২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫
`

ভারতে উর্দু ভাষা ও সংস্কৃতি নিয়ে শায়খ নদভির পর্যবেক্ষণ

-

অসংখ্য জাতি, ধর্ম, বর্ণ, গোষ্ঠী, সমাজ, কৃষ্টি, ভাষা ও নৃতত্ত্ব ও বিভিন্ন সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলে বিভক্ত এক বিশাল জনগোষ্ঠীর আবাসস্থল ভারতীয় উপমহাদেশ। কোটি কোটি মুসলমান শত শত বছর ধরে ভারতে হিন্দু ও অপরাপর জাতিগোষ্ঠীর পাশাপাশি অবস্থান করে আসছেন। সাম্প্রদায়িকতার বহ্নিশিখা অনেক সময় শত বছরের বন্ধুত্বের সম্পর্ক ও প্রীতির বন্ধনকে জ্বালিয়ে ভস্ম করে দেয়। তবুও মুসলমানরা নিজ মাতৃভূমি ভারতকে ভালোবাসেন; সমাজের উন্নয়নে মেধাকে কাজে লাগান এবং সার্বভৌমত্ব রক্ষায় জান কোরবান করেন। চিহ্নিত সাম্প্রদায়িক শক্তির নখরথাবা মুসলমানদের অনুভূতি ও মর্যাদাবোধ ক্ষত-বিক্ষত করে। ‘বহিরাগত’ হিসেবে তাদের সম্মান ও মর্যাদাকে ভূলুণ্ঠিত করার অপপ্রয়াস চালানো হয়। এমনকি ৭০০ বছরের মুসলিম শাসনামলকে চিত্রায়িত করা হয়েছে ‘অন্ধকার যুগ’ রূপে। কায়েমি স্বার্থাম্বেষী মহলের এমন মিথ্যাচার ভারতীয় মুসলমানদের মনে জন্ম দেয় হীনম্মন্যতার। এদেশে শিল্প, সাহিত্যচর্চা, লোকাচার, সংস্কৃতিচর্চা, সভ্যতার বিকাশ তথা পুরো জাতিগোষ্ঠীর সামগ্রিক উন্নয়নে মুসলমানদের অবদান ভারতবর্ষের ইতিহাসে এক বিশেষ স্থান দখল করে আছে।
আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন সাহিত্যিক, তুলনামূলক ধর্মতত্ত্বের স্কলার, ভারতের নদওয়াতুল ওলামা লক্ষেèৗর সাবেক রেক্টর আল্লøামা সাইয়েদ আবুল হাসান আলী নদভি উপর্যুক্ত সত্যটিকে প্রতিষ্ঠার প্রয়াস চালিয়েছেন তার তথ্য ও উপাত্তনির্ভর ‘হিন্দুস্তানি মুসলমান এক তারিখি জায়েযা’ নামক গ্রন্থে। ভূমিকায় তিনি বলেন, ‘মুসলমানরা কেবল এদেশের মর্যাদাবান নাগরিক এবং প্রাচীন অধিবাসীই নয় বরং বিশাল ভারতের তারা স্থপতি ও নির্মাতা। মুসলমান সে জাতি যারা এদেশের সেবা করেন, মর্যাদা বৃদ্ধি করেন, জনগণের কৃষ্টি ও মননে সৃষ্টি করেন নতুন প্রাণচাঞ্চল্য, জাগ্রত করেন এদেশের জনগণের মধ্যে নৈতিকতা ও মূল্যবোধের নতুন স্পন্দন। তারাই নবতর দক্ষতায় বাগান সাজান, তাদের ভিত্তি অত্যন্ত মজবুত। এদেশের প্রতিটি জমিখণ্ড, প্রতিটি ধূলিকণা মুসলমানদের সৃষ্টিশীল প্রতিভা, আন্তরিকতা, নির্মাণকুশলতা ও সেবার উদ্দীপনার প্রকৃষ্ট স্বাক্ষর বহন করে আছে। ভারতীয় সভ্যতার প্রতিটি পর্যায়ে তাদের সুস্থ মানস ও উন্নত রুচিবোধের স্মৃতি বিদ্যমান। ভারতীয় মুসলমানদের অন্যতম সমস্যা হচ্ছে ভাষাসমস্যা। উর্দু ভাষা হচ্ছে ভারতের বিভিন্ন ধর্ম, সংস্কৃতি ও শ্রেণীর মিলনের ফলে সৃষ্ট একটি নতুন ভাষা। এ ভাষার মূলে ও নির্মাণশৈলীতে সংস্কৃতি, আরবি, ফারসি ও তুর্কির বিশেষ প্রভাব বিদ্যমান। ভারতে ব্রিটিশ শাসনামলে বিপুলসংখ্যক ইংরেজি শব্দ উর্দুসাহিত্য পরিভাষার অন্তর্ভুক্ত হয়ে পড়ে। ফলে উর্দুভাষা সত্যিকার অর্থে ভারতীয় জাতীয়তার প্রতীক ও সাধারণ মানুষের ভাবপ্রকাশের শ্রেষ্ঠতম মাধ্যমরূপে স্বীকৃতি পায়। ভারতের বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠী মিলে উর্দুকে বুদ্ধিবৃত্তি, সংস্কৃতি, কবিতা, সাহিত্য, সাংবাদিকতা ও ভাবের আদান-প্রদানের শক্তিশালী বাহন হিসেবে গড়ে তুলেন। উত্তর প্রদেশ, বিহার, পাঞ্জাব, হায়দরাবাদ, দিল্লি এবং তার সন্নিহিত অঞ্চলের অধিবাসীদের উর্দুই হচ্ছে মাতৃভাষা। কিছু ইংরেজি সংবাদপত্র বাদ দিলে সবচেয়ে বহুপঠিত সংবাদপত্র প্রকাশিত হয় উর্দু ভাষায়।’
ইংরেজির পর উর্দুই ছিল ভারতের দ্বিতীয় সরকারি ভাষা। আদালত, সরকারি অফিস ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে উর্দুর বিচরণ ছিল জোরালো ও সচ্ছন্দ। উত্তর প্রদেশের সাবেক লেফটেন্যান্ট গভর্নর স্যার অ্যান্থনি ম্যাকডোনাল্ড হিন্দিকে আদালতের ভাষারূপে ঘোষণা দিয়ে দু’ভাষার এবং হিন্দু ও মুসলমানদের মধ্যে শত্রুতার বীজ বপন করেন। ১৯৪৭ সালে দেশ বিভক্তির পর ভারতীয় ইউনিয়নের সংবিধানে হিন্দিকে সরকারি ভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দিয়ে ৩৪৩ ধারায় বলা হয়, দেবনাগরী হরফে হিন্দিই হবে ভারত ইউনিয়নের সরকারি ভাষা। এ ছাড়া সংবিধানের ৩৪৫ ধারায় দেশের আরো ১৪টি ভাষাকে ভারতীয় ভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া হয়। এসব ভাষায় যারা কথা বলেন তাদের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে সন্তান-সন্ততিদের নিজেদের ভাষায় শিক্ষা দেবেন। এ ক্ষেত্রে সব ধরনের সুযোগ-সুবিধে দেবে সরকার। এ ক্ষেত্রে ভারতের রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা রয়েছে তিনি যেকোনো রাজ্য কর্র্তৃপক্ষকে সে রাজ্যের জনগোষ্ঠীর ভাষার ভিত্তিতে যেকোনো ভাষাকে সরকারি ভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দেয়ার নির্দেশ দিতে পারেন। সংবিধানে বলা হয়েছেÑ ‘যেকোনো রাজ্যের জনসংখ্যার একটি উল্লেখযোগ্য অংশ যদি চায় যে, তারা সে ভাষা ব্যবহার করবে যে ভাষায় তারা কথা বলে এবং রাজ্য সরকারও সে ভাষাকে স্বীকৃতি প্রদান করুক; রাষ্ট্রপতি যদি এতে সন্তুষ্ট হন তা হলে দাবির পরিপ্রেক্ষিতে সে ভাষাকে পুরো রাজ্যের জন্য অথবা রাজ্যের কোনো অংশবিশেষের সরকারি ভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দিতে রাজ্য কর্তৃপক্ষকে নির্দেশ দিতে পারেন (ভারতীয় ইউনিয়ন সংবিধান, ধারা নং ৩৪৭)।’
শায়খ আলী মিয়া নদভি বলেন, কিন্তু সংবিধানের উপরিউক্ত গ্যারান্টি সত্ত্বেও উর্দুর জন্ম ও বিকাশভূমি উত্তর প্রদেশ ও দিল্লি থেকে উর্দুকে নির্বাসন দেয়া হয়। শিক্ষাব্যবস্থায় প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরেও উর্দুর অস্তিত্বকে বরদাশত করা হয়নি। শিক্ষা ব্যবস্থা ও পাঠ্যক্রমের স্তরে হিন্দিকে শিক্ষার মাধ্যম বানানো হয়। উত্তর প্রদেশ সরকারের পক্ষপাতমূলক সিদ্ধান্তের ফলে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও অফিস আদালতে উর্দু ব্যবহারের ওপর অলিখিত নিষেধাজ্ঞা জারি হয়েছে। সৃষ্ট এ পরিস্থিতি উর্দুভাষী জনগোষ্ঠীকে দারুণভাবে হতাশ ও বিস্মিত করে দেয়। উর্দুর প্রতি সরকারের দৃষ্টিভঙ্গির কারণে মুসলমানদের মধ্যে ক্ষোভ ও বেদনার সৃষ্টি হয়। কারণ উর্দুর মর্যাদা ও ব্যবহার হ্রাস পেলে কেবল মুসলমানদের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ক্ষতি হবে না, বরং তাদের আকিদা ও মাজহাবের ভবিষ্যতকে প্রশ্নসাপেক্ষ করে তুলবে। কারণ উর্দু ভাষাই ভারতীয় মুসলমানদের সংস্কৃতি ও সভ্যতার একমাত্র যোগাযোগ মাধ্যম। উর্দু ভাষায় রয়েছে মুসলমানদের প্রায় সব ধর্মীয় সাহিত্য। উর্দু ভাষার বর্ণমালা আরবি বর্ণমালার কাছাকাছি হওয়ার কারণে পবিত্র কুরআন তিলাওয়াত সহজতর হয়। উর্দু ভাষা থেকে বঞ্চিত হওয়ার অর্থ মুসলমানরা জাতীয়তা, সংস্কৃতি, সম্প্রদায়গত বৈশিষ্ট্য, ধর্মীয় ঐতিহ্য হারিয়ে ফেলে আত্মপরিচয়হীন জাতিতে পরিণত হয়ে পড়বে। এ অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে উর্দুভাষীরা সরকারি দৃষ্টিভঙ্গির বিরুদ্ধে ব্যাপক বিক্ষোভ প্রদর্শন করতে থাকে। ফলে কেন্দ্রীয় সরকার দিল্লিতে ১৯৪৯ সালে প্রাদেশিক শিক্ষামন্ত্রীদের এক সম্মেলন আহ্বান করে। ওই সম্মেলনে বিদ্যালয়ের শিক্ষার মাধ্যমসংক্রান্ত নিম্নোক্ত প্রস্তাব গৃহীত হয়Ñ‘মাধ্যমিক মৌলিক স্তরে শিশুদের শিক্ষা ও পরীক্ষার মাধ্যম অবশ্যই মাতৃভাষায় হওয়া চাই। যেখানে রাষ্ট্রীয় ও রাজ্যের ভাষা থেকে মাতৃভাষা ভিন্ন হবে সেখানে মাতৃভাষায় শিক্ষাদানে কমপক্ষে একজন শিক্ষক নিয়োগ করা হবে তবে শর্ত থাকে যে, সংশ্লিষ্ট বিদ্যালয়ে ন্যূনপক্ষে ৪০ জন অথবা ক্লাসে ১০ জন ওই ভাষাভাষী ছাত্রছাত্রী থাকতে হবে। শিক্ষার্থীর মা-বাবা ও অভিভাবক যে ভাষাকে মাতৃভাষা হিসেবে ঘোষণা দেবেন সেটিই হবে ওই শিক্ষার্থীর ‘মাতৃভাষা’ (হিন্দুস্তানি মুসলমান এক তারিখি জায়েযা, বাংলা অনুবাদ, ড. আ ফ ম খালিদ হোসেন, পৃষ্ঠা : ১৪৭-৮)।
দুর্ভাগ্যজনকভাবে উপরিউক্ত সিদ্ধান্ত শুধু ঘোষণার মধ্যে সীমাবদ্ধ রয়ে গেল। উত্তর প্রদেশের সরকারি ও পৌর বিদ্যালয়গুলোতে হিন্দিকে বাধ্যতামূলক শিক্ষা দেয়া হয়। প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পর্যায়ে কেবল হিন্দিই পরীক্ষার মাধ্যম হিসেবে অব্যাহত থাকে। উর্দু শিক্ষা প্রায় বন্ধ করে দেয়া হয়। যেসব শিশুদের মাতৃভাষা উর্দু তারাও প্রাথমিক পর্যায়ে উর্দু ভাষা শিক্ষার সৌভাগ্য থেকে বঞ্চিত হয়ে পড়ে। মুসলমান ও উর্দুভাষী জনগণ ১৯৪৯ সালে দিল্লিতে গৃহীত সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের মাধ্যমে তাদের সন্তানদের স্কুলে উর্দুশিক্ষার ব্যবস্থা করতে সরকারের কাছে বারবার আবেদন-নিবেদন করতে থাকে। একমাত্র লক্ষেèৗতেই ১০ হাজার মা-বাবা ও অভিভাবক রাজ্যের শিক্ষামন্ত্রীর কাছে এ ব্যাপারে লিখিত আবেদন জানান কিন্তু প্রতিশ্রুতি সত্ত্বেও সংশ্লিষ্ট মন্ত্রী কোনো মনোযোগ দেননি।
সব প্রয়াস ব্যর্থ হওয়ার পর উর্দুভাষী জনগণ সংবিধানের ৩৪৭ ধারার আশ্রয় নিয়ে প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রপতির সমীপে একটি স্মারকলিপি দেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। উর্দু উন্নয়ন সমিতির উদ্যোগে স্বেচ্ছায় ও শান্তিপূর্ণ উপায়ে প্রায় ২০ লাখ ৫০ হাজার মানুষের এবং ২০ লাখ ছাত্রছাত্রীর স্বাক্ষর সংগ্রহ করা হয় স্মারকলিপিতে। আঞ্জুমানে-ই-তারাক্কি-ই-উর্দুর সভাপতি, বিহারের সাবেক গভর্নর ও আলীগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভিসি ড. জাকির হোসেনের নেতৃত্বে হিন্দু-মুসলিম উভয় সম্প্রদায়ের জননেতা ও শিক্ষাবিদদের সমন্বয়ে একটি প্রতিনিধিদল গঠন করা হয়। ১৯৫৪ সালে উত্তর প্রদেশের আঞ্চলিক ভাষা হিসেবে উর্দুকে স্বীকৃতি দেয়ার দাবি জানিয়ে স্মারকলিপিটি রাষ্ট্রপতিকে দেয়া হয়। স্মারকলিপিতে উল্লেখ করা হয়, ক. যেসব ছাত্রছাত্রীর মাতৃভাষা উর্দু তাদের প্রাথমিক স্তরে উর্দু ভাষায় শিক্ষা প্রদানের সুবিধে দেয়া হোক। খ. যেসব স্কুলে ৪০ জন বা ক্লাসে ১০ জন উর্দুভাষী শিক্ষার্থী রয়েছে তাদের জন্য উর্দু শিক্ষক নিয়োগ দেয়া হোক। গ. তাদের অফিস ও আদালতে উর্দু ভাষায় লিখিত আবেদন ও আর্জি বিবেচনায় নেয়া হোক। ঘ. সরকারের সব নির্দেশনাবলি, নোটিফিকেশন, গেজেট, বিল, সংবাদ বিজ্ঞপ্তি ও অন্যান্য প্রকাশনা উর্দু ভাষায় করা হোক। ঙ. আগের রেওয়াজ মতো উর্দু ভাষায় রচিত ব্যতিক্রমধর্মী গদ্য ও পদ্য সাহিত্যের জন্য রাষ্ট্রীয় পুরস্কার ঘোষণা করা হোক। চ. সরকারি গণগ্রন্থাগার, একাডেমি, সেমিনার, লাইব্রেরি ও পাঠকক্ষের জন্য উর্দু ভাষায় রচিত গ্রন্থগুলো ক্রয় করা হোক। ছ. সরকারি দফতরগুলোতে আবার উর্দুকে রাষ্ট্রীয় ভাষা হিসেবে মর্যাদা ও স্বীকৃতি দেয়া হোক।
১২ সদস্যবিশিষ্ট প্রতিনিধি দলে পাঁচজন ছিলেন হিন্দু বিশেষজ্ঞ। রাষ্ট্রপতি প্রতিনিধিদলকে উষ্ণ অভ্যর্থনা জানান ও তাদের বক্তব্য মনোযোগসহকারে শোনেন ও দাবিগুলোর প্রতি সহানুভূতি জানান। ব্যাস এতটুকু। স্মারকলিপির আলোকে এমন কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়নি, যাতে উর্দুভাষীদের স্বস্তি মেলে। তাদের ভবিষ্যৎ বিপন্ন হওয়ার হাত থেকে মুক্তি পায়। শিক্ষা বিভাগ আগেকার মতো উর্দুর সাথে বিমাতাসুলভ আচরণ অব্যাহত রাখে। উর্দু ভাষাভাষী অঞ্চলের শিশুরা আগের মতোই মাতৃভাষার প্রাথমিক শিক্ষা গ্রহণের সুযোগ থেকে বঞ্চিত রয়ে গেল। যার ফলে নবপ্রজন্মের শিশুরা ক্রমেই প্রাচীন সভ্যতা, সংস্কৃতি, আকিদা, মাজহাব ও পূর্ববর্তী যুগের বুজুুর্গদের সাথে তাদের সম্পর্ক হারিয়ে ফেলে। অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে, নবপ্রজন্ম নিজেদের ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক পরিবেশ থেকে শত যোজন দূরে চলে গেছে। শত প্রচেষ্টা চালিয়েও তাদের নিজেদের তাহজিব ও তামাদ্দুনের সাথে পরিচিত করানো সম্ভব হচ্ছে না। কারণ নতুন ও পুরনোর মাঝে যে সেতুবন্ধন ছিল তা ভেঙে গেছে (প্রাগুক্ত, পৃষ্ঠা : ১৪৮-৯)।
১৯৬১ সালের আগস্টে দিল্লিতে অনুষ্ঠিত কেন্দ্রীয় সরকারে উদ্যোগে বিভিন্ন অঙ্গরাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীদের এক সম্মেলনে বহুল আলোচিত ‘তিন ভাষার ফর্মুলা’ উদ্ভাবন করা হয়। ফর্মুলা অনুযায়ী মাধ্যমিক পর্যায়ে ছাত্রছাত্রীদের হিন্দি, ইংরেজি ও একটি ভারতীয় ভাষা শিখতে হবে। আশা করা হয়েছিল উর্দুভাষী শিক্ষার্থীরা মাধ্যমিক পর্যায়ে মাতৃভাষার শিক্ষার সুযোগ পাবে। কিন্তু উত্তরপ্রদেশ কর্তৃপক্ষের পক্ষপাতমূলক নীতি ও উর্দুভাষী শিক্ষার্থীদের আশার গুড়ে বালি ছিটিয়ে দিলো। কর্তৃপক্ষ ঘোষণা দিলোÑ কেন্দ্রের এ সিদ্ধান্ত তাদের জন্য প্রযোজ্য নয়, বরং এটি দক্ষিণ ভারতের ভাষার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। এ ব্যাখ্যা মাধ্যমিক পর্যায়ে উর্দুভাষার শিক্ষা গ্রহণেচ্ছু শিক্ষার্থীদের অনিশ্চয়তার অন্ধকারে ঠেলে দেয়। উর্দুকে সমাজজীবন থেকে নির্বাসিত করার এটি কর্তৃপক্ষীয় উদ্যোগÑ এ কথা নির্দ্বিধায় বলা চলে।
শায়খ আলী মিয়া নদভি জোর দিয়ে বলেন, উর্দু ভাষার প্রতি সরকারের পক্ষপাতদুষ্ট দৃষ্টিভঙ্গি ভারতীয় মুসলমানদের উভয় সঙ্কটে নিপতিত করে দেয়। তারা এক বিস্ময়কর নৈতিক অবিশ্বাসের শিকার হন। নিজ মাতৃভূমিতে তারা পরিচয় সঙ্কটে পড়ার ভয়ে শঙ্কিত হয়ে পড়েন। এতদসত্ত্বেও ভারতের মুসলমানদের হতাশ হয়ে হাত-পা ছেড়ে দিয়ে বসে থাকার কোনো যৌক্তিক কারণ নেই। রাজনৈতিক সচেতনতা মুসলমানদের ভারতের বৃহত্তর শক্তিরূপে প্রতিষ্ঠিত করবে এবং বিদ্যমান সমস্যার একটি ন্যায়ানুগ ও সম্মানজনক সমাধানে আসতে একান্তভাবে বাধ্য। বিজ্ঞ জনমত মুসলমান ও উর্দুভাষী জনগোষ্ঠীর ভাষাবিদ্যা ও সাংস্কৃতিক আকাক্সক্ষাকে বাস্তবরূপ দানের প্রজ্ঞা শিগগির উপলব্ধি করতে সক্ষম হবে। ভারতে বসবাসরত বিভিন্ন সম্প্রদায়ের ভাষা, ধর্ম ও সংস্কৃতির লালনে আস্থা ও প্রত্যাশার একটি অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি জাতীয় অগ্রগতি ও সমৃদ্ধির অপরিহার্য পূর্বশর্ত। সংখ্যালঘুদের মনে এমন আস্থার জন্ম দিতে হবে যে, সাম্রাজ্যবাদী শোষণ ও বঞ্চনার দিন ফুরিয়ে গেছে; স্বাধীনতা অর্জিত হয়েছে এবং কোনো ভাষা, হোক সেটি হিন্দি, কোনোক্রমেই যেন অন্য ভাষার উন্নয়নের পথে বাধা হয়ে না দাঁড়ায়।
ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল কংগ্রেস যখন সম্মিলিতভাবে স্বাধীনতা আন্দোলনের শুরু করেন এবং ভারতের বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর ধর্মীয়, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অধিকার সংরক্ষণের গ্যারান্টি দেন তখন বিভিন্ন সম্প্রদায়ের জনগণ কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে ভারতের স্বাধীনতা অর্জনে ইংরেজদের বিরুদ্ধে তীব্র লড়াইয়ে লিপ্ত হন শুধু একটি আশা বুকে নিয়ে তা হলোÑ আকিদা, ধর্ম, ভাষা ও সংস্কৃতির অধিকার যা ইংরেজ শাসনামলে জনগণ থেকে ছিনিয়ে নেয়া হয়েছিল। স্বাধীনতা অর্জনের পর তা তারা আবার ফিরে পাবে। মেধা ও প্রয়োজন অনুসারে তারা নিজেদের উত্তরাধিকার ঐতিহ্য ও লালিত আদর্শকে বিকশিত করতে অধিকতর স্বাধীনতা ভোগ করবে। এটাই ছিল তাদের প্রত্যাশা। কিন্তু আফসোস! সে প্রত্যাশা অপূর্ণ রয়ে গেল। হ
লেখক : অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক ও গবেষক
drkhalid09@gmail.com


আরো সংবাদ



premium cement