২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫
`

মাওলানা কালীম সিদ্দীকীর অপরাধ কী?

-

বিখ্যাত ও সুপরিচিত দায়ী ও মুবাল্লিগ মাওলানা কালীম সিদ্দীকীকে গ্রেফতার করায় মুসলমানদের মাঝে অসন্তোষ ও ক্ষোভ সৃষ্টি হয়েছে। ২২ সেপ্টেম্বর বুধবার রাতে উত্তর প্রদেশ এটিএসের সন্ত্রাস দমন শাখা তাকে গ্রেফতার করে, যখন তিনি মিরাটে একটি প্রোগ্রাম শেষে নিজের ঘরে ফিরছিলেন। মাওলানা কালীম সিদ্দীকীর বিরুদ্ধে অবৈধ ধর্মান্তরে জড়িত থাকা এবং এর জন্য বিদেশ থেকে প্রচুর অর্থ সংগ্রহের অভিযোগ আনা হয়েছে। সবাই জানেন, মাওলানা সিদ্দীকী একজন চিন্তক ইসলামী স্কলার। তার মৌলিক কাজ অন্য ধর্মের সাথে আন্তঃসংলাপের ব্যবস্থা করা এবং ইসলামের বিষয়ে স্বদেশীদের মননে ছড়িয়ে পড়া ভুল ধারণাগুলোকে দূর করা। তার এই মিশনেই প্রভাবিত হয়ে অনেক মানুষ ইসলাম কবুল করেছে। কিন্তু যে অভিযোগে তাকে গ্রেফতার করা হয়েছে, তা এই দিক দিয়ে মারাত্মক যে, তার সব কর্মকাণ্ডকে ‘অবৈধ’ আখ্যায়িত করে তাকে ধর্মান্তরের ‘এক বিপজ্জনক সিন্ডিকেটের নেতা’ অভিহিত করা হচ্ছে। অথচ তিনি ইসলাম প্রচারের জন্য যা কিছু করেছেন, এ দেশের সংবিধান প্রতিটি নাগরিককে তার অনুমতি দিয়েছে।
আপনাদের মনে থাকার কথা, গত জুনে এই অভিযোগেই দিল্লিø থেকে মুহাম্মাদ ওমর গৌতম ও মুফতি জাহাঙ্গীর কাসেমীকে গ্রেফতার করা হয়। এই দুইজন সেই পদ্ধতিতেই ইসলামের পরিচয় এবং প্রচার-প্রসারের (তাবলিগ) কাজ করছিলেন, মাওলানা কালীম সিদ্দীকী যে পথের যাত্রী। তাদের জিজ্ঞাসাবাদের পর দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে আরো ছয় ব্যক্তিকে আটক করা হয়। তারা সবাই এখনো জেলে রয়েছেন। তাদের অবৈধ ধর্মান্তরের এক বিপজ্জনক সিন্ডিকেটের অংশ হিসেবে অভিহিত করা হচ্ছে। যে সময় দিল্লিতে মুহাম্মদ ওমর গৌতম ও মুফতি জাহাঙ্গীর কাসেমীকে গ্রেফতার করা হয়, তখনই এটার আশঙ্কা করা হয়েছিল যে, পুলিশ মাওলানা কালীম সিদ্দীকীর ওপরও হাত দেবে। কিন্তু তার ব্যক্তিত্ব ও আন্তর্জাতিক পরিচিতির ভিত্তিতে মানুষের বিশ্বাস ছিল, সম্ভবত পুলিশ তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে সাহস করবে না। কিন্তু এ ধারণা ভুল প্রমাণিত হয়েছে। তাকে গ্রেফতার করে প্রথমে আদালতের নিয়ন্ত্রণে পাঠানো হয়। পরের দিন পুলিশ তাকে ১০ দিনের দীর্ঘ রিমান্ডে নেয়ার সফলতা অর্জন করে।
উল্লেখ্য, গত ৭ সেপ্টেম্বর মাওলানা কালীম সিদ্দীকী মুম্বাইয়ের একটি পাঁচতারা হোটেলে আরএসএস নেতা মোহন ভাগবতের একটি অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করেছিলেন। ওই অনুষ্ঠানকে ভাগবতের ‘মুসলিম বুদ্ধিজীবীদের সাথে সাক্ষাৎ’ শিরোনাম দেয়া হয়েছিল। বলা হচ্ছে, ওই সাক্ষাৎ অনুষ্ঠানের জন্য স্বয়ং ভাগবতের ভাই মাওলানা কালীম সিদ্দীকীকে আমন্ত্রণ জানানোর জন্য তার বাড়ি গেছিলেন। অথচ এ নিয়ে বেশ কিছু মহলে মাওলানার সমালোচনাও হয়েছে। তবে বলা হয়ে থাকে যে, তিনি তার দাওয়াতি মিশনে সেখানে গিয়েছিলেন। কিছু লোকের ধারণা এটাও যে, মাওলানা কালীম সিদ্দীকী মোহন ভাগবতের সাথে সাক্ষাতে যোগ দেন ‘আগের ঘটনা থেকে আত্মরক্ষা’র জন্য। কিন্তু এ ধারণা ভুল প্রমাণিত হয়েছে। কেননা, পুলিশ তার বিরুদ্ধে প্রাথমিক যে চার্জশিট মিডিয়ার সামনে পেশ করেছে, তাতে তার বিরুদ্ধে ধর্মান্তরের এক ভয়ঙ্কর সিন্ডিকেটে যুক্ত হওয়ার অভিযোগ দায়ের করা হয়েছে, যেখানে ‘কোটি কোটি রুপি’ বিদেশ থেকে অর্থায়ন করা হয়েছে।
এডিজি প্রশান্ত কুমারের দাবি, মাওলানা কালীম সিদ্দীকীর সংগঠন গ্লোবাল পিস সেন্টার ও জামেয়া ইমাম ওয়ালিউল্লাহ মানুষকে ভয় দেখিয়ে, হুমকি দিয়ে ধর্মান্তর করায়। প্রশান্ত কুমার এটিও দাবি করেন যে, ধর্ম পরিবর্তনের জন্য তার বিভিন্ন ব্যাংক খাতে তিন কোটি রুপির বিদেশী অর্থায়ন হয়েছে যার মধ্যে দেড় কোটি রুপি তার অ্যাকাউন্টে এসেছে বাহরাইন থেকে। এডিজি এটিও দাবি করেন যে, মুহাম্মদ ওমর গৌতম ও মুফতি জাহাঙ্গীর কাসেমীকে জিজ্ঞাসাবাদের ভিত্তিতে মাওলানা কালীম সিদ্দীকীকে গ্রেফতার করা হয়েছে। এটিএস (অ্যান্টি টেরোরিস্ট স্কোয়াড) যখন তার ব্যাপারে তথ্য সংগ্রহ করে, তখন জানতে পারে যে, তিনি তার পৈতৃক এলাকা মোজাফফর নগরের ফুলাতে জামেয়া ওয়ালিউল্লাহ নামে একটি ট্রাস্ট পরিচালনা করেন যা দেশজুড়ে সমাজসেবা ও অন্যান্য কল্যাণমূলক কর্মকাণ্ডের আড়ালে ধর্ম পরিবর্তনের একটি সিন্ডিকেট। তিনি বলেন, মাওলানা কালীম সিদ্দীকী ট্রাস্ট পরিচালনার পাশাপাশি দেশের বিভিন্ন মাদরাসার জন্য অর্থায়নও করে থাকেন। ওই মাদরাসাগুলোতে মানবতার বার্তা কর্মসূচির অধীনে দোজখের ভয় ও রুপির লোভ দেখিয়ে ধর্ম পরিবর্তন করান। অথচ এখন পর্যন্ত এমন কোনো ব্যক্তি সামনে এলো না, যে এ কথা বলেছে যে, মাওলানা কালীম সিদ্দীকী নিজ ধর্ম পরিবর্তনের জন্য তার ওপর চাপ প্রয়োগ করেছেন বা তাকে কোনো লোভ দেখিয়েছেন। বাস্তবতা হলোÑ যদি কোনো ব্যক্তি কারো ওপর চাপ প্রয়োগ করে কিংবা তাকে লোভ দেখিয়ে ধর্ম পরিবর্তনে বাধ্য করে, তাহলে এটি অবৈধ কর্মকাণ্ড যার জন্য অবশ্যই নির্ধারিত শাস্তি হওয়া উচিত। কিন্তু যদি কেউ স্বেচ্ছায় তার ধর্ম পরিবর্তন করে এবং কোনো ব্যক্তি তাতে সহযোগিতা করে থাকে, তাহলে তার বিরুদ্ধে কোনো আইনি ধরপাকড় হওয়া উচিত নয়। কেননা, ভারতের সংবিধান এ দেশে বসবাসরত প্রতিটি নাগরিককে এ বিষয়ে অনুমতি দেয়, সে যে ধর্ম ইচ্ছা গ্রহণ করতে পারবে। ধর্মের বিষয়ে সরকারের হস্তক্ষেপ করার কোনো অধিকার নেই।
সবাই জানেন, ভারতের সংবিধান তার নাগরিকদের এ বিষয়ের পূর্ণ অনুমতি প্রদান করে যে, সে যেই ধর্মই ইচ্ছা, গ্রহণ করতে পারবে এবং ওই ধর্মের প্রচার ও প্রসারে অংশগ্রহণ করতে পারবে। এই সাংবিধানিক স্বাধীনতার সুবিধা নিয়ে আমাদের দেশে খ্রিষ্টান মিশনারিরা চরম দরিদ্র ও পশ্চাৎপদ জনবসতিগুলোতে কাজ করছে এবং লোকদের খ্রিষ্টান ধর্মের দিকে আকৃষ্ট করছে। কিন্তু দেশে যখন থেকে বিজেপি পরিপূর্ণরূপে সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে ক্ষমতায় আসে, তারা এমন অনেক কাজ করেছে, যা অসাংবিধানিক ও অগণতান্ত্রিক। তারই একটি হচ্ছে, এ দেশে বসবাসরত সংখ্যালঘুদের পথে বাধা সৃষ্টি করা। বর্তমান সরকার চাচ্ছে, এ দেশে এক ধর্ম, এক ভাষা ও এক সংস্কৃতির শাসন চলবে। অর্থাৎ শুধু সংখ্যাগরিষ্ঠদের ধর্মই উন্নয়ন কর্মকাণ্ড করতে পারবে। আর এর অনুসারীদের সব ধরনের নিরাপত্তা ও সুবিধা দেয়া হবে। পক্ষান্তরে সংখ্যালঘুরা, বিশেষ করে মুসলমানদের এর কোনোভাবেই অনুমতি নেই যে, তারা তাদের ধর্ম ও সংস্কৃতির প্রচার করবে। এ কারণেই মুসলমানদের সম্পর্কে প্রতিটি বিষয়কে ‘জিহাদ’ নাম দিয়ে জগাখিচুড়ি বানানোর চেষ্টা বৃদ্ধি পেয়েছে। শুধু এই নয় যে, মুসলমানদের জীবন-জীবিকা সঙ্কীর্ণ করা হচ্ছে। বরং তাদের বিভিন্ন শিরোনামে মামলা-মোকদ্দমায় জড়ানো হচ্ছে। এই অত্যাচারের একটাই উদ্দেশ্য, মুসলমানরা শুধু তাদের জান-মাল ও ইজ্জত-আব্র“ সংরক্ষণের মাঝে সন্তুষ্ট থাকুক এবং একজন নাগরিক হিসেবে নিজেদের সব মৌলিক সাংবিধানিক অধিকার থেকে হাত গুটিয়ে নেয়ার ঘোষণা দিক। ধর্মান্তরের নামে উলামায়ে কেরামের গ্রেফতারি ও তাদের সাথে নিকৃষ্ট অপরাধীর মতো আচরণ এ কথা প্রমাণ করে যে, এখন দেশে আইন-কানুনের শাসন বিলুপ্ত হতে যাচ্ছে।
মাওলানা কালীম সিদ্দীকীর বিরুদ্ধে বিদেশী অর্থায়নের মাধ্যমে ধর্ম পরিবর্তন করানোর প্রমাণ হিসেবে এটা বলা হচ্ছে যে, তার অ্যাকাউন্টে তিন কোটি রুপি বিদেশ থেকে এসেছে যার মধ্যে দেড় কোটি রুপি শুধু বাহরাইন থেকে এসেছে। এখানে সবচেয়ে বড় প্রশ্ন হচ্ছে, যে অর্থ কারো ব্যাংক অ্যাকাউন্টে জমা হয়, তিনি তার পূর্ণ হিসাব সংরক্ষণ করেন। ইনকাম ট্যাক্স বিভাগও সে সম্পর্কে অবগত থাকে। যদি তিন কোটি রুপির বিশাল অর্থ তার অ্যাকাউন্টে সন্দেহভাজন লোকেরা জমা করে থাকে, তাহলে তার তদন্ত কেন করা হয়নি? এ কথা সবাই জানেন যে, অবৈধ কর্মকাণ্ডে লিপ্ত লোকেরা কখনোই ব্যাংকের মাধ্যমে লেনদেন করে না। তারা হুন্ডির শরণাপন্ন হয়। এ দেশে কতগুলো ধর্মীয় ও অধর্মীয় প্রতিষ্ঠান এমন আছে, যারা বিদেশ থেকে আর্থিক সহায়তা লাভ করে এবং তারা স্বরাষ্ট মন্ত্রণালয় থেকে বিশেষ অনুমতি নিয়ে এমন কর্মকাণ্ড করে? যদি এভাবেই কোনো মাধ্যমে মাওলানা কালীম সিদ্দীকীর অ্যাকাউন্টে কোনো অর্থ দ্বীনি শিক্ষার জন্য জমা হয়, তাহলে সেটা বেআইনি কিভাবে হতে পারে? যদি তিনি বাস্তবিকই বিদেশী অর্থ সহায়তা পেয়ে থাকেন, তাহলে ইডি (এনফোর্সমেন্ট ডাইরেক্টরেট) বা ইনকাম ট্যাক্স বিভাগের তদন্ত করা উচিত ছিল। কিন্তু তাকে উত্তর প্রদেশের এটিএসের সন্ত্রাস দমন শাখা রিমান্ডে নিয়েছে। যদি এটা মেনেও নেয়া হয় যে, তিনি মানুষের ধর্ম পরিবর্তন করাচ্ছেন; ধর্মান্তরের বিষয়টি সন্ত্রাস কিভাবে হলো? এটা মূলত প্রতিটি মুসলমানকে সন্ত্রাসী ও দেশের শত্র“ প্রমাণ করার সাম্প্রদায়িক মানসিকতার ফল যে কাজে প্রশাসনের সবাই জড়িত।
মুম্বাই থেকে প্রকাশিত দৈনিক মুম্বাই উর্দু নিউজ ২৬ সেপ্টেম্বর, ২০২১ হতে উর্দু থেকে ভাষান্তর ইমতিয়াজ বিন মাহতাব
ahmadimtiajdr@gmail.com
লেখক : ভারতের প্রখ্যাত সাংবাদিক ও কলামিস্ট


আরো সংবাদ



premium cement
গফরগাঁওয়ে পানিতে ডুবে শিশুর মৃত্যু দ্রব্যমূল্য ঊর্ধ্বগতিতে সাধারণ মানুষ দিশেহারা : আমিনুল লিবিয়ায় নিয়ে সালথার যুবককে নির্যাতনের ঘটনায় মামলা, গ্রেফতার ১ মনুষ্য চামড়ায় তৈরি বইয়ের মলাট সরানো হলো হার্ভাড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আওয়ামী লীগকে বর্জন করতে হবে : ডা: ইরান আমরা একটা পরাধীন জাতিতে পরিণত হয়েছি : মেজর হাফিজ তরুণীর লাশ উদ্ধারের পর প্রেমিকসহ ৪ জনের বিরুদ্ধে মামলা ভিয়েনায় মুসলিম বিশ্বের রাষ্ট্রদূতদের ইফতারে ইসলামিক রিলিজিয়াস অথোরিটি আমন্ত্রিত এবার বাজারে এলো শাওমির তৈরি বৈদ্যুতিক গাড়ি সকল কাজের জন্য আল্লাহর কাছে জবাবদিহিতার অনুভূতি থাকতে হবে : মাওলানা হালিম বিএনপি জনগণের ভাগ্য পরিবর্তনের জন্য রাজনীতি করে : ড. মঈন খান

সকল