২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫
`

‘সব স্বপ্নই মরীচিকা নয়’

দেখা অদেখা
-

বিশ্বের প্রতিটি সতর্ক মানুষ নিজের ও তার পরিজনদের ভূত-ভবিষ্যৎ নিয়ে ভাবেন, সম্মুখের দিকে তাকান, চিন্তা করেন অনাগত দিনের গর্ভে কার জন্য কী লুকানো আছে, তা কিভাবে ঠাউর করবেন। তবে এমন মানুষের সংখ্যা কম নয়, যারা কিছু ভাবেন না, গড্ডলিকা প্রবাহে গা ভাসিয়ে বেড়ান। ভোগ বিলাসে মত্ত থাকেন। তাদের জীবনে কোনো স্বপ্ন থাকে না। তবে যারা এত সহজভাবে জীবনকে গ্রহণ করেন না, তাদের সবাই জীবন সায়াহ্নে এসে চিন্তা-চেতনায় ভয়ভীতি আসে।
জীবনাবসানের কথা ভেবে। ভয়ভীতি আসে ওপারের অন্তঃহীন জীবনে কী আছে, কী ঘটবে। আর যারা আরো গভীরে যান, তাদের মন মস্তিষ্কে এমন জিজ্ঞাসার উন্মেষ হয়, পৃথিবীতে কেন এলেন, কিভাবে এলেন। এরপর তো আর কল্পনা করা যায় না, এমন দার্শনিক বোধ নিবেচনা কাউকে কাউকে উতলাও করে তোলে যাদের হৃদয় মনে পূর্ব থেকেই এই বিষয়গুলো আচ্ছন্ন থাকে। তারা জীবনকে নিয়ে স্বপ্ন দেখেন। তার আলোকে আগামীতে চলার একটা পথও রচনা করেন। তবে এসব তখনই সফল হবে যখন এমন চেতনায় শুভ বোধকে ঢেলে দেয়া যাবে। জীবনকে বদলে দেয়ার আয়োজন সুসম্পন্ন করা যাবে। তাহলেই সেই স্বপ্ন হবে সার্থক। কিন্তু অন্যথা হলে এত সব ভাবনা বোধ বিবেচনা হবে কেবলই স্বপ্ন বিলাস। তাসের ঘরের মতো একটু হাওয়ায় সব হয়ে যাবে ওলট-পালট, এলোমেলো। স্বপ্ন আসলে খুব সাধারণ বিষয় নয়। সম্ভবত এমন সব কারণে অনেকে মজা করার জন্য বলে থাকেন, কুঁড়েঘরে শুয়ে লক্ষ টাকার স্বপ্ন দেখে। এমন হাস্যরসিকতা কখনো কখনো ভ্রান্ত প্রমাণিত হয়। বহু মানুষ এভাবে কুঁড়েঘরে শুয়েও অসাধ্য মন্ত্র কাজ করেছে, ‘একবার না পারিলে দেখ শতবার।’ এসব কোনো কল্পকাহিনী নয় বা দূর কোনো দেশের কোনো দৃষ্টান্তও নয়। খোদ এ দেশেরই এমন ঘটনা রয়েছে, যাদের কেউ কেউ প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায় তেমন এগোতে পারেননি সুযোগ না থাকায়। তা সত্ত্বেও পরিশ্রম, অধ্যবসায়, বাস্তব জীবনের অভিজ্ঞতা তাদের অনেককেই বৈশয়িক সাফল্যের সাথে সাথে সামাজিক মর্যাদার ক্ষেত্রেও অনেক উচ্চস্বরে পৌঁছে দিয়েছে। এক সময় নিজের জীবনের ভার বহন করা ছিল তার জন্য গ্লানি ক্লান্তি আর দুশ্চিন্তায় ভরা। সব কিছু মনে হতো অমাবস্যার ঘোর অন্ধকার। কিন্তু দমে যাননি। বরং দ্বিগুণ মনোবল আর মানসিকতা নিয়ে দৌড়েছেন। সে দৌড় একেবারে যে খুব দীর্ঘ ছিল তেমন নয়। সহসাই উপরে ওঠার মইটা তার পদযুগলের কাছে এসে অপেক্ষা করেছে। এক দিন নিজের জীবনের ভার বহন করা ছিল তার জন্য অসহ্য যন্ত্রণার। আজ তার স্কন্ধে হাজার মানুষের ভার স্রষ্টা তাকে বহন করার শক্তি দিয়েছেন। যে স্বপ্ন তিনি দেখতেন তা আজ সফল হয়েছে। তবে এমন স্বপ্ন দেখতে হয় ঘুমের ঘোরের মধ্যে নয়।
এমন উদাহরণ বা দৃষ্টান্ত যদি আরো অনেককে প্রেরণা জোগাতে স্বপ্ন দেখতে উদ্বুদ্ধ করত, তবে বহু অসাধ্য সাধন এ দেশে ঘটে যেত। যে মানুষের কথা বলা হলো তা খুব বিরল নয়। তাদের চলার পথটা অবশ্যই কখনো মসৃণ ছিল না। সমাজ রাষ্ট্র তাদের খুব একটা কিছু দেয়নি বা সাহায্য সহায়তা দিয়েছে এমনও নয়। সেই সব মানুষের জীবনে কঠিন বাস্তবতা ছিল; তবে স্বপ্ন পূরণে অদম্য প্রচেষ্টা জারি রেখেছেন। যারা এভাবে এগোতে চান, তাদের, মনে রাখতে হবে লক্ষ্যে পৌঁছার জন্য অফুরান সময় সুযোগ পাওয়া যাবে না। আসলে জীবনটা কোনো লং জার্নি বা দীর্ঘ অভিযাত্রা নয়। পাহাড়ি নদী যেমন স্রোতস্বিনী, দ্রুত মোহনায় পৌঁছার জন্য তীরের দুই ধারে কী ঘটছে তা দেখার অবকাশ তার থাকে না। খরস্রোতা নদী শুধু সম্মুখেই এগিয়ে যায়। মানুষের জীবনও তেমনি দ্রুত প্রত্যুষ থেকে গোধূলিলগ্নে পৌঁছে যায়। তার পরও ক্ষণস্থায়ী এই জীবনের ডেসটিনি বা লক্ষ্য হতে হবে দিগন্ত ছোঁয়ার মতো, মন মানস আর স্বপ্ন পূরণের প্রতিযোগিতায় বিরামহীন ও বিরতিহীন পথ চলার সাহস ও উদ্যম। মানুষ পৃথিবীতে প্রকৃত পক্ষে অবস্থান করে মুসাফিরের মতো; পথের ধারে সরাইখানায় পথচারী ক্ষণিকের জন্য যেমন বিশ্রাম নেয়। তা কেবল খনিকের বিরতি মাত্র। এই ক্ষণস্থায়ী জীবনেও মানুষ পৃথিবীর কাছ থেকে গ্রহণ করে স্রষ্টার অসংখ্য যত নেয়ামত। খাওয়া খাদ্য তো আছেই তার ওপর আলো, বাতাস আর এমন অনেক কিছু যা আমরা দেখি না উপলব্ধি করি না; আমাদের পঞ্চ ইন্দ্রিয়ের ধরা-ছোঁয়ার বাইরে। মানুষকে এর তো একটা বিনিময় দেয়ার কথা ভাবা উচিত। কিন্তু স্রষ্টাকে আমরা কী দিতে পারব? হ্যাঁ, মানুষের প্রতি দরদ অকৃত্রিম ভালোবাসা, তার কষ্ট দুর্ভোগের সময় পাশে গিয়ে দাঁড়ানো। এতটুকু তো আমাদের পারা উচিত। এতটুকু যদি দেয়া না যায় তবে আমরা তো হবো কৃতঘœ। তবে এইটুকু দেয়ার জন্যই নিজেকে নানাভাবে প্রস্তুত করতে হবে। নিজের বিবেককে শাণিত করে তুলতে হবে। আর সে জন্য কিছু দেয়ার অর্থ হচ্ছে, মানুষের প্রতি দরদি হওয়া।
অবশ্যই নিজেকে যোগ্য করে তুলতে হবে। অবিরাম অধ্যয়ন আর অধ্যবসায় ও শুভবুদ্ধির চর্চা করার কোনো বিকল্প নেই। সার্বক্ষণিক ধ্যান জ্ঞান আর স্বপ্ন হতে হবে মানুষের কল্যাণের জন্য প্রস্তুত থাকা। স্বীয় কর্মকুশলতা দিয়েই তা সম্ভব হয়ে উঠতে পারে।
স্বপ্ন নিয়ে এই নিবন্ধ রচনার প্রেরণা মূলত পেয়েছি এক মনীষী বক্তব্য ও বাণী থেকে। তিনি ছিলেন পারমাণবিক বিজ্ঞানী, দার্শনিক পাণ্ডিত্যের বাতিঘর, সাহিত্যানুরাগী বেশ কিছু অসাধারণ পুস্তকের প্রণেতা। সেসব পুস্তক বহু মানুষের জীবন বদলে দেয়ার মতো। তিনি হচ্ছেন ভারতের সাবেক রাষ্ট্রপতি মরহুম এ পি জে আবুল কালাম। গতানুগতিতা থেকে তার ভাবনা দর্শন ছিল একেবারেই স্বতন্ত্র। এ নিবন্ধের সূচনা করেছি মানুষের স্বপ্ন নিয়ে। আর ড. কালামের স্বপ্ন নিয়ে যে বোধ ভাবনা সেটা একেবারেই স্বতন্ত্র। স্বপ্ন নিয়ে তার বিখ্যাত বাণী হচ্ছে, ‘স্বপ্ন সেটা নয়, যেটা তুমি ঘুমিয়ে দেখো। স্বপ্ন সেটা যেটা তোমায় ঘুমাতে দেয় না।’ ‘যারা হৃদয় দিয়ে কাজ করতে পারে না, তাদের অর্জন অন্তঃসারশূন্য, উৎসাহহীন সাফল্য তার দিকে তিক্ততার উদ্ভব ঘটায়।’ আকাশের দিকে তাকাও, আমরা একা নই। পুরো মহাবিশ্ব আমাদের প্রতি বন্ধুসুলভ। যারা এমনতর স্বপ্ন দেখে এবং কাজ করে শুধু তাদের শ্রেষ্ঠতা দেয়ার জন্য প্রয়াস চলে এই বিশ্বে। সৃষ্টিকর্তা সব সময় আমাদের সাথে আছেন।’ এসব অপূর্ব দর্শনের ভেতরে যদি প্রবেশ করা যায় আর অনুশীলন করা হয় তবে জীবন বদলে যাওয়ার যে কথা বলেছি, তার কোনো অন্যথা হবে না। সে শুধু এগিয়ে যাবে।
পৃথিবীর কোনো মনীষীই বিশেষ কোনো গোষ্ঠী কিংবা ভৌগোলিক সীমার মধ্যে বসবাসকারী মানুষই শুধু তার নীতি আদর্শের মাধ্যমে উপকৃত হোক এমন খণ্ডিত ভাবনায় তারা আচ্ছন্ন থাকেন না। বিশ্বের এমন বিজ্ঞ সাধকরা তাদের কাজ চেতনা, অবদানকে সঞ্চারিত করেন পুরো মানবজাতির উন্নতি প্রগতি উৎকর্ষ আর কল্যাণের নিমিত্তে। তাদের উদার ধ্যান-ধারণা নিজের মধ্যে অঙ্কুরিত হয় স্রষ্টার প্রতি বিশ্বাস ও তার নাজিল করা শিক্ষা থেকে। এমন শিক্ষার ভিত্তিতে মানুষকে সমৃদ্ধ হওয়ার অসংখ্য আহ্বান রয়েছে ঐশী মহাগ্রন্থ আল কুরআনে। সৎ চিন্তার দ্বারা মানুষ যোগ্য সক্ষম হওয়া এবং মানবতার কল্যাণের জন্য দায়িত্ব পালনের কথা সেখানে রয়েছে। এমন চেতনা আর স্বপ্ন সৃষ্টিশীল মানুষকে নিয়ত নিমগ্ন ও নিবেদিত রাখে। যারা এমন দীক্ষা থেকে নিজেদের গড়ে তুলতে সমর্থ হন, তাদের জন্য পুরস্কার তথা মুক্তি লাভের আশ্বাসও রয়েছে।
অপর দিকে একদল স্বার্থান্ধ মানুষরূপী অমানুষ অপরের অধিকার, তার কষ্টের সঞ্চয় বিনা দ্বিধায় ছিনিয়ে নিয়ে সুখ সম্ভোগে মত্ত হয়ে ওঠে। এমন অন্যায় স্বার্থপরতা নিয়ে এদের মধ্যে নেই কোনো গ্লানি বা কখনো এ জন্য যে, স্রষ্টার কাছে তাদের জবাবদিহি করতে হবে, এই চেতনা বিন্দুমাত্র এদের মধ্যে অবশিষ্ট আছে, তা উপলব্ধি হয় না। এরা সংখ্যায় বেশি না হলেও এক ফোঁটা বিষ যেমন শত মানুষের জীবন সংহারের জন্য যথেষ্ট হতে পারে, তেমনি নিজেদের কুকর্ম দিয়ে সমাজের হাজারও মানুষের জীবনকে এরা দুর্বিষহ করে তোলে। তার পরও তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয় না। কারণ এরা রাজনীতির খলনায়কদের সহচর আর প্রিয়ভাজন। এ খল রাজনীতিকদের কোনো গণভিত্তি থাকে না। এদের ভিত্তি হচ্ছে সেসব দুরাচারী যাদের কথা মাত্র উল্লেখ করে এসেছি।
সমাজে এসব সমস্যা তো আছেই, তার ওপর আরো অনেক ‘অসুখে’ দেশ ভুগছে যার নিরাময় অতি জরুরি। এ জন্য ওষুধ পথ্য জোগান যদি যথা সময় দিতে পারা না যায়, তবে রোগ দ্রুত দুরারোগ্য হয়ে পড়বে। উদাহরণ হিসেবে বলতে চাই কোভিডের কথা। কী ভয়ানক বিপদেই না ছিল দেশ। এখনো যে সবটুকু বিপদ কেটে গেছে, তা বলব না। তবে তরী কতটা তো তীরে উঠার কাছাকাছি এসেছে। নানা দিক থেকে আমাদের সাধ্যে সীমাবদ্ধতার বলার অর্থ হবে মায়ের কাছে খালার বাড়ির গল্প বলার মতো। কোভিড আজ পর্যন্ত অনেক ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়েছে এবং তা থেমে নেই, জানমালের প্রভূত ক্ষতিসাধন করেছে। আগে উল্লেখ করেছি আমাদের সম্পদের সীমাবদ্ধতার কথা। তার পরও এ কথা কৃতজ্ঞতার সাথে স্বীকার করব, মহান স্রষ্টা দেশের প্রধানমন্ত্রীকে কোভিড নিয়ন্ত্রণের জন্য যারপরনাই সাহায্য করে চলেছেন। আমাদের দেশের জনসংখ্যা ১৬ কোটির বেশি। এই বিপুলসংখ্যক মানুষের জন্য বিনামূল্যে কোভিডের টিকা দেয়ার আয়োজন সম্পন্ন করার কাজ চলছে। সেই সাথে দেশে অন্য দেশের সহযোগিতায় কোভিডের টিকা যৌথভাবে প্রস্তুত করা যায় কি না তার চেষ্টাও হচ্ছে।
এখানে ড. আবদুল কালামের স্বপ্ন নিয়ে যে কথা তা পুনরায় উদ্ধৃত করছি, ‘স্বপ্ন সেটা যেটা মানুষকে ঘুমাতে দেয় না’। আমাদের দেশের সর্বোচ্চ নির্বাহীর কোভিড নিরাময়ের যে সদিচ্ছা বা স্বপ্ন সম্ভবত সেটা তাকে নির্ঘুম রেখেছে। স্রষ্টা তাকে সৎসাহস জুগিয়েছেন। সরকারের বাংলাদেশকে এগিয়ে নেয়ার ভিশনের যে ধারণা সম্পর্কে খানিকটা অবহিত হয়েছি, সে পরিপ্রেক্ষিতেই বলছি, যারা মনকে কাজে ঢেলে দিতে পারবে না, তাদের অর্জন বলতে কিছু নেই, সব কিছু অন্তঃসারশূন্য। বস্তুত এখানে কাজের দক্ষতা অর্জন এবং পারফেকশনে পৌঁছার জন্য প্রজ্ঞা ধৈর্য সহনশীলতার দরকার। আর সৎ উদ্দেশ্যে সেই সমালোচনাকারীদের প্রতি এতটা মনোযোগ দেয়া উচিত যাতে তাদের সঠিক ত্রুটিবিচ্যুতি চিহ্নিত করে তা থেকে নিজেকে বের করে আনা। আরো যাতে উজ্জ্বলতর সোপানে পৌঁছার পথ নিষ্কণ্টক করা সম্ভব হয়। সবাই শুনছে দেশকে উন্নয়নের মহাসড়কে পৌঁছে দেয়ার কথা হচ্ছে। সত্যি সত্যিই তা যেন বোঝানো হয়। তাহলে কেউই একে প্রশংসা করতে কার্পণ্য করবে না। লক্ষণীয়, কিছু কাজ অবশ্যই আমরা দেখছি। কিন্তু কথা হচ্ছে, এসব কার্যক্রম বাস্তবায়ন হলে এবং যেগুলো সম্পন্ন হয়েছে, তার সুবিধাভোগী হতে পারছেন কতজন? কেউ কেউ মনে করেন, যা কিছু হচ্ছে তা কেবল রাজধানী ও বড় বড় শহরকেন্দ্রিক। এ কথা ঠিক, প্রতিটি দেশের মুখমণ্ডল হচ্ছে তার রাজধানী। যতটুকু জানি উন্নত যেকোনো দেশের নাগরিকরা কখনোই এমনটা ভাবে না যে, তাদের সরকার রাজধানীর প্রতি পক্ষপাতিত্ব করছেন। কেননা উন্নয়নের ক্ষেত্রে সেসব দেশে সব অঞ্চলকেই সমানভাবে গুরুত্ব ও প্রাধান্য দেয়া হয়ে থাকে। আর সে কারণে বৈষম্যের কোনো অভিযোগ উঠে না। শুধু উন্নয়নই নয়, শিক্ষার উচ্চতর সুযোগ, উন্নত স্বাস্থ্য পরিচর্যার ক্ষেত্রেও কোনো বঞ্চনার প্রশ্ন উঠে না। তা ছাড়া সর্বত্র জীবনমান তথা জীবন ধারণের ব্যয়ের বিশেষ কোনো তারতম্য সেসব দেশে নেই। বাজারে পণ্যের মান ও মূল্য নিয়ন্ত্রণের ব্যাপারে সরকারের নজরদারির পাশাপাশি সেখানকার ব্যবসায়ীদের নীতিনৈতিকতা বিষয়টিও উল্লেখ করার মতো যা আমাদের সমাজে কল্পনা করা যায় না। আমাদের কর্তৃপক্ষের বাজার ও পণ্যের মান নিয়ন্ত্রণের কোনো ভাবনাচিন্তা এবং প্রচেষ্টা রয়েছে, তেমন নজির পেশ করার কথা ভাবাই যায় না। অন্য কোনো বিষয়ের কথা উল্লেখ করব না। শুধু একটা কথাই বলতে চাই। মানুষের জীবন রক্ষার যে ওষুধপত্র, সেখানেও রয়েছে মারাত্মক গলদ। বাজারে ভেজাল ও মানহীন ওষুধ বিক্রি হয় বাধাহীনভাবে। এসব ভেজাল ওষুধ খেয়ে কত মানুষের জীবনাবসান ঘটে তার হিসাব কে রাখে।
আমাদের দেশে বিভিন্ন ক্ষেত্রে যদি পক্ষপাতিত্বের অভিযোগ উঠে বা সমালোচনা হয়, তবে তা এড়াতে কিংবা তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিতে কেউ পারবে না। মনে রাখতে হবে দেশটা আমাদের সবার। সংবিধান বলেছে এ দেশের মালিক জনগণ। কে কোথায় বাস করে সেটা বিবেচ্য নয়। কোনো অজপাড়া গাঁয়ের মানুষ হলেও তার অধিকার কারো চেয়ে এক বিন্দুও কম নয়। সংবিধানের এসব মূল্যবান নির্দেশনার প্রতি যাদের গুরুত্ব দেয়ার কথা, তাদের মধ্যে এ নিয়ে দায়িত্ব অনুভব করার কথা লক্ষ করা যায় না। এটা নিছক আক্ষেপ করার বিষয় নয়, একে প্রশাসনিক উদাসীনতাই বলতে হবে। সুশাসন বলতে মোটা দাগে যা বুঝি, দায়িত্ব পালন নিয়ে এমন হেলা তার পরিপন্থী। বস্তুত সুশাসনের পরিধি বা সীমারেখা বহু বিস্তৃত। দেশের অগ্রগতি তথা জীবন স্বাচ্ছন্দ্যময় করে তোলার যাবতীয় কার্যক্রম সুশাসনের আওতাধীন।
দেশের অঞ্চল ভেদে সমান অধিকারের কথা উপরে বলেছি। সে বিবেচনায় দেশের গ্রামগঞ্জে এখন বিদ্যুৎ পৌঁছেছে, অবশ্যই তা বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর প্রতি সরকারের প্রতিশ্রুতি এবং রাষ্ট্রীয় নির্দেশনার বাস্তবায়ন। সর্বত্র বিদ্যুৎ পৌঁছার ফলে সেসব জনপদের মানুষের কল্যাণ ও অধিকার পূর্ণ হয়েছে। বিদ্যুৎ শুধু দুর্গম অঞ্চলের বসবাসকারীদের রাতের আঁধারকেই দূর করেনি। তাদের মন মানসের আঁধারকেও দূরীভূত করেছে। যেমন বিদ্যুৎ মানুষকে বৈদ্যুতিক যন্ত্রপাতি ব্যবহারের সুযোগ করে দিয়ে তাদের জীবনকে সহজ ও স্বাচ্ছন্দ্যময় করেছে। টেলিভিশন দেখার সুযোগ ঘটায় সেই সব জনপদের মানুষের জন্য খুলে গেছে গোটা বিশ্বের দুয়ার। তাদের কাছে পৌঁছে যাচ্ছে সব তথ্য, নতুন যত উদ্ভাবন, জ্ঞান-বিজ্ঞানের সমৃদ্ধ জগতে প্রবেশ করার সুযোগ তাদের জন্য উন্মুক্ত হয়েছে। রাষ্ট্রকে জনগণের পাঁচ মৌলিক চাহিদা তথা অধিকার পূর্ণ করার তাগিদ দিয়েছে সংবিধান। আজকের প্রেক্ষাপটে নিভৃত অঞ্চলের মানুষের জন্য বিদ্যুতের পর সুচিকিৎসা নিশ্চিত করার বিষয়টি সরকারের অগ্রাধিকারের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করা একান্ত বাঞ্ছনীয়। একটি সুস্থ সবল কর্মঠ জাতি চাইলে তার প্রতিটি নাগরিককেই সুস্থ সবল থাকতে হবে, এটা ভুললে চলবে না। উপজেলা পর্যায়ে স্বাস্থ্য পরিচর্যার কিঞ্চিত সুযোগ ঘটেছে বটে। তাকে আরো উন্নত করার পাশাপাশি তার পরিধি আরো অভ্যন্তরে নিয়ে যেতে হবে। শিক্ষা লাভের সুযোগ বিস্তৃত হয়েছে সন্দেহ নেই। তার পরও কিন্তু আছে, শিক্ষার মান ও বিদ্যালয়ের অবকাঠামো, শিক্ষকদের যোগ্যতা এবং অন্যান্য হাল হকিকত এতই রুগ্ণ, যে সেখান থেকে ভালো কোনো ফল পাওয়ার আশা করা যায় না। অথচ শিক্ষাকে একটি জাতির মেরুদণ্ড মনে করা হয়। মেরুদণ্ড যদি ক্ষয়প্রাপ্ত হয়, তবে তো জাতির পক্ষে উঠে দাঁড়ানোই সম্ভব হবে না।
আগের কথায় ফিরে আসি, উন্নয়নের সব প্রকল্পকে এক পাল্লায় তুলে ওজন করার মনোভাবকে অর্বাচীনে ভাবনাই বলতে হবে। সে বিবেচনায় এমন কিছু প্রকল্প বাস্তবায়নের পথে রয়েছে যা আমাদের ন্যাশনাল প্রাইড বা জাতীয় গৌরবের বিষয়। যেমন পদ্মা সেতু, যা অত্যন্ত চ্যালেঞ্জিং একটি প্রকল্প। সেই সাথে কর্ণফুলী নদীর তলদেশ দিয়ে যে ট্যানেল তৈরি হচ্ছে, সেটাও বিশেষ করে উল্লেখ করার মতো। এই দুই প্রকল্পই জনহিতকর এবং অর্থনৈতিক দিক থেকে বিবেচনা করলে উভয়ের গুরুত্ব সমধিক। ড. কালামের বাণী বা একটি উদাহরণ আবারো উল্লেখ করছি, যদি তুমি তোমার কাজকে স্যালুট করো, দেখো তোমায় অর কাউকে স্যালুট করতে হবে না।’ এই বাণীর এই অংশ আমাদের কেনো কোনো ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। আবার বাণীর একটি অংশও আমাদের অনেক ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। যেমন, কিন্তু তুমি যদি তোমার কাজকে অসম্মান করো, অমর্যাদা করো, ফাঁকি দাও তাহলে তোমায় সবাইকে স্যালুট করতে হবে। আমাদের দেশে যাদের ক্ষেত্রে এসব কথা অক্ষরে অক্ষরে নির্ভুল তাদের অবশ্যই আত্ম সমালোচনা ও অনুশোচনা করা ছাড়া ভিন্ন কিছু নেই। সাম্প্রতিককালে দেশের কিছু রাজনৈতিক কর্তৃপক্ষ বহু ভুলত্রুটি করেছেন। কিন্তু তাদের মধ্যে অনুশোচনার কিছুু মাত্র লক্ষণ দেখা যায়নি। দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে এমন অক্ষমতায় আজকের পরিস্থিতিতে অনুকম্পা দেখানোর কোনো সুযোগ আছে কি?
এখানে একটা কথা বারবার মনে উঁকি দিচ্ছে। মহামারী কোভিড কবে, কখন শেষ হবে তার উত্তর কারো কাছে নেই। এমন কি, উন্নত বিশ্বের প্রখ্যাত বিজ্ঞানীরাও এ ক্ষেত্রে লা-জবাব। তারা বরং নিরন্তর গবেষণা চালিয়ে যাচ্ছেন। ভবিষ্যতে ভিন্ন কোনো স্বাস্থ্য সমস্যা, পরিবেশ ও আবহাওয়াজনিত ভয়ঙ্কর সব সঙ্কট মোকাবেলা করা এবং সম্ভাব্য সব বিকল্প নিয়ে গবেষণা কাজ করছেন। আমরা জেনেছি, বহু বৈচিত্র্য আর অপর সৌন্দর্যের বিস্ময়কর সমন্বয়ে সৃষ্ট সহনীয় গ্রহ পৃথিবীও এখন এক মহাবিপর্যয়ের মুখে। বিশ্বব্যাপী বিজ্ঞানীরা এসব নিয়ে দুশ্চিন্তায় রয়েছেন।
আমরা এসব বিপদে কিছু কি করতে পারি? অবশ্যই এমন প্রশ্নে আমাদের মতো দেশের পক্ষে মূক হয়ে থাকা ছাড়া আর কোনো পথ তো অবশিষ্ট নেই। এমন ভাবনা স্বাভাবিক হলেও ভিন্ন কোনো স্বপ্ন দেখা নিষিদ্ধ কোনো ফল নয়। কথায় বলে, দশের লাঠি একের বোঝা। শেষ হয়ে যাওয়ার আগে, এই ধারণাকে ফেলনা না ভেবে আমাদের কর্তৃপক্ষের কোভিড ও অন্যান্য বিষয় নিয়ে দেশের বিজ্ঞানীদের এগিয়ে আসার ব্যবস্থা করা এবং সরকারের পক্ষে সম্ভাব্য যতটুকু সহায়তা দেয়া যায়, তার চেষ্টা জরুরি। বিশ্বের পরিবেশের প্রতি যে হুমকি তাতে গোটা বিশ্বের সব দেশ যদি কিছু কিছু অবদান রাখে তবে তা ‘তিলে তিলে তাল’ হয়ে উঠতে পারে। আর আমাদের পরিবেশের সুরক্ষা নিয়ে আত্মসমালোচনা করার সময় যেন পার হয়ে যাচ্ছে। কেননা পরিবেশ নিয়ে বাংলাদেশ ইতোমধ্যে ভয়াবহ বিপর্যয়ের দিকে দুর্বার গতিতে ছুটছে। আর তার প্রতিকারের জন্য আমরা কচ্ছপের গতিতেও চলছি না। এমন পরিস্থিতিতে একটা উদাহরণ স্মরণে আসছে। ইতালির নৃপতি নিরোর কথা। যখন দেশের রাজধানী রোম আগুনে ভস্ম হতে চলেছিল কথিত আছে, নিরো তখন নীরবে নিভৃতে বসে একান্ত মনে বাঁশি বাজিয়ে যাচ্ছিলেন। তেমনি দেশের পরিবেশ, আবহাওয়ার উষ্ণতা সব তছনছ করে দিতে চলেছে। তখন সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় যেন হিমালয়ের হিমশীতল বরফের মধ্যে মৈনাকের মতো মুখ ঢেকে অবচেতন ও নিমগ্ন হয়ে আছে। এমন সব বিষয় জাতির জন্য দুঃস্বপ্নের কারণ হয়ে উঠেছে।
জাতিসঙ্ঘ থেকে পরিবেশ আবহাওয়া ও বৈশ্বিক উষ্ণতা নিয়ে যে মহাবিপর্যয়ের বার্তা দিয়ে বিশ্ববাসীকে সচেতন করে তোলার চেষ্টা করছে, তাতে তো সবার ঘুম হারাম হয়ে যাওয়ার কথা। কিন্তু আমরা অঘোরে ঘুমাচ্ছি। এর আগে বহু নিবন্ধে এ কথা নয়া দিগন্তসহ আরো অনেক জাতীয় দৈনিকে উল্লেখ করা হয়েছে; কিন্তু সংশ্লিষ্ট সংস্থা ও প্রতিষ্ঠান তো কুম্ভকর্ণের মতো হয়ে আছে। যেন তারা সবাই মূক ও বধির। হ
ndigantababor@gmail.com


আরো সংবাদ



premium cement