২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫
`

চীনের স্থানীয় মুদ্রার অবমূল্যায়ন ও চীন-মার্কিন বাণিজ্য বিরোধ

-

চীন-যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য বিরোধ দীর্ঘ দিনের। বিশেষ করে চীন বিশ্ব অর্থনীতিতে তার প্রবল উপস্থিতি জানান দেয়ার পর থেকেই এই বিরোধ তীব্র হয়ে উঠেছে। কয়েক বছর আগে বিশ্ব অর্থনীতিতে জাপানকে দ্বিতীয় অবস্থান থেকে হটিয়ে দিয়ে চীন সেই জায়গাটি দখল করেছে। শুধু তাই নয়, ইতোমধ্যেই দেশটি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের শীর্ষস্থান দখলের প্রতিযোগিতায় অনেকটাই এগিয়ে গেছে। একটি আন্তর্জাতিক গবেষণা সংস্থা কয়েক বছর আগে এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করে যে, চীন যেভাবে বিশ্ব অর্থনীতিতে তার অবস্থান শক্তিশালী করছে, তাতে ২০৫০ সালের মধ্যেই দেশটি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনৈতিক আধিপত্য অতিক্রম করে যেতে পারবে। ইতোমধ্যে চীন পারচেজিং পাওয়ার প্যারিটি (পিপিপি) বিবেচনায় যুক্তরাষ্ট্রকে অতিক্রম করে গেছে। তাই যুক্তরাষ্ট্র নানাভাবে চেষ্টা করছে চীনের এই অর্থনৈতিক আধিপত্য রুখে দেয়ার। বিভিন্ন অভিযোগ উত্থাপন করছে দেশটির বিরুদ্ধে। বিশেষ করে চীনের বিরুদ্ধে অনৈতিক বাণিজ্যের অভিযোগ করে আনছে যুুক্তরাষ্ট্র। তাদের অভিযোগ, আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে চীনের অনৈতিক চর্চার কারণে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রর স্থানীয় উৎপাদক শ্রেণী মারাত্মক ক্ষতির মুখোমুখি।
যুক্তরাষ্ট্রের প্রধান অভিযোগ হচ্ছে, রফতানিমুখী অর্থনীতির দেশ চীন ইচ্ছে করেই তাদের স্থানীয় মুদ্রা ইয়েনের অবমূল্যায়ন করে রেখেছে। তারা মুক্তবাজার অর্থনীতির সূত্র অনুযায়ী, বাজার চাহিদার ওপর স্থানীয় মুদ্রার মান নির্ধারণের ব্যবস্থা করছে না। বরং কৃত্রিমভাবে স্থানীয় মুদ্রার অবমূল্যায়ন করে চলেছে। এতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে চীনা পণ্যের সাথে স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত ও বাজারজাতকৃত পণ্য মার খাচ্ছে। চীন বরাবরই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের উত্থাপিত এ অভিযোগ অস্বীকার করে আসছে।
বিশ্লেষকরা মনে করছেন, চীন-মার্কিন বাণিজ্য বিরোধ যত না অর্থনৈতিক তার চেয়ে বেশি রাজনৈতিক কারণে সৃষ্ট। দুই দেশের বাণিজ্যবিরোধ প্রায়ই সঙ্ঘাতে পরিণত হওয়ার পর্যায়ে চলে যায়। যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সময় চীন-মার্কিন বাণিজ্যিক দ্বন্দ্ব ভয়াবহ আকার ধারণ করে। একপর্যায়ে যুক্তরাষ্ট্র চীনের অন্তত সাড়ে পাঁচ হাজার পণ্যের ওপর আমদানি নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। চীনও পাল্টা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পণ্য আমদানির ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। নতুন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের আমলে চীন-মার্কিন বাণিজ্য বিরোধের উত্তাপ কিছুটা কমে এলেও শেষ হয়েছে বলা যাবে না। আগামীতে যেকোনো সময় এ বিরোধ আবারো চাঙ্গা হয়ে উঠতে পারে। প্রশ্ন উঠতে পারে, চীন মার্কিন ডলারের বিপরীতে তার স্থানীয় মুদ্রা ইয়েনের কৃত্রিমভাবে অবমূল্যায়ন ঘটিয়ে কি সুবিধা পাচ্ছে? চীন রফতানিমুখী একটি দেশ। দেশটি আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে যতটা আমদানি করে তার চেয়ে অনেক বেশি পণ্য ও সেবা রফতানি করে। চীন সাধারণত স্বল্প মূল্যের পণ্য রফতানি করে। স্থানীয় মুদ্রা ইয়েনের ব্যাপক অবমূল্যায়নের কারণে চীনা উৎপাদক ও রফতানিকারকরা বিশেষ সুবিধা পায়। কোনো দেশ তার স্থানীয় মুদ্রার অবমূল্যায়ন ঘটালে দেশটির রফতানিকারকরা লাভবান হয়। আবার কোনো কারণে স্থানীয় মুদ্রার অতিমূল্যায়ন করা হলে দেশটির আমদানিকারকরা লাভবান হয়। একটি উদাহরণের মাধ্যমে বিষয়টি অনুধাবন করা যেতে পারে। মনে করি, প্রতি মার্কিন ডলারের মূল্য বাংলাদেশী মুদ্রায় ৮৫ টাকা; অর্থাৎ ১ মার্কিন ডলার কিনতে ৮৫ টাকা প্রয়োজন হয়। কোনো কারণে মার্কিন ডলারের বিপরীতে বাংলাদেশী স্থানীয় মুদ্রা টাকার অবমূল্যায়ন ঘটিয়ে ৮৭ টাকা নির্ধারণ করা হলো। তা হলে একজন পণ্য রফতানিকারক তার উৎপাদন খরচ ঠিক রেখে আগের মতোই ১ মার্কিন ডলারের পণ্য রফতানি করে স্থানীয় মুদ্রায় ৮৭ টাকা পাবেন; অর্থাৎ তার ২ টাকা অতিরিক্ত লাভ হবে। কিন্তু যারা আমদানিকারক তারা ক্ষতিগ্রস্ত হবেন। কারণ তাদের পণ্য আমদানির জন্য মার্কিন ডলার ক্রয় করার জন্য আগের চেয়ে ২ টাকা বেশি ব্যয় করতে হবে। এতে স্থানীয় বাজারে পণ্যমূল্য বাড়বে। গণদুর্ভোগ বাড়বে। যেসব দেশ রফতানিমুখী তারা স্থানীয় মুদ্রার অবমূল্যায়নের কারণে লাভবান হয়।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র অনেক দিন ধরেই চীনের বিরুদ্ধে এ অভিযোগ তুলছে। এখন দেখা যেতে পারে ২০১২ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত চীন তার স্থানীয় মুদ্রার কতটা অবমূল্যায়ন করেছে। ২০১২ সালে প্রতি মার্কিন ডলারের বিপরীতে চীনের স্থানীয় মুদ্রার বিনিময় হার ছিল ৬ দশমিক ২৭ ইয়েন; অর্থাৎ বর্ণিত সময়ের মধ্যে চীনের স্থানীয় মুদ্রার অবমূল্যায়ন ঘটেছে ১২ দশমিক ২৮ শতাংশ। একই সময়ে প্রতি মার্কিন ডলারের বিপরীতে পাকিস্তানি রুপির বিনিময় হার দাঁড়িয়েছে ৯০ দশমিক ০২ রুপি থেকে ১৫৯ দশমিক ৯০ রুপি; অর্থাৎ পাকিস্তানের রুপির অবমূল্যায়ন ঘটেছে ৭৭ দশমিক ৬২ শতাংশ। প্রতি মার্কিন ডলারের বিপরীতে ভারতীয় রুপির বিনিময় হার দাঁড়িয়েছে ৪৮ দশমিক ৪৫ রুপি থেকে বৃদ্ধি পেয়ে ৭০ দশমিক ৮৫ রুপিতে উন্নীত হয়েছে। ভিয়েতনামি ডংয়ের বিনিময় হার ২০ দশমিক ৮৯ থেকে বেড়ে ২৩ দশমিক ২১ ডংয়ে উন্নীত হয়েছে। স্থানীয় মুদ্রার অবমূল্যায়নের হার ১১ দশমিক ১০ শতাংশ। তুরস্কের স্থানীয় মুদ্রা লিরার বিপরীতে প্রতি মার্কিন ডলারের বিনিময় হার ১ দশমিক ৭৫ লিরা থেকে ২১২ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়ে ৫ দশমিক ৪৭ লিরায় উন্নীত হয়েছে। শ্রীলঙ্কান রুপির বিনিময় হার ৫৫ দশমিক ৫০ শতাংশ অবমূল্যায়িত হয়ে ১১৩ দশমিক ৮২ রুপি থেকে ১৭৭ রুপিতে উন্নীত হয়েছে। একই সময়ে বাংলাদেশী টাকার অবমূল্যায়ন হয়েছে ১ দশমিক ৫৮ শতাংশ। প্রতি মার্কিন ডলারের বিনিময় হার ৮৩ দশমিক ০৪ টাকা থেকে বৃদ্ধি পেয়ে ৮৪ দশমিক ৩৫ টাকায় উন্নীত হয়। পরিসংখ্যান থেকে প্রতীয়মান হয় যে, বর্ণিত সময়ে মার্কিন ডলারের বিপরীতে স্থানীয় মুদ্রার সবচেয়ে কম অবমূল্যায়ন ঘটেছে বাংলাদেশের টাকার ক্ষেত্রে। চীন, ভারত, ভিয়েতনাম, তুরস্ক, শ্রীলঙ্কাসহ প্রভৃতি দেশ আন্তর্জাতিক বাজারে বাংলাদেশী পণ্যের সবচেয়ে বড় প্রতিযোগী। স্থানীয় মুদ্রার ব্যাপক অবমূল্যায়নে এসব দেশ আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতিযোগিতা সক্ষমতার ক্ষেত্রে বাংলাদেশের চেয়ে অনেকটাই এগিয়ে রয়েছে। বিশেষ করে তৈরি পোশাক রফতানির ক্ষেত্রে দেশগুলো ভালো অবস্থানে চলে যাওয়ার সম্ভাবনা উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে। সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক বাজারে তৈরি পোশাক রফতানির ক্ষেত্রে ভিয়েতনামের কাছে দ্বিতীয় স্থান হারিয়েছে। অনেক দিন ধরেই বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক বাজারে তৈরী পোশাক রফতানির ক্ষেত্রে দ্বিতীয় অবস্থানে ছিল। চীন এ ক্ষেত্রে সবার উপরে ছিল। চীনের অবস্থান ঠিক থাকলেও ভারতের অবস্থান এক ধাপ অবনমন ঘটেছে। ভারত চতুর্থ স্থান থেকে পঞ্চম স্থানে নেমে গেছে। তুরস্ক চতুর্থ স্থানে উঠে এসেছে। বাংলাদেশ ১৯৯৪ সাল থেকে ভাসমান বিনিময় হার অনুসরণ করে আসছে। এর অর্থ হচ্ছে বাজার চাহিদা ও জোগানের ওপর নির্ভর করে স্থানীয় মুদ্রার বিনিময় হার নির্ধারিত হবে। আগে বাংলাদেশ ব্যাংক প্রতিদিনের মুদ্রার বিনিময় হার নির্ধারণ করে দিত। কিন্তু বাংলাদেশ ব্যাংক মাঝে মধ্যেই মুদ্রাবাজারে হস্তক্ষেপ করে থাকে। অনেক দিন ধরেই স্থানীয় বাজারে প্রতি মার্কিন ডলার ৮৫ টাকায় বিক্রি হচ্ছিল। কয়েক দিন আগে স্থানীয় মুদ্রার কিছুটা অবমূল্যায়ন ঘটেছে। বর্তমানে প্রতি মার্কিন ডলার ৮৭ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। স্থানীয় মুদ্রা টাকার অবমূল্যায়ন ঘটায় আমদানি ব্যয় বৃদ্ধি পাবে। এতে গণদুর্ভোগ সৃষ্টির আশঙ্কা রয়েছে। এ অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য বাংলাদেশ ব্যাংক অচিরেই কিছু ব্যবস্থা নেবে। এর মধ্যে সবচেয়ে সহজ ব্যবস্থা হবে বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভ থেকে কিছু মার্কিন ডলার বাজারে ছেড়ে দেয়া। এটি করা হলে স্থানীয় বাজারে মার্কিন ডলারের জোগান বৃদ্ধি পাবে। এতে মার্কিন ডলারের অতিমূল্যায়ন রোধ করা সম্ভব হবে। প্রতিবেশী কোনো কোনো দেশ ইচ্ছা করেই তাদের স্থানীয় মুদ্রার অবমূল্যায়ন ঘটিয়ে রাখছে। এটি করা হচ্ছে বাংলাদেশের মতো দেশের আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের প্রতিযোগিতা সক্ষমতা কমানোর জন্য। বিশেষ করে ভিয়েতনাম আন্তর্জাতিক বাজারে বাংলাদেশের তৈরী পোশাকসামগ্রী রফতানিতে তীব্র প্রতিযোগিতা শুরু করেছে। তারা বেশ কয়েক বছর আগে পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে বাংলাদেশকে অতিক্রম করে যাওয়ার জন্য। তারা এরই মধ্যে সেই লক্ষ্য অর্জনে সক্ষম হয়েছে। আগামীতে তৈরী পোশাক রফতানিতে বাংলাদেশ আর কখনোই ভিয়েতনামকে অতিক্রম করে যেতে পারবে না। কারণ ভিয়েতনাম সম্প্রতি ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে শুল্কমুক্ত রফতানিসংবলিত জিএসপি সুবিধা পেয়েছে। ফলে আগামীতে ইউরোপীয় ইউনিয়নের ২৭টি দেশে ভিয়েতনামের পণ্য রফতানিতে কোনো শুল্ক দিতে হবে না। আর বাংলাদেশ ২০২৬ সালে উন্নয়নশীল দেশের চূড়ান্ত তালিকায় উত্তীর্ণ হওয়ার পর ২০২৯ সাল থেকে ইউরোপীয় ইউনিয়নের দেয়া জিএসপি সুবিধা হারাবে। বাংলাদেশের তৈরী পোশাকের ৬১ শতাংশই যায় ইউরোপীয় ইউনিয়ন। এ সাফল্যের মূলে রয়েছে জিএসপি সুবিধা। জিএসপি সুবিধা প্রত্যাহৃত হলে বাংলাদেশের তৈরী পোশাক তথা পুরো রফতানি বাণিজ্য মুখ থুবড়ে পড়তে পারে। উপরে যেসব দেশের কথা উল্লেখ করা হয়েছে, তাদের সবাই আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতিযোগিতা সক্ষমতা বাড়ানোর জন্য স্থানীয় মুদ্রার অবমূল্যায়ন ঘটিয়ে রেখেছে। কিন্তু বাংলাদেশ তা করতে পারছে না। কারণ বাংলাদেশ যে পরিমাণ পণ্য রফতানি করে তার চেয়ে প্রায় দ্বিগুণ পণ্য আমদানি করে। কাজেই বাংলাদেশ স্থানীয় মুদ্রার অবমূল্যায়ন ঘটালে তাতে দেশের সাধারণ মানুষের দুর্ভোগ বৃদ্ধি পাবে। কিন্তু আন্তর্জাতিক বাজারে বাংলাদেশের প্রতিদ্বন্দ্বী দেশগুলোর বেশির ভাগই রফতানিমুখী দেশ। তারা যে পরিমাণ পণ্য রফতানি করে আমদানি করে তার চেয়ে অনেক কম পণ্য। কাজেই তারা অবমূল্যায়নের মাধ্যমে লাভবান হচ্ছে। হ


আরো সংবাদ



premium cement