২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫
`

গুয়ানতানামো বে কারাগার

-

গুয়ানতানামো বে কারাগার কিউবায় অবস্থিত হলেও কেউ কোনো দিন প্রশ্ন তোলেনি যে, ওখানে যুক্তরাষ্ট্র কিভাবে তাদের নৌবাহিনীর অধীনে একটি সামরিক কারাগার বানিয়েছে? রোমহর্ষক সব মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা ঘটিয়েছে।
না, ঠিক বলা হলো না। পৃথিবীর যতগুলো রোমহর্ষক মানবাধিকার লঙ্ঘনের/হরণের ঘটনা ঘটেছে, তার মধ্যে এই কারাগারের নাম শীর্ষে থাকবে তাতে কোনো সন্দেহ নেই। গুয়ানতানামো বে কি যুক্তরাষ্ট্রের দখলে? নাকি কিউবাই এর মালিক? কিভাবে যুক্তরাষ্ট্র সেখানে কারাগার বানাল? সেটা আমরা জানি না। তবে আমরা জানি ওই কারাগার কুখ্যাতিতে শীর্ষে উঠেছে প্রকাশিত ভিডিও ক্লিপগুলো ভাইরাল হওয়ায় এবং সংবাদমাধ্যমগুলোর অব্যাহত অনুসন্ধানী রিপোর্টিংয়ের মাধ্যমে। শারীরিক নির্যাতন কত বিচিত্র পদ্ধতিতে নগ্ন-নিষ্ঠুরভাবে নির্যাতন করা যায়, সেটা মার্কিনি সেনারা দেখিয়েছে।
রাশিয়ার গুলাগ দ্বীপপুঞ্জের সোভিয়েত ইউনিয়নের কনসেনট্রেশন ক্যাম্পে সে দেশের ভিন্ন মতাবলম্বী রাজনৈতিক বন্দীদের যেভাবে নির্যাতন করা হতো, বন্দীদের, গুয়ানতামো বে কারাগারে যাদের আটকে রাখা হয়েছিল এবং যারা গত ২০ বছর ধরে আজ পর্যন্ত বন্দী জীবনযাপন করছে, তাদের রাজনৈতিক মত যাই হোক না কেন, তারা যুক্তরাষ্ট্রের মানুষ নয়। যুক্তরাষ্ট্র মনে করে তার ক্ষতি করেছে বা করবে এমন লোক যে দেশেরই হোক না কেন তাদের ধরে এনে আটকে রেখে বিচার করছে। বন্দীদের ওপর মার্কিনি বাহিনীর চরম অত্যাচার, নির্যাতন আর মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিভিন্ন রোমহর্ষক ঘটনা সংবাদমাধ্যমে আমরা দেখেছি, পড়েছি এবং তা নিয়ে অনেক লেখালেখি হয়েছে এবং এখনো হচ্ছে। আমার ধারণা, গুয়ানতানামো বে কারাগার ও তার বন্দীদের নিয়ে একটি অনন্যসাধারণ উপন্যাস হতে পারে, যা বাস্তব কারাগারের একটি পূর্ণাঙ্গ উপাদান থেকে জাত হবে।
মানবাধিকার লঙ্ঘন ঘটনা তো শুরু হয়েছে এই কারাগার তৈরির সময় থেকেই। কতটা আত্মকেন্দ্রিক স্বার্থের লক্ষ্য নিয়ে এই কারাগার তৈরি করা হয়েছে, সেটাও দেখার বিষয়, দ্বিতীয়ত, নিজ দেশের ভূখণ্ডে সামরিক বাহিনীর নেতৃত্বে ও অধীনে এমন একটি কারাগার সৃষ্টি কেন করেনি যুক্তরাষ্ট্র সেটাও খতিয়ে দেখা যেতে পারে। ভিন্ন একটি দেশের মাটিতে, সেই দেশের ভূমি দখল করে কিংবা সেই দেশ থেকে ভূমি কিনে নিয়ে বা লিজ নিয়ে কারাগার বানানোর পরিকল্পনার ভেতরেই আছে মানবাধিকার হরণের একটি রাজনৈতিক সামরিক সিদ্ধান্ত, যা মানুষের বিরুদ্ধে যায়। আমেরিকান রাজনীতির বা তাদের পররাষ্ট্রবিষয়ক পরিকল্পনার বিষয়ে সমালোচনা করলেই সেই মানুষটি কেন আমেরিকার শত্রুতে পরিণত হবে। এই ভাবনাটাও অবৈধ ও অগণতান্ত্রিক? এই প্রশ্নটিও বোধ হয় তোলা জরুরি। কোনো সামরিক বাহিনীর নিজস্ব কারাগার থাকতে হবে। এই কনসেপশনও যে ভুল, সেটাও আমরা ভেবে বলিনি কখনো। কারণ, অনেক স্বার্থ জড়িত সেখানে। রাজনীতি যেমন রাজনৈতিক দলগুলোর নিজস্ব আদর্শ ও পরিকল্পনা মোতাবেক চলে, যার মূল লক্ষ্য জনগণ, সেই জনগণের নামে ক্ষমতাসীন দল তার রাজনৈতিক এজেন্ডা বাস্তবায়ন করে। সেটা হতে পারে, যদি সেই এজেন্ডায় জনগণের স্বার্থ ৮০ থেকে ৯০ পার্সেন্ট থাকে সেটা গ্রহণযোগ্য বলে আমাদের সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় যুক্তিতে খাটে। তার চেয়ে কম থাকলেই বুঝতে হবে, অন্য কোনো স্বার্থের জন্য সরকার ওই প্রকল্প নিয়েছে।
নিউ ইয়র্ক মহানগরের ম্যানহাটানে অবস্থিত টুইন টাওয়ার ধ্বংসের সূত্র ধরে আমেরিকা শুরু করে সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে অনন্ত যুদ্ধ। সেই যুদ্ধে শামিল হয় পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ। বাংলাদেশও সেই সন্ত্রাস নির্মূলের অঙ্গীকারাবদ্ধ দেশ। কিন্তু ওসামা বিন লাদেনের নামের পরিচালিত ওই ধ্বংসযজ্ঞের মূল টার্গেট হয় মুসলমানরা। কারণ লাদেন মুসলমান। ব্যক্তিগতভাবে লাদেনের সন্ত্রাসী কার্যকলাপ দোষী সাব্যস্ত হয়নি, যতটুকু তাকে দোষী মনে করা হয় তার চেয়েও বেশি দোষী করে তোলা হয়েছে মুসলিম ধর্ম সম্প্রদায়কে। গোটা সম্প্রদায়কে ফান্ডামেন্টাল, যার অর্থ তাদের কাছে ধর্মান্ধ ও সন্ত্রাসী বলে বর্ণনা করা হয়েছে। এটাও এক ধরনের প্রতিহিংসাত্মক সাম্প্রদায়িকতা, তা যারা পোষণ করে তাদের মনোবিকৃতির ফল। কারণ কি এই যে, মুসলমানরা শণৈঃ শণৈঃ অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিকভাবে পৃথিবীর শীর্ষ দেশে পরিণত হতে যাচ্ছে এই প্রফেসর হান্টিংটনের দর্শনের প্রভাবে আমেরিকা মুসলিমবিরোধী পরিকল্পনার আয়োজন করে? ব্যক্তির বা একটি সশস্ত্রগোষ্ঠীর অপকর্ম ও অপরাধ তার ধর্ম সম্প্রদায়ের ওপর চাপানোও যে সাম্প্রদায়িক অপরাধ মার্কিনি রাষ্ট্রযন্ত্র মনে করেনি। আর তারই অত্যন্ত কুফল হচ্ছে গুয়ানতানামো বে কারাগার।
চরমতম অন্যায়ই কেবল নয়, যুক্তরাষ্ট্র সামরিক শক্তির জোরে অন্য দেশের ভেতরে ঢুকে কোনো সন্ত্রাসী বা সাধারণ একজনকে ধরে নিয়ে যেতে পারে না। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র সেটা করছে। তাদের গুয়ানতানামো বে কারাগারে বন্দী করে রেখে শারীরিক, মানসিক নির্যাতন করেছে। বিশ্ব সংবাদমাধ্যমে এসব নিউজ আমরা পড়েছি/দেখেছি। এখনো ওই কারাগারে ৩৯ জন বন্দী রয়েছেন। তাদের কারো কারো বিচার করছে সামরিক আদালত (এটা ধারণা। না হলে যুক্তরাষ্ট্রের কোনো বিচারক কি ভিন্ন দেশের ভেতরে গিয়ে বিচার করতে পারেন?) বিনা বিচারে প্রায় কুড়ি বছর ধরে যারা মানবাধিকার হরণ করে চলেছে, যুক্তরাষ্ট্র কি তার জন্য জবাবদিহি করছে? আমি যতটুকু জানি, তারা তা করেনি, এখনো করছে না। যুক্তরাষ্ট্রের সংসদের নিম্নকক্ষে (প্রতিনিধি পরিষদে) এ নিয়ে যৎসামান্য আলোচনা হয়েছে বলে মনে পড়ছে, উচ্চকক্ষ সিনেটেও তার হাওয়া গেছে। কোনো কোনো ন্যায়পরায়ণ সিনেটর প্রশ্নও উত্থাপন করেছেন, কিন্তু এর বেশি কিছু হয়েছে বলে মনে হয় না।
এখন, ২০ বছর পর জাতিসঙ্ঘ বলছে গুয়ানতামো বে কারাগার যুক্তরাষ্ট্রের বন্ধ করে দেয়া উচিত। সেই রকম একটি আহ্বানও জাতিসঙ্ঘ করেছে। তা জাতিসঙ্ঘ করতেই পারে। ওই বিশ্ব প্রতিষ্ঠানটি তো আর আমেরিকাকে নির্দেশ দিতে পারে না যে বন্ধ করুন গুয়ানতামো বে কারাগার এবং বলতে পারে না যে, তুমি (আমেরিকা) মানবাধিকার লঙ্ঘনের ক্ষেত্রে পৃথিবীর সেরা দেশ। সব থেকে আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে আমেরিকা যেখানে নিজের দেশের ভেতরেই মানবাধিকার লঙ্ঘন করে চলেছে নানা ভাবে, নানান সামাজিক ও রাজনৈতিক বৈষম্যের ভেতর দিয়ে, তারা কি করে পৃথিবীর অন্য দেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে নানা হুমকি দিতে পারে? না, পারে না। কিন্তু আবার পারে। কারণ, তার অর্থনৈতিক শক্তির জোরে সেটা করতে পারে। সেই জোরে সে তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোর ওপর ওই মানবাধিকারের ছড়ি ঘোরায়। গরিব দেশগুলো তার মান রক্ষার কারণে যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে টুঁ শব্দটিও করে না। তার কারণ, গরিব দেশের উন্নয়ন মডেলের সেরা বিনিয়োগকারী যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্র দেশগুলো। যুক্তরাষ্ট্র নাখোশ হলে মহাবিপদ গরিব দেশের জন্য। আমাদের দেশের কথাই ধরুন না কেন। যদি যুক্তরাষ্ট্রের মানবাধিকার হরণের ব্যাপারে সরকার কোনো প্রশ্ন তোলে, তাহলে তার সব প্রকল্পের টুঁটি চেপে ধরবে তারা। তার সহযোগীরা উন্নয়ন খাতে যে বিনিয়োগ করছে, তার রশিটি টাইট করে দেবে এবং একসময় গিয়ে তা বন্ধ করে দেবে।
আবার যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিদ্বন্দ্বী গণচীনের রাজনৈতিক অপরাধের বা উইঘুর মুসলিমদের ওপর যে সামাজিক ও নৈতিক সন্ত্রাস চালাচ্ছে, তাদের জনসংখ্যা যাতে বৃদ্ধি না পায় তার জন্য নানান অপচেষ্টা অব্যাহত রেখেছে। আমাদের সরকার যদি চীনের ওই সব রাজনৈতিক ও সামাজিক মানবাধিকার অপকর্মের দিকে প্রশ্নের আঙুল তুলে তাহলেও আমাদের উন্নয়ন রূপরেখা থেমে যাবে। কিছুদিন আগে মার্কিনি প্রশাসন র্যাবের সাবেক ও বর্তমান সাতজন কর্মকর্তার বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে, তার কোনো জবাব কিন্তু দিতে পারেনি সরকার। সরকার চায় না শাঁখের করাতের নিচে নিজের মাথাটি দিতে।
আমরা তাই গুয়ানতানামো বে কারাগার নিয়ে কোনো প্রশ্ন উঠাব না। বলব না যুক্তরাষ্ট্র নিজেই তো মানবাধিকার লঙ্ঘন করছে। আমাদের র্যাবের অফিসাররা তো আমেরিকারই সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে অনন্ত যুদ্ধের সহযোগী যোদ্ধা। তারা যদি অপরাধ করে থাকে, তার দায় তো যুক্তরাষ্ট্রেরই। কেননা, তাদের সাথে কাঁধ মিলিয়েই তো সন্ত্রাস দমনে, সন্ত্রাসী দমন করে, কিছু নিরীহকেও মেরেছে হয়তোবা। হ্যাঁ, এটা অন্যায়, মানবাধিকার লঙ্ঘনের শামিল। কিন্তু আমেরিকা বাংলাদেশকে এই যুদ্ধের সৈনিক না করলে তো এ-প্রশ্ন আজ উঠত না। র্যাব, পুলিশ এরা তো সন্ত্রাসীদের দমনে উদগ্রভাবে উৎসাহী নয়। সন্ত্রাসীরা না থাকলে তাদের চলবে কেমন করে? তাদের বাহিনীর উপযোগিতা থাকতে হলে সমাজ-সংসারে সন্ত্রাসী থাকতে হবে। তাদের দমনে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীও কাজ করে যাবে। শুধু দেখতে হবে, যাতে মানবাধিকার হরণ না হয়, মানবাধিকার লঙ্ঘন না হয়।
আমরা আসলে কারো বিরুদ্ধেই কিছু বলতে চাই না। কেবল বলি মানুষের অধিকার বিষয়টি অত্যন্ত স্পর্শকাতর, জাতিসঙ্ঘও সেটা বুঝেছে। পৃথিবীর আরো অনেক দেশের সরকারই তা অনুভব করেন। হয়তো তারাও বিষয়টি জাতিসঙ্ঘের দরবারে উত্থাপন করে থাকবেন। এ নিয়ে বেশি নাড়াচারা করলে হিতে বিপরীত হতে পারে। কবি ঈশ্বর গুপ্ত লিখেছেন- আমরা তো মা পোষা গরু!


আরো সংবাদ



premium cement