ভাসানচরে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন ও জাতিসঙ্ঘ
- তন্ময় চৌধুরী
- ২৯ অক্টোবর ২০২১, ০০:০৫, আপডেট: ২৮ অক্টোবর ২০২১, ২৩:৩০
ভাসানচরে রোহিঙ্গাদের জন্য বাংলাদেশের গৃহীত মানবিক সহায়তা কার্যক্রমে জাতিসঙ্ঘ যুক্ত হবে বলে একটি সমঝোতাস্মারক স্বাক্ষরিত হয়েছে গত ৯ অক্টোবর। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণমন্ত্রণালয়ের সচিব মো: মহসিন এবং জাতিসঙ্ঘের শরণার্থী বিষয়ক সংস্থা ইউএনএইচসিআর-এর বাংলাদেশের প্রতিনিধি জোহানেস ভ্যানডারক্লাউ সচিবালয়ে সমঝোতাস্মারকে (এমওইউ) স্বাক্ষর করেন। এ সমঝোতার ফলে বাংলাদেশ সরকার ও ইউএনএইচসিআর যৌথভাবে ভাসানচরে রোহিঙ্গাদের খাদ্য ও পুষ্টি, সুপেয় পানি, পয়ঃনিষ্কাশন, চিকিৎসা, দক্ষতা প্রশিক্ষণ, মিয়ানমারের ভাষায় পাঠক্রম ও অনানুষ্ঠানিক শিক্ষা এবং জীবিকায়নের ব্যবস্থা করবে। এর ফলে, রোহিঙ্গারা আরো উন্নত জীবনের সাময়িক নিশ্চয়তা পেল। অন্য দিকে বাংলাদেশের জন্য তা এক ধরনের কূটনৈতিক সাফল্য; যদিও তার পূর্ণতা পাবে মিয়ানমারে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের মাধ্যমেই।
ভাসানচরে জাতিসঙ্ঘ সম্পৃক্ত হওয়ায় স্থানান্তরিত রোহিঙ্গারা সেখানে সচ্ছলভাবে জীবন যাপন করতে পারবে এবং ভবিষ্যতে মিয়ানমারে টেকসই প্রত্যাবর্তনের জন্য তারা আরো ভালোভাবে প্রস্তুত হতে পারবে বলে ইউএনএইচসিআর বিবৃতি দিয়েছে। বাংলাদেশের পক্ষ থেকেও বলা হয়েছে, কক্সবাজারে অবস্থিত রোহিঙ্গাদের মতো ভাসানচরে স্থানান্তরিত রোহিঙ্গারাও সমান মানবিক সহায়তা পাবে। চুক্তির ফলে আনন্দিত রোহিঙ্গারা ভাসানচর এবং কক্সবাজারের বিভিন্ন ক্যাম্পে র্যালি, মিছিল ও মিষ্টি বিতরণ করে। ‘স্বাগত জাতিসঙ্ঘ’, ‘ধন্যবাদ বাংলাদেশ’সহ বিভিন্ন প্ল্যাকার্ড, ব্যানার ও ফেস্টুন নিয়ে র্যালি করে রোহিঙ্গারা বাংলাদেশ সরকার ও জাতিসঙ্ঘের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানিয়ে স্লোগান দেয়। দুঃখের বিষয়, কিছু মানবাধিকার সংগঠন ও আন্তর্জাতিক বেসরকারি সংগঠন এখনো ভাসানচরের বিরুদ্ধে মিথ্যা তথ্য প্রচার করছে, যা মোটেও কাম্য নয়।
২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট মিয়ানমার সামরিক বাহিনীর গণহত্যা ও হিংস্র উচ্ছেদ অভিযান থেকে পালিয়ে আসা প্রায় সাড়ে সাত লাখ রোহিঙ্গাকে আশ্রয় দেয় বাংলাদেশ। নতুন ও পুরনো মিলিয়ে বর্তমানে ১১ লাখ রোহিঙ্গা কক্সবাজারে অবস্থান করছে। রোহিঙ্গাদের আশ্রয়ণের ব্যবস্থা হিসেবে প্রায় ছয় হাজার একর বনভূমি ধ্বংসের ফলে প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের ঝুঁঁকি দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে কক্সবাজারে। তা ছাড়া প্রত্যাবাসনে দীর্ঘসূত্রতা, বৈদেশিক অনুদান দিন দিন কমে যাওয়ার ফলে আয় ও জীবন-মান নিয়ে অনেক রোহিঙ্গার হতাশাগ্রস্ত হওয়া এবং অস্ত্র, মাদক, স্বর্ণ ও মানবপাচার ইত্যাদি বিষয়ে আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে রোহিঙ্গাদের মধ্যে অপরাধপ্রবণতা দিন দিন বেড়েই যাচ্ছে। তাই রোহিঙ্গাদের সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা এবং প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের ফলে সৃষ্ট জীবননাশের হুমকি থেকে রোহিঙ্গাদের রক্ষার্থে, এক লাখ রোহিঙ্গাকে ভাসানচরে স্থানান্তরের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে বাংলাদেশ।
২০১৯ সালের ৪ ডিসেম্বর ভাসানচরে রোহিঙ্গাদের স্থানান্তর শুরু হয়। এ পর্যন্ত ছয় দফায় প্রায় ১৯ হাজার রোহিঙ্গাকে স্থানান্তর করেছে বাংলাদেশ সরকার। ১৩ হাজার একর আয়তনের ওই চরে ১২০টি গুচ্ছগ্রামের অবকাঠামো তৈরি করে এক লাখের বেশি মানুষের বসবাসের ব্যবস্থা করা হয়েছে। পরিকল্পিত ও প্রশস্ত আবাসন, স্কুল, মাঠ, মসজিদ, স্বাস্থ্যকেন্দ্র ও সাইক্লোন শেল্টারসহ সব ধরনের সুযোগ-সুবিধা রয়েছে ভাসানচরে। মানবতার খাতিরে বাংলাদেশ যেখানে রোহিঙ্গাদের জন্য প্রায় ৩৫০ মিলিয়ন ডলার খরচ করে শরণার্থী ব্যবস্থাপনার মডেল হিসেবে ভাসানচরের মতো দৃষ্টান্তমূলক প্রকল্প হাতে নিয়েছে, সেখানে কিছু মানবাধিকার ও আন্তর্জাতিক বেসরকারি সংগঠনের মায়াকান্না সত্যিই অবাক করছে। শুরুতে জোরপূর্বক, অর্থের প্রলোভন, মিথ্যা আশ্বাস ইত্যাদির মাধ্যমে রোহিঙ্গা স্থানান্তর করা হচ্ছে বলে তথ্য প্রচার করা হয়। পরবর্তী সময়ে ভাসানচরকে জেলখানা, ডিটেনশন সেন্টার ইত্যাদি বলে গুজব ছড়ানো হয়। এমনকি সাধারণ রোহিঙ্গাদেরকে হুমকি দেয়ার অভিযোগও ওঠে কয়েকটি মানবাধিকার ও আন্তর্জাতিক বেসরকারি সংগঠনের বিরুদ্ধে।
গত ২৯ সেপ্টেম্বর, রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের পক্ষে সক্রিয় রোহিঙ্গা নেতা মুহিবুল্লাহ মাস্টারকে হত্যা এবং ২২ অক্টোবর কক্সবাজার রোহিঙ্গা ক্যাম্পে অবস্থিত একটি মাদরাসায় হামলা চালিয়ে সাত রোহিঙ্গাকে হত্যা, বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্ত এলাকা থেকে শুধু সেপ্টেম্বরেই ৩৪ লাখ পিস ইয়াবা উদ্ধার, নিজেদের মধ্যে আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে ১০৮ জন রোহিঙ্গা নিহত হওয়ার মতো ঘটনাগুলো প্রমাণ করে, রোহিঙ্গাদের একটি অংশ কী পরিমাণ অপরাধপ্রবণ হয়ে উঠছে। রোহিঙ্গা নেতা ও এনজিওকর্মীদের নিরাপত্তা চেয়ে কিছু আন্তর্জাতিক সংগঠন বিবৃতি দিয়েছে। অথচ রোহিঙ্গা সঙ্কটের টেকসই সমাধান হিসেবে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের বিষয়ে তাদের কোনো সক্রিয় ভূমিকা পরিলক্ষিত হচ্ছে না। কক্সবাজারে রোহিঙ্গা বসতিগুলো পাহাড়ি ঢালুতে তৈরি এবং ঘিঞ্জিপূর্ণ হওয়ায়, বিভিন্ন অপরাধ যথাসময়ে নিয়ন্ত্রণ করাও কষ্টসাধ্য হয়ে পড়ে বলে মনে করেন নিরাপত্তা বিশ্লেষকরা। আন্তর্জাতিক বেসরকারি সংগঠনগুলোর উচিত, বাণিজ্যিক স্বার্থ ত্যাগ করে অতিদ্রুত এক লাখ রোহিঙ্গাকে ভাসানচরে স্থানান্তর প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণ করে সাধারণ রোহিঙ্গাদের নিরাপত্তা নিশ্চিতে এগিয়ে আসা। তা ছাড়া তারা একত্রিত হয়ে রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে ফেরত পাঠানোর বিষয়ে, বিশ্ব জনমত গঠনে আন্তর্জাতিক বিভিন্ন ফোরামে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখতে পারে। রোহিঙ্গাদের টেকসই ও মর্যাদাপূর্ণ প্রত্যাবাসনে অবদান রাখার মাধ্যমেই আন্তর্জাতিক মানবাধিকার ও বেসরকারি সংগঠনগুলোর প্রকৃত মানবিক সহায়তা কার্যক্রমের বহিঃপ্রকাশ ঘটবে।
বিভিন্ন সময়ে জাতিসঙ্ঘ, ওআইসি, ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন প্রতিনিধি, রাষ্ট্রদূতদের দল, জাতিসঙ্ঘ সাধারণ পরিষদের ৭৫তম অধিবেশনের সভাপতিসহ সবাই ভাসানচর প্রকল্প সম্পর্কে ইতিবাচক মনোভাব ও বিবৃতি দিয়েছেন। সব ষড়যন্ত্র প্রতিহত করে বাংলাদেশ এখন জাতিসঙ্ঘকে ভাসানচরে সম্পৃক্ত করতে সমর্থ হয়েছে। মানবিক সহায়তার পাশাপাশি এখন পরিপূর্ণভাবে অভ্যন্তরীণ ও আঞ্চলিক নিরাপত্তা এবং রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের উপর কঠোর মনোযোগী হতে হবে বাংলাদেশ ও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে। জাতিসঙ্ঘ যদি শুধু বাংলাদেশে রোহিঙ্গাদের সুবিধা দেয়ার ওপর জোর দেয়, তাহলে অনিশ্চয়তার মধ্যে থাকা রোহিঙ্গারা কখনোই নিজ দেশে ফিরে যেতে আগ্রহী হবে না। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের উচিত, মিয়ানমারকে রাখাইন রাজ্যে রোহিঙ্গাদের গণহত্যার জন্য অভিযুক্ত করা এবং যথাযথ প্রত্যাবাসনের জন্য একটি অভ্যন্তরীণ পরিবেশ গড়ে তুলতে দেশটিকে বাধ্য করা। মিয়ানমারে প্রত্যাবাসন বিলম্বিত ও ভাসানচরে রোহিঙ্গাদের স্থানান্তর প্রক্রিয়া বাধাগ্রস্ত করার উদ্দেশ্যে রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোতে অস্থিতিশীল পরিবেশ তৈরি করার যে ষড়যন্ত্র, তা নস্যাৎ করতে হবে। রোহিঙ্গা স্থানান্তর প্রক্রিয়ার মতো, রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়ায়ও যুক্ত হয়ে, রোহিঙ্গাদের প্রতি বাংলাদেশের উদারতা ও উদ্যোগকে সমর্থন করবে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়; সে প্রত্যাশাই করছি।
লেখক : দক্ষিণ এশিয়ার রাজনীতি অভিবাসন ও মানবিক নিরাপত্তা নিয়ে একজন স্বাধীন গবেষক
ctonmoy555@gmail.com
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা