তুরস্ক-ইরান : শত্রু-মিত্র সম্পর্কের ঝুঁকি
অবলোকন- মাসুম খলিলী
- ২০ অক্টোবর ২০২১, ০০:০০
এক.
সমৃদ্ধ ইতিহাসের উত্তরাধিকার মধ্যপ্রাচ্যের প্রধান দুই আঞ্চলিক শক্তিধর দেশ অনারব তুরস্ক ও ইরান এখন বৈশ্বিক আলোচনার দুই প্রধান কেন্দ্র। ইরান হলো শিয়া মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ থিওলজিক্যাল গণতান্ত্রিক ইসলামী রাষ্ট্র। অন্য দিকে তুরস্ক সুন্নি মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ শাসনতান্ত্রিকভাবে উদার সেক্যুলার গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র। প্রথমটি ইতিহাসখ্যাত পারস্য সাম্রাজ্যের উত্তরাধিকার আর দ্বিতীয়টি উসমানীয় খেলাফতখ্যাত তুর্কি সাম্রাজ্যের আধুনিক উত্তরাধিকার। প্রথমটি, রাজতন্ত্রের অধীনে দীর্ঘকাল থেকে ১৯৭৯ সালে ইসলামী বিপ্লবের মধ্য দিয়ে একধরনের গণতন্ত্র ও ইসলামী থিওলজির মিশেল শাসনব্যবস্থায় এখন পরিচালিত হচ্ছে। দ্বিতীয়টি, প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর খেলাফতের অবসান ঘোষণা করে এবং মোস্তফা কামাল পাশার উগ্র সেক্যুলার শাসনে বিংশ শতকের পৌনে এক শতাব্দী শাসিত হয়েছে। ২০০২ সালে রজব তৈয়ব এরদোগানের নেতৃত্বে জাস্টিজ অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট পার্টি (একেপি) ক্ষমতায় আসার পর নতুন এক শাসনধারার সূচনা হয় তুরস্কে। ২০২১ সালে এ কলাম লেখার সময় পর্যন্ত তুরস্কে শাসনতান্ত্রিকভাবে সেক্যুলার শাসন বজায় থাকলেও খেলাফত আমলের প্যান ইসলামিজম ধারা প্রবলভাবে এখন দৃশ্যমান হয়ে উঠেছে।
ইরান ও তুরস্কের মধ্যে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কে জটিল টানাপড়েন এবং সহযোগিতা দু’টিই দেখা যায়। দু’টি দেশই পরস্পরের প্রধান বাণিজ্য অংশীদার এবং ভৌগোলিক সান্নিধ্যের পাশাপাশি ঐতিহাসিক, সাংস্কৃতিক, ভাষাগত এবং জাতিগত বৈশিষ্ট্যের দিক থেকে একে অপরের ওপর নির্ভরশীল বলে মনে করা হয়। বৃহত্তর ইরানি নৃগোষ্ঠী কুর্দিরা তুরস্কের আর তুর্কি বংশোদ্ভূত গোষ্ঠী আজারবাইজানিরা ইরানের দ্বিতীয় বৃহত্তম জাতিগোষ্ঠী। দু’টি দেশই একসময়ের উল্লেখযোগ্য সভ্যতা ও সাম্রাজ্যের উত্তরাধিকার আর এখন উভয়ই বিভিন্ন ছায়াগোষ্ঠীকে সমর্থন দিয়ে মধ্যপ্রাচ্যে প্রভাব বিস্তারের জন্য লড়াই করছে।
ইতিহাস গন্তব্য ও কৌশল
তুরস্ক ও ইরান এমন দুই প্রতিবেশী দেশ যাদের মধ্যে নির্ভরতা সহযোগিতা এবং প্রতিযোগিতা তিনটি বিষয় সমান্তরালভাবে দৃশ্যমান। প্রতিবেশী দেশ হিসেবে অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিক ক্ষেত্রে নির্ভরতা দুই দেশের মধ্যে ঐতিহাসিককাল থেকে চলে এসেছে। দুই দেশই মানচিত্রের বাইরে যখনই অভিন্ন স্বার্থের বিষয় এসেছে তখনই একে অপরকে সহযোগিতা করেছে। আবার যখনই কৌশলগত স্বার্থের সঙ্ঘাত এসেছে তখনই একে অপরের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে। সিরিয়া, ইরাক, আজারবাইজান এমনকি লিবিয়া বা আফগান ইস্যুতেও দুই দেশের নীতি পদক্ষেপে পার্থক্য দেখা গেছে। তবে এসব বিষয় প্রক্সি সঙ্ঘাতের মধ্যে সীমিত থেকেছে, প্রত্যক্ষ লড়াই পর্যন্ত গড়ায়নি।
মধ্যপ্রাচ্যে বিপরীতমুখী স্বার্থ সঙ্ঘাতের পাশাপাশি অভিন্ন কিছু নীতি পদক্ষেপ দুই দেশকে নিতে দেখা গেছে যার লক্ষ্য মূলত ইসরাইল। ইরান বৈধ রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দেয় না ইসরাইলকে। রাজতন্ত্র শাসনে রেজা শাহের সাথে কূটনৈতিক ও কৌশলগতভাবে গভীর সম্পর্ক থাকলেও আয়াতুল্লাহ খোমেনির নেতৃত্বে বিপ্লবের পর ইসরাইলের সাথে ইরান দৃশ্যমান কোনো সম্পর্ক রাখেনি। বরং ইরানি পরমাণু কেন্দ্রে হামলা, বিজ্ঞানীদের হত্যা এবং ইরানি ছায়াশক্তিগুলোকে নিশানা বানানোর ঘটনায় দুই আঞ্চলিক শক্তির মধ্যে সর্বাত্মক বৈরী সম্পর্ক প্রায়ই প্রকাশ পায়। ইসরাইলের প্রধান প্রতিপক্ষ ফিলিস্তিনি প্রতিরোধ সংগ্রামীদের সাথেও রয়েছে ইরানের গভীর সম্পর্ক।
অন্য দিকে আধুনিক তুরস্কের প্রতিষ্ঠাতা কামাল আতার্তুক ও তার উত্তরসূরি সরকার ইসরাইল প্রতিষ্ঠার পর থেকে দেশটির সাথে সম্পর্ক বজায় রেখেছে। ২০০২ সালে একে পার্টি ও তার আগে নাজমুদ্দিন আরবাকানের নেতৃত্বে রাফা পার্টি ক্ষমতায় থাকাকালেও ইসরাইলের সাথে কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন হয়নি। তবে গাজা অবরোধ ভেঙে উপত্যকাটিতে ত্রাণ সহায়তা নিয়ে যাওয়া তুর্কি জাহাজে ইসরাইলের হামলার পর দুই দেশের কূটনৈতিক সম্পর্ক ভেঙে পড়ে। ইসরাইলের সাথে আরব ও মুসলিম দেশগুলোর সম্পর্ক স্বাভাবিক করার বিষয়ে ইরানের মতোই তীব্রভাবে বিরোধিতা করেছে তুরস্ক। দুই দেশই একই মাত্রায় বিরোধিতা করেছে জেরুসালেমে ইসরাইলের রাজধানী স্থাপন এবং গাজায় সামরিক অভিযানের ব্যাপারে। তবে ইসরাইলের বিরুদ্ধে ফিলিস্তিনি প্রতিরোধ সংগ্রামীদের ইরান সামরিক সহায়তা দিলেও তুরস্ক দিয়েছে কূটনৈতিক মানবিক ও অর্থনৈতিক সহায়তা।
ইরান ও তুরস্ক দু’টি দেশই আঞ্চলিক এমনকি বৈশ্বিকভাবে প্রাধান্য বিস্তারকারী শক্তি হিসেবে আবির্ভূত হওয়ার উচ্চাকাক্সক্ষা লালন করে বলে মনে করা হয়। ইরান পারস্য সাম্রাজ্যের পরবর্তী গৌরবোজ্জ্বল সময় ফাতেমি খেলাফতের প্রভাবের পুনরুজ্জীবন আর তুরস্ক উসমানীয় খেলাফতের প্রভাবের অধ্যায়টি নতুন বাস্তবতার পরিপ্রেক্ষিতে ফিরে পেতে চায় বলে মনে হয়। তবে দু’টি দেশের ভৌগোলিক অবস্থান ধর্মীয় ও জাতিগত বিশ্বাস আর বাস্তবতার কারণে প্রভাব বিস্তারের কৌশল ও পথ বেশ ভিন্ন।
ইরান বিশ্বস্ত ছায়াশক্তি হিসেবে ব্যতিক্রম ছাড়া শিয়া ধর্মমতের মুসলিম জনগোষ্ঠী ও অঞ্চলকে বেছে নেয়। লেবাননের হিজবুল্লাহ, ইয়েমেনে হুতি আনসারুল্লাহ অথবা ইরাকের মিলিশিয়া গোষ্ঠীগুলো শিয়া ধর্মমতে বিশ্বাসী। এর বাইরে শিয়া প্রধান অঞ্চল ও দেশগুলোর যেখানে ধর্মীয় চেতনা প্রবল নয় সেখানে ধর্মীয় সক্রিয়তা তৈরি ইরানের বর্তমান শাসনের অন্যতম কৌশল। একই সাথে সুন্নি ধর্মমতে বিশ্বাসীদের শিয়া ধর্মমতে নিয়ে আসার একটি প্রকল্পও রয়েছে তেহরানের। শিয়া ধর্মমতের বিস্তার ও এর অনুসারীদের সংগঠিত করার বিষয়টি শিয়া ইমামরা ধর্মীয় দায়িত্বের অংশ হিসেবে পালন করেন। তবে এর পাশাপাশি এ উদ্যোগের একটি কৌশলগত দিকও রয়েছে, যার প্রধান লক্ষ্য ইরানকেন্দ্রিক একটি শিয়াপ্রধান শাসন বলয় সৃষ্টি করা।
তুর্কি উসমানীয় খেলাফত পরিচালিত হতো সুন্নি ধর্মমত ধারণ করে। এ সাম্রাজ্যের মধ্যে তুর্কি ও আরব জাতিগোষ্ঠীর মুসলিম অঞ্চল ছাড়াও বলকান ও পূর্ব ইউরোপের কিছু এলাকা অন্তর্ভুক্ত ছিল। এটি প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর লুজান চুক্তির মাধ্যমে ভেঙে পড়ে। তুর্কি খেলাফতের উত্তরাধিকার রাষ্ট্র তুরস্কের প্রতিষ্ঠাতা কামাল আতাতুর্ক খেলাফত ব্যবস্থার অবসান ঘোষণা করে ধর্মনিরপেক্ষ তুরস্কের নতুন অভিযাত্রা শুরু করেন। এরপর তুর্কি রাষ্ট্রের সাথে ইসলামী ধর্মমত ও দৃষ্টিভঙ্গির একপ্রকার দেয়াল তৈরির চেষ্টা হয়। তবে এর পরও ৬০০ বছরের উসমানীয় খেলাফতের সময় যে ধর্মবিশ্বাস ও সংস্কৃতি লালিত হয় তার গভীর প্রভাব তুর্কি সমাজে থেকে যায়। কামাল পাশা তার সময়ে তুর্কি ভাষার আরবি অক্ষরকে রোমান অক্ষর দিয়ে প্রতিস্থাপন, অনেক ক্ষেত্রে ধর্মীয় আনুষ্ঠানিকতার ক্ষেত্রেও আরবিকে তুর্কি ভাষা দিয়ে বদলে দেয়া, ধর্মীয় অনুশীলনকে রাষ্ট্রীয় কর্মকাণ্ড থেকে বিদায় করে পাশ্চাত্য জীবনাচরণকে তুর্কি সমাজ জীবনে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করেন। আর সামরিক বাহিনীকে উগ্র ধর্মনিরপেক্ষকতার রক্ষকের ভূমিকায় নিয়ে আসেন।
উসমানীয় উত্তরাধিকার ও আজকের তুরস্ক
পৌনে একশত বছরের এই প্রচেষ্টা তুর্কি সমাজ থেকে ইসলামের শেকড় নিঃশেষ করতে পারেনি। বদিউজ্জামান নুরসির নেতৃত্বে প্যান ইসলামী আন্দোলন তুর্কি সমাজের ভেতরে একধরনের পরিবর্তন তৈরি করে। পঞ্চাশ দশকে জনপ্রিয় জাতীয়তাবাদী নেতা আদনান মেন্ডারিজ উগ্র সেক্যুলারিজমের রাশ টেনে ধর্মীয় মূল্যবোধ ও বিধিবিধান ফেরানোর চেষ্টা করেন। আরবিতে আজান দেয়া এবং বেশ কিছু বন্ধ করে দেয়া মসজিদ খুলে দেবার উদ্যোগ নেন তিনি। কিন্তু সেনাবাহিনী অভ্যুত্থান ঘটিয়ে তাকে ক্ষমতা থেকে সরিয়ে দেয় এবং কয়েকজন সহযোগীসহ তাকে মৃত্যুদণ্ড দিয়ে তা কার্যকর করে। এরপর অধ্যাপক ড. নাজমুদ্দিন আরবাকান বদিউজ্জামান নুরসির আন্দোলনকে রাজনৈতিকভাবে এগিয়ে নেন। নব্বইয়ের দশকে তিনি রাফা পার্টির নেতৃত্বাধীন কোয়ালিশন সরকার গঠন করেন। কিন্তু মেয়াদ পূর্ণ হবার আগেই সামরিক বাহিনী তার দলকে সাংবিধানিক আদালতের মাধ্যমে নিষিদ্ধ করে আর তাকে সরকার থেকে বিদায় করে।
ড. আরবাকানের দলেরই দুই নেতা রজব তৈয়ব এরদোগান ও আব্দুল্লাহ গুল একে পার্টি গঠন করে ২০০২ সালে সরকার গঠনে সক্ষম হন। এরপর থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত নিরবচ্ছিন্নভাবে একে পার্টি ও এর নেতা এরদোগান ক্ষমতায় রয়েছেন। একে পার্টির দুই দশকে তুরস্কের শাসনতন্ত্রে সেক্যুলারিজম বহাল থাকলেও ধর্মীয় বিধিবিধান পালন রাষ্ট্রীয় কর্মকাণ্ড থেকে নিষিদ্ধ করার ব্যবস্থাকে বিদায় জানানো হয়। সামরিক বাহিনীতে ধর্মচর্চায় প্রতিবন্ধকতা ও মদ্যপান বাধ্যতামূলক থাকার বিষয়ও বাদ দেয়া হয়। একই সাথে ধর্মের সম্পৃক্ততার কারণে রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ করার বিধানও অকার্যকর হয়ে পড়ে।
তুর্কি প্রেসিডেন্ট রজব তৈয়েব এরদোগান ও তার দল একে পার্টির তুরস্ক নিয়ে একধরনের কৌশলগত পরিকল্পনা দৃশ্যমান হয় গত দুই দশকে। সাধারণভাবে তুর্কি খেলাফতের কাঠামো তিনি ফিরিয়ে আনার স্বপ্ন দেখেন বলে যে সমালোচনা এরদোগানের ব্যাপারে করা হয় সেটি বাস্তবসম্মত বলে মনে হয় না। তবে তিনি মধ্যপন্থী মুসলিম দেশগুলোর সমন্বয়ে একটি মুসলিম শক্তি বলয় তৈরি করতে চান। এই বলয়ে সৌদি আরব, মিসর, কাতার, কুয়েত, আলজেরিয়া, তিউনিসিয়া, লিবিয়া, আজারবাইজান, তুর্কমেনিস্তানসহ মধ্যএশীয় প্রজাতন্ত্রগুলো, পাকিস্তান, ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া রয়েছে। এই ফোরামের আনুষ্ঠানিক রূপদানে প্রথম কুয়ালালামপুর সম্মেলনে ইরান অংশগ্রহণ করেছিল আর এই সম্মেলন ব্যর্থ করার লক্ষ্যে সৌদি আরব-আমিরাত সর্বাত্মক বিরোধিতা করে। শেষ পর্যন্ত এই উদ্যোগ খুব বেশি দূর সামনে অগ্রসর হয়নি।
তবে এ ধরনের একটি বলয় তৈরির আনুষ্ঠানিক কার্যক্রমে ভেতর থেকে নেটওয়ার্ক তৈরির কাজ অগ্রসর হচ্ছে। এ ব্যাপারে এরদোগানের নিজস্ব যে কৌশল সাম্প্রতিক বছরগুলোতে দেখা গেছে তাতে কয়েকটি পদক্ষেপ দৃশ্যমান হয়। প্রথমত, তুরস্কের প্রতিপক্ষ শক্তিচক্রের সাথে বৈরিতা কমিয়ে আনা। এটি সৌদি আরব, মিসর, আমিরাতের সাথে নেয়া হয়েছে। দ্বিতীয়ত, বৈশ্বিক পরাশক্তিগুলোর সাথে ভারসাম্যমূলক সম্পর্ক নির্মাণ। এ ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন ও ফ্রান্সের সাথে ন্যাটো জোটের অংশীদারিত্ব রয়েছে। এর প্রতিপক্ষের মধ্যে রাশিয়া ও চীনের সাথে ভিন্নমতের বিষয়গুলোকে একপ্রান্তে সরিয়ে সম্পর্ক তৈরি করা হয়। রাশিয়ার সাথে ইউক্রেন-ক্রিমিয়া সিরিয়া লিবিয়া ফ্রন্টে বিরোধ রয়েছে আঙ্কারার। তবে এস৪০০ প্রতিরক্ষাব্যবস্থা ক্রয় ও পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ নিয়ে সমঝোতা রয়েছে দুই দেশের। রাশিয়ার সাথে সমঝোতার মাধ্যমে তুরস্ক আজারবাইজান ও সিরিয়ার সঙ্কটের সমাধান করতে চাইছে। চীনের সাথেও জোরালো বাণিজ্য ও বিনিয়োগ সম্পর্ক তৈরি করেছে তুরস্ক। তৃতীয়ত, আঞ্চলিকভাবে ভিন্ন কৌশলগত লক্ষ্য অর্জনের চেষ্টারত ইরানের সাথে বিরোধের ক্ষেত্রগুলোতে সমঝোতা চেষ্টার পাশাপাশি সহযোগিতার ক্ষেত্রগুলোতে একসাথে কাজ করা।
আজারবাইজান, সিরিয়া ও ইরাকে সঙ্ঘাত সৃষ্টির মতো পরিস্থিতি একাধিকবার উদ্ভব হয়েছে। সেই বিরোধ বাড়তে না দিয়ে আঙ্কারা সেটি নমনীয় করার চেষ্টা করেছে। ইরানও এ ক্ষেত্রে ইতিবাচক সাড়া দিচ্ছে বলে মনে হয়।
সম্পর্কের উত্থান পতন
তুরস্ক-ইরানের সম্পর্কে নানা সময় উত্থান-পতন লক্ষ করা যায়। ২০১৭ সালের জানুয়ারি থেকে, সিরিয়ার গৃহযুদ্ধের সমাধানের জন্য আস্তানা আলোচনায় ইরান ও রাশিয়ার সাথে ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করেছে তুরস্ক। ২০১৭ সালে কাতার কূটনৈতিক সঙ্কটের সময় ইরানের সাথে তুরস্কের সম্পর্ক আরো উন্নত হয়। সেখানে সৌদি আরব ও সংযুক্ত আরব আমিরাতের সাথে বিরোধে কাতারকে উভয় দেশই সমর্থন করে।
২০১৭-১৮ সালে ইরানি বিক্ষোভের সময় ইরানের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপের অভিযোগ এনে তুরস্ক যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরাইলের নিন্দা জানায়। ২০১৮ সালের গ্রীষ্মে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাথে তাদের নিজ নিজ বিরোধে ইরান ও তুরস্ক একে অপরকে সমর্থন করে। ইরানের সাথে পরমাণু চুক্তি থেকে যুক্তরাষ্ট্রের প্রত্যাহারের পর ইরানের ওপর মার্কিন নিষেধাজ্ঞার প্রকাশ্য বিরোধিতা করে তুরস্ক। আর অ্যান্ড্রু ব্রুনসনকে আটক করার বিষয়ে তুরস্কের ওপর মার্কিন নিষেধাজ্ঞার নিন্দা করে ইরান।
২০১৯ সালের ফেব্রুয়ারিতে, মধ্যপ্রাচ্যে ইরানের প্রভাব মোকাবেলায় এক শীর্ষ সম্মেলনে যোগ দেয়ার জন্য যুক্তরাষ্ট্রের আমন্ত্রণ প্রত্যাখ্যান করে তুরস্ক। ২০২০ সালের জানুয়ারিতে, তুরস্ক যুক্তরাষ্ট্রের দ্বারা কাসেম সোলাইমানি হত্যার নিন্দা জানায় এবং দাবি করে যে এটি এই অঞ্চলে অস্থিতিশীলতা সৃষ্টি করবে।
এই সব ইতিবাচক দিক সত্ত্বেও তুরস্ক যখন সেনা হত্যার প্রতিশোধ হিসাবে সিরিয়া সরকারের বিরুদ্ধে সামরিক অভিযান শুরু করে তখন এই সমঝোতা ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ব্যর্থ অভ্যুত্থানের পর থেকে তুরস্কের সাথে সুসম্পর্ক বজায় রাখা ইরান সিরিয়া আক্রমণ ও সিরিয়ার আঞ্চলিক অধিকার লঙ্ঘনের জন্য আঙ্কারার সমালোচনা ও নিন্দা করে ।
সিরিয়া ছাড়াও মধ্য এশিয়ায়, বিশেষ করে মুসলিম প্রজাতন্ত্রগুলোতে প্রভাব বিস্তারের জন্য তুরস্ক ইরান যখন প্রতিযোগিতা করে তখনো তাদের বৈরিতা প্রকাশ পায়। লিবিয়ার দ্বিতীয় দফা সঙ্ঘাতে ইরানের বহুমুখী ভূমিকা আছে বলে মনে করা হয়। ইরানের বিরুদ্ধে লিবিয়ায় তুর্কিবিরোধী যুদ্ধবাজ খলিফা হাফতারকে অস্ত্র সরবরাহের অভিযোগ করে ইসরাইল। ইরান পরে অবশ্য প্রকাশ্যে লিবিয়ার গৃহযুদ্ধে তুর্কি সামরিক হস্তক্ষেপের প্রতি সমর্থন প্রকাশ করে। যদিও জাতিসঙ্ঘের একটি প্রতিবেদনে বলা হয়, ইরান হাফতারের বাহিনীকে ট্যাংক বিধ্বংসী ক্ষেপণাস্ত্র সরবরাহ করেছিল।
২০২০ সালে নাগরনো-কারাবাখ সংঘর্ষের সময় আর্মেনিয়ায় রুশ অস্ত্রশস্ত্র হস্তান্তরের সাথে ইরানি ট্রাক জড়িত থাকার খবর বের হয়। ইরান অবশ্য জোরালোভাবে এটি অস্বীকার করে এবং আর্মেনিয়া ও আজারবাইজানের মধ্যে মধ্যস্থতার প্রস্তাব দেয়। পরে ইরান আজারবাইজানের ‘আঞ্চলিক অখণ্ডতার’ প্রতি তার সমর্থন নিশ্চিত করে। তবে ইরানে এই সঙ্ঘাতে তুরস্কের ভূমিকার সমালোচনাও করে আর আগুনে ঘি ঢালার পরিবর্তে শান্তি উদ্যোগকে সমর্থন করার জন্য আঙ্কারার প্রতি আহ্বান জানায়। ইরান তার সীমান্তের কাছাকাছি ‘সন্ত্রাসীদের’ উপস্থিতি সম্পর্কেও সতর্ক করে এবং সিরিয়ার জিহাদিদের নাগরনো-কারাবাখ ব্যবহার করার জন্য অভিযোগ করে তুরস্ক এবং আজারবাইজানের বিরুদ্ধে।
এ ছাড়াও ইরান কিছু তুর্কি নাগরিকসহ উত্তর ও উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলীয় ইরানি শহরে আজারবাইজানপন্থী বেশ কয়েকজন বিক্ষোভকারীকে গ্রেফতার করে। এটি নিয়ে আজারবাইজান এবং ইরানের মধ্যে ঐতিহাসিকভাবে অস্বস্তিকর সম্পর্ক ছিল। এটি মূলত ইরানের আবুলফাজ এলচিবির মতো আজারবাইজানি নেতাদের দ্বারা প্রচারিত প্যান-তুর্কিস্ট অনুভূতির ভয় এবং ইরানের আঞ্চলিক প্রতিপক্ষ ইসরাইলের সাথে আজারবাইজানের ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের কারণে সৃষ্টি হয় বলে মনে করা হয়। অন্য দিকে আর্মেনিয়া ও ইরানের মধ্যে শক্তিশালী অর্থনৈতিক সম্পর্ক রয়েছে যা আজারবাইজানের জন্য স্বস্তিকর নয়। তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রজব তৈয়ব এরদোগানের একটি কবিতা আবৃত্তি করা নিয়েও বিতর্ক ওঠে। এটাকে কেন্দ্র করে তুরস্ক এবং ইরানের মধ্যে সম্পর্কের অবনতি ঘটে।
২০২১ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং ইইউ দ্বারা চিহ্নিত সন্ত্রাসী গোষ্ঠী কুর্দিস্তান ওয়ার্কার্স পার্টির (পিকেকে) বিরুদ্ধে তুর্কি আক্রমণের প্রতিশোধ হিসেবে ইরান সমর্থিত প্রক্সি গ্রুপ আশাব আল-কাহফ ইরাকের একটি তুর্কি সামরিক ঘাঁটিতে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালায়। উপরন্তু, ইরানের আরেক প্রক্সি হরকাত হিজবুল্লাহ আল-নুজাবা ইরাকে তার কার্যক্রম শেষ না করলে তুরস্ক আক্রমণ করবে বলে হুমকি দেয়। পিকেকের বিরুদ্ধে পরবর্তী অভিযানের ব্যাপারে ইরান থেকে তুরস্কের প্রতি এই হামলাকে একটি সতর্কতা হিসেবে বিবেচনা করা হয়েছিল। তুর্কি রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন সংবাদমাধ্যম দাবি করে যে হামলাটি এই গোষ্ঠীর প্রতি ইরানের সমর্থনকে প্রতিফলিত করে।
ইরাকের সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে তুরস্ক এবং ইরান সহযোগিতার অঙ্গীকার করে। এরপর হাজার হাজার তুর্কি সেনা উত্তর ইরাকের জঙ্গিদের বিরুদ্ধে তাদের সেনা হত্যার প্রতিশোধ নিতে গিয়ে বিমান ও স্থল আক্রমণ চালায়।
অর্থনৈতিক সহযোগিতা
ইরান এবং তুরস্কের মধ্যে খুব ঘনিষ্ঠ বাণিজ্য এবং অর্থনৈতিক সম্পর্ক রয়েছে। উভয় দেশই অর্থনৈতিক সহযোগিতা সংস্থার সদস্য। দুই দেশের মধ্যে দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য বৃদ্ধি পাচ্ছে। ২০০০ থেকে ২০০৫ এর মধ্যে, এই বাণিজ্য এক বিলিয়ন ডলার থেকে চার বিলিয়ন ডলারে উন্নীত হয়েছে। তুরস্কে ইরানের গ্যাস রফতানিও বৃদ্ধি পেয়েছে। বর্তমানে, তুরস্ক ইরান থেকে বছরে ১০ বিলিয়ন ঘনমিটার গ্যাস আমদানি করে, যা তার চাহিদার প্রায় ৩০ শতাংশ। ইরানের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার মতে, তুরস্ক দক্ষিণ পার্স গ্যাস ক্ষেত্রের উন্নয়নে ১২ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগের পরিকল্পনা করছে। উভয়ের দ্বিমুখী বাণিজ্য ২০১০ সালে ১০ বিলিয়ন ডলার ছিল। উভয় সরকারই ঘোষণা করেছে যে অদূর ভবিষ্যতে এটি ২০ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছাবে।
প্রায় দুই শতাব্দী ধরে লেভান্ট থেকে ইরাক এবং ককেশাসে ভূরাজনৈতিক প্রতিযোগিতা সত্ত্বেও, তুরস্ক এবং ইরান নিজেদের মধ্যে শান্তি বজায় রেখেছে। ক্রমবর্ধমান শক্তি এবং বাণিজ্যিক সম্পর্ককে শেয়ার করেছে, এমনকি তাদের স্বার্থ এক হলে আঞ্চলিকভাবে সহযোগিতাও করেছে। তবুও আজ যখন তাদের অর্থনীতি ক্রমবর্ধমানভাবে পরস্পরের সাথে জড়িয়ে আছে তখন ইরাক ও সিরিয়ায় ভূ-রাজনৈতিক স্বার্থ নিয়ে দু’দেশের গভীর মতবিরোধ তাদের সঙ্ঘাতের পথে নিয়ে যাচ্ছে।
সঙ্ঘাতের মূল ক্ষেত্র সিরিয়া-ইরাক
তুরস্ক এবং ইরান সাধারণভাবে সহঅবস্থানের দীর্ঘ ইতিহাস লালন করার বিষয়ে একমত বলে মনে হয়। ২০১১ সাল থেকে মধ্যপ্রাচ্য ও উত্তর আফ্রিকাজুড়ে যে উত্থান-পতন ঘটেছে তাতে ইরাক ও সিরিয়া উভয়ের জন্যই গুরুত্বপূর্ণ দু’টি দেশ। এই দুই দেশে একে অপরের বৈরী কূটকৌশলে দ্বন্দ্ব বেড়েছে। উভয়ই মসুল, তেল আফার, আলেপ্পো এবং রাক্কা রণক্ষেত্রে স্থানীয় অংশীদার এবং প্রক্সিদের ক্ষমতায়ন করেছে। আইএসকে পরাজিত বা প্রান্তিক করা এবং স্বায়ত্তশাসিত চিন্তার সিরিয়ান কুর্দিদের উত্থান রোধ করার ব্যাপারে উভয়ে কাজ করলেও বিশৃঙ্খলা থেকে উপকৃত হওয়ার লক্ষ্য আর অন্যের উচ্চাকাক্সক্ষা সম্পর্কে গভীর সন্দেহ তাদের এমন ব্যবস্থায় পৌঁছাতে বাধা দিয়েছে, যাতে সঙ্ঘাত কমতে পারে। শান্তির পরিবর্তে জাতিগত উত্তেজনা, রক্তপাত, অঞ্চলজুড়ে ক্রমবর্ধমান অস্থিতিশীলতার ঝুঁকি সৃষ্টির ইঙ্গিত বেশ পাওয়া যাচ্ছে। এমনকি যদি অসাবধানতাবশত তাদের প্রভাবের ক্ষেত্রগুলোতে সংঘর্ষ হয় তাতেও বিস্মিত হওয়ার কিছু থাকবে না। ইরানের তৈরি ড্রোন উত্তর সিরিয়ায় চার তুর্কি সৈন্যকে হত্যা করার পর এমন আশঙ্কা দেখা দেয়।
তুরস্ক এবং ইরান তাদের প্রভাব বিস্তারের এলাকায় বিশেষ করে লেভান্ট এবং ইরাকে দীর্ঘ দিন ধরে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছে, কিন্তু শেষ পূর্ণাঙ্গ অটোমান-পার্সিয়ান যুদ্ধের (১৮২১-১৮২৩) পর থেকে তারা অনেকাংশে শান্তিপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রেখেছে। সোভিয়েত ইউনিয়নের পতন ককেশাস ও মধ্য এশিয়ায় প্রতিদ্বন্দ্বিতার জন্য নতুন ক্ষেত্র খুলে দেয়। যুগোস্লাভিয়ার ভাঙ্গন এবং আফগানিস্তান ও ইরাকে মার্কিন আক্রমণ আর এর পরবর্তী ঘটনাপ্রবাহ নতুন পরিস্থিতি সৃষ্টি করে। ২০১১ সালের আরব বিদ্রোহ উভয় দেশকে, জনপ্রিয় আন্দোলনের চ্যাম্পিয়ন হিসেবে তুলে ধরে এবং তাদের নিজস্ব স্বার্থ অনুযায়ী এই অঞ্চলটিকে পুনর্নির্মাণে ভূমিকা পালনের সুযোগ এনে দেয়। হ
mrkmmb@gmail.com
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা