এই পুলিশ বা সরকার কর্তৃক দেশ আর চলছে না’- এমন ঔদ্ধত্য লুকানো রয়েছে হুমকিটির মধ্যে। অথচ সেখানেও পুলিশের পাশ কাটানোর চাতুরী। আনুগত্যের এই কদর্যরূপ শিষ্টের দমন আর দুষ্টের পালনকে বেগবান না করে পারে?
অন্য দিকে যে দেশ থেকে লাখ লাখ কোটি টাকা পাচার হয়, যেখানে দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে সঠিকভাবে ব্যবস্থা না নিয়ে সুযোগ পেলেই সাধারণ মানুষকে জিম্মি করা হয়, অধিকাংশরা যেখানে স্রোতে গা ভাসান, ক্ষমতাসীনদের সাথে নানাভাবে নিজের ঘনিষ্ঠতা প্রমাণের চেষ্টা করেন, সেখানে কিছু সৎ কর্মকর্তা-কর্মচারী অনিয়ম ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে যদি লড়াই করার সাহস দেখায়, বিনিময়ে তাদের কপালে জোটে কখনো তিরস্কার, কখনো পদোন্নতি বঞ্চিত হওয়া আবার কখনো হতে হয় তাৎক্ষণিক বরখাস্ত। এসবের মধ্য দিয়ে আসলে কী বার্তা যায়?
লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট
rintu108@gmail.com


আরো সংবাদ



premium cement