২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০, ১৭ রমজান ১৪৪৫
`

বিচারকের বিচারে আইনের ছাত্ররা হতভম্ব

সুশাসন
-

আমাদের দেশে সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মধ্যে সর্বপ্রথম রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে এলএলবি (অনার্স) কোর্স চালু করা হয়। পরে ঢাকা ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে চালু করা হয় এলএলবি (অনার্স) কোর্স। দেশে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পর বেশ কয়েকটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে বর্তমানে এলএলবি (অনার্স) ও এলএলএম কোর্স চালু আছে। দেশের সরকারি ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে এলএলবি (অনার্স) ও এলএলএম কোর্স চালুর ফলে আইন বিষয়ে অধ্যয়নের ক্ষেত্রে গুণগত পরিবর্তন এসেছে। বর্তমানে একজন ছাত্র উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার পর সরাসরি বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে এলএলবি (অনার্স) কোর্সে অধ্যয়নের সুযোগ পাওয়ায় ২২-২৩ বছর বয়সে শিক্ষানবিস আইনজীবী হিসেবে সিনিয়রের চেম্বারে যাওয়া-আসা শুরু করে। কিছু কিছু ছাত্রের ক্ষেত্রে দেখা যায় এলএলবি (অনার্স) কোর্স অধ্যয়নকালীন সিনিয়রের চেম্বারে রাতে দু-এক ঘণ্টা অনুশীলন গ্রহণ করে। বর্তমানে এলএলবি (অনার্স) কোর্সসমূহ চার বছর মেয়াদের এবং এলএলবি (অনার্স) কোর্স সমাপ্ত হওয়ার পর কোনো ছাত্র এলএলএম পড়তে চাইলে তার অতিরিক্ত এক বছর সময় ব্যয় হয়। অধিকাংশ ছাত্রের ক্ষেত্রে দেখা যায় আইনজীবী হিসেবে পেশা গ্রহণ করলে ছাত্রজীবনের ইতি টানার আগেই সিনিয়রের চেম্বার ও সিনিয়রের সাথে বিভিন্ন আদালতে মামলা পরিচালনায় সহযোগিতা করে নিজেকে আইনজীবী হিসেবে প্রতিষ্ঠার প্রাথমিক প্রস্তুতি সম্পন্ন করে।
বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে এলএলবি (অনার্স) ও এলএলএম কোর্স চালুর পূর্বে অধিকাংশ ক্ষেত্রে দেখা যেত যেকোনো কলেজ থেকে স্নাতক ডিগ্রি অর্জনের পর নৈশ কলেজে দু’বছর মেয়াদি এলএলবি কোর্সে অংশগ্রহণ করে এলএলবি ডিগ্রিধারী হয়ে আইন পেশায় নিয়োজিত হতো। আবার কেউ কেউ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিভিন্ন বিষয়ে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জনের পর অন্য কোথাও ভালো চাকরি না পেলে নৈশ কলেজে দুই বছর মেয়াদি আইন কোর্সে অধ্যয়ন করে আইনজীবী হিসেবে পেশা গ্রহণের সুযোগ গ্রহণ করতো। বর্তমানে আইন পেশায় এলএলবি (অনার্স) ও এলএলএম ডিগ্রিধারী এবং বিভিন্ন আইন কলেজ হতে দু’বছর মেয়াদি এলএলবি ডিগ্রিধারী একযোগে প্রবেশের সুযোগ পাচ্ছে।
সাধারণ্যে একটি ধারণা আছে যে, তীক্ষ্ণ মেধাসম্পন্নরাই আইন পেশায় সফলতা লাভ করেন। তাই ছাত্র বয়স থেকে যারা তীক্ষ্ণ মেধাসম্পন্ন ও বাকপটু এদেরকে আইনশাস্ত্র অধ্যয়ন বিষয়ে পরিবারের পক্ষ থেকে উৎসাহ দেয়া হয়। এলএলবি (অনার্স) পর্যায়ে সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে আসনসংখ্যা সীমিত হওয়ায় অনেক মেধাবী ছাত্রকে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে এলএলবি (অনার্স) কোর্সে ভর্তি হতে দেখা যায়। এরূপ একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন খণ্ডকালীন শিক্ষক যানজটের কারণে নির্ধারিত সময়ের প্রায় ২০ মিনিট পর শ্রেণিকক্ষে উপস্থিত হয়ে বিলম্বে উপস্থিতির কারণ ব্যাখ্যা করে নির্ধারিত বিষয়ের পাঠদানে উদ্যত হলে জনৈক চটপটে ও মেধাবী ছাত্র একটি দৈনিক পত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদের প্রতি শিক্ষকের দৃষ্টি আকর্ষণ করে শিক্ষকের কাছে জানতে চায়- কাউকে কান ধরতে বাধ্য করা দেশের প্রচলিত আইনের অধীনে শাস্তির আওতায় পড়ে কি না। আর শাস্তির আওতায় না পড়ে থাকলে সংক্ষুব্ধ ব্যক্তির প্রতিকার প্রদানে আমাদের করণীয় কী? ছাত্রটি থেকে উভয় প্রশ্ন শোনার পর শিক্ষক সংবাদপত্রে প্রকাশিত সংবাদটির প্রতি মনোনিবেশ করে জানতে পারেন দেশের উচ্চ আদালতের জনৈক বিচারক অফিসে যাওয়ার সময় তার কথিত মতে, ট্রাফিক পুলিশ তার গাড়ি দাঁড়িয়ে থাকাকালে অন্য দিকের গাড়ি ছাড়ায় তাঁর কালক্ষেপণ হওয়ার কারণে তিনি ট্রাফিক পুলিশকে জনসমক্ষে কান ধরতে বাধ্য করেন। সংবাদপত্রে প্রকাশিত সংবাদে বিচারকের নাম উল্লেখ না করলেও গাড়ির নম্বর এবং এ বিষয়ে ট্রাফিক পুলিশ কর্তৃক শাহবাগ থানা, ঢাকায় জিডি করার বিষয় উল্লেখ করা হয়।
ছাত্রটির উত্থাপিত প্রশ্নদ্বয় এবং সংবাদপত্রে প্রকাশিত সংবাদটির বিষয়বস্তু উপলব্ধি করার পর শিক্ষক বিষয়টি তার সেদিনের নির্ধারিত পাঠদান বিষয়ের বহির্ভূত হওয়ায় ক্লাস রিপ্রেজেনটেটিভকে লাইব্রেরি থেকে দণ্ডবিধি বইটি নিয়ে আসার জন্য নির্দেশ প্রদান করেন। খণ্ডকালীন শিক্ষক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকতার বাইরে জীবনের গুরুত্বপূর্ণ সময় আইন পেশা ও বিচারিক পেশায় নিয়োজিত থাকায় যদিও তার সুস্পষ্ট ধারণা ছিল যে, কাউকে কান ধরতে বাধ্য করা প্রচলিত আইনের অধীনে শাস্তির আওতায় পড়ে না; তবু তিনি দণ্ডবিধির সংশ্লিষ্ট ধারা অর্থাৎ ৫৩ ধারা অবলোকনের পর ছাত্রদের উদ্দেশে বলেন, একজন ব্যক্তি কোনো অপরাধ করলে অপরাধের মাত্রানুযায়ী দেশের প্রচলিত আইন অনুযায়ী তাকে পাঁচ ধরনের শাস্তি প্রদান করা যায়। এ শাস্তিগুলো হচ্ছে (ক) মৃত্যুদণ্ড, (খ) যাবজ্জীবন কারাদণ্ড, (গ) সশ্রম অথবা বিনাশ্রম কারাদণ্ড, (ঘ) সম্পদের বাজেয়াপ্তি ও (ঙ) অর্থদণ্ড।
এ প্রসঙ্গে সম্প্রতি অস্ট্রেলিয়া-ফেরত অপর এক ছাত্র শ্রেণিকক্ষে উপস্থিত সবার অবগতির জন্য বলে, সে অস্ট্রেলিয়া থাকাকালে উচ্চ আদালতের জনৈক বিচারক ট্রাফিক আইন ভঙ্গ করার দায়ে তাকে ওই আইনের অধীনে সর্বোচ্চ সাজা প্রদান করা হয় এবং সর্বোচ্চ সাজা প্রদানের পেছনে যে যুক্তি দেয়া হয় তা হলো তিনি আইনের লোক হয়ে কী করে আইন ভঙ্গ করলেন? শ্রেণিকক্ষে উপস্থিত ছাত্ররা ইতঃপূর্বে পূর্ববর্তী সেমিস্টারে বাংলাদেশের সংবিধান বিষয়ে অধ্যয়ন করায় অধিকাংশ ছাত্রের সংবিধান দ্বারা স্বীকৃত মৌলিক অধিকার বিষয়ে, উচ্চ আদালতের বিচারক নিয়োগে যোগ্যতার বিষয়ে এবং উচ্চ আদালতের বিচারকদের বিচারক পদ গ্রহণ-পূর্ববর্তী পঠিত শপথের বাক্যাবলি বিষয়ে ধারণা ছিল। সংবিধানের বিধানাবলির বিষয়ে সুস্পষ্ট ধারণাসম্পন্ন এমন একজন ছাত্র সংবিধানের ৩৫(৫) অনুচ্ছেদের প্রতি শিক্ষকের দৃষ্টি আকর্ষণপূর্বক তাকে এবং শ্রেণিকক্ষে উপস্থিত সবার অবগতির জন্য বলল, ওই উপ-অনুচ্ছেদের বিধান অনুযায়ী কোনো ব্যক্তিকে অমানবিক বা লাঞ্ছনাকর দণ্ড দেয়া বা কারো সাথে অনুরূপ ব্যবহার করা সংবিধান সমর্থন করে না। এবার ছাত্রটি উচ্চ আদালতের একজন বিচারকের সাংবিধানিক পদ গ্রহণ-পূর্ববর্তী শপথের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলল, শপথ গ্রহণের সময় তিনি যে বাক্যাবলি পাঠ করেছেন তার মধ্যে অন্যান্য বিষয়ের পাশাপাশি তিনি সুস্পষ্টরূপে ঘোষণা করেছেন যে, তিনি বাংলাদেশের সংবিধান ও আইনের রক্ষণ, সমর্থন ও নিরাপত্তা বিধান করবেন এবং ভীতি বা অনুগ্রহ, অনুরাগ বা বিরাগের বশবর্তী না হয়ে সবার প্রতি আইন অনুযায়ী যথাবিহিত আচরণ করবেন। এরপর শ্রেণিকক্ষে উপস্থিত সব ছাত্র সমস্বরে শিক্ষকের নিকট বিষয়গুলোর ব্যাখ্যা দাবি করল। শিক্ষক ব্যাখ্যা দেয়ার আগে ছাত্রদের উদ্দেশে বললেন, তোমরা ইতোমধ্যে আইনের মৌলিক বিষয়গুলো অধ্যয়ন করেছ এবং একটি চলমান বিষয়ের উপর দু’জন ছাত্র যে ব্যাখ্যা প্রদান করেছে তা তোমাদের জ্ঞানের গভীরতার পরিচায়ক। তাই আমি ব্যখ্যা দেয়ার আগে তোমরা নিজেদের মধ্যে আলোচনা করে বলো, বিষয়টির সুরাহা কোথায়? ছাত্ররা প্রায় ১০ মিনিটকাল নিজেদের মধ্যে আলোচনা করার পর বলল, আমাদের বিচারব্যবস্থা যে মৌল নীতির উপর প্রতিষ্ঠিত তা হচ্ছে Presumption of innocence যার অর্থ দাঁড়ায়- যতক্ষণ পর্যন্ত না আদালতের সম্মুখে উপস্থাপিত সাক্ষ্য দ্বারা প্রমাণিত না হবে যে একজন ব্যক্তি দোষী ততক্ষণ পর্যন্ত তাকে সাজা দেয়ার কোনো অবকাশ নেই। তা ছাড়া আমাদের ফৌজদারি বিচারব্যবস্থা প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক হওয়ায় অপরাধীর অপরাধ প্রমাণের দায়িত্ব রাষ্ট্রপক্ষের উপর বর্তায়। এর বাইরে একজন বিচারককে সাজা প্রদানের আগে নিশ্চিত হতে হয় যে, রাষ্ট্রপক্ষ দোষী ব্যক্তির বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগ সব সন্দেহের ঊর্ধ্বে প্রমাণ করতে সমর্থ হয়েছে। একটি মামলায় যখন উপরিউক্ত সব বিষয়ের সমন্বয় ঘটে একমাত্র তখনই একজন অপরাধীকে দোষীরূপে সাজা দেয়ার অবকাশ সৃষ্টি হয়। ছাত্ররা আরো অভিমত ব্যক্ত করে যে, আইনের দৃষ্টিতে দেশের সব নাগরিক সমান হওয়ায় ট্রাফিক পুলিশের নিকট উচ্চ আদালতের বিচারকের কোনো বিশেষ সুযোগ দাবি করার কারণের উদ্ভব হয়নি। ছাত্রদের কাছ থেকে আইনের ব্যাখ্যাগুলো জানার পর শিক্ষকের কোনো দ্বিমত করার অবকাশ ছিল না যে, উচ্চ আদালতের বিচারক সেদিন ট্রাফিক পুলিশের সাথে যে আচরণ করেছেন তা দেশের সর্বোচ্চ আইন সংবিধানের ৩৫(৫) অনুচ্ছেদের পরিপন্থী এবং তার সাংবিধানিক পদ গ্রহণ-পূর্ববর্তী পঠিত শপথের সাথে সাংঘর্ষিক।
সংবিধান ও আইনকে সমুন্নত রাখার দায়িত্বপ্রাপ্ত উচ্চ আদালতের একজন বিচারকের এ ধরনের কার্যকলাপ শুধু তার নিজের জন্য অবমাননাকর নয় বরং সমগ্র বিচারব্যবস্থার জন্য অবমাননাকর। তাই বিচারাঙ্গনের সাথে সংশ্লিষ্ট সবার দায়িত্ব হবে, এ ধরনের ঘটনার পুনরাবৃত্তিরোধে আইন অনুযায়ী ঘটনাটির প্রতিকার বিধান করা। আর প্রতিকার বিধানে আমরা অসমর্থ হলে ভবিষ্যতে এ ধরনের ঘটনায় বিপরীত কিছু ঘটলে অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না।
লেখক : সাবেক জজ, সংবিধান, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক বিশ্লেষক
E-mail: iktederahmed@yahoo.com


আরো সংবাদ



premium cement