২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫
`

ওহ ছাত্রলীগ!

চলতে ফিরতে দেখা
-

ছাত্রলীগের ঘাতকদের পৈশাচিক নির্যাতনে নিহত বুয়েটের শিক্ষার্থী আবরার ফাহাদ খুন হয়েছেন ২০১৯ সালের ৭ অক্টোবর। তার ওপর লোমহর্ষক নির্যাতনের বিস্তারিত বিবরণ সে সময়ের সব গণমাধ্যমে প্রচারিত হয়েছে। রাতভর দফায় দফায় পিটিয়ে তাকে হত্যা করা হয়েছিল। দু’বছর পর সে মামলার রায় ঘোষণার কথা ছিল গত সপ্তাহে। কিন্তু অজ্ঞাত কারণে রায় ঘোষণা স্থগিত হয়ে যায়। এ সপ্তাহে সে রায় ঘোষণার কথা রয়েছে। আসলে এখন রায় ঘোষণা স্থগিত হলে কিংবা তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেয়ার সময় পেছালে সংশয় ঘিরে ধরে। আবরারের ছোট ভাই সে কথা উল্লেখ করেছেন। তিনি বলেছেন, সাগর-রুনি হত্যাকাণ্ডের ১০ বছর পেরিয়ে গেছে। ৮৪ বার সে হত্যাকাণ্ডের তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেয়ার তারিখ পিছিয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ চুরির তদন্ত প্রতিবেদনও খাবি খাচ্ছে।
এখন ঘটনার ঘনঘটা। একটি ঘটনার পর আরেকটি ঘটনা ঘটছে। ফলে আগের ঘটনা, তা সে যত লোমহর্ষকই হোক না কেন, চাপা পড়ে যাচ্ছে। আওয়ামী লীগের যেসব নেতা সারা দিন বিএনপি-জামায়াতের পিণ্ডি চটকাচ্ছেন, তারা ছাত্রলীগের পৈশাচিকতা-বর্বরতা সম্পর্কে কমই কথা বলেন। কিংবা মোটেও বলেন না। ফলে ছাত্রলীগের জন্য চালু হয়েছে এক বিচারহীনতার সংস্কৃতি, দায়মুক্তির সংস্কৃতি। এর ফলে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে তাদের বর্বরতার ঘটনা। দেশের উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে গেস্টরুম-গণরুম কালচার গড়ে তুলেছেন তারা। সেখানে নিরীহ সাধারণ ছাত্রদের ডেকে নিয়ে ধারাবাহিকভাবে তাদের ওপর নির্যাতন চালায় ছাত্রলীগ। হলের সিট বণ্টনের দায়িত্ব তারা নিজেদের হাতে নিয়ে নেয়। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এলাকায় টেন্ডারবাজি চাঁদাবাজির মহোৎসব চালাতে থাকে। কোনো ক্ষেত্রে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর প্রশাসন ছাত্রলীগের সহযোগী, কোনো কোনো ক্ষেত্রে তারা অসহায়। কখনো কখনো মনে হয়, নিজেদের পদ-পদবি টিকিয়ে রাখার জন্য প্রশাসন ছাত্রলীগের সন্ত্রাসীদের হাতের পুতুলে পরিণত হয়েছে।
গত মাসে চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজে ছাত্রলীগের প্রতিদ্বন্দ্বী দু’গ্রুপের মধ্যে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ হয়। তাতে মাথায় ভারী কিছুর আঘাতে আহত হন এক ছাত্র। মৃত্যুর সাথে লড়ে তিনি ফিরে এসেছেন বটে, কিন্তু তার মাথায় কিছু অংশ এখনো তার পেটের ভেতরে সংরক্ষণ করা আছে। তিনি আরো সুস্থ হলে অপারেশন করে ওই অংশ আবার মাথায় সংযোজন করা হবে। এখানেও দায়মুক্তির সংস্কৃতি বড় প্রবল। এসব ঘটনা শাসকদের মনে কোনো দাগ কাটে না। ঘাতকদের বিরুদ্ধে তেমন কোনো ব্যবস্থা চোখে পড়ে না। আবারো সেই দায়মুক্তির সংস্কৃতি। এখন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ছাত্রলীগের বিবদমান গ্রুপগুলোর মধ্যে সঙ্ঘাতের ঘটনাই বেশি ঘটছে। সরকার কিংবা প্রশাসন এ ক্ষেত্রে চুপ মেরে থাকে।
এখানে সাম্প্রতিক আরো দু’টি ঘটনার কথা উল্লেখ করা যায়। একটি ঘটনা খুলনা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের। সেখানে ছাত্রলীগ নেতাকর্মীদের লাঞ্ছনা ও অপদস্থের শিকার হওয়ার পর এক শিক্ষক হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন। ওই শিক্ষকের নাম অধ্যাপক ড. সেলিম হোসেন। মঙ্গলবার বেলা ৩টার দিকে তিনি মারা যান। এর আগে ক্যাম্পাসে তার নিজ কক্ষে তাকে লাঞ্ছিত করে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা। এ-সংক্রান্ত কয়েকটি ভিডিও ক্লিপ ইতোমধ্যে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছে। ড. সেলিম হোসেন ইলেকট্রিক্যাল ও ইলেকট্রনিক ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের অধ্যাপক এবং লালন শাহ হলের প্রভোস্ট ছিলেন। শিক্ষার্থীরা জানিয়েছেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের লালন শাহ হলের খাদ্য ব্যবস্থাপনার নির্বাচন নিয়ে কয়েক দিন ধরে ছাত্রলীগ নেতারা প্রভোস্ট ড. সেলিম হোসেনের ওপর চাপ সৃষ্টি করছিলেন। মঙ্গলবার দুপুরে ছাত্রলীগ নেতারা ওই শিক্ষকের সাথে দুর্ব্যবহার করেন ও হুমকি দেন। ড. সেলিম এতে প্রচণ্ড মানসিক আঘাত পান এবং পরে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যান।
খুব স্বাভাবিকভাবেই এ ঘটনায় বিশ্ববিদ্যালয় উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে। ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত ও বিচার দাবিতে উপাচার্যের কার্যালয় ঘেরাও করেন শিক্ষার্থীরা। তারা পাঁচ দফা দাবি জানান। পাশাপাশি ঘটনার তদন্ত ও বিচার দাবিতে কর্মবিরতি পালন করেছেন শিক্ষকরা। লালন শাহ হলে ছাত্রদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, সরকারি চাকরি পাওয়ার পর কুয়েট ছাত্রলীগের সভাপতি দায়িত্ব ছেড়ে দিয়েছেন। আর বিভিন্ন হল ও সুযোগ-সুবিধার নিয়ন্ত্রণ নিয়ে কয়েকটি ভাগে ভাগ হয়ে পড়েছে ছাত্রলীগ। একটি গ্রুপের নেতৃত্ব দিচ্ছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের সাধারণ সম্পাদক সাদমান নাহিয়ান-সেজান। হলের ডাইনিং ব্যবস্থাপনার কাজ তার অনুসারীদের নিয়ন্ত্রণে রাখতে কয়েক দিন ধরে ড. সেলিমকে চাপ দিচ্ছিলেন তিনি। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভিডিও ফুটেজে দেখা গেছে সেজানের নেতৃত্বে ছাত্রলীগের কয়েকজন নেতাকর্মী ক্যাম্পাসের রাস্তায় ড. সেলিম হোসেনের সাথে খারাপ ব্যবহার করছেন, তর্কবিতর্ক করছেন। পরে তারা তাকে অনুসরণ করে তড়িৎ প্রকৌশল ভবনে শিক্ষকের ব্যক্তিগত কক্ষে প্রবেশ করেন। তারা প্রায় আধা ঘণ্টা অবস্থান করে বেরিয়ে যান। পরে অধ্যাপক সেলিম বের হয়ে বাসায় যান। বাসায় ফেরার পর ড. সেলিম বাথরুমে যান। বেলা আড়াইটার দিকে তার স্ত্রী লক্ষ করেন দীর্ঘ সময় ড. সেলিম বাথরুম থেকে বের হচ্ছেন না। তখন বাথরুমের দরজা ভেঙে তাকে নেয়া হয় খুলনা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে। সেখানে ডাক্তাররা তাকে মৃত ঘোষণা করেন। সেলিম হোসেনের স্ত্রী সাবিনা খাতুন বলেন, আমাদের সব শেষ হয়ে গেছে। আপনারা সিসি টিভি ক্যামেরার ফুটেজ দেখেন। সেই ভিডিও দেখলে সব পরিষ্কার হয়ে যাবে।
ড. সেলিমের লাশ ক্যাম্পাসে নেয়া হলে সাধারণ শিক্ষার্থীরা অ্যাম্বুলেন্সটি আটকে দেন। শিক্ষকরা বুধবার বিষয়টি দেখবেন বলে আশ্বাস দেন। কিন্তু বুধবারও কোনো পদক্ষেপ না নেয়ায় শিক্ষার্থীরা ক্লাস বর্জন করে প্রশাসন ভবন ঘেরাও করেন। ঘটনার সুষ্ঠু বিচার না হওয়া পর্যন্ত অ্যাকাডেমিক কার্যক্রমে অংশ না নেয়ার ঘোষণা দিয়েছে কুয়েট শিক্ষক সমিতি। সমিতির সভাপতি প্রতীক চন্দ্র বিশ্বাস জানিয়েছেন, ড. সেলিম হোসেনের মৃত্যুর জন্য দায়ী ছাত্রদের বহিষ্কারসহ শাস্তি না দেয়া পর্যন্ত কোনো শিক্ষক অ্যাকাডেমিক কার্যক্রমে অংশ নেবেন না। বুধবার থেকে সেজানকে ক্যাম্পাসে দেখা যাচ্ছে না। তিনি ফোনও রিসিভ করছেন না। নগরীর খানজাহান আলী থানার ওসি প্রবীর কুমার বিশ্বাস বলেছেন, কুয়েটের ঘটনায় এখন পর্যন্ত কেউ অভিযোগ করেননি। সে কারণে মামলা বা জিডি হয়নি।
কুয়েটের ক্যাম্পাসে ড. সেলিমের সাথে অসৌজন্যমূলক তর্কবিতর্ক করেছেন ছাত্রলীগ নেতারা। তার কক্ষে গিয়েও তারা আধা ঘণ্টা ছিলেন। কক্ষের ভেতরে সিসি টিভি নেই। সেখানে ছাত্রলীগের ঘাতকরা ওই শিক্ষকের সাথে না জানি কী অসৎ আচরণ করেছেন! শিক্ষক হিসেবে সে গ্লানির ভার সইতে পারেননি ড. সেলিম হোসেন। এখন থানাগুলো থেকে খুব সহজ একটি বিবৃতি পাওয়া যায়। আর তা হলো ঘটনার ব্যাপারে কেউ অভিযোগ করেননি। ফলে জিডি বা মামলা নেয়ার কোনো প্রশ্নই ওঠে না।
আওয়ামী লীগের যেসব নেতা বিএনপি-জামায়াত বলে সারা দিন মুখে ফেনা তুলে ফেলেন, তারা এখন পর্যন্ত মুখ খোলেননি। কেউ বলেননি যে, ড. সেলিমের মৃত্যুর জন্য দায়ী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। সেজানকে কেন এখনো আটক করা হয়নি সেই প্রশ্নও জোরালোভাবে করার কেউ নেই।
ড. সেলিমের পরিবারের কোনো শক্তিশালী বাহিনী নেই। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসন কিংবা পুলিশ প্রশাসন এই বিপদের দিনে কেউই যে তাদের পাশে থাকবে না সেটি নিশ্চিত করে বলা যায়। ফলে মামলা করবেন কোন শক্তিতে। এতে ছাত্রলীগের বাহিনী আরো কয়েক গুণ উদ্যমে এগিয়ে যাওয়ার সুযোগ পাবে।
ছাত্রলীগের নামে দুর্বৃত্তদের আরেক ঘাঁটি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়। এখানেও ছাত্রলীগের গণরুম বা গেস্টরুম কালচার আছে। সেখানে ছাত্রলীগের পৈশাচিক অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে সম্প্রতি কমপক্ষে পাঁচজন ছাত্র হল ছেড়ে চলে গেছেন। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ হলে ছাত্রলীগের ঘাতকদের হাতে লাঞ্ছিত হয়ে তারা হল ত্যাগ করেছেন। ইংরেজি দৈনিক নিউ এইজ পত্রিকা রিপোর্ট করেছে যে, ছাত্রলীগ নেতাদের শারীরিক ও মানসিক অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে তারা হল ত্যাগ করেছেন। গত ২৯ নভেম্বর এই নির্যাতনের ঘটনা ঘটে। সংশ্লিষ্ট ছাত্রদের গেস্টরুমে ডেকে নিয়ে বেধড়ক পেটায় এবং জানায় যে, ছাত্রলীগের কর্মসূচিতে যোগ না দিলে ভবিষ্যৎ পরিণতি আরো ভয়াবহ হবে। ছাত্রলীগের নেতা অভিজিত রায় এই অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, ছাত্রদের সিট বণ্টনের জন্য গেস্টরুম মিটিং ডাকা হয়েছিল। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ তাদের সিট বণ্টনের দায়িত্ব দিয়েছে কি না, জানতে চাইলে সিট বণ্টনে শৃঙ্খলা আনতে হল প্রশাসনকে সহযোগিতা করার জন্য তারা এই কাজ করছেন বলে জানান। হলের প্রভোস্ট আব্দুল্লাহেল কাফি বলেছেন, এ সম্পর্কিত কোনো অভিযোগ পেলে তিনি ব্যবস্থা নেবেন। দায়িত্ব এড়ানোর কী অভিনব কৌশল! হল প্রশাসন ও পুলিশ প্রশাসনের ব্যবস্থা নেয়ার দিল্লি দূর অস্ত।
লেখক : সাংবাদিক ও সাহিত্যিক
rezwansiddiqui@yahoo.com


আরো সংবাদ



premium cement