১৮ এপ্রিল ২০২৪, ০৫ বৈশাখ ১৪৩১, ০৮ শাওয়াল ১৪৪৫
`

খনিজ ও প্রাকৃতিক সম্পদের ব্যবহার

-

অর্থনৈতিকভাবে বাংলাদেশ এগোচ্ছে; তাতে কোনো সন্দেহ নেই। বিগত এক দশক ধরে বাংলাদেশের অর্থনীতি স্থিতিশীল রয়েছে। জিডিপি গড় ৭-এর মধ্যে। তবে জিডিপির হিসাবটি আপেক্ষিকতার ঘেরাটোপে বন্দী। সরকার একরকম বললে বিশ্বব্যাংক, আইএমএফসহ অন্যান্য সংস্থা ও অর্থনীতিবিদরা এর সাথে দ্বিমত করেন। এ গরমিলের মধ্যেই আমাদের অর্থনীতি সামনের দিকে অগ্রসরমান। একথা সত্যি, মধ্যম গতিতে চলতে পারলে বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ার এক নম্বর ধনী দেশ হতে পারতো।
যদিও অর্থনৈতিক অগ্রগতির দিক থেকে আমরা এখন ভারত ও পাকিস্তানের চেয়ে এগিয়ে। তবে লক্ষ্য হওয়া উচিত সিঙ্গাপুর, যে দেশটি শূন্য থেকে সমৃদ্ধ হয়েছে। সাড়ে চার দশক আগেও সিঙ্গাপুরের বলতে গেলে কিছুই ছিল না। ৭২৮ বর্গকিলোমিটার আয়তনের ছোট দেশটি ১৯৬৩ সালে স্বাধীনতার পর মালয় ফেডারেশনে যুক্ত হয়। ১৯৬৫ সালে মালয়েশিয়া থেকে বের করে দেয়া হয়। সে সময়ের প্রধানমন্ত্রী লি কুয়ান ইউ আফসোস করে বলেছিলেন ‘এখন আমাদের কি হবে! কি করে বাঁচব!’ সিঙ্গাপুরের জমি নেই, চাষবাসেও উপায় নেই। এ অবস্থায় স্বাবলম্বী হতে পণ্য আমদানি-রফতানির ওপর জোর দেয় দেশটি। ভৌগোলিক অবস্থান কাজে লাগিয়ে বন্দরকে আমদানি-রফতানির গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র হিসেবে গড়ে তোলা হয়। বাজারভিত্তিক অর্থনীতি আঁকড়ে ধরে। এটিই এখন দেশটির ভিত্তি। মূলশক্তি আমদানিকৃত পণ্যের পরিশোধন এবং রফতানি। বিশ্বে সিঙ্গাপুর রফতানির দিক দিয়ে ১৪ নম্বর। আমদানিতে ১৫ নম্বর। দুর্নীতিমুক্ত পরিবেশ, দক্ষ জনশক্তি, শক্তিশালী অবকাঠামো ও নি¤œ ট্যাক্স রেটের কারণে বিশ্বের সবচেয়ে বেশি সরাসরি বিদেশী বিনিয়োগের দেশে পরিণত হয়েছে। এসব দেশের উন্নতি দেখে উন্নয়নকামী দেশ হিসেবে দ্রুত অগ্রসরমান অর্থনীতির বিশ্বে আমাদের অবস্থান ও সম্ভাবনার বিষয়টি ভাবা জরুরি। শূন্য নই, আমাদের প্রাকৃতিক প্রাচুর্য রয়েছে। রয়েছে বিশাল জনগোষ্ঠী। প্রয়োজন শুধু সম্পদ আহরণ এবং যথাযথ কাজে লাগানো।
আমাদের অর্থনীতির অন্যতম ভিত্তি হতে পারে আবিষ্কৃত ও অনাবিষ্কৃত বিপুল প্রাকৃতিক সম্পদ। এ সম্পদ আঁকড়ে ধরেই বাংলাদেশ হতে পারে এশিয়ার অন্যতম অর্থনৈতিক শক্তি। শুধু প্রয়োজন সরকার ও রাজনৈতিক দলগুলোর উপলব্ধি ও সম্পদের যথাযথ ব্যবহার। ইতোমধ্যে জিওলজিক্যাল সার্ভে অব বাংলাদেশ (জিএসবি) বিভিন্ন সমীক্ষা চালিয়ে যাচ্ছে। যদিও মাটির নিচে কী পরিমাণ খনিজসম্পদ রয়েছে, তা এখনো সঠিকভাবে নির্ণয় করা সম্ভব হয়নি। তবে প্রায়ই মূল্যবান খনিজসম্পদ আবিষ্কারের খবর আমাদের বিস্মিত করে। যেমন আশা জাগিয়েছে দিনাজপুরের হাকিমপুর উপজেলার (হিলি) মশিদপুর এলাকায় মূল্যবান আকরিক লোহার খনির সন্ধান। জিএসবির হিসাব অনুযায়ী, এই খনির দেড় হাজার থেকে দুই হাজার ফুট গভীরতায় এক থেকে তিন ফুট পুরুত্বে ম্যাগনেটিক মিনারেলস, হেমাটাইট, ম্যাগনেটাইট ও লিমোনাইট পাওয়া গেছে। একই সাথে খনির ১২০০ ফুট গভীরে রয়েছে চুনাপাথর। লৌহ আকরিকের খনির আবিষ্কার দেশের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। এই আবিষ্কারের ফলে বহির্বিশ্বে বাংলাদেশের ভাবমর্যাদা বাড়বে। বলা প্রয়োজন, ইতোমধ্যে বাংলাদেশে অত্যন্ত মূল্যবান বিভিন্ন খনিজসম্পদের সন্ধান পাওয়া গেছে। গ্যাস, তেল, কয়লা ছাড়াও পাওয়া গেছে স্বর্ণের চেয়েও দামি ইউরেনিয়াম। অন্যান্য মূল্যবান খনিজের মধ্যে রয়েছে, চুনা পাথর, কঠিন পাথর, নুড়ি পাথর, কাচ বালি, হোয়াইট ক্লে, ব্রিক ক্লে, পিট, মিনারেলস সমৃদ্ধ বিচ স্যান্ড। ভূতাত্ত্বিকভাবে বাংলাদেশ ‘বেঙ্গল ব্যাসিন’-এর বিরাট অংশজুড়ে রয়েছে। এর উত্তরাংশ শতকরা ১২ ভাগ পাললিক পাথর, উত্তর ও উত্তর-পূর্বাংশের ৮ ভাগ প্লিস্টোসিন এবং উত্তর-পশ্চিম, মধ্য উত্তরাংশ ও পূর্বাংশ শতকরা ৮০ ভাগ বালু, পলি ও কাদা দ্বারা পরিবেষ্টিত। অর্থাৎ দেশের এই অংশ বিভিন্ন ধরনের খনিজসম্পদের বেল্ট হিসেবে পরিচিত। ইতোমধ্যে জিএসবি দেশের ৪২ ভাগ ভূখণ্ডে যে জরিপ পরিচালনা করেছে, তাতে বিভিন্ন ধরনের খনিজ পদার্থ প্রাপ্তির উজ্জ্বল সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। এসব সম্পদ যথাযথভাবে আহরণ ও ব্যবহার করতে পারলে বাংলাদেশের অর্থনীতির চেহারা বদলে যাবে । বাংলাদেশকে যে ইমার্জিং টাইগার হিসেবে বিবেচনা করা হয়, এর অন্যতম কারণ আবিষ্কৃত ও অনাবিষ্কৃত মূল্যবান খনিজসম্পদের ভাণ্ডার। বিশ্বের পরাশক্তিধর দেশগুলো যে ইউরেনিয়ামকে ব্যবহার করে পারমাণবিক শক্তি অর্জন করেছে, এর পর্যাপ্ত মজুদ বাংলাদেশে রয়েছে। ১৯৭৫ সালে মৌলভীবাজারে প্রথম ইউরেনিয়ামের সন্ধান মেলে। এরপর ১৯৮৫ সালে সিলেটের জৈন্তাপুরে এবং ১৯৮৯ সালে ময়মনসিংহের গারো পাহাড় পরিবেষ্টিত সোমেশ্বরী নদীতে ইউরেনিয়াম পাওয়া যায়। সাম্প্রতি জিএসবির জরিপে পদ্মা, ব্রহ্মপুত্র, যমুনা এবং সিলেট ও ময়মনসিংহের নদীবাহিত বালুতে ভারী খনিজ ও আহরণযোগ্য ইউরেনিয়াম পাওয়ার কথা বলা হয়েছে। জিএসবি পদ্মা-যমুনার প্রায় ১০টি স্থানে ২০ মিটার গভীর থেকে বালু সংগ্রহ করে পরীক্ষা করে দেখেছে, আহরণযোগ্য ভারী খনিজ ও রাসায়নিক পদার্থের পরিমাণ প্রায় সাড়ে ৯ শতাংশ। বাণিজ্যিক ভিত্তিতে উৎপাদনের জন্য ৭ শতাংশ যথেষ্ট। এক টন বালুতে এক গ্রাম ইউরেনিয়াম পাওয়া গেলেই বাণিজ্যিকভাবে তা আহরণযোগ্য বলে বিবেচনা করা হয়। এই আহরণযোগ্য ইউরেনিয়াম ব্যবহার করে বাংলাদেশ ব্যাপকভাবে উপকৃত হতে পারে। বাংলাদেশ পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের অনুমতি পাওয়ায় ইউরেনিয়াম ব্যবহারের উজ্জ্বল সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। এতে ইউরেনিয়াম ব্যবহার করা হলে সাশ্রয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন যেমন সম্ভব, তেমনি জ্বালানি সঙ্কটও কমবে। বেশ কয়েক বছর আগে সমুদ্র উপকূলের বালুতে অত্যন্ত মূল্যবান ভারী খনিজপদার্থের সন্ধান পাওয়া যায়। এ খনিজের নাম দেয়া হয় ‘ব্ল্যাক গোল্ড’ বা কালো সোনা। ইতোমধ্যে এই সম্পদ আহরণে সমীক্ষার জন্য অস্ট্রেলিয়ার একটি প্রতিষ্ঠান সরকারের কাছে অনুমতি চেয়ে আবেদন করেছে। ইউরেনিয়াম ও ব্ল্যাক গোল্ড ছাড়াও সিরামিকের জন্য হোয়াইট ক্লে, কাচের জন্য গ্ল্যাস স্যান্ড, ইটের জন্য ব্রিক ক্লে, জ্বালানির জন্য পিট কয়লা থেকে শুরু করে আরো মূল্যবান খনিজসম্পদের সন্ধান পাওয়া গেছে। মাটির নিচে আরো কী পরিমাণ মূল্যবান খনিজসম্পদ রয়েছে, তা এখনো অজানা। এ ছাড়া বাংলাদেশের সমুদ্রসীমায় অফুরন্ত তেল ও গ্যাস যে রয়েছে, তা জানা গেছে। প্রাকৃতিক মূল্যবান খনিজের পর্যাপ্ততা এবং সর্বশেষ লোহার খনি আবিষ্কারের মধ্য দিয়ে এটাই প্রমাণিত হয়, প্রাকৃতিক সম্পদের দিক থেকে বাংলাদেশ পৃথিবীর কোনো দেশের চেয়ে কম নয়। এই সম্পদ আহরণ ও ব্যবহারযোগ্য করে তুলতে পারলে বাংলাদেশ যে সিঙ্গাপুরকে ছাড়িয়ে যেতে পারবে, তাতে সন্দেহ নেই।
এ পর্যন্ত যেসব মূল্যবান খনিজসম্পদের সন্ধান পাওয়া গেছে, তা যথাযথভাবে আহরণ ও ব্যবহারযোগ্য করে তুলতে পারলে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে যে বৈপ্লবিক পরিবর্তন হবে, তাতে সন্দেহ নেই। এক ইউরেনিয়াম দিয়েই বাংলাদেশ অনেকদূর এগিয়ে যেতে পারে। এর সাথে অন্যান্য খনিজসম্পদ যুক্ত হলে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক সূচক কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে, তা সহজেই অনুমেয়। এ কথা অনস্বীকার্য, এসব সম্পদ আহরণে আমাদের প্রযুক্তিগত সীমাবদ্ধতা রয়েছে। এই অসামর্থ্য কাটিয়ে ওঠার পরিকল্পিত উদ্যোগ যে আছে, তাও পরিলক্ষিত হচ্ছে না। আমরা কেবল সম্পদের খবরে সীমাবদ্ধ হয়ে পড়ছি। এ অবস্থা হলে সম্পদ আবিষ্কার করলেই কি আর না করলেই কি! কাজেই প্রাকৃতিক সম্পদের মজুদ আবিষ্কারের পর তা অর্থনীতি সমৃদ্ধ করতে কাজে লাগাতে হবে। হ
nayemulislamnayem148@gmail.com


আরো সংবাদ



premium cement