২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১, ১৩ শাওয়াল ১৪৪৫
`

করোনা নিয়ন্ত্রণে মাস্ক-টিকার ভূমিকা

করোনা নিয়ন্ত্রণে মাস্ক-টিকার ভূমিকা -

ইলেকট্রন মাইক্রোস্কপিক অণুজীব করোনাভাইরাস, যার দাপটে আজ সারা পৃথিবী স্তব্ধ। প্রাণঘাতী করোনাভাইরাসের ট্রান্সমিশন চ্যানেল ভাঙতে এখন পর্যন্ত কার্যকর অস্ত্র সুরক্ষাসামগ্রী মাস্ক, হ্যান্ড গ্লোভস, পিপিই ও হ্যান্ড স্যানিটাইজার সামগ্রী, লকডাউন-শাটডাউন প্রয়োগ করে যাচ্ছি আমরা। মানুষ থেকে মানুষে সংক্রমিত, বিশ্বব্যাপী বহুল আলোচিত একবিংশ শতাব্দীর সর্বাধিক প্রাণঘাতী অসুখ কোভিড-১৯।
সভ্যতার ইতিহাসে খুব কম উদাহরণই আছে, যেখানে একটি রোগ অতি অল্প সময়ে বৈশ্বিক অর্থনীতি, রাজনীতি ও সমাজনীতিতে এতটা প্রভাব বিস্তার করতে পেরেছে। টিকা দেয়ার লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত হওয়ার পরও পরিস্থিতি সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে আসছে না অনেক দেশে। মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন তার দেশে করোনার শঙ্কা থেকে ‘ফ্রিডম ডে’ ঘোষণা করেও আবার জনগণকে মাস্কে অভ্যস্ত করছেন। বুস্টার ডোজের কথাও বলছেন। করোনা নিয়ন্ত্রণে পৃথিবীর ‘সফল’ দেশ নিউজিল্যান্ডও সব ধরনের কার্যক্রম চালু করছে না, দেশের সীমান্তও খুলছে না। তবে সেখানে এখন সংক্রমণ প্রায় শূন্যের কোঠায়। করোনা সংক্রমণের প্রাথমিক পর্যায়ে এমনকি বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাও মাস্কের ব্যাপারে এতটা জোর দেয়নি, যেমন এখন দিচ্ছে। কিন্তু দক্ষিণ কোরিয়া, জাপান, তাইওয়ান ও ভিয়েতনামের মতো দেশ প্রথম থেকেই মাস্ক ব্যবহার করে সফলতা পেয়েছে।
এ অবস্থায় করোনার ভয়াল থাবা থেকে বাঁচার জন্য তাবত দুনিয়ার করোনা বিজ্ঞানীরা গবেষণার পর গবেষণা করে যাচ্ছেন। এখন পর্যন্ত বিজ্ঞানীরা এ রোগ সংক্রমণের প্রধান পথ হিসেবে চিহ্নিত করেছেন নাক-মুখ-চোখ-হাত এবং ‘রেস্পিরেটরি পার্টিকেল’ নামক বাহন। এই বাহন সাইজ ও সংক্রমণ সক্ষমতার ওপর ভিত্তি করে দুই রকম। একটি হলো রেস্পিরেটরি ড্রপলেট (৫-১০০০ মাইক্রোমিটার) ও অন্যটি রেস্পিরেটরি নিউক্লিয়াই অথবা অ্যারোসল (১-৫ মাইক্রোমিটার)। করোনার সংক্রমণের জন্য রেস্পিরেটরি ড্রপলেট এবং হাত-ফোমাইটসের মাধ্যম দায়ী শতকরা নিরানব্বই ভাগ আর মাত্র শতকরা এক ভাগ দায়ী রেস্পিরেটরি অ্যারোসল। রেস্পিরেটরি পার্টিকেল তৈরি হয় মানুষের শ্বাস-প্রশ্বাস, কথাবার্তা, গান-বক্তৃতা, হাঁচি-কাশি ইত্যাদি প্রক্রিয়াকালে।
মানুষের হাঁচি-কাশির সময়ে যে রেস্পিরেটরি ড্রপলেট বের হয়, তা বাইরে এসে তিন ভাগ হয়ে যায়। প্রথমাংশ নিজের জামাকাপড়, চেয়ার-টেবিল ইত্যাদিতে পড়ে; দ্বিতীয়াংশ ড্রপলেট হিসেবেই মাটিতে পড়ে এবং সর্বশেষ অংশ ড্রপলেট ভেঙে রেস্পিরেটরি অ্যারোসল হিসেবে বাতাসে ভেসে বেড়ায়। আমেরিকান জার্নাল অব রেস্পিরেটরি অ্যান্ড ক্রিটিক্যাল কেয়ার মেডিসিনে প্রকাশিত এক গবেষণায় কিভাবে রেস্পিরেটরি ড্রপলেট ও নিউক্লিয়াই এর মাধ্যমে মানুষকে আক্রান্ত হয়- এ-সংক্রান্ত গুরুত্বপূর্ণ তথ্য বেরিয়ে এসেছে। তারা বলছেন একটি কাশি ও হাঁচিতে যথাক্রমে তিন হাজার ও ৪০ হাজার রেস্পিরেটরি ড্রপলেট (৫-১০০০ মাইক্রোমিটার) বের হয়ে আসে; যাদের শরীর থেকে বের হওয়ার গতিবেগও যথাক্রমে ঘণ্টায় ৫০ ও ২০০ মাইল। ১০০ ও ১০ মাইক্রোমিটার সাইজের একটি ড্রপলেট যথাক্রমে ১০ ও ২০ সেকেন্ডের মধ্যে মাটিতে পড়ে। একজন সুপার স্প্রেডার একটি জোরালো হাঁচিতে ২০ কোটি ভাইরাস পার্টিকেল ছাড়ে। আবার ১-৫ মাইক্রোমিটার সাইজের রেস্পিরেটরি ড্রপলেট নিউক্লিয়াই হালকা হওয়ায় বাতাসে ঘুরে বেড়ায়।
এক টেবিল বা পাশাপাশি টেবিলে কথা বলতে বলতে যে খাওয়া-দাওয়া বা মুখোমুখি কথাবার্তা হয়, তাতেও এমনকি একজন করোনা রোগী ১০ মিনিটের মধ্যে সবাইকে ইনফেক্ট করতে পারে। এ ব্যাপারে নিয়ম হলো- যত বেশি ভাইরাল লোড, যত অধিক বদ্ধ ঘর এবং যত সময় যত বেশি অন্য ‘কোমর্বিড’ রোগী একসাথে অবস্থান করবে, সে অনুপাতে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকিও তত বাড়তে থাকবে। আর এ অবস্থায় যদি বদ্ধ ঘরে স্পিলিট এসি চালু থাকে, তা হলে একই রুমে অবস্থানকারী সবাই করোনা আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকিতে পড়ে যায়। কারণ স্পিলিট এসি ঘরের বাতাস টেনে নিয়ে ঠাণ্ডা করে আবার ঘরেই ছেড়ে দেয়।
প্রতি মিনিটে একজন করোনা রোগী স্বাভাবিক শ্বাস-প্রশ্বাস ও কথাবার্তা বলার সময় যথাক্রমে ২০-৩০টি ও ২০০-৩০০টি ভাইরাস পার্টিকেল বাতাসে ছাড়ে। আর স্বাভাবিক কথাবার্তা বলার সময় শ্বাস-প্রশ্বাসের চেয়ে ১০ গুণ বেশি ভাইরাস পার্টিকেল ছাড়ে। রেস্পিরেটরি ড্রপলেট দু’ভাবে রোগ ছড়ায়। একটি হলো মাস্কবিহীন সরাসরি সামনা-সামনি অবস্থানে থেকে কথাবার্তা বলাবলি ও হাঁচি-কাশির মাধ্যমে। আরেকটি হলো করোনা রোগীর ব্যবহার্য দ্রব্যাদি ব্যবহার করে। ড্রপলেট ভারী হওয়ায় মাটিতে পড়ে যায় আর অ্যারোসল হালকা হওয়ায় বদ্ধ পরিবেশে ২-৩ ঘণ্টা বাতাসে ভেসে বেড়ায়। সুতরাং দেখা যাচ্ছে, মাস্কবিহীন সামনা-সামনি অবস্থান আর আক্রান্ত রোগীর ফোমাইটস ধারণ, ড্রপলেট, ইনফেকশনের এক নম্বর কারণ। স্পিলিট এসি সংযুক্ত বদ্ধ অফিস, হোটেল-রেস্তোরাঁ আর ঘর-জানালা হচ্ছে করোনা সংক্রমণের বড় কারখানা। বদ্ধ পরিবেশে একজন করোনা রোগী একজন সুস্থ লোকের তিন ফুট দূরত্বের মধ্যে হাঁচি বা কাশি দিলে ২-৩ মিনিটের মধ্যে ১০০০ ভাইরাস দ্বারা আক্রান্ত হতে পারে।
একটি বদ্ধ ঘরে একজন করোনা আক্রান্ত রোগীর হাঁচি-কাশির সাথে সাথেই যদি সুস্থ লোক ঘরে ঢোকে, তারও ৫ মিনিটের মধ্যে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি থাকে। ওই রকম একটি বদ্ধ ঘরে শুধু নরমাল শ্বাস-প্রশ্বাসে প্রতি মিনিটে যে ২০-৩০টি ভাইরাস পার্টিকেল ছাড়ে, তা দিয়ে ঘরে থাকা একজন সুস্থ লোক ৫০ মিনিটে ১০০০ ভাইরাস পার্টিকেল নিজের অজান্তেই নিজের শরীরে ঢুকাবে। এমন পরিবেশে একজন লোক আক্রান্ত হবে কি হবে না, তা নির্ভর করে ব্যক্তির ইমিউন সিস্টেমের অবস্থা, ভাইরাসটির সংক্রমণ ও রোগগ্রস্ত করার ক্ষমতা, হাঁচি-কাশিতে ভাইরাসের পরিমাণ ও শরীরের বাইরে ভাইরাসের অবস্থান সময়, রোগীর সাথে সুস্থ লোকের দূরত্ব ও অবস্থান সময়, পরিবেশ, বয়স, কো-মর্বিডিটি ইত্যাদির ওপর। বিজ্ঞানীদের ভাষ্য হলো, আক্রান্ত হওয়ার জন্য ৫০-১০০০টি ভাইরাস পার্টিকেলই যথেষ্ট।
উপসর্গহীন রোগীরা সামাজিক সংক্রমণে সবচেয়ে অগ্রণী ভূমিকা পালন করে। সামাজিক সংক্রমণের ক্ষেত্রে দেখা গেছে, ৪০ শতাংশ সংক্রমণ ঘটায় উপসর্গহীন করোনা রোগীরা।
এখানে বর্ণিত সব অবস্থায় সরাসরি ও তাৎক্ষণিকভাবে যে ব্যবস্থাটি আমাদেরকে সংক্রমণের হাত থেকে বাঁচাতে পারে, তা হলো মাস্ক ব্যবহার ও স্বাস্থ্যবিধি মানা। এ ক্ষেত্রে টিকার সরাসরি কোনো ভূমিকা নেই। শুধু টিকাপ্রাপ্ত ব্যক্তিরা যাদের শরীরে পর্যাপ্ত অ্যান্টিবডি তৈরি হয়েছে এবং যাদের টিকা গ্রহণের পর অন্তত দুই সপ্তাহ অতিবাহিত হয়েছে, তারাই কমবেশি রক্ষা পাবে। টিকা নেয়ার পর ১৫ দিন অতিবাহিত হয়েছে, কিন্তু ব্যক্তি যেকোনো কারণে ইমিউনো কম্প্রোমাইজড বা বয়স্ক এবং পুরো সমাজে করোনার বিরুদ্ধে হার্ড ইমিউনিটি তৈরি হয়নি- এ রকম একটি অবস্থায় মাস্ক-স্বাস্থ্যবিধি মানা ছাড়া অন্য কোনো উপায়ে সংক্রমণের হাত থেকে রক্ষা পাওয়া সম্ভব নয়।
কাজেই করোনা মহামারীর সংক্রমণ বদ্ধ অফিস-আদালত, ক্লাসরুম, ঘর-করিডোর, জনসমাগম, হোটেল-রেস্তোরাঁ, হাটবাজার আর স্থির বাতাসে হয়; রাস্তাঘাট কিংবা খোলা পরিবেশে নয়।
রোগ ছড়ানোয় হাতের ভূমিকাটা অনেকটা বিয়ের ঘটকের মতো। হাত তার স্পর্শ দ্বারা রোগজীবাণু নিয়ে সুস্থ মানুষ পর্যন্ত পৌঁছাতে দূতিয়ালির ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়। ২০১৬ সালে অস্ট্রেলিয়ার নিউ সাউথ ওয়েলসের একটি সমীক্ষায় বলা হয়, মানুষ প্রতি ঘণ্টায় গড়ে ২৩ বার হাত দিয়ে মুখ স্পর্শ করে থাকে।
করোনার থেকে বাঁচার জন্য এর উৎস তথা করোনা রোগীর দ্রুত রোগ নির্ণয়, আইসোলেশন, চিকিৎসা, রোগীর সংস্পর্শে আসা ব্যক্তিদের কোয়ারেন্টিন, এর বাহক ও সাসেপ্টিবল হোস্টকে রক্ষা করতে সারা পৃথিবী এক হয়ে কাজ করছে। এখন পর্যন্ত করোনা নিয়ন্ত্রণে সবচেয়ে সহজ, সাশ্রয়ী, কার্যকর ও ফলপ্রসূ পন্থা হলো করোনার বাহক রেস্পিরেটরি পার্টিকেলের চ্যানেলটিকে ব্লক করে দেয়া।
এটি বাস্তবায়ন করতে আমরা ব্যক্তিগত, পারিবারিক ও সামাজিক পরিসরে সর্বদা সাবান দিয়ে হাত ধুয়ে পরিষ্কার রাখা, অপরিষ্কার হাতে নাক-মুখ-চোখ স্পর্শ করা থেকে দূরে থাকা, মাস্ক পরিধান, সামাজিক দূরত্ব রক্ষা করে চলা, বদ্ধ পরিবেশ ও লোকসমাগম এড়িয়ে চলা এবং রাষ্ট্রীয় বা বৈশ্বিক পর্যায়ে লকডাউন-শাটডাউন-কারফিউ ইত্যাদি কার্যক্রম পরিচালনা করে থাকি। লকডাউন-শাটডাউন একটি কার্যকর ও ফলপ্রসূ পন্থা হলেও এর বাস্তবায়ন খুবই কঠিন, অর্থনীতি বিনাশকারী, রুটি-রুজি তথা জীবন-জীবিকার ধ্বংসকারী এক বেদনাদায়ক পন্থা। বাস্তব কারণে এবং মানুষ সামাজিক জীব বিধায় একত্রে সবার পুরোপুরি স্বাস্থ্যবিধি মানা সম্ভব নয়। পৃথিবীর কোনো আইন দিয়েও সব মানুষকে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব নয়। এ জন্যই বলা যায়, টিকা আর মাস্ক-স্বাস্থ্যবিধি ‘দুই সহোদর ভাই’। একজনকে ছাড়া আরেকজনের চলে না। এসব বিবেচনায় এখন বিজ্ঞানীরা এ রোগ দমনে দু’টি সহজ কার্যকর টিকা পন্থায় বেশি মনোযোগী হতে চাচ্ছেন।
এই দু’টি টিকা পন্থার একটিকে আমরা বলছি নাক-মুখ ঢেকে ‘মাস্ক’ পরিধান করা ‘টিকা’ এবং অন্যটি ইঞ্জেকশন পুশ করা ‘টিকা’। একটি হলো রোগজীবাণুর শরীরে ঢোকার রাস্তা ব্লক করে দেয়া আর অন্যটি হলো শরীরে ঢোকার পর তাকে মেরে ফেলা। এ দু’টির মধ্যে সবচেয়ে সস্তা কিন্তু অত্যন্ত কার্যকর পন্থা হলো ভাইরাসের ঢোকার রাস্তা বন্ধকল্পে সর্বদা মাস্ক পরিধান করা। সে হিসেবে মাস্ক পরিধানই হলো সবার আগে বাস্তবায়নযোগ্য সবচেয়ে বড় টিকা। তবে মাস্ক পরিধান করলেও অন্যান্য স্বাস্থ্যবিধি ও টিকা প্রক্রিয়ার সাথে সম্পৃক্ত রাখতে হবে।
‘এপিডেমিওলজি বিশেষজ্ঞ’রা বলে থাকেন, করোনার চ্যানেল ব্লক করার তিনটি বড় উপায় আছে। মাস্ক পরিধান করা, সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে সব ধরনের কাজ করা এবং সম্ভাব্য ইনফেক্টেড হাত দিয়ে নাক, মুখ ও চোখ স্পর্শ না করা। রোগজীবাণুর চ্যানেল ব্লকে মাস্ক ব্যবহার তথা স্বাস্থ্যবিধির একক ভূমিকা থাকলেও টিকার সরাসরি কোনো ভূমিকা নেই। শাটডাউন-লকডাউন, মাস্ক পরিধান, স্বাস্থ্যবিধি ইত্যাদির পূর্ণ বাস্তবায়ন করতে মানুষ চাপে পড়ে যায়, অর্থনীতি ধ্বংস হয়ে যায় আর টিকা পন্থায় অনেক টাকা খরচ হয়ে যায়। একটি চীনা গবেষণা প্রতিষ্ঠান বলছে, রোগজীবাণুর চ্যানেল ব্লক পদ্ধতির সঠিক প্রয়োগ ৭৯ শতাংশ ক্ষেত্রে রোগ প্রতিরোধে সক্ষম।
বিশেষ করে উপসর্গহীন, ‘প্রি’-উপসর্গযুক্ত ও অল্প উপসর্গযুক্ত করোনা রোগী অনেকটা গুপ্তঘাতকের মতো। রোগ আছে ঠিকই এবং সুস্থ মানুষের সাথেই উঠাবসা করছেন; কিন্তু আমাদের অজান্তেই রোগ ছড়িয়ে বেড়াচ্ছেন। এ অজানা গুপ্তঘাতকদের হাত থেকে বাঁচতে দরকার সর্বদা মানসম্মত মাস্ক পরিধান করা ও স্বাস্থ্যবিধি মানা জরুরি। কিন্তু টিকা এই উপরিউক্ত তিন ধরনের রোগী হওয়া থেকে বিরত রাখতে পারে না। পক্ষান্তরে, প্রচলিত টিকা উৎপাদন, সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের অনুমতি গ্রহণ ও বাজারজাতকরণ খুবই জটিল ও ব্যয়বহুল একটি প্রক্রিয়া। এই টিকা গ্রহণ করলেও স্বাস্থ্যবিধি মানতে হয়। মাস্কবিহীন টিকা বা টিকাবিহীন মাস্ক কোনোটিই শতভাগ কার্যকর নয়। তাই মাস্ক, টিকা, স্বাস্থ্যবিধি, চিকিৎসা ও আতঙ্ক নয়; বরং সতর্কতা- এসব মিলেই করোনায় সফলতা। মাস্ক পরিধানে ভাইরাস মারা যায় হোস্টের অভাবে। প্রচলিত টিকা গ্রহণে ভাইরাস নিষ্ক্রিয় হয় হোস্টের ভেতরে। মাস্ক পরিধান আর স্বাস্থ্যবিধি করোনা নিয়ন্ত্রণে সুফল স্বল্প মেয়াদে এবং টিকা কার্যক্রমের সুফল দীর্ঘ মেয়াদে। মাস্ক পরিধানে চ্যানেল সম্পূর্ণ ব্লক করা গেলে উপসর্গহীন, উপসর্গযুক্ত প্রভৃতি কোনো ধরনের করোনা আক্রান্তের বালাই নেই। অথচ প্রচলিত টিকা গ্রহণে উপসর্গহীন ও মৃদু উপসর্গযুক্ত রোগবালাইয়ের সম্ভাবনা তো থাকছেই; তদুপরি কোনো টিকারই শতভাগ কার্যকারিতার নিশ্চয়তা নেই। তবে টিকাপ্রাপ্ত ব্যক্তি করোনা আক্রান্ত হলে অন্যকে সংক্রমণ করার ঝুঁকি অনেক কম। লকডাউন-শাটডাউন ছাড়া মাস্ক পরিধান আইন বাস্তবায়ন যত সহজ, টিকা কার্যক্রমের মাধ্যমে হার্ড ইমিউনিটির সমাজ গড়া তত কঠিন। টিকা গ্রহণে চলতি সংক্রমণ ঠেকানো যায় না। টিকার কার্যকারিতা পাওয়া যায় টিকা নেয়ার দুই সপ্তাহ পর। কিন্তু মাস্ক পরিধানের উদ্দেশ্যই হলো চলতি সংক্রমণ ঠেকানো। গবেষণায় নাসারন্ধ্র ও গলবিলে করোনার জীবাণু দেখা গেছে দুই ডোজ টিকা নেয়া মানুষের শরীরে। করোনা প্রতিরোধে টিকার ভূমিকাটা হলো একটি রাষ্ট্রে অনেকটাই যুদ্ধের দামামায় আহ্বান ও উত্তেজনা সৃষ্টিকারী বাদক দলের মতো, যাদের আহ্বানে সেনাবাহিনী যুদ্ধের জন্য প্রস্তুতি গ্রহণ করে অথবা বলা যায় টিকা গাড়ির ড্রাইভিং সিটে বসা ড্রাইভারের কোমরে বাঁধা সিটবেল্টের মতো, যা তাকে দুর্ঘটনা থেকে রক্ষা করতে পারে না বটে; কিন্তু দুর্ঘটনা ঘটে গেলে তাকে কিছুটা হলেও সুরক্ষা দেয়। মাস্ক হলো কাঁটাতারের বেড়া, যা শত্রুকে তার ত্রিসীমানায় ঢুকতে দেয় না। টিকা হলো সারা রাত জেগে থাকা বাড়ির পাহারাদার বা গ্রামের চৌকিদার, যে শত্রু ঢোকার সাথে সাথে সবাইকে জাগিয়ে তুলবে। কোনো টিকার শতভাগ নিশ্চয়তা নেই। বয়স্ক, দুর্বল ও ইমিউনো কম্প্রোমাইজড ব্যক্তিরা টিকা নিলেও ইমিউন সিস্টেম দুর্বল হওয়ায় পর্যাপ্ত অ্যান্টিবডি তৈরি হয় না। ক্যান্সার রোগীর জন্য কোভিড মারাত্মক ঝুঁকিপূর্ণ। যাদের ফুসফুসে ক্যান্সার আছে এবং নিউমোনিয়ায়ও যারা আক্রান্ত, তারা আরো ঝুঁকিপূর্ণ। কেমোথেরাপি ও রেডিওথেরাপি যারা নিচ্ছেন, তাদের রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা এই চিকিৎসাপদ্ধতির কারণেই অনেক কম। লিউকেমিয়া, লিমফোমা, এইচআইভি, মাল্টিপল মায়েলোমা সরাসরি শরীরের রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা সৃষ্টিকারী কোষকেই আক্রমণ করে; ফলে ভাইরাসের বিরুদ্ধে লড়াই করবে কে?
নতুন ভ্যারিয়েন্টের ভাইরাস হলে টিকা নেয়া থাকলেও যে কেউই করোনা আক্রান্ত হয়ে যেতে পারে। আবার গবেষণাতেও দেখা গেছে, টিকাপ্রাপ্ত রোগীরা নিজেরা আক্রান্ত না হলেও তাদের নাসিকায় বা গলবিলে থাকা করোনাভাইরাস থাকলে তার মাধ্যমে অন্যরা আক্রান্ত হতে পারে। এখন এসব ভালনারেবল গ্রুপের সুরক্ষা কোথা থেকে পাবে? তার উত্তরই হলো, মাস্ক পরিধান করা ও স্বাস্থ্যবিধি মানা। হার্ড ইমিউনিটি তৈরি না হওয়া পর্যন্ত এ অবস্থা চলতে থাকতে হবে। করোনাভাইরাসের সব ভ্যারিয়েন্টই মাস্কে আটকা পড়ে। মাস্ক ব্যবহার করা সব ধরনের করোনাভাইরাসের বিরুদ্ধেই সমান কার্যকর। কিন্তু টিকা সব ধরনের ভ্যারিয়েন্টের বিরুদ্ধে সমান কার্যকর নয়। মাস্ক পরিধান তথা স্বাস্থ্যবিধি বায়ুবাহিত সব ভাইরাস-ব্যাকটেরিয়া-ফাংগাল রোগকেই প্রতিহত করে। কিন্তু টিকা শুধু করোনাভাইরাসের বিরুদ্ধেই কার্যকর। যুক্তরাষ্ট্রের ইউনিভার্সিটি অব মিশিগানের প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ডা: প্রীতি মালানি বলেন, “মাস্ক পরা আর সামাজিক দূরত্বের দিন শিগগিরই শেষ হচ্ছে না। যত দিন না ‘হার্ড ইমিউনিটি’ তৈরি হচ্ছে, তত দিন স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার কোনো বিকল্প নেই।” কুইন্স ইউনিভার্সিটি অব বেলফাস্টের ওয়েলকাম-উল্ফসন ইনস্টিটিউট ফর এক্সপেরিমেন্টাল মেডিসিনের ড. কনর বামফোর্ড বলেন, সাধারণ স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলেই ছোঁয়াচে ভাইরাসের সংক্রমণ থেকে কার্যকরভাবে সুরক্ষা পাওয়া সম্ভব।
বিশেষজ্ঞদের মতে, মাস্ক পরলে, কিছু সময় পরপর সাবান পানিতে হাত ধুয়ে নিলে আর জনসমাগম যথাসম্ভব এড়িয়ে চললে করোনা সংক্রমণ ৯০-৯৫ শতাংশ নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব। পাবলিক হেলথ ইংল্যান্ডের ড. জেক ডানিং বলেন, সত্যিই যদি উদ্বিগ্ন হয় মানুষ, তারা ব্যক্তিগত ও হাতের পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতার দিকে নজর দিলে আরো ভালো করবে। বর্তমানে করোনা প্রতিরোধে অনেকে সচেতন হয়ে যে সার্জিক্যাল মাস্ক ব্যবহার করছেন, এটি খুবই সহজলভ্য, সস্তা অথচ রোগপ্রতিরোধে অত্যন্ত কার্যকর। এই অসাধারণ মাস্কের উদ্ভাবক ছিলেন একজন ফরাসি সার্জন ডা: পল বার্জার (১৮৪৫-১৯০৮)। তিনি ছিলেন সেই সময়কার প্যারিসের একজন দক্ষ সার্জন ও অধ্যাপক।
তিনি প্রতিটি অপারেশনের আগে অবশ্যই একটি জীবাণুমুক্ত পরিবেশ রক্ষার চেষ্টা করতেন, কিন্তু অপারেশন থিয়েটারে মাস্ক পরার প্রচলন তখনো শুরু হয়নি। ফলে কিছু রোগীর খুব মামুলি অপারেশনেই ইনফেকশন হয়ে যেত। সে সময়ের আর একজন ফরাসি প্যাথলজিস্ট কার্ল ফ্লাজে আবিষ্কার করেন যে, মানুষের লালায় জীবাণু থাকে এবং সেখান থেকেও জীবাণু ছড়াতে পারে। ডা: বার্জার লক্ষ করেন, সার্জারি করার সময় তার মুখ থেকে অনেক ড্রপলেট রোগীর শরীরে যাচ্ছে কিংবা আশপাশে ছড়াচ্ছে। তখন তার মনে হলো তা হলে এটিই তার রোগীদের অপারেশন- পরবর্তী ইনফেকশনের মূল কারণ।
এরপর ১৮৯৭ সালের অক্টোবরে ডা: বার্জার বানিয়ে ফেললেন ‘গজ’ দিয়ে ছয় স্তরের আয়তাকার একটি কাপড়ের টুকরোর মাস্ক। তার দাড়িকে যাতে আরো ভালো করে ঢেকে রাখে এবং নাকের অংশে কাপড়টা যাতে আটকে থাকে, সে জন্য ফিতা দিয়ে পেছনে তা বাঁধা থাকত। এটিই ছিল দুনিয়ার প্রথম সার্জিক্যাল মাস্ক। নিজের এ উদ্ভাবনকে তিনি টানা পনেরো মাস ব্যবহার করেন প্রতিটি অপারেশনে। এতে খেয়াল করলেন, ইনফেকশন হওয়ার হার আগের চেয়ে বেশ কমেছে; যদিও অনেক ডাক্তার প্রথমে নারাজ ছিলেন মাস্ক পরতে।
* ১৮৯৯ সালে যক্ষ্মা প্রতিরোধে মাস্ক ব্যবহারের প্রসঙ্গ আসে। ১৯০৫ সালে বিজ্ঞানী হ্যামিলটন জানান, স্টোপ্টোকক্কাস জীবাণু ছড়িয়ে পড়ে অদৃশ্য থুতু তথা ড্রপলেটের মাধ্যমে। তিনি বললেন, ‘স্কারলেট ফিভার’ও ছড়ায় ড্রপলেট দিয়ে। * ১৯১৮ সালে চিকিৎসক ওয়েভার জানান, ডিপথেরিয়া ঠেকাতে মাস্কের বিকল্প নেই এবং হাত না ধুয়ে নাকে-মুখে হাত দেয়া যাবে না।
‘স্প্যানিশ ফ্লু’য়ের বছরে মাস্ক হয়ে গেল সর্বজনীন। কারণ তত দিনে ফ্লু ঠেকাতে তার অপরিহার্যতার কথা মানুষ জেনে গিয়েছিল। কিন্তু তখনো পর্যন্ত প্রতিষেধক হিসেবে কোনো টিকা আবিষ্কার না হওয়ায় ন্যাচারাল ইনফেকশন, ন্যাচারাল ইনফেকশনে উপসর্গযুক্ত রোগীর সাধ্যমতো সিম্পটোম্যাটিক চিকিৎসা, স্বাস্থ্যবিধি মানা ও মাস্ক পরিধান- এ কয়েকটি পন্থাতেই মহামারী মহাঘাতক ইনফ্লুয়েঞ্জাকে প্রতিরোধের প্রয়াস চালিয়েছিল। ১৯৪০ সালে ইনফ্লুয়েঞ্জা টিকা আবিষ্কারের আগ পর্যন্ত এভাবেই চলছিল। * ২০১৩ সালে গবেষকরা প্রমাণ করেছেন, ফ্লুয়ের রোগী এবং তার কাছে যারা থাকেন, তারা সবাই যদি মাস্ক পরেন রোগ ছড়ানোর আশঙ্কা ৬০-৮০ শতাংশ কমে যায়। জানা গেল, জ্বর-হাঁচি-কাশি হলে বা স্রেফ হাঁচি-সর্দি হলেও রোগীর চার পাশে এমনিই ভাইরাসের বাতাবরণ থাকে, তা কাশি হোক বা না হোক। তাই হাঁচি-কাশি বা কথা বলার মাধ্যমে ছড়ায় যত রোগ, তা যক্ষ্মা হোক কিংবা সাধারণ সর্দি-কাশি, করোনা হোক- সবার ‘উত্তর’ লেখা আছে মাস্কের মধ্যেই। মাস্ক ঠেকায় পরিবেশ দূষণের ক্ষতি। বাঁচায় পোলেন অ্যালার্জি, ডাস্ট অ্যালার্জি, পরোক্ষ ধূমপানজনিত ক্ষতির হাত থেকে। * মাস্ক বায়ুবাহিত অন্য মহামারী রোগ থেকেও সুরক্ষা দেয়।
একমাত্র মাস্ক পুরোপুরি সুরক্ষা কখনই দেবে না। ১৯১৮-১৯ সালের ইনফ্লুয়েঞ্জা মহামারীতে একটি স্লোগান সারা পৃথিবীতে জনপ্রিয় করে তোলা হয়েছিল আর তা হলো ‘হাঁচি-কাশি আর অধিক কথন, রোগ ছড়াবে যখন-তখন’। আমরা এমনি একটি প্যান্ডেমিক পার করছি। * ইউএস সেন্টার ফর ডিজিজ কন্ট্রোল অ্যান্ড প্রিভেনশনের তরফে জানানো হয়েছে, ঘরে বানানো সাধারণ থ্রি লেয়ার মাস্ক পরলেই বিপদের আশঙ্কা অনেক কমে যায়। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নির্দেশ মোতাবেক, মাস্ক হবে ত্রিস্তরীয়, যার বাইরের স্তর গাঢ় নীল বা সবুজ, যা পলিয়েস্টার জাতীয় উপাদানে তৈরি এবং যা তরল বিকর্ষক; মাঝের স্তরে থাকবে বুননহীন পলিপ্রপিলিন জাতীয় উপাদান এবং ভেতরের স্তরে সাদা সুতি, যা শোষক হিসেবে কাজ করে। ত্রিস্তরীয় ডিসপোজেবল সার্জিক্যাল মাস্কেও এতই সুরক্ষা। সিঙ্গল লেয়ার সার্জিক্যাল মাস্ক দু’টি করে পরলে প্রায় ৯০ শতাংশ সুরক্ষা হয়। কাপড়ের মাস্কের সুবিধা হলো বাড়ি এসে ভালো করে সাবান দিয়ে ধুয়ে রোদে শুকিয়ে আবার তিন দিন পর ব্যবহার করা যায়।
* রাস্তায় বের হলে, বাজারে-অফিসে, রেস্তোরাঁয়-হোটেলে, যেকোনো লোকসমাগমে, লিফটে উঠলে, ট্রেনে, বাসে, প্লেনে, যেকোনো লাইনে দাঁড়িয়ে, বাইরের লোকজন ঘরে এলে, ঘরের ভেতর করোনা রোগী হলে অবশ্যই মাস্ক পরবেন খুশি মনে। * ফাঁকা রাস্তায়, খোলা মাঠে-প্রান্তরে, নদী-সমুদ্রে, পাহাড়ে-বনে-জঙ্গলে, একাকী শীতল ছায়াতলে, করোনা রোগীবিহীন ঘরে এবং শরীরচর্চা-খেলাধুলার সময়কালে মাস্ক পরার দরকার নেই। * ক্রনিক অবস্ট্রাক্টিভ পালমোনারি ডিজিজ বা সিওপিডি বা হাঁপানির মতো ক্রনিক ফুসফুস রোগে ও হার্টের অসুখে মাস্ক পরবেন চিকিৎসকের পরামর্শে। * ডাবল সার্জিক্যাল মাস্ক ব্যবহার কোভিডের সংক্রমণ ৯৬ দশমিক ৪ শতাংশ রুখে দিতে পারে। সার্জিক্যাল মাস্ক অন্যকে রেস্পিরেটরি ড্রপলেট ও অ্যারোসল সংক্রমণ থেকে বাঁচায়, কিন্তু নিজেকে রেস্পিরেটরি অ্যারোসল মেডিয়েটেড ইনফেকশন থেকে রক্ষা করতে পারে না। এ ক্ষেত্রে এন ৯৫ মাস্ক অত্যন্ত কার্যকর।
* মাস্ক পরার আগে সাবান-পানিতে হাত ভালো করে ধুয়ে মুছে নিন। * এমনভাবে চেপে পরুন যে, নাক ও মুখ আঁটসাঁটভাবে মাস্কের মধ্যে থাকে। * মাস্কের উল্টো পিঠ ব্যবহার করা যাবে না। * অন্যের ব্যবহৃত মাস্ক পরা যাবে না। * মাস্কের সামনে হাত দেবেন না। কথা বলার সময় নামিয়ে দেবেন না। কোনো কারণে হাত দিতে গেলে আগে হাত ধুয়ে নেবেন। * ডিসপোজেবল মাস্ক একবারের বেশি ব্যবহার করবেন না। * মাস্ক খোলার সময় প্রথমে পেছনের ফিতে খুলবেন। নাক-মুখের অংশে হাত দেবেন না। ডিজপোজেবল হলে খুলে ঢাকনা দেয়া বিনে ফেলে হাত ধুয়ে শুকিয়ে নিন। মাস্ক পরবেন যথা নিয়মে, খুলবেন যথা নিয়মে এবং ফেলবেনও যথা নিয়মে। মাস্ক পরা, খোলা বা ধরার আগে ও পরে অবশ্যই সাবান দিয়ে কমপক্ষে ২০ সেকেন্ড হাত ধুতে হবে।
মাস্ক পরে বাইরে বের হলে ফাঁকা রাস্তায় পড়ে থাকলেও অন্য ব্যক্তির সাথে ও মোবাইলে কথা বলার সময়, হাঁচি-কাশির সময় হরহামেশাই মাস্কটা খুলে ফেলা হয় বা নাক-মুখের নিচে নামিয়ে ফেলা হয়। এটি বোকামি ছাড়া কিছু নয়। সময় সময়ে এটি থুতনিতে রাখার জিনিস নয়। কোনো অবস্থায়ই নাক খোলা রাখা যাবে না।
সম্প্রতি চার ধরনের মাস্কের ওপর এক সমীক্ষা চালানো হয়। এন ৯৫ মাস্ক, ত্রিস্তরীয় ডিসপোজিবল সার্জিক্যাল মাস্ক, দ্বিস্তরীয় কটন-পলিয়েস্টার মাস্ক ও মোটা সুতির মাস্কের কার্যকারিতা পরীক্ষা করা ছিল এ সমীক্ষার উদ্দেশ্য। সমীক্ষায় দেখা গেছে, চার ধরনের মাস্কেই আর্দ্রতার পরিমাণ বাড়ে। তবে আর্দ্রতা সবচেয়ে বেশি মেলে মোটা সুতির মাস্কে। আমরা জানি, শ্বাস নেয়ার সময় বাতাস আমাদের ফুসফুসে প্রবেশ করে। আর মাস্ক এ বাতাস পরিশোধনে সাহায্য করে থাকে। শ্বাস নেয়ার সময় যে বাতাস ফুসফুসে যায়, এতে আর্দ্রতা বাড়িয়ে তোলে মাস্ক। এতেই হয় উপকার। আর্দ্রতার পরিমাণ বেশি হলে ফুসফুসে ভাইরাসের বিস্তারও বাধাপ্রাপ্ত হয়। চিকিৎসার পরিভাষায় এর নাম ‘মিইকোসিলিয়ারি ক্লিয়ারেন্স’।
‘বায়োফিজিক্যাল জার্নাল’-এ প্রকাশিত এ সমীক্ষা জানায়, শ্বাসনালীর হাইড্রেশন প্রক্রিয়া শরীরে রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করতে বিশেষ ভূমিকা নিয়ে থাকে এবং ওই হাইড্রেশন প্রক্রিয়ায় সহায়তা করে থাকে আর্দ্রতাযুক্ত শ্বাস। যে বাতাস যত বেশি আর্দ্র, এর হাইড্রেশন প্রক্রিয়ার পাশে থাকার ক্ষমতা তত বেশি; অর্থাৎ যাদের ফুসফুসে আর্দ্রতাযুক্ত বাতাস যত বেশি প্রবেশ করবে, তাদের কোভিডে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা তত কমবে। একই সাথে কমবে অন্যান্য সংক্রমণের আশঙ্কাও।
দ্য প্রসিডিংস অব ন্যাশনাল একাডেমি অব সায়েন্সেজে প্রকাশিত আরেক গবেষণা প্রতিবেদনে বিজ্ঞানীরা জানান, মহামারীর বিস্তার রোধে কোনো কোনো সময় শারীরিক দূরত্ব বজায় রাখা এবং বাসায় থাকার চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দাঁড়ায় মাস্ক। উত্তর ইতালি ও যুক্তরাষ্ট্রের নিউ ইয়র্ক শহরে মাস্ক পরার নিয়ম জারির পর ওই সময় বিশ্বের সবচেয়ে বেশি করোনা আক্রান্ত এ দুই এলাকায় সংক্রমণের প্রবণতা নাটকীয়ভাবে বদলে যায়।
নিউ ইয়র্কে বাধ্যতামূলক মাস্ক পরার নিয়ম কার্যকর হওয়ার পর নতুন সংক্রমণের হার প্রতিদিন ৩ শতাংশ হারে কমতে থাকে। মনে রাখা প্রয়োজন, করোনা নিয়ন্ত্রণে এলেও বায়ুদূষণের চাপ সহজে কমবে না। তাই মাস্ক ছাড়া চলবে না। মাস্ককে লজ্জা নিবারণের অংশ নয়, বরং ‘পোশাকের অংশ’ মনে করতে হবে। পরিশেষে যুক্তরাষ্ট্রের ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক মুশফিক মোবারকের নেতৃত্বে বাংলাদেশে পরিচালিত মাস্ক ও স্বাস্থ্যবিধিসংক্রান্ত এক মাঠপর্যায়ের গবেষণায় উঠে আসা ফলাফল, যা দৈনিক প্রথম আলোতে ১১ জুন, ২০২১-তে প্রকাশ পেয়েছিল; তার সার নির্জাস দিয়ে লেখাটি শেষ করতে চাই। লকডাউনে ক্ষতির চেয়ে মাস্ক ব্যবহার নিশ্চিত করতে ব্যয় হয় ১৮ ভাগের ১ ভাগ। সার্জিক্যাল মাস্কের কার্যকারিতা ৯৫ শতাংশ এবং কাপড়ের মাস্কের ৪০ শতাংশ পর্যন্ত। টিকা সবচেয়ে কার্যকর ও দীর্ঘমেয়াদি সমাধান। কিন্তু সবাইকে টিকার আওতায় আনা সময়সাপেক্ষ বিষয়। সামাজিকভাবে মাস্ক পরাসহ স্বাস্থ্যবিধি নিশ্চিত করতে পারলে লকডাউন-শাটডাউনের প্রয়োজন নেই। এতে জীবন ও জীবিকা উভয়ই রক্ষা পায়।
লেখক : সহযোগী অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান, ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব কিডনি ডিজিজেস অ্যান্ড ইউরোলজি, শের-ই-বাংলা নগর, ঢাকা।


আরো সংবাদ



premium cement