১৬ এপ্রিল ২০২৪, ০৩ বৈশাখ ১৪৩১, ০৬ শাওয়াল ১৪৪৫
`

আফগানিস্তান : মানবতার রক্ষাই কর্তব্য

-

রাজনীতিকদের চোরা চাহনি সাধারণ মানুষ কতটা বোঝে? আমার ধারণা খুব একটা বোঝে না। কেবল কোনো রাজনৈতিক দুর্যোগের মধ্যে পড়লে, কেবল জান-প্রাণে আঘাত লাগলে তখনই বোঝে সেই চোরা চাহনির মর্ম।
এই এখন যেমন বুঝছে আফগানিস্তানের সাধারণ মানুষ। তাদের অনেকেরই ধারণা ছিল যুক্তরাষ্ট্র তাদের দেশ থেকে চলে গেলেই মুক্তি মিলবে। তা হয়েছে বৈকি কিছুটা। ভূ-রাজনৈতিকভাবে তারা এখন স্বাধীন, তা নিশ্চিত করেই বলা যায়। তারা এখন নিজেদের শাসনাধীন। কিন্তু এই আত্মনিয়ন্ত্রণ কতটা অর্জিত হয়েছে?
তালেবান সরকার গত আগস্টে রাজধানী কাবুলের দখল নিলেও আজ পর্যন্ত মেয়েদের স্কুলে পাঠানোর ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিতে পারেনি। মেয়েরা শিক্ষা নিতে পারবে কি না, তা নিয়ে খুবই শঙ্কার মধ্যে আছে সে দেশের সাধারণ মানুষ, যারা রাজনীতি, যুদ্ধ ইত্যাদি বিষয়ে তেমনভাবে জড়িত নয়। তারা জানে না, তাদের কন্যারা কবে স্কুলে যেতে পারবে। তালেবান মেয়েদের স্কুলে পাঠানোর জন্য একটি কাঠামো তৈরিতে ব্যস্ত। কী সেই কাঠামো? জাতিসঙ্ঘের কাছে সেই কাঠামোর খসড়া হয়তো দিয়ে থাকবে তালেবান। কিন্তু সেই কাঠামোর চেহারাটা কেমন তা কেউ জানে না।
এটি হচ্ছে হাজারটা সঙ্কটের একটি মাত্র। ওই হাজারটা সঙ্কটের সমাধান তালেবান কেমন করে করবে, তা সাধারণ মানুষ জানে না। রাজনীতিকরা সেই সব সঙ্কটের মধ্যে পড়ে হাবুডুবু খাচ্ছে। আফগানিস্তানে বর্তমানে সবচেয়ে বড় সমস্যা হচ্ছে তাদের আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি না থাকা। যুক্তরাষ্ট্র দেশটি ছেড়ে যাওয়ার পরও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় তাদের স্বীকৃতি দেয়নি। এমনকি যারা তালেবানের পাশে ছিল রাজনৈতিক সাহস জোগানোর জন্য, তারাও স্বীকৃতি দেয়নি আজও। বিশেষ করে পাকিস্তান, চীন, ইরান, রাশিয়া, ভারত প্রভৃতি দেশ চুপচাপ। এদেরই সমর্থনকারী দেশগুলোও স্বীকৃতির প্রশ্নে নীরব। অথচ আফগানিস্তানে মানবিক সাহায্য অত্যন্ত জরুরি। সে দেশে অন্ন-বস্ত্র-চিকিৎসা-বাসস্থান, শিক্ষা প্রভৃতি ক্ষেত্রে তীব্র সঙ্কট চলছে। এই সঙ্কট থেকে তাদের রক্ষার প্রধান দায় তো মূলত যুক্তরাষ্ট্রের। কারণ, তারা দেশটিতে দীর্ঘ ২০ বছর ধরে দখলদারিত্ব ও শাসন চালিয়েছে। যদিও সর্বশেষ সরকার ছিল আশরাফ গনির, তবে তা নামমাত্রই, আসলে মার্কিনিরাই সব কিছু চালাত। যুক্তরাষ্ট্র স্বীকৃতি দেয়নি। দিচ্ছে না মানবিক সাহায্যও। সাহায্য দিতে পারে পাকিস্তান, চীন ও ইরান। তারাও হাত গুটিয়ে বসে আছে। রাশিয়া, ভারত এ নিয়ে উদ্বিগ্ন নয়। চার পাশের দেশগুলোর মধ্যে ইরান, পাকিস্তান, চীনÑ এই বৃহৎ সীমান্ত প্রতিবেশী ‘ছপ্পন’ ধরে বসে আছে। তাদের নিজ নিজ স্বার্থ দেখছে। কিন্তু সেই স্বার্থের ফোকর গলিয়ে যে আফগানিস্তানের সাধারণ মানুষের জীবন মারাত্মক সঙ্কটের গহনে পড়ে যাচ্ছে, সেটা তারা আমলে নিচ্ছে না, তার জন্য তারা দুঃখিতও নয়।
আফগানিস্তানের সাথে পাকিস্তানের স্থলসীমানার আকার অনেক বড়। দুই হাজার ৬৭০ কিলোমিটার। পাকিস্তানের পশ্চিম সীমান্তের গোটা এলাকাই আফগানিস্তানের সঙ্গে সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিকভাবে জড়িত। তালেবান ক্ষমতায় আসার পর পাকিস্তান অনেকটাই স্বস্তিতে। কিন্তু আবার অস্বস্তি বিরাজ করছে তালেবান সরকারের অংশীদার হাক্কানি নেটওয়ার্ককে নিয়ে। কারণ, পাকিস্তানি সামরিক ও রাজনৈতিক নেতারা মনে করেন ওই হাক্কানি নেটওয়ার্কের সহযোগিতা পায় ভারতের গোয়েন্দারা। তারা পাকিস্তানের বিরুদ্ধে তৎপরতা চালায় ওই হাক্কানিদের সহযোগে। হাক্কানি নেটওয়ার্ক অবশ্য এই অভিযোগের কোনো জবাব দেয়নি। নীরবতাই সম্মতির লক্ষণ ধরলে তাদের নিয়ে তোলা অভিযোগের ভিত্তি থাকতে পারে। এ কারণেও পাকিস্তানের সরকার প্রধান ইমরান খান বলেছেন তারা অপেক্ষা করছেন বড় দেশগুলোর জন্য। তিনি ‘একযোগে’ স্বীকৃতি দেয়ার কথা বলেছেন।
ইরানও স্বীকৃতি না দিয়ে বসে আছে। তার ভেতরে স্বস্তি সৃষ্টি হয়েছে তার ঘাড়ের কাছে থেকে যুক্তরাষ্ট্র চলে যাওয়ায়। আবার তার অস্বস্তি বা নাখোশ হওয়ার কারণ অন্য জায়গায়। তারা দেখতে চায় তালেবান সরকারে শিয়া মুসলমানদের অংশগ্রহণ। কিন্তু আফগানিস্তানের শিয়া সম্প্রদায় ‘হাজারা’দের কাউকেই নেয়নি তালেবান। ষোলোটি উপজাতিগোষ্ঠীর প্রতিনিধিত্ব তালেবান সরকারে থাকলেও ‘হাজারা’দের কাউকেই রাখা হয়নি। এ কারণে ইরান নাখোশ আফগান সরকারের ওপর। আর চীন সরকার ভাবিত তার সঙ্গে আফগানিস্তানের ৯২ কিলোমিটারের সীমান্ত নিয়ে। আফগানিস্তানে যদি রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা চলতে থাকে তাহলে তার অভিঘাত গিয়ে পৌঁছবে ওয়াখান করিডোর পার হয়ে আরো ভেতরে। সেটা সুখের হবে না, চীনা সরকার সেটা জানে। তবে চীনের অন্য দুর্ভাবনা হচ্ছে জিনজিয়াং নিয়ে। সেখানকার উইঘুর মুসলমানদের উসকে দিতে পারে আফগানিস্তানের প্রতিরোধ যুদ্ধে জয়ী তালেবানরা। তাতে করে তাদের ‘বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনেশিয়েটিভ’ (বিআরআই) প্রকল্প হুমকির মুখে পড়বে। চীন ইতোমধ্যেই অনেক বিনিয়োগ করেছে আফগানিস্তানে। তাদের চোখ এখন সে দেশের খনিজসম্পদের ওপর। শুধু তাদের চোখ কেন, আমেরিকাসহ গোটা ইউরোপের দৃষ্টি আফগানিস্তানের প্রায় তিন লাখ কোটি ডলারের (আনুমানিক) খনিজসম্পদের ওপর। সব ক্ষেত্রেই বড়, ধনী দেশগুলোর নানান বিনিয়োগ আছে বা হবে, শুধু মানবিক ক্ষেত্রে বিনিয়োগের পরিমাণ হবে যৎসামান্য। এটাই বর্তমান বিশ্বের রাজনীতি-অর্থনীতির প্যাটার্ন।
কোন বিষয়টি আগে পূরণ করতে হবে বা অগ্রাধিকার দিতে হবে, একটি সরকার যদি তা না বোঝে, তাহলে জনগণের অবস্থা করুণ হতে বাধ্য। বোধকরি তালেবান সরকারও বুঝতে পারছে না যে শিক্ষা খুবই জরুরি আফগান শিশু-কিশোরদের জন্য। সেই শিক্ষার কারিকুলাম হতে হবে একই সঙ্গে নিজস্ব জীবন ও সংস্কৃতি অনুযায়ী এবং আন্তর্জাতিক। এই দুই ধারার সংমিশ্রণেই সৃজন করতে হবে শিক্ষা কারিকুলাম। কারণ কেবল দেশীয় ও ঐতিহ্যিক শিক্ষা নিয়ে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সাথে পা মিলিয়ে চলা যাবে না। চলতে হলে আন্তর্জাতিক ভাষা ও শিক্ষা থাকতে হবে। না হলে কানেকটিভিটি গড়ে উঠবে না। এই কানেকটিভিটি জরুরি বিষয়, দেশের উন্নয়নের জন্য, দেশের সার্বিক উন্নয়নের দ্বার উন্মুক্ত করার জন্য। চীন সেটি বেশ আগেই বুঝেছিল। তাই গত চল্লিশ বছরে কী পরিমাণ উন্নতি করেছে চীন, তা তার বিদেশে বিনিয়োগ (বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ) লক্ষ্য করলেই অনুমান করা যায়। তার সামরিক খাতের উন্নয়ন অনেক ধাপ উপরে উঠে গেছে শুধু মার্কিনি সামরিক হুমকি মোকাবেলার জন্যই নয়, তার প্রতিবেশী দেশগুলোর ওপর সামরিক ও অর্থনৈতিক চাপ প্রয়োগের জন্যও। দেশটি বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করছে বটে, তবে তাদের জনগণের ওপর রাজনৈতিক চাপও কম নয়। বিশেষ করে উইঘুর মুসলমানদের ওপর রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক চাপ তাদের মননশীলতায় যে মানবিকতার তীব্র অভাব আছে তা বোঝা যায়।
ডেভেলপমেন্টের ক্ষেত্র কোনটা সেটা সব কিছুর আগে বুঝতে হবে। সার্বিক উন্নয়নের প্রধান শর্ত হচ্ছে শিক্ষা। প্রতিটি শিশুকে শিক্ষিত করতে হবে। আফগান সরকারকেই কেবল নয়, পৃথিবীর সব সরকারের জন্যই এটি জরুরি বিষয় এবং এর ওপরই জোর দিতে হবে। এ সেক্টরে বিনিয়োগ বাড়াতে হবে। আর সেই বিনিয়োগ হবে অস্ত্র কেনার বিনিয়োগের চেয়ে বেশি। বর্তমান বিশ্বের কোনো দেশ আর ভাবে না যে কোনো দেশ দখল করে পরাধীন করবে। ঔপনিবেশিক কাল পরবর্তী স্বাধীন চিন্তার কালও অতিক্রম করে আমরা পৌঁছে গেছি উত্তর ঔপনিবেশিক কালের ধারায়। এ কালে সাম্রাজ্যবাদী চেতনা ‘দেশ দখলের মতো’ মোটাদাগের মধ্যে নেই। এখনকার রাজনীতি আর্থনীতিক সাম্রাজ্যবাদের। ঔপনিবেশিক রাজনীতিরই পরবর্তী ধাপে উদ্ভাবিত হয়েছে পুঁজির সাম্রাজ্যবাদ। তাই এখন বড় দেশগুলো পুঁজির জোরে দখল নিচ্ছে অনেক উন্নয়নশীল ও দরিদ্র দেশ এবং তাদের সম্পদ লুটে নিচ্ছে নানা রাজনৈতিক-অর্থনীতির ছলাকলার মাধ্যমে। আফগানিস্তানের ওপর তাই উন্নয়নের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক নীলনকশা প্রণয়ন চলছে। বাংলাদেশের তেল-গ্যাস ক্ষেত্রগুলো যেমন বিদেশী বিনিয়োগকারীদের কাছে ব্লক তৈরি করে বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। তারাই ভোগ করবে বেশির ভাগ। মিনিমাম পাবো আমরা। আফগানিস্তানের খনিজসম্পদ এভাবেই ভোগ-দখলের চেষ্টা করছে আমেরিকাসহ ইউরোপীয় দেশগুলো। সেই তরিকায় চীন ও ভারতও আছে।
তালেবান সরকার ধনীদের এ সবই জানে বা বোঝে। কিন্তু কিছু করার নেই। তাদের অর্থনৈতিক সঙ্কট এতটাই যে, হাত পাতা ছাড়া অন্য উপায় নেই। সেটা করতেই তারা কাবুল দখলের আগেই চীনের সঙ্গে একটি মানসিক সমঝোতায় পৌঁছেছিল। কাবুলের নিয়ন্ত্রণ নেয়ার পর পাকিস্তান, ইরান ও চীন চাইছে আফগানিস্তানের সঙ্গে সম্পর্কোন্নয়নে, তালেবানরাও চায় আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পাওয়ার লক্ষ্যে। ব্যাপারটা ভাইসভারসা। ওই তিন দেশের প্রয়োজন যাতে তাদের দেশ আফগানিস্তানের ভূমি ব্যবহার করে কোনো রকম ক্ষতি করতে না পারে।
আমরা মনে করি, তালেবান সরকারকে সব দেশেরই স্বীকৃতি দেয়া উচিত। না দিলে তারা মানবিক বিপর্যয়ের মধ্যে নিপতিত হবে। সে বিপর্যয়ের দায় কোনো দেশই এড়াতে পারে না। আফগানিস্তানে এর মধ্যেই সে রকম বিপর্যয়ের আলামত দেখা যাচ্ছে।
এ পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ জরুরি। মানবতার রক্ষাই তাদের আশু ও প্রধান কর্তব্য। হ

 


আরো সংবাদ



premium cement
স্বাধীনতা সূচকে ১৬৪টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ১৪১তম নাটোর পৌরসভা কার্যালয়ের ভিতরে দুপক্ষের সংঘর্ষে একজন নিহত কাঁঠালিয়ায় মাঠে ছাগল আনতে গিয়ে বজ্রপাতে কিশোরে মৃত্যু সালমান খানের বাড়িতে গুলির ঘটনায় গ্রেফতার ২ আরো দুই সদস্য বাড়িয়ে সাত সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন রাবির নতুন জনসংযোগ প্রশাসক অধ্যাপক ড. প্রণব কুমার পাণ্ডে অপরাধ না করেও আসামি হওয়া এখন নিয়মে পরিণত হয়েছে : মির্জা ফখরুল লাঙ্গলবন্দে ব্রহ্মপুত্র নদে স্নানোৎসবে নেমে শিশুর মৃত্যু ধূমপান করতে নিষেধ করায় গলায় ফাঁস দিয়ে আত্মহত্যা বড় বোনের বৌভাতের গিয়ে দুর্ঘটনায় স্কুলছাত্র নিহত কোটালীপাড়ায় মোটরসাইকেলের ধাক্কায় বৃদ্ধ নিহত

সকল