২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১, ১৪ শাওয়াল ১৪৪৫
`

এ ঘুম কি কখনো ভাঙবে

দেখা-অদেখা
-

স্নিগ্ধ, সুন্দর, দেশ ও দেশের মানুষের প্রতি প্রীতি ভালোবাসা স্নেহ মমতা দায়িত্ববোধ, রাষ্ট্রীয় বিধিব্যবস্থা, মহান স্রষ্টার প্রতি অখণ্ড আনুগত্য-এসব বোধ যখন মানুষ খুইয়ে ফেলে তখন ব্যক্তি বা ব্যক্তিসমষ্টির ভেতর মনুষ্যত্ব চেতনার লেশমাত্র আর অবশিষ্ট থাকে না। নীতিহীনতা স্বার্থান্ধতা শুচি শুভ্রতার গুণাবলি থেকে যোজন যোজন দূরে ছিটকে পড়ে তারা। ব্যক্তি, সমাজ, দেশ কোনো কিছুই তখন এদের কাছে নিরাপদ নয়। অঢেল দুধের মাঝে একফোঁটা গো-মূত্র নিক্ষিপ্ত হলে সুপেয় দুধ যেমন পানের অযোগ্য হয়ে যায় তেমনি ওপরের ওই মানুষরূপী অমানুষগুলোর শ্বাস-প্রশ্বাসের সাথে যে বিষবাষ্প তাদের নাসারন্ধ্র থেকে বেরিয়ে আসে সেটা সমাজের বায়ুকে এতটা বিষাক্ত করে ফেলে যে তা শ্বাস নেয়ার মতো পর্যায়ে থাকে না। সেসব মনুষ্যত্বহীন ব্যক্তিরা দশ হাতে সমাজ সংসারকে সংহার করতে উদ্যত হয়ে পড়ে। তারা এমন অপকর্ম করবেই বা না কেন? কোথাও তো কেউ নেই যে, এদের বাধাবিপত্তি সৃষ্টি করবে। এরা তখন নিজেদের ভাবে ‘অপ্রতিরোধ্য’।
এসব মানুষরূপীর বেশি শিকার হয় কিছু নির্বোধ মানুষ যারা বলতে গেলে অগ্রপশ্চাৎ বিবেচনা করে না; সাময়িক প্রাপ্তির কথা ভেবে নানা ঝুঁকি নিয়ে বসে। তাদের নির্বুদ্ধিতার জন্য খোয়াতে হয় বিপুল অর্থ। এমন অজ্ঞানতার জের তাকে ভবিষ্যতে দীর্ঘ দিন বিপর্যস্ত করে রাখে। আমাদের সমাজে এমন সব ব্যক্তি যাতে ঠকবাজদের হাতে পড়ে সর্বস্বান্ত না হয় তা ঠেকানোর কোনো প্রশাসনিক ব্যবস্থা তো নেই। আমরা উল্লেখ করব, কত মানুষকে এমন কারণে বিপদগ্রস্ত হয়ে প্রচুর অর্থদণ্ড দিতে হয়েছে।
সমাজের হতচ্ছাড়া এই দুর্বৃত্তরা দেশকে কেবলই পেছনে টেনে নিয়ে চলেছে। মানুষকে প্রতারণার ফাঁদে ফেলার জন্য এরা এবং তাদের প্রতিষ্ঠিত তথাকথিত ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান, যা কোনো আইন কানুনের তোয়াক্কা না করে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে; এ প্রতিষ্ঠানগুলো ‘ব্যবস্থা’র সাইন বোর্ড নিয়ে এমন সব গর্হিত কাজ করে চলেছে সেটা প্রকৃত পক্ষে সব রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাকে চ্যালেঞ্জ করে অগ্রসর হচ্ছে এদের বেআইনি যত কার্যক্রম।
যখন লোকচক্ষুর অন্তরাল থেকে বেরিয়ে আসে, তখনই কেবল সাধারণ মানুষ জানতে বুঝতে পারে এরা কত ভয়ঙ্কর। শুধু কোনো নদী নয়, গোটা বঙ্গোপসাগরকে এই দুর্বৃত্তরা পেটের ভেতর ঢুকিয়ে নিয়েছে। শুধু তাই নয়, এমনকি দেশের সর্বোচ্চ পর্বতশৃঙ্গ তাজিং ডং পর্যন্ত অনায়াসে হজম করে ফেলেছে। আরো হতভম্ব হতে হয়, এদের ক্ষুধার মাত্রাটা কত ব্যাপক যে ক্ষুধা দূর করতে দেশের প্রশাসন পর্যন্ত এদের সহায়তা করে। কেননা এমন সব অনিয়ম রুখতে যত বিধিব্যবস্থা রয়েছে সে সবের কোনো তোয়াক্কা না করে এবং প্রচলিত সকল ব্যবস্থার প্রতি বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে দুর্বার গতিতে সব মাড়িয়ে সম্মুখেই অগ্রসর হচ্ছে। আগেই বলেছি ন্যায়-অন্যায় কোনো বাছ বিচার না করে নিজের সম্পদ বাড়ানোর প্রতিযোগিতায় এরা মত্ত। জনগণ জানে দেশের সম্পদের কৃচ্ছ্র কতটা। আর এই দুর্বৃত্তরা জানে, এরই ভেতর দিয়ে সম্পদ কোন অন্ধকার গলিপথ দিয়ে বের করে আনা যাবে। চোরাই অর্থ দেশে রাখা নিরাপদ নয় জেনে মুহূর্তেই তা পাচার করে দেয় দেশের বাইরে। এসব ব্যক্তি কখনো বৈধপথে হাঁটে না। তাদের সব কাজ চলে আঁধারে নীরবে নিভৃতে। তাছাড়া এসব কর্ম নিয়ে দেশের প্রশাসন বা সরকারি মেশিনারিজগুলো যেন পানির অতল গভীরে ডুব দিয়ে থাকে, কিছু যেন তাদের স্পর্শ না করে।
এদিকে আমরা অর্বাচীনরা কিছুদিন পরপরই শুনি, দেশ থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা পাচার হয়ে গেছে। তবে খবর এতটুকুই, কারা কিভাবে অর্থ পাচার করল তা কিন্তু জানা যায় না। বোধ হয় কোনো দিনই জানা যাবে না। অর্থ পাচারের সাথে জড়িতদের চেহারা সুরত কেউ দেখেছে কি না তাও বলা যায় না। সম্প্রতি এক খবরে জানা গেছে, সুইস ব্যাংকে বহু বাংলাদেশীর বিপুল অঙ্কের টাকা জমা রয়েছে। নিশ্চয়ই সবার মনে আছে, কিছুকাল পূর্বে বাংলাদেশ ব্যাংকের বিপুল অর্থ বাইরে চলে গেছে। সেটা যেমন রহস্য, যা কখনো সাধারণ্যের কাছে উন্মোচিত হবে না, সুইজ ব্যাংকের কাহিনী কেউ জানবে না।
রাষ্ট্রযন্ত্রের যত কলকব্জা রয়েছে, তা যদি সঠিকভাবে কাজ না করে তবে বুঝতে হবে, এর সুষ্ঠু রক্ষণাবেক্ষণে অবহেলা এবং তার চালক হয় অদক্ষ বা অমনোযোগী; দায়িত্ব পালনের ব্যাপারে নিষ্ঠার অভাব অপরিসীম। এসব কারণে অর্থ পাচারের মতো নানা অনাকাক্সিক্ষত দুর্ঘটনা ঘটতে থাকবেই। প্রতিটি দেশ বিধিবদ্ধ আইন কানুন অনুসরণ করে চলে। কিন্তু প্রশাসনিক ব্যবস্থায় যদি দুর্বলতা থাকে, আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় অনীহা, সুশাসন এবং শুদ্ধাচারের ক্ষেত্রে দায়িত্ব পালনে গাফিলতি দেখা দেয় তবে রাষ্ট্রে অনাচার অনিয়ম দুরাচারীদের দৌরাত্ম্য এতটাই বৃদ্ধি পায়, যা দেশের নাগরিকদের অধিকার খর্ব ও সম্পদের খেয়ানত হতে থাকবে। যেমন দেহে যখন অসুখ-বিসুখ দেখা দেয় যথাসময় তার নিরাময়ের ব্যবস্থা যদি না হয় তাহলে একপর্যায়ে আর কোনো প্রতিষেধকই কাজ করবে না। দেশে এখন ঘন ঘন এমন সব অপরাধ অপকর্ম ঘটছে। তাকে অবশ্যই অশনিসঙ্কেত বলতে হবে। এই সঙ্কেতের ভাব ভাষা ও গুরুত্ব উপলব্ধি করার ক্ষেত্রে বিলম্ব হলে মানুষ দেশ নিয়ে যে আশার আলোর ঝলকানি দেখছে তা হঠাৎ করেই নিভে যেতে পারে। তাতে যে অন্ধকারের সৃষ্টি হবে তখন মানুষের পক্ষে পথচলা দুরূহ হলেও মানুষরূপী হিংস্র হয়ে উঠবে; দানব তস্করদের জন্য জনপদগুলো হবে অভয়ারণ্য। শত হাতে অর্থ সম্পদ লুটেপুটে নিয়ে ছাই ভস্মই ফেলে যাবে।
অন্যায় অন্যায্য পথে চলতে এসব দুর্বৃত্তরা এতটা বাধাহীনভাবে এগিয়ে যাবে? রাষ্ট্রীয় প্রশাসন কি এমন অসহায় অক্ষম, সে সব কিছু দেখেও নীরব দর্শকের মতো মূক হয়ে থাকবে? তাছাড়া এটাও কি বিশ্বাস করতে হবে, দুরাচারীদের পেছনে কারো কোনো মদদ নেই? অদৃশ্যে থেকে এদের কেউ কোনো আশীর্বাদ দিচ্ছে না? পথ অতিক্রম করতে কেউ কি তাদের সবুজসঙ্কেত দিচ্ছে না? এসব বিষয় মানুষ বোঝে। তাদের যারা এত বোকা ঠাওরাবে, আসলে তারাই আহাম্মক।
এই নিবন্ধে দুরাচারীদের দুষ্কর্মের যে আভাস ইঙ্গিত দেয়া হয়েছে অতি সাম্প্রতিককালের জাতীয় দৈনিকে প্রকাশিত ২-১টি প্রতিবেদন থেকেই এসব বিষয় জেনেছি। সেসব প্রতিবেদনের শিরোনাম ও রিপোর্টের তথ্য-উপাত্ত সংক্ষিপ্তভাবে তুলে ধরা হবে। এটা ঠিক যে, এমন বহু রিপোর্ট রয়েছে কিন্তু পত্রিকায় তো স্থান সঙ্কুলান হবে না। সে যাই হোক, একটা বিষয় উল্লেখ করতে চাই, প্রশাসনের একটি অংশ সাংবাদিকদের প্রতি নেতিবাচক মনোভাব দেখিয়ে আসছেন, যা সাংবাদিক সমাজকে ক্ষুব্ধ এবং বেদনাবিধুর করে তুলেছে। একটা কথা দ্বিধাহীনভাবে বলতে চাই, সাংবাদিক সমাজ কোনোকালেই রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে বা মনগড়া কোনো রিপোর্ট তৈরি করে না কিংবা করতে পারে না। কেননা রিপোর্ট তৈরির ক্ষেত্রে যে সাধারণ ‘ব্যাকরণ’ রয়েছে সেখানে বস্তুনিষ্ঠ তথ্য-উপাত্ত ভিন্ন কোনো ‘ফ্যাব্রিকেশন’ করা সম্ভব নয়। সাংবাদিকরা দেশের মানুষ এবং দেশের প্রতি প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। এই দুইয়ের কল্যাণ কিভাবে হবে সেটাই তাদের সারাক্ষণের চিন্তা। তবে সেই সাথে যাদের দ্বারা জনগণ ও দেশের স্বার্থ ক্ষুণ্ন হবার সম্ভাবনা থাকে, সাংবাদিকরা অবিরাম তাদের বিপক্ষে কলম চালনা করেই যান। নিজস্ব মত বা রাজনৈতিক চেতনার ঊর্ধ্বে উঠেই তারা সে কাজ করেন। সাংবাদিকদের নিজস্ব রাজনৈতিক মত ও বিশ্বাস নেই, এ কথা বলব না। তবে অ্যাক্টিভিস্টদের মতো তারা পথেঘাটে রাজনীতি নিয়ে স্লোগান দিয়ে বেড়ান না বা দলবাজি করেন না। তাদের রাজনীতি চর্চা কেবলমাত্র ভোটদানের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে। নির্বাচন এবং অন্য কোনো রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে যারা অন্যায় অনিয়ম করে, মতপথের ঊর্ধ্বে উঠে সংবাদকর্মীরা তার সমালোচনা করার সাথে সাথে ঘটনার ব্যাপারে পক্ষপাতিত্বহীন রিপোর্ট প্রকাশ করেন।
তা ছাড়া যেকোনো সাংবাদিকের পক্ষে প্রতিবেদন রচনার ক্ষেত্রে এ বিষয়ে যে ব্যাকরণ রয়েছে তাও লঙ্ঘন করা সম্ভব নয়। কোনো সময় যদি বিশেষ কোনো দিকে রিপোর্ট ঝুঁকে পড়া বা নিজস্ব মতামত ও ব্যাখ্যা তাতে সংযুক্ত করা হয় সেটাও সম্ভব নয়। কেননা সম্পাদকের কাঁচি বড় অকরুণ। সে কাঁচি যথাস্থানে চালাতে এতটুকু মনস্তাপ সম্পাদকের হয় না। প্রতিবেদন রচনার ব্যাকরণে যা যা আদর্শিক সেটাই কেবল বিচার্য বিষয়। কেউ হয়তো বলবেন, সম্পাদকীয় পাতায় তো মতামত সন্নিবেশিত থাকে। সে প্রসঙ্গে কথা হচ্ছে- এটাও সংবাদপত্রের ব্যাকরণসিদ্ধ এবং দীর্ঘকাল থেকেই এর অনুশীলন হয়ে আসছে। যে মতামতের কথা বলা হলো তা প্রবীণ সম্পাদকের অভিজ্ঞতাসঞ্জাতবোধ, যা সব ক্ষেত্রেই কল্যাণচিন্তা থেকেই সম্পাদকীয় পাতায় সংযুক্ত হয়ে থাকে। তা কখনোই বায়বীয় নয়। সে সমালোচনা দুর্মুখের সমালোচনা বা অসৎ উদ্দেশ্যেও নয়। বহু বিবেচনার পর যা সত্য সঠিক বলে মনে করা হয় তাই প্রকাশ করা হয়। এ কথাও সত্য, কেউই পুরোপুরি ভুলত্রুটির ঊর্ধ্বে নয়।
সম্প্রতি একটি জাতীয় দৈনিকের খবরে তথ্য ও সম্প্রচারমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ একশ্রেণীর সংবাদপত্র ও তাদের কর্তৃপক্ষের ব্যাপারে কিছু মতামত ব্যক্ত করেছেন, যাকে কোনোভাবেই খাটো করে দেখার অবকাশ নেই। বরং তিনি বাস্তব অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতেই সত্য কথাটিই বলেছেন। “গণমাধ্যম কেউ নিজের স্বার্থে, কেউ ব্যবসায়িক স্বার্থকে ‘প্রোটেকশন’ দেয়ার জন্য ব্যবহারের চেষ্টা করছে। আবার কেউ ব্রিফকেস নিয়ে গণমাধ্যমের মালিক হয়ে যাচ্ছেন, তিনিই সাংবাদিক তিনিই রিপোর্টার। এক দফতর থেকে ওই দফতরে ঘুরে বেড়ান। বিজ্ঞাপন কালেকশন করেন এবং সেই বিজ্ঞাপন যেদিন পান সেদিন পত্রিকা ছাপেন। ১০০ পত্রিকা ছাপান, ১০০ দফতরে দেন। এতে ভালো গণমাধ্যমগুলো চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ছে। অনেক সময় তাদের পক্ষে টিকে থাকা কঠিন হয়ে যাচ্ছে। ব্রিফকেসবন্দি পত্রিকা যেগুলো আসলে ছাপাই হয় না, সেগুলো মাঝেমধ্যে হঠাৎ ছাপায়। সেগুলো আমি বন্ধের উদ্যোগ নিয়েছি।”
মন্ত্রী যে সিদ্ধান্তের কথা জানালেন তা প্রকৃতপক্ষে একটা ইতিবাচক পদক্ষেপ। সত্যিকার সংবাদপত্রগুলোর জন্য তা কল্যাণকর হবে।
মন্ত্রীকে সাধুবাদ জানিয়ে বলতে চাই, সমাজের এমন ক্ষত সৃষ্টিকারীদের দৌরাত্ম্য এখন সীমাহীন। তথ্য মন্ত্রণালয়ের সাথে এদের সংশ্লিষ্টতা নেই। প্রশাসনের অন্যদেরও তাই এমন ভিজিলেন্স থাকা দায়িত্ব যাতে মানুষ সমাজ ও রাষ্ট্রের প্রতি তাদের যে কমিটমেন্ট তা পূর্ণ হবে; সমাজের দ্রুত অগ্রগতি ঘটবে। সরকারের সব কর্মকর্তা বিবেক ও মানুষের প্রতি ভালোবাসা বুকে নিয়ে কাজ করলে নিজের পদমর্যাদার প্রতি সুবিচার করা হবে।
পত্রিকা থেকে অনিয়মের যে কলঙ্কগুলো উদ্ধৃত করার কথা বলেছি তা এখন তুলে ধরতে চাচ্ছি। দেশের অন্যতম জাতীয় দৈনিক ‘প্রথম আলো’য় প্রকাশিত খবর দিয়েই শুরু করছি। তার প্রতিবেদনের শিরোনাম ছিল- ‘লোপাট ২১ হাজার কোটি’। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বহু ছাড়ে ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে পণ্য কিনে আবার বিক্রি করতেন পুরনো ঢাকার জনৈক ব্যবসায়ী (নাম প্রকাশ করা হলো না)। ওই ব্যবসায়ী পাঁচটি ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানের পণ্য কিনতে টাকা জমা দিয়েছিলেন। এর মধ্যে দুুটির মালিক প্রতারণা মামলায় কারাগারে। এক মালিক বিদেশে পালিয়ে গেছেন। দুটি টাকা ফেরত দিচ্ছে না। ই-কমার্সের নামে প্রতারণার শিকার হাজার হাজার মানুষ। এমনি প্রতারণার শিকার হয়ে ৯ বছর আগে আত্মহত্যা করেছিলেন এক ব্যক্তি। টাকা হজমের এমন বহু রিপোর্ট রয়েছে বিভিন্ন পত্রিকায়।
দৈনিক সমকালের রিপোর্টের শিরোনাম হচ্ছে- ‘লোভ দেখিয়ে টাকা হাতানো থামেনি’। রিপোর্টে বর্ণনা করা হয়েছে, ‘ই-কমার্সের নামে বিশাল ছাড়ের লোভ দেখিয়ে গ্রাহকের অর্থ হাতিয়ে নেয়ার তৎপরতা অব্যাহত রয়েছে। সরকার ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর নানা তৎপরতার মধ্যেও তাদের ব্যবসা চলছে। অন্তত চারটি ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানে এখনো ২০ থেকে ৭০ শতাংশ পর্যন্ত ছাড়ের অফার রয়েছে। এসব অফারের গ্রাহকের জন্য ক্যাশ অন ডেলিভারির (সিওডি) সুযোগ নেই। অগ্রিম টাকা দিয়ে পণ্য কিনতে হচ্ছে। আগের অফারের পণ্যই এখনো গ্রাহকদের কাছে সরবরাহ করতে না পারলেও নতুন অফার দিচ্ছে প্রতিষ্ঠানগুলো।’ এভাবে শত হাজার কোটি টাকা আত্মসাৎ করছে এসব প্রতিষ্ঠান।
কালের কণ্ঠ পত্রিকার শিরোনাম- ‘ইভ্যালির কায়দায় আরো ৫ কোম্পানি’। রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়েছে, ‘বিতর্কিত ইভ্যালির মতো ‘পঞ্জি’ মডেলে ব্যবসা চালাচ্ছে আরো পাঁচটি ই-কমার্স কোম্পানি।’ রিপোর্টে বক্সের মধ্যে উল্লেখ করা আছে, ‘মার্চ থেকে জুন পর্যন্ত শীর্ষ ২৫টি ই-কমার্সে লেনদেন হয়েছে ছয় হাজার ৭০০ কোটি টাকা। আরো উল্লেখ রয়েছে, এখানে আত্মসাৎ হয়েছে এক হাজার ৫০০ কোটি টাকা।’ এমন সব প্রতিষ্ঠানের দুর্নীতির খতিয়ান বের করতে সুষ্ঠু তদন্ত জরুরি। যেসব অর্থ-কড়ি লোপাট হয়েছে তাতে অনেকে মনে করে এটা শুধু ‘আইসবার্গের পিক’ মাত্র। ব্যবসার নামে কী পরিমাণ অর্থ লোপাট হয়েছে, কত ব্যক্তি এসবের সাথে জড়িত এবং কত মানুষ প্রতারিত হয়েছেন সেটা আসলে জানা এখন সম্ভব নয়। বহু প্রতারক গাঢাকা দিয়ে আছে। কেউ বিদেশে পালিয়েছে। তার পরও অনেক প্রতিষ্ঠান ব্যবসার নামে প্রতারণা চালিয়েই যাচ্ছে। এই নিবন্ধে তো দু-একটি প্রতিষ্ঠানের খবর মাত্র উল্লেখ করা হয়েছে। পত্রিকার সচেতন পাঠকরা নিশ্চয়ই প্রতিদিন খবরের কাগজ পাঠ করছেন, কত অনিয়ম হচ্ছে আর বিপুল অর্থ লোপাট আর পাচারের কাহিনী জানছেন। এই পর্যায়ে দেশের উচ্চ আদালত এমন অর্থ তছরুপের প্রসঙ্গে মন্তব্য করেছেন, ‘মানুষ নিঃস্ব হলে পরে পদক্ষেপ নেয়া হয়।’ এর সরল অর্থ এটাই, সংশ্লিষ্ট প্রশাসন প্রকৃতপক্ষে নাকে তেল দিয়ে ঘুমায়, সে ঘুম তো কখনোই ভাঙতে চাইবে না। আমরা এর আগেও দেখেছি উচ্চ আদালত স্বপ্রণোদিত হয়ে সমাজ-রাষ্ট্রের বহু ব্যত্যয় তুলে ধরে তাদের বিজ্ঞ অভিমত পর্যবেক্ষণ ব্যক্ত করেছেন। কিন্তু কে তার হদিস করে? সব যেন হাওয়ায় মিলিয়ে যায়।
যেসব অনিয়ম অপরাধ আর অর্থ লোপাট হওয়া নিয়ে পত্রিকা থেকে উদ্ধৃত করা হয়েছে, এগুলো দূর অতীত থেকেই হয়ে আসছে। কোনো প্রশাসনেরই তাতে কখনো কানে পানি প্রবেশ করেছে বলে মনে হয় না। আমাদের সব পর্যায়ের এবং বিভিন্ন রাজনৈতিক সংগঠনের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিরা যখন মাঠে ঘাটে এসব অব্যবস্থা অনিয়ম দুর্নীতির কথা বলেন তখন মনে হয় তাদের মুখে খই ফুটছে। কিন্তু এসব নিছক লিপ সার্ভিস বৈ কিছু নয়। সরকারি দলের যেসব নেতা সংসদ সদস্য, কালেভদ্রেও দুর্নীতি অনিয়ম নিয়ে সংসদে তাদের ‘টুঁ’ শব্দটি পর্যন্ত করতে শোনা যায় না। সংসদ এবং সংসদের বাইরে তাদের এমন দ্বিচারিতা নিয়ে কোনো মন্তব্য করতে চাই না। শুধু প্রশ্ন করব, স্বাধীনতার ৫০ বছর পর আজ কেন মানুষের ভাগ্যের চাকা ঠেলা ধাক্কা দিয়ে ঘোরাতে হয়? এ পথ মসৃণ করা গেল না কেন? যেসব অনিয়মের কথা উপরে উল্লেখ করেছি তার রিমেডির জন্য দ্রুত পদক্ষেপ নেয়া আবশ্যক। সে ক্ষেত্রে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। অপরাধীদের আইনের আওতায় নিয়ে এসে বিহিত ব্যবস্থা অর্থাৎ তাদের বিরুদ্ধে আইন প্রয়োগ করে শাস্তির বিধান করা না হলে যে অপরাধপ্রবণতা সমাজ রাষ্ট্রকে গ্রাস করতে চাইছে তা প্রতিহত করা অসম্ভব হয়ে পড়বে।
‘আইনের শাসন’ বলতে বোঝায় শাসক ও শাসিত একই আইনের অধীনে থাকবে। কোনো ব্যক্তি আইনের ঊর্ধ্বে নয়। অপরাধ যেই করুক, তার ক্ষমতা পদমর্যাদা নির্বিশেষে কিছু মাত্র পার্থক্য করা যাবে না, অপরাধীদের ক্ষেত্রে অনুকম্পা দেখানো যাবে না। কথাটা আইনের শাসন বলবৎকারীদের জন্য শ্রুতিমধুর হবে না বটে, তার পরও বলছি। আইনের শাসনের সূচকে সাম্প্রতিককালে বাংলাদেশের অবনতি ঘটেছে। সেই সূচক অনুসারে, বিশ্বের ১২৮ দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ১১৫তম স্থানে। আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় যে সংস্থাগুলো দায়িত্বশীল, অভিযোগ রয়েছে, তারা স্বয়ং বেআইনি কার্যক্রমের সাথে জড়িত। সেই সাথে নিজেদের মধ্যে শৃঙ্খলারও অভাব রয়েছে। এসব বাহিনীর সদস্যদের দুর্নীতি অনিয়ম এবং নাগরিকদের সাথে হয়রানিমূলক আচরণ করার বহু অভিযোগ রয়েছে। বাহিনীর কোনো কোনো সদস্যের বিরুদ্ধে মাদক গ্রহণ এবং মাদক পাচারে সহযোগিতা করার বহু ঘটনা রয়েছে। তাদের শাস্তির সম্মুখীন হতে হয়েছে। বাহিনীর কিছু সদস্যের মাদক গ্রহণের বিষয় প্রকাশ্যে এলে বাহিনীতে ডোপ স্টেস্টের ব্যবস্থা চালু করা হয়েছে। এ কথা স্বীকার করতে হবে, বাহিনীর শীর্ষ কর্মকর্তা এসব বিষয়ে কঠোর অবস্থানে রয়েছেন। মাঝে মধ্যেই তার তরফ থেকে যেসব বক্তব্য বিবৃতি পত্র-পত্রিকায় দেখা যায়, তাতে বাহিনীকে সুশৃঙ্খল এবং দক্ষ করার ব্যাপারে তার নিষ্ঠা আন্তরিকতার প্রকাশ পরিষ্কার হয়ে ওঠে।
আইনের শাসন বলবৎ করাই যথেষ্ট নয়। দেশে সুশাসন প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে সরকারের একটি অংশ হিসাবে তাদের ভূমিকা রাখার দায়িত্ব রয়েছে। সুশাসনের সাথে যেসব বৈশিষ্ট্য রয়েছে তার অন্যতম হচ্ছে আইনের শাসন ও দুর্নীতির মূলোচ্ছেদ করা। আইনের শাসন নিয়ে সামান্য কিছু বলা হয়েছে বটে। দেশের পুলিশ বাহিনীরও দুর্নীতি উচ্ছেদে সরকারের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানকে সহায়তা দেয়ার ক্ষেত্রে ভূমিকা রাখছে। দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে সরকারের সংশ্লিষ্ট সংস্থার অভিযানের সময় পুলিশ বাহিনীর দায়িত্ব পালন অপরিহার্য হয়ে ওঠে। আমরা উন্নয়ন ও নাগরিক অধিকারের সুরক্ষার কথা বলি। সেখানে অবশ্যই উচ্চমানসম্পন্ন তথা প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত চৌকস পুলিশের ধারণাকে বাইরে রাখা হলে কোনোক্রমে সেসব ধারণার বাস্তবায়ন সম্ভব হবে না। আধুনিক সমাজের আইডিয়া থেকে আইডিয়াল পুলিশ বাহিনীর সম্পৃক্ততাকে পৃথক করা যাবে না। পুলিশের ওপর গুরুত্ব আরোপ নিয়ে যেসব কথা বলা হলো তাতে কেউ যেন মনে না করেন- পুলিশ বাহিনী নিয়ে যেসব কথা বলা হয়েছে তাতে বেশ কিছু বলা হয়েছে। আমাদের পুলিশ বাহিনী নিয়ে যে প্রত্যাশা সেটা হলো, গণতন্ত্রের পীঠস্থান গ্রেট ব্রিটেনের স্বনাম খ্যাত যে পুলিশ বাহিনী, আমাদের মগজে সেই পুলিশকেই লালন করি। আমরা মার্কিন পুলিশকে বরং বর্ণবাদী পুলিশ ভাবি। তাদের ধারণা ‘কালার আর বেইজের’ ঊর্ধ্বে ওঠা সম্ভব নয়।
পৃথিবীর যেসব দেশে আইনের শাসন বিদ্যমান, সেখানে আইন কোনো অবস্থায় কারো সাথে আপস করে না বা অনুকম্পা দেখাতে বিন্দুমাত্র অভ্যস্ত নয়; ব্যক্তি প্রতিষ্ঠান তা যতটা গুরুত্বপূর্ণ হোক না কেন। তাদের দ্বারা আইন ভঙ্গের কারণ ঘটলে, অসততা প্রদর্শন করা হলে, কারো অতীত ও বর্তমান পরিচয় যাই হোক আইনের কাঠগড়ায় তাকে দাঁড়াতেই হবে।
বিশ্বব্যাপী বহুল পঠিত একটি খবর হচ্ছে, ২০১২ সালে নির্বাচনী প্রচারণার সময় অবৈধ অর্থায়নের দায়ে অভিযুক্ত হয়েছেন ফ্রান্সের সাবেক প্রেসিডেন্ট নিকোলাস সারকোজি। সম্প্রতি আদালত তাকে এক বছরের কারাদণ্ড দিয়েছেন। বিশ্বে একটা নতুন কোনো ঘটনা নয়। অনেক দেশেই মন্ত্রী-প্রধানমন্ত্রী এমনকি প্রেসিডেন্টকে আইনের ব্যত্যয় ঘটানোর কারণে শাস্তি ভোগ করতে হয়েছে। সমাজের উপরতলায় আইনের প্রয়োগ যদি স্বচ্ছ ও যথাযথ হয় তবে সর্বত্র ইতিবাচক প্রভাব পড়বে। এই প্রভাব আমাদের দেশে বিদ্যমান নেই বলে যত অঘটন ঘটছে অহরহ। শাস্তির বিধান থাকা সত্ত্বেও তা কার্যকর হতে বহু বিলম্ব ঘটার কারণে সব অর্থহীন হয়ে পড়ে। দেশের যে সর্বভুক ব্যক্তির রাষ্ট্রীয় সম্পদ লুণ্ঠনের যেসব কাহিনী বলা হয়েছে, তার পরিপ্রেক্ষিতে সুদূর অতীতের জগদ্বিখ্যাত এক নৃপতির কথা স্মরণ হলো। তিনি মেসিডোনিয়ার তৃতীয় আলেকজান্ডার যিনি অধিক পরিচিত মহান আলেকজান্ডার নামে; যার জন্ম ৩৫৬ খ্রিষ্ট-পূর্বাব্দে। ৩৩৬ খ্রিষ্ট-পূর্বাব্দে তার পিতার মৃত্যুর পর মাত্র ২০ বছর বয়সে তিনি পিতার স্থলাভিষিক্ত হন। তার শাসনামলের অধিকাংশ সময় তিনি উত্তর-পূর্ব আফ্রিকা ও পশ্চিম এশিয়াজুড়ে সামরিক অভিযান পরিচালনা করেছেন। ৩০ বছর বয়সের মধ্যেই তিনি মিসর থেকে পশ্চিম ভারত পর্যন্ত প্রাচীন বিশ্বের বৃহত্তর সাম্রাজ্যগুলোর অন্যতম একটি সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। দীর্ঘকাল সমরাভিযান চালিয়ে ভারত থেকে প্রত্যাবর্তনের কিছু পর খ্রিষ্টপূর্ব ৩২৩ অব্দে ইরাকের ব্যাবিলনে তার মৃত্যু হয়। এত ইতিহাস বলার কারণ হচ্ছে- কথিত আছে তার মৃত্যু-পূর্বাহ্নে তিনি তার সহযোগীদের এই মর্মে নির্দেশ দিয়েছিলেন যে, মৃত্যুর পর তার শবযাত্রার সময় যেন তার হাত দুটো কফিনের বাইরে দু’পাশে বের করে রাখা হয় যাতে মানুষ দেখতে পায় বিশ্ববিজয়ী আলেকজান্ডার পৃথিবী ছেড়ে যাচ্ছে একেবারে শূন্য হাতে। কিছুই তার সাথে নেই। স্বাভাবিকভাবে মনে জাগে, দেশের দুরাচারী সর্বভুকরা কি অমরত্বের কোনো পয়গাম নিয়ে পৃথিবীতে এসেছে? নাকি বিশ্বের চিরায়ত নিয়মে এই ধরা থেকে চলে যেতে হবে? তাদের কালেভদ্রে কি স্মরণ হয় এসব কথা? তখন চোরাই সব সম্পদ কোথায় নিয়ে যাবেন?
ndigantababor@gmail.com


আরো সংবাদ



premium cement