২০ এপ্রিল ২০২৪, ০৭ বৈশাখ ১৪৩১, ১০ শাওয়াল ১৪৪৫
`

সমাজের দায় নাকি সরকারের

-

সমাজে যে কত রকম অন্যায় হয়, হতে পারে, তা আমরা সাদা চোখে দেখিÑ অন্যায়-অপরাধ বলে মনে করি না অনেক সময়। সেসব যেন অন্যায় বা অপরাধই নয়, এভাবেই চলে আমাদের চেতনা বা সাংস্কৃতিক শিক্ষা। এই যেমন খেলাচ্ছলে অন্যের বাড়ির বেড়া ভেঙে দেয়া, গাছের ইটা দিয়ে আম পেড়ে নেয়া, কিংবা বিনা কারণে অন্যের গরু, বাছুর, ছাগল-ভেড়া ইত্যাদি ধরে নিয়ে গিয়ে ‘খোঁয়াড়ে’ দেয়া ইত্যাদি। ঠিক ওই একই মানসিকতা থেকে গ্রামবাংলায় পাশের বাড়ির তরুণীকে খারাপ কথা বলা বা কটূক্তি করে মজা লোটাÑ যাকে শহুরে ভাষায় বলে ‘ইভটিজিং’ আজো যুব মানসে টিকে আছে। তাদের নবযৌবনের সাহসের ওই কাজটি যে মারাত্মক ক্ষতি ডেকে আনতে পারে, তা নিয়ে আমাদের সমাজ নেতারা তেমন একটা ভাবিত নন। কিন্তু ওই ইভটিজিংয়ের কারণে স্পর্শকাতর অনেক তরুণী আত্মহত্যার পথ বেছে নিয়েছে, সেসব সংবাদ আমরা বহুবারই পত্রিকায় পড়েছি। সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে বাসা বেঁধে আছে ওই হিং¯্র সাপটি। আমরা তাকে পাত্তা দিই না। সেই ইভটিজিংয়ের [এক্সটেনডেড] বাড়তি ও বড় অপরাধের নাম হতে পারে, বন্ধু-বান্ধবীদের নিয়ে পার্টি করা। সম্প্রতি ভারতীয় সিনেমার সুপার স্টার মুম্বাই বাদশাহখ্যাত শাহরুখ খানের ছেলে আরিয়ান ও তার বন্ধু-বান্ধবীরা ধরা পড়েছে পুলিশের হাতে, মাদকদ্রব্যসহ। আরিয়ান খান এখনো পুলিশের কাস্টডিতে।
আনন্দভ্রমণ ও হৈ-হুল্লোড় করা, মাদক গ্রহণ, মদ খেয়ে আনন্দফুর্তির আয়োজন এবং বাগি¦তণ্ডা, গালি-গালাজ, দেখে নেয়ার হুমকি, থানা পুলিশের হস্তক্ষেপ এবং অভিযুক্তকে আটক এসব কি এখন আমাদের দেশেও কম-বেশি নিত্যনৈমিত্তিক হয়ে ওঠেনি?। বোট রেস্তোরাঁয় চিত্রনায়িকা পরীমণির কেসটা কিন্তু সেই রকমই অনেকটা। আপন জুয়েলার্সের মালিকের তরুণ ছেলের বিচার শেষ হয়েছে বলা যেতে পারে। ওই ঘটনাটিও ওই কথিত পার্টির পথেই হয়েছে। পরীমণিকে যে রকম হেনস্তা করা হয়েছে, তিনি শিল্পী না হলে সমাজের ভয়ে [সমাজ সবসময়ই ছি ছি করে ওঠে কোনো দোষ বিচার না করেই] হয়তো তিনি আত্মহননের পথ বেছে নিতে পারতেন। তার ভাগ্য ভালো বলতে হবে। তিনি সমাজের ওই ধরনের টিটকারির তোয়াক্কা করেননি। এই সমাজ শিল্পীদের খারাপ চোখেই দেখে আজো। প্রয়োজনের সময় তা প্রকাশ করে।
গত শতকের ৮/৯-এর দশকে আমরা দেখেছি ইভটিজিং ও পুলিশের হয়রানি, অপদস্থ করা ও অপরাধী সাব্যস্ত করার হুমকির পর ভিকটিম তরুণী আত্মহত্যা করেছেন। এরকম আরো বহু ঘটনা গণমাধ্যমে আসে না, তাও ওই সমাজের চোখে ‘খারাপ’ মেয়ে হিসেবে গণ্য হওয়ার ভয়ে।
খালি চোখে বা সাদা চোখে দেখলে মনে হতে পারে সমাজের ভেতরে বাস করা এই মারাত্মক ‘রোগ’ বা অপরাধপ্রবণতাটি নেই। মাস্তানপ্রবণ আমাদের সমাজের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে নিত্যই এমনটা ঘটে চলেছে। প্রযুক্তির বানে আসা টিকটক নামের ভিডিও সংস্কৃতি একশ্রেণীর বিকৃত অর্ধশিক্ষিত ও নিরক্ষর ছেলেমেয়েদের অপকর্ম সমাজে আরো অপরাধের দরোজা খুলে দিচ্ছে বা দিয়ে চলেছে। অতি সম্প্রতি মিরপুর থেকে যে তিনটি মেয়ে উধাও হয়ে গিয়েছিল, তারা অবশেষে ফিরে এসেছে। তাদের একজনের নামের সাথে ‘টিকটক অমুক’ লেখা পড়েছি পত্রিকায়। টিকটক নামক ভিডিওর এক আতঙ্কজনক খেলা চলছে সমাজে। গণযোগাযোগমাধ্যমে অশ্লীল-প্রায় ভিডিও আপ করে ভিকটিমকে নগ্ন করে দিচ্ছে। সাংস্কৃতিক দুর্বৃত্তায়ন এখন নতুন যুগের সূচনা করতে যাচ্ছে। আবার সম্ভ্রমহানির পর তার চিত্র ধারণ করে ব্ল্যাকমেইল করার অনেক সংবাদই আসে গণমাধ্যমে ও পুলিশের কাছে। তার মানে, যে নামেই ডাকা হোক না কেন, সমাজে নারীদের মানসম্মান নিয়ে দেশের সাক্ষর-শিক্ষিত সমাজ তেমনটা সজাগ ও ভাবিত নয় বলেই মনে করা যায়। পরিবারে ও সমাজে নারীর মর্যাদা তেমন বাড়েনি। সমাজে শিক্ষার হার বেড়েছে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। আমাদের গড় শিক্ষার হার সরকারি হিসেবে ৬২ শতাংশ এরও বেশি। কিন্তু সেই শিক্ষিত লোকেরাও ওই ধরনের অপরাধে জড়িয়ে পড়েছে। যৌন হয়রানির ঘটনাও কমবেশি বেড়েছে শিক্ষিত সমাজে। এমনকি যারা সম্পদশালী তাদের ছেলেমেয়েরাও সেই রকম কাজে জড়িয়ে পড়ছে কিংবা ভিকটিম হচ্ছে। এসব দেখে মনে হচ্ছে প্রকৃতপক্ষে আমাদের প্রকৃত শিক্ষা হয়নি আদৌ। আমাদের শিক্ষাধারায় নৈতিকতার বিষয়-আশয় জোরালোভাবে নেই। থাকলেও, তার ওপর জোর দিয়ে শেখানো হয় না সেসব। শিক্ষা কারিকুলামে কী শেখানো হয়, তার প্রতিফলন তো সমাজে লক্ষ করা যাচ্ছে না। এসব বিষয় নিয়ে আমাদের প্রজ্ঞাবান মানুষের ভাবনা আমরা দেখতে চাই। চাই তাদের মত ও দূরদর্শী পরামর্শ ও প্রদর্শিত পথ, যা আখেরে সমাজকে অবক্ষয়ের খাদের পাড় থেকে ফিরিয়ে আনবে।

২.
খুবই ছোটো বিষয়, ছোটো একটি পাথরের ঢিল ছোড়ার ফলে একজনের জীবন চলে যেতে পারে। হয়তো খেলাচ্ছলেই সেসব শিশু ও কিশোররা সেটা করছে এবং তা প্রায় নিয়মিত ঘটানো হচ্ছে, তা একটি সম্ভাবনাময় জীবনকে যে চিরদিনের জন্য পঙ্গু করে দিতে পারে, মৃত্যুর পথে ঠেলে দিতে পারে। এটা কি তারা ভেবেছে, না বোঝে? না, তারা ভাবে না, ভাবে না বলেই ওই অপরাধ করে চলেছে। এখন একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়–য়া মেয়ে, রাজশাহী থেকে খুলনা যাওয়ার পথে ওই রকম দুষ্ট ও প্রায় বিকৃতমস্তিষ্ক কিশোরের হাতে পাথরের ঢিলে মারাত্মকভাবে আহত হয়ে হাসপাতালে মৃত্যুর সাথে লড়ছে। পাথরের ঢিলটি এসে লেগেছিল তার মাথায়।
যাত্রী নিয়ে ছুটে চলা ট্রেনে পাথর ছুড়ে মারার মধ্যে কী আনন্দ আছে? না, সে কাজে আনন্দ নেই। আছে বিকৃত মনের এক ধরনের তৃষা। নিজের রোষ প্রকাশ করা বা সরকারি সম্পদ, যা মূলত জনগণের সম্পদ, তা ধ্বংস করার মানসিকতা পোষণ একটি সমাজে কতটা সামাজিক ন্যায়কে তুলে ধরছে বা কতটা অন্যায় বলে গণ্য হচ্ছে?
রেল কর্তৃপক্ষ এই পাথর ছুড়ে মারার বিষয়টি নিয়ে খুবই বিব্রতকর অবস্থায় রয়েছে। কারণ, এতে যাত্রীর জীবনই কেবল হুমকির মুখে পড়ে না, রেলসম্পদেরও ক্ষতি হচ্ছে। রেলপথের কোন এলাকায় এমনটা ঘটছে? কর্তৃপক্ষ বিষয়টি পরখ করে দেখেছেন যে, ২০টি জেলার ৭০টি পয়েন্টে কিছু বালক ও যুবক এই অপরাধ-অপকর্ম করছে এবং তা নিয়মিতই। কিছু অবশ্য বিকৃতমস্তিষ্ক বালকও এর সাথে জড়িত। তবে অধিকাংশই অপ্রাপ্তবয়স্ক বিধায় তাদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নিতে পারেনি তারা। হ্যাঁ, তারা অপ্রাপ্ত বয়স্ক, কিন্তু তারা যা করছে তা কি সামাজিকভাবে অন্যায় ও অপরাধ নয়? বা তা কি সমাজ গ্রাহ্য করে? কেন করে? কিংবা কেন করে না? সমাজবিজ্ঞানীদের এ বিষয়টি নিয়ে ভাবা দরকার।
ওই অন্যায়কারী বালকেরা কি জানে যে এ কাজ অপরাধের? তাদের কি শেখানো হয়নি যে পাথর ছোড়া আইনের চোখে অপরাধ? তাদের জেল-জরিমানা হতে পারে? হতে পারে যাবজ্জীবন জেলও? হ্যাঁ, তারা জানে না। তাদের বাবা-মাও জানে না। তাদের প্রতিবেশীরা জানলেও সেই শিক্ষা ও সচেতনতা নেই যে ওই অপরাধীদের নিষেধ করবে। তারা সেই দায়িত্ব পালন করে না। কেন করে না, তাদেরও যে কিছুটা দায় আছে, সমাজের প্রতি কর্তব্য আছে, দেশের প্রতি, জাতির আকাক্সক্ষার প্রতি করণীয় আছে সেটা শিক্ষিত-নিরক্ষর কেউ পালন করে না।
একটি ছোট কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ উদাহরণ দেয়া যাক। আপনি একটি গলি দিয়ে বেরিয়ে বড় রাস্তায় যাবেন। দেখলেন একটি রিকশা সেই গলির মুখে, অনেকটা জায়গা ব্লক করে দাঁড়িয়ে আছে। আরেক জায়গায়, মেইন রোড থেকে আবাসিক এলাকার সড়কে ঢোকার মুখে অনেক রিকশা রাস্তার ৫০ শতাংশ ব্লক করে দাঁড়িয়ে আছে। ফলে ওই পথ দিয়ে মেইন রোড থেকে ভেতরে গাড়ি ঢুকতে পারছে না। পুলিশ এসব দেখেও তার দায়িত্ব পালন করে না। নির্বিকার দাঁড়িয়ে থাকে। মহানগর ঢাকায় জ্যামের অন্যতম কারণ এ ধরনের গাড়ির ব্যারিকেড। কোনো গাড়িই ট্রাফিক আইন মেনে চলে না। উল্টো দিক থেকে আসা গাড়ি ফিরিয়ে দিয়ে তার অন্যায়কে চালকের কুঅভ্যাসে ধস নামায় না ট্রাফিক পুলিশ। বরং তাদের অন্যায়কে সুযোগ করে দিয়ে মনে করে জ্যামজট সমস্যার সমাধান করে ফেলেছে। ঢাকার সর্বত্রই এই অন্যায় হচ্ছে ট্রাফিক পুলিশের কারণেই। তারা যদি আইন যথাযথ প্রয়োগ করত তাহলে এমন জ্যাম হতো না। এ বিষয়টি ট্রাফিক পুলিশ কর্তৃপক্ষ ভেবে দেখতে পারেন। তাদের জনবলকে এই শিক্ষাটা কড়াভাবে পালন করতে দিলে ও পারলে মহানগরের এই পরিণতি হতো না।
রেলপথে পাথর ছুড়ে মানুষের জীবন নিরাপত্তাহীন করার অপরাধীদের ধরতে হবে। চিহ্নিত ৭০ স্পটে সিসি টিভি ক্যামেরা ফিট করে স্যাবোটাজ হচ্ছে কি না, কারা এর সঙ্গে জড়িত, তাদের সামাজিক ও রাজনৈতিক পরিচয় কি, তাদের মানসিক বৈকল্য কেন এমন ধ্বংসাত্মক, তা খুঁজে বের করতে হবে। সেই সাথে সরকারের অন্যতম দায়িত্ব হচ্ছে স্কুল, কলেজে সাংস্কৃতিক চেতনায় এমন সব অন্যায় সম্পর্কে সচেতনতা গড়ে তোলা। এ কাজে স্কুল, কলেজের শিক্ষকগণ বিশেষ ভূমিকা রাখতে পারেন। সমাজের নেতারা, রাজনৈতিক কর্মীরা এ কাজে নিজেদের জড়িয়ে রাখলে মানুষের জীবনের নিরাপত্তা বিধান সহজ হবে। আর পরিবারের প্রধানদেরও দায়িত্ব আছে, তাদের ছেলেমেয়েদের নৈতিক শিক্ষায় উন্নত করে তোলা জরুরি। ধর্মীয় শিক্ষা ও মূল্যবোধের উন্মেষ ঘটানোর বিকল্প নেই। সে কাজে মসজিদের ইমামরা বিশেষ ভূমিকা পালন করতে পারেন। শিশুরা পরিবার থেকেই ধর্মীয় শিক্ষা পায় সর্বপ্রথম।

 


আরো সংবাদ



premium cement

সকল