২০ এপ্রিল ২০২৪, ০৭ বৈশাখ ১৪৩১, ১০ শাওয়াল ১৪৪৫
`

আফগান সঙ্কট নিরসনে ওআইসির উদ্যোগ

-

মুসলিম বিশ্বের প্রতিনিধিত্বকারী সংগঠন ইসলামী সহযোগিতা সংস্থা (ওআইসি) সম্প্রতি আফগানিস্তানের বিষয়ে একটি শক্তিশালী বার্তা পাঠিয়েছে। আফগান পরিস্থিতিতে উদ্বিগ্ন হয়ে দুটি প্রধান দেশ সৌদি আরবের উদ্যোগে ও পাকিস্তানের আয়োজনে ওআইসি ইসলামাবাদে একটি বৃহত্তম আন্তর্জাতিক সম্মেলন সম্পন্ন করেছে। গত বছরের আগস্ট মাসে তালেবানের হাতে কাবুল সরকারের পতনের পরিপ্রেক্ষিতে মার্কিন সেনারা আফগানিস্তান ত্যাগ করার পর থেকে এ পর্যন্ত দেশটিতে যে মানবিক বিপর্যয় এবং অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে যে সর্বনাশ ঘটেছে সে ব্যাপারে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণের লক্ষ্যেই এই সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়।
এই সম্মেলনে জাতিসঙ্ঘ সংস্থাগুলোর প্রতিনিধি, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, আরব লিগ, জিসিসি এবং জাতিসঙ্ঘ নিরাপত্তা পরিষদের স্থায়ী সদস্য রাষ্ট্রগুলো ও জাপানের প্রতিনিধিরা অংশগ্রহণ করেন।
তাৎক্ষণিক সিদ্ধান্ত গ্রহণের লক্ষ্যে জরুরিভাবে এই সম্মেলন আহ্বান করার কারণে সম্মেলনটি ছিল খুবই গুরুত্বপূর্ণ। সম্মেলনে সৌদি আরবের পররাষ্ট্রমন্ত্রী প্রিন্স ফয়সাল বিন ফারহান একটি গুরুত্বপূর্ণ বক্তব্য দেন। তার বক্তব্য শীর্ষ সম্মেলনের চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে প্রতিফলিত ও গৃহীত হয়। তিনি আফগানিস্তানকে সন্ত্রাসী এবং চরমপন্থী গ্রুপগুলোর আশ্রয়দাতা হওয়ার বিরুদ্ধে হুঁশিয়ার করেছেন। সম্মেলনে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান যুক্তরাষ্ট্রের প্রতি আফগানিস্তানের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন না করার আহ্বান জানান। অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ বার্তার মধ্যে ওআইসি সেক্রেটারি জেনারেল হিসেইন ইব্রাহীম তাহার বক্তব্য প্রণিধানযোগ্য। তিনি আফগানিস্তানের দলগুলোর প্রতি আফগান জনগণের স্বার্থকে এগিয়ে নেয়ার উদ্দেশ্যে জীবন-জীবিকার হেফাজত, সহিংসতার প্রতি নিন্দা জানানো এবং আফগান জনগণের জন্য একটি সুন্দর স্থিতিশীল ও সমৃদ্ধশালী জীবনমান উন্নয়নের জন্য স্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে কাজ করার আহ্বান জানান। অবশ্য তালেবানের প্রতি মতপার্থক্য বাদ দিয়ে দেশে এবং বিদেশে নিজেদের পক্ষে আস্থা তৈরি এবং তারা যে একটি দেশ পরিচালনায় সক্ষম সেটা প্রমাণ করার ব্যাপারে চাপ রয়েছে।
ওআইসি মহাসচিব আফগানিস্তানের শান্তি প্রক্রিয়াকে সমর্থন দানের ব্যাপারে তার প্রতিশ্রুতি ব্যক্ত করেন। তিনি শান্তি প্রতিষ্ঠায় সহযোগিতা করার বিষয়টিও পুনর্ব্যক্ত করেন। তিনি ওআইসির কাবুল মিশনের মাধ্যমে সদস্য রাষ্ট্রগুলোর সমর্থন নিয়ে সেখানে মানবিক কার্যক্রম বৃদ্ধি করা হবে বলে জানান। জনাব তাহা আফগানবিষয়ক ওআইসির নতুন বিশেষ দূতের মাধ্যমে সেখানে মানবিক সহায়তা এবং রাজনৈতিক সম্পৃক্ততার ক্ষেত্রে সমন্বয় করা হবে বলে জানান।
তালেবানরা গত আগস্টে দেশের নিয়ন্ত্রণ নেয়ার পর থেকে দেশটির পরিস্থিতি অবনতি হয়। দেশটির ক্ষুধা, দারিদ্র্য ও মানবিক পরিস্থিতি নিয়ে এখন সবাই উদ্বিগ্ন। জাতিসঙ্ঘের মতে, প্রায় দুই কোটি ৩০ লাখ মানুষ ইতোমধ্যেই ক্ষুধা ও খাদ্যাভাবের মুখে রয়েছে। অপুষ্টির শিকার শিশুদের জন্য স্বাস্থ্যসহায়তা খুবই অপর্যাপ্ত। শিক্ষকদের ৭০ শতাংশ বেতন পাচ্ছেন না এবং লাখ লাখ শিশু স্কুলে যেতে পারছে না।
অপর দিকে আফগানিস্তানে শীত জেঁকে বসেছে এবং কোভিড-১৯ সর্বত্র হানা দিচ্ছে। মুদ্রার দাম পড়ে যাচ্ছে। অপর দিকে প্রত্যেকটি নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের মূল্য প্রতিদিন বাড়ছে। বাণিজ্য ও বিনিয়োগ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। আর্থিক খাত ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে এবং সামাজিক সেবাগুলো বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। বর্তমান রূঢ় বাস্তবতায় ভবিষ্যৎ বিপর্যয়ের জন্য এটাই হচ্ছে পটভূমি। এই অবস্থা চলতে থাকলে রাজনৈতিক, সামাজিক এবং অর্থনৈতিকভাবে জনগণকে চরম দারিদ্র্য, বাস্তুচ্যুতি এবং অভিবাসনের দিকে ঠেলে দেয়া হবে- যার অর্থ হলো দেশের ভেতরে এবং বাইরে অস্থিতিশীলতা, মানব পাচার এবং মানবাধিকার লঙ্ঘন, অবৈধ কর্মকাণ্ড, চরমপন্থা এবং সন্ত্রাসবাদ বৃদ্ধি পাবে।
বিদেশে আফগানিস্তানের যে শত শত কোটি ডলারের অর্থ ও সম্পদ আটক করে রাখা হয়েছে, তা উদ্ধার বা ছাড় করতে এবং আন্তর্জাতিক সহায়তা পাওয়ার লক্ষ্যে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি অর্জনের জন্য তালেবানরা এখন মরিয়া। তালেবান সরকারের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন এবং আফগান কর্তৃপক্ষের প্রতিনিধি হিসেবে সেখানে একটি বিবৃতি দেন। তাকে আনুষ্ঠানিক গ্রুপফটোতে অংশগ্রহণের জন্য আমন্ত্রণ জানানো হয়নি এবং আনুষ্ঠানিক দলিল যাতে তালেবানকে স্বীকৃতি দেয়া হয়নি। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় এটা স্পষ্ট করেছে যে, স্বীকৃতি পেতে হলে অবশ্যই কিছু শর্ত পূরণ করতে হবে। এই অচলাবস্থার জন্য আফগান জনগণকে মূল্য দিতে হবে। আফগান জনগণের জীবন বাঁচাতে এবং দেশটিকে বিশ্ব থেকে সম্পূর্ণভাবে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়া থেকে রক্ষা করতে কিছু কিছু ক্ষেত্রে সমঝোতায় পৌঁছানোর প্রয়োজন।
তালেবানদের অবশ্যই উপলব্ধি করতে হবে যে, জাতিসঙ্ঘ সনদ, ওআইসি সনদ এর নীতিমালা ও বাধ্যবাধকতার বাইরে গিয়ে এবং মানবাধিকারসহ আন্তর্জাতিক চুক্তি এবং কনভেশন থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে তারা দেশ পরিচালনা করতে পারবে না। তাদেরকে আরো বুঝতে হবে নারীসহ আফগানিস্তানের সব মানুষের অংশগ্রহণ ছাড়া তারা সমাজ এবং সরকার পরিচালনা করতে পারবে না।
আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ও নিষেধাজ্ঞার মাধ্যমে স্কুল, হাসপাতাল ও বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান পরিচালনায় মানবিক সহায়তা ও অর্থনৈতিক সম্পদ থেকে বঞ্চিত করে আফগান জনগণকে অব্যাহতভাবে শাস্তি দিতে পারবে না। এর অর্থ হলো অবশ্যই প্রয়োজনীয় সহায়তা দিতে হবে। এবং বৈধ ও গ্রহণযোগ্য মাধ্যমের সাহায্যে তহবিল বরাদ্দ নিশ্চিত করতে হবে।
অপর দিকে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় ও আফগান দলগুলো বা পক্ষের মধ্যে একটি টেকসই যোগাযোগ ও সংলাপ চালিয়ে যাওয়ার জন্য অবশ্যই একটি প্রক্রিয়া বা পদ্ধতি সৃষ্টি বা উদ্ভাবন করতে হবে। ওআইসি সম্মেলনের একটি প্রক্রিয়া বা উপায় খুঁজে বের করার আগেই এসব কাজকে অগ্রাধিকার দিয়ে এগিয়ে নিতে হবে। অন্যান্য আন্তর্জাতিক অভিনেতাদের সাথে অংশীদারিত্বের ভিত্তিতে আফগানিস্তানে মানবিক সহায়তা পৌঁছে দেয়ার লক্ষ্যে ইসলামী উন্নয়ন ব্যাংকের পৃষ্ঠপোষকতায় একটি ট্রাস্ট ফান্ড গঠনের যে সিদ্ধান্ত ওআইসি গ্রহণ করেছে- সেটা বেশ সমালোচিত হয়েছে।
ওআইসি আফগানিস্তানে খাদ্যনিরাপত্তা কর্মসূচিও চালু করেছে। এ প্রেক্ষাপটে সংস্থাটি খাদ্যনিরাপত্তা বিষয়ক ইসলামী সংস্থার প্রতি প্রয়োজনীয় কাজের ব্যাপারে উদ্যোগ গ্রহণের অনুরোধ জানিয়েছে।
গুরুত্ব অনুধাবন করে ওআইসি আন্তর্জাতিক ইসলামী ফিকাহ অ্যাকাডেমির নেতৃত্বে বিশিষ্ট ধর্মীয় স্কলার ও আলেমদের নিয়ে একটি প্রতিনিধিদল গঠন করবে। তারা আফগানদের সাথে মতবিনিময় করবেন। আফগানদের সাথে পরমতসহিষ্ণুতা, ইসলামে পরিমিতিবোধ, শিক্ষায় সমানাধিকার এবং ইসলামে নারী অধিকারসহ বিভিন্ন বিষয়ে আলোচনা করবেন। সার্বিক বিবেচনায় আফগানিস্তানকে রক্ষার ব্যাপারে ওআইসির প্রচেষ্টায় আশার সঞ্চার হয়েছে।
মাহা আকেল জেদ্দাভিত্তিক সৌদি লেখিকা।
আরব নিউজের সৌজন্যে
ভাষান্তর : মুহাম্মদ খায়রুল বাশার।


আরো সংবাদ



premium cement