২০ এপ্রিল ২০২৪, ০৭ বৈশাখ ১৪৩১, ১০ শাওয়াল ১৪৪৫
`

টোকিওতে অলিম্পিক বিশ্ব ক্রীড়া ও বাংলাদেশ

-

অলিম্পিক ক্রীড়া অনুষ্ঠান বিশ্বের সব দেশের মানুষের জন্য এক আকর্ষণীয় অনুষ্ঠান। বিশ্বের সব মানুষের মধ্যে, বিভিন্ন দেশের মধ্যে নানা বিষয়ে মতপার্থক্য আছে। মতপার্থক্য থাকা স্বাভাবিক। কোনো দেশ সমাজতান্ত্রিক, কোনো দেশ গণতান্ত্রিক, কোনো দেশ ইসলামপন্থী, কোনো দেশ স্বৈরতন্ত্রপন্থী। কিন্তু বিশ্বের সব মানুষ ও রাষ্ট্রের একটি বিষয়ে মতপার্থক্য নেই; সেটি হচ্ছে অলিম্পিক আসর। বিভিন্ন দেশ পছন্দ অনুযায়ী নিজ নিজ দেশে ক্রীড়া অনুষ্ঠান করে। সেই আলোকে ক্রীড়ামান উন্নয়নের প্রচেষ্টা চালায় যাতে করে গ্রেটেস্ট শো অন আর্থ অলিম্পিক ক্রীড়ায় অংশগ্রহণ করে ট্রফি জিতে দেশের সম্মান, মর্যাদা অন্যান্য দেশের সামনে তুলে ধরতে পারে।
নানা বাধাবিপত্তি ভয়াল করোনা উপেক্ষা করে ২০২০ সালের অলিম্পিক ২০২১ সালের ২৩ জুলাই শুরু হয় জাপানের রাজধানী টোকিওতে। অলিম্পিক আসরের স্থান নির্বাচনে জাপান ক্রীড়া অনুষ্ঠানের অনুমতি লাভ করে তুরস্ক ও স্পেনকে ভোটে পরাজিত করে। জাপানের ঐতিহ্য, বিশ্ব দরবারে আগের প্রবল শক্তি সামর্থ্য, সামরিক শক্তি বর্তমান অর্থনৈতিক শক্তি এসব নিশ্চয় ভোটারের ওপর প্রভাব ফেলেছিল টোকিওকে স্থান নির্বাচনের জন্য। অন্যান্য দেশ যারা অলিম্পিক স্থান নির্বাচনে নিজ দেশের জন্য প্রচার চালায় তাদের থেকে জাপানের ঐতিহ্য, শক্তি সামর্থ্য, অর্থনৈতিক, অতীতে এবং বর্তমানেও সামরিক শক্তিতে বহুলাংশে জাপান অগ্রগণ্য। এসব বিবেচনায় পৃথিবীর গ্রেটেস্ট শো অন আর্থ, সূর্যোদয়ের দেশ জাপানের রাজধানী টোকিওকে বেছে নেয়া। প্রতি চার বছর অন্তর এ অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়।
এ অনুষ্ঠানের প্রথম প্রবর্তন হয় গ্রিসে গ্রিক দেবতা জিউসের সম্মানার্থে। প্রথম অনুষ্ঠান শুরু হয় তৎকালীন গ্রিসের পিলোপনিসাসের অলিম্পাসে। তৎকালীন এ অনুষ্ঠানে হর্স রেস, বক্সিং, ফুট রেস, চ্যারিয়ট রেস, সাহিত্য, নাটক, গান, হাস্যরস প্রভৃতি বিষয় প্রতিযোগিতা হতো। অনুষ্ঠানগুলো অনেক সময় সাময়িক বিরতি দিয়ে অনুষ্ঠিত হতো, যা আবার শুরু হয় খ্রিষ্টপূর্ব ৭৭৬ সাল হতে ৩৯৪ এডি পর্যন্ত যা ১৮৯৬ সালে এথেন্সে পুনরায় শুরু হয়। বর্তমানে জাপানে যে অলিম্পিক ক্রীড়া অনুষ্ঠান এই জাপান ১৮৫৩ সাল পর্যন্ত একটি সামন্তবাদী, সামরিকতন্ত্রী এবং বিভিন্ন গোত্রে বিভক্ত ছিল। ধর্মীয় দিক থেকে জাপানিরা প্রধানত বৌদ্ধ ও শিন্টো সম্প্রদায়ভুক্ত। ১৮৫৩ সালে যুক্তরাষ্ট্রের নৌবাহিনীর কমান্ডার কমোডর পেরি চারটি যুদ্ধজাহাজ নিয়ে জাপানের ইয়োদা উপকূলে উপস্থিত হন। মার্কিন বাণিজ্যিক জাহাজ জাপানি বন্দরে প্রবেশের অনুমতি প্রার্থনা করে বাণিজ্যের জন্য। কমোডর পেরি পশ্চিম দেশীয় টেলিগ্রাম ও রেলওয়ের মডেল দেখান যা জাপান নিজ দেশে করতে পারে তাদের সহযোগিতায় এবং এ মর্মে জাপানের সম্রাটের কাছে জাপানি বন্দরে প্রবেশের অনুমতি প্রার্থনা জানিয়ে পত্র লেখেন। পরবর্তীকালে কমোডর পেরি আটটি যুদ্ধ জাহাজ নিয়ে জাপানে হাজির হয়ে পুনরায় আবেদন জানান। আবেদন বিবেচনাকালে আলোচকদের একাংশ অভিমত ব্যক্ত করে বন্দরে প্রবেশের অনুমতি দিলে তাতে জাপানের স্বাধীনতা হুমকির সম্মুখীন হবে। আলোকচকদের অপর অংশ প্রকাশ করে বন্দরের সুযোগ-সুবিধা দিয়ে তাহাদের সহায়তায় জাপানে বড় বড় শিল্প কারখানা নির্মাণ করা সম্ভব হবে।
আলোচকদের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী যুক্তরাষ্ট্রকে জাপানি বন্দর ব্যবহারের সুযোগ দেয়া হয়। পরে ব্রিটেন, জার্মানি, ফ্রান্স, ইটালি নানা প্রকার অছিলায় জাপানি বন্দরে প্রবেশের অধিকার লাভ করে। এ সুযোগ দেয়ার পরিবর্তে জাপান ওইসব দেশের উন্নয়নের কারণ উপলব্ধি করে নিজেদের উন্নত করতে দেশটির বহু লোককে ওইসব দেশে পাঠায় তাদের শিল্পকারখানা পরিদর্শনে। এর ফলে জাপান উন্নত শিল্প কারখানা স্থাপন করতে পারে। এ ছাড়া ওইসব দেশের প্রকৌশলীদের জাপানে আমন্ত্রণ জানানো হয় যাতে বড় শিল্প কারখানা নির্মাণে সহায়তা করতে পারেন।
১৮৭০ সাল থেকে ১৯০১ সাল পর্যন্ত জাপানের ৭৪টি প্রতিনিধিদল ব্রিটেন, জার্মানি, ফ্রান্স, ইটালি, যুক্তরাষ্ট্র শিক্ষা সফরে যায়। প্রতিনিধিদলের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত থাকে উচ্চপদস্থ শিল্পপতি, ব্যবসায়ী, সামরিক, বেসামরিক ব্যক্তি । ওইসব দেশের বিভিন্ন শাখার বিশেষজ্ঞদের জাপানে আমন্ত্রণ জানানো হয় বড় বড় শিল্পপ্রতিষ্ঠান নির্মাণে সহায়তা করতে। সুসম্পর্ক গড়ে তোলা হলেও সাধারণ জাপানিরা ওইসব দেশের লোকদের ‘শ্বেত সাম্রাজ্যবাদী’ ‘বর্বর’ হিসেবে আখ্যায়িত করত। জাপানিদের অসীম অধ্যবসায় ও বিদেশীদের সাহায্যে দেশটি বড় বড় আধুনিক শিল্পকারখানা গড়ে তোলে। শিল্পকারখানা গড়ার ফলে উৎপাদিত পণ্য বিভিন্ন দেশে রফতানির জন্য জাপান বাজার দখলে উৎসাহিত হয়। এই অভিলাসে ১৮৭৬ সালে জাপান কোরিয়ার (বর্তমান দুই কোরিয়া একত্রে) বিরুদ্ধে নৌবাহিনী পাঠায়। কোরিয়া দুর্বল রাষ্ট্র হিসেবে বিরোধিতা করতে না পেরে এক অসম চুক্তি করে কোরিয়ার পুশান, গেনসান ও চেমুলপে বন্দরগুলো জাপানিদের ব্যবসা করতে উন্মুক্ত করে দেয়া হয়। আর কোরিয়ায় উপস্থিত জাপানি নাগরিকদের ‘এক্সট্রা টেরিটরিয়াল’ নাগরিকত্ব সুবিধা দেয়া হয়। পার্শ্ববর্তী দেশ চীনের বাজার দখলে জাপান যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়। ফলে ১৮৯৫ সালে চীন-জাপান যুদ্ধ শুরু হয়। যুদ্ধে জাপান জয়লাভ করে। ১৮৯৫ সালের ১৭ এপ্রিল ‘শিমোনা সাকাই শান্তি’ চুক্তি স্বাক্ষর হয়। চুক্তি অনুযায়ী কোরিয়াকে জাপানের প্রভাবাধীন রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকার করা হয়। কোরিয়াকে স্বাধীন রাষ্ট্র ঘোষণা করা হয়। চীনের ফরমোজা (বর্তমান তাইওয়ান) দ্বীপ, পেসকাডোবস দ্বীপ, লিয়াওটং পেনিনসুলারের কিয়দংশ জাপানের কর্তৃত্বে ছেড়ে দেয়া হয়। জাপানকে ২৫ কোটি ১১ লাখ ৬০ হাজার ২৫৬ পাউন্ড ক্ষতিপূরণ দিতে বলা হয়। একই সাথে চীনের চারটি বন্দর জাপানকে উন্মুক্ত করে দেয়া হয় জাপানিদের ব্যবসা বাণিজ্যের জন্য। পরে ১৯১০ সালের ২২ আগস্ট কোরিয়াকে জাপানের সাম্রাজ্যভুক্ত করা হয়। ১৯৩১ সালে মাঞ্চুরিয়া জাপানের অধিকারে এলেও ব্রিটিশ ও ফরাসি সাম্রাজ্যবাদীদের মতো অত্যাচারের স্টিমরোলার চালানো হয়নি। বরং জাপানিদের অধিকারে আগের শাসনব্যবস্থা, মন্ত্রিপরিষদ, বিচারব্যবস্থা বহাল রাখা হয়। এশীয় দেশগুলোর সর্বপ্রথম দেশ জাপান বৃহৎ উন্নত ইউরোপীয় দেশ রাশিয়ার সাথে নৌ ও স্থলযুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে। ১০ মার্চ ১৯০৫ সালে মুকদেনের স্থলযুদ্ধে রাশিয়া এবং পোর্ট আর্থারের নৌযুদ্ধে রাশিয়া পরাজিত হয়। রাশিয়ার এ পরাজয়কে ঐতিহাসিকরা পৃথিবীর সমকালীন যুগের উল্লেখযোগ্য ঘটনা হিসেবে উল্লেখ করেছেন।
যে ইউরোপ এশিয়ার বহু দেশকে পরাজিত করে এশিয়াবাসীকে কলঙ্কিত করেছে জাপানিদের এ বিজয় এশিয়াবাসীর জন্য একটি গর্বের ঘটনা। এ যুদ্ধে রাশিয়ার তুলনায় কমসংখ্যক সৈন্য ও নৌবাহিনী থাকা সত্ত্বেও জাপান সেনা ও নৌবাহিনী দক্ষতা ও সাহস দিয়ে জয়লাভ করে। ‘পোর্টসমাউথ শান্তি চুক্তির’ মাধ্যমে জাপান রাশিয়ার যুদ্ধের অবসান হয়। চুক্তির মাধ্যমে রাশিয়াকে পোর্ট আর্থার, রাশিয়ার দক্ষিণ রেলওয়ে, শাখালিখান দ্বীপের দক্ষিণাংশ জাপানের কাছে ছেড়ে দিতে হয়। এ যুদ্ধের ফলে ব্রিটেন, জার্মানি, ফ্রান্স প্রভৃতি দেশ থেকে জাপান উন্নত জাতি তা পৃথিবীবাসীর কাছে প্রতীয়মান হয়।
আজকের বিশ্বের অনেকে অন্যতম বৃহৎ শক্তিশালী দেশ যুক্তরাষ্ট্রের হুমকিতে তটস্থ। সেই যুক্তরাষ্ট্রকে এশিয়া মহাদেশের জাপান পার্লহার্বার নৌঘাঁটিতে আক্রমণ করে মার্কিন নৌবাহিনীর প্রভূত ক্ষতি করে। আজো অন্য কোনো দেশ যুক্তরাষ্ট্রে হামলা করতে সাহস করেনি। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ চলাকালীন ব্রিটিশ, ফরাসিদের পরাজিত করে ফিলিপাইন, ভিয়েতনাম, কম্বোডিয়া, মালয়, ইন্দোনেশিয়া, বার্মা, ভারতের আসামের কিয়দংশ, আন্দামান নিকোবর দখল করেছিল জাপান। এ কথা সত্য, যুদ্ধের শেষ পর্যায়ে আমেরিকার অ্যাটম বোমার আঘাতে জাপানের পরাজয় নিশ্চিত হয়। পরাজয় হলেও জাপানের ঐতিহাসিক সামরিক বিজয়গুলোতে জাপান তথা এশিয়ার বহু মানুষ গর্বিত। এ গর্বিত জাতির রাজধানী টোকিওতে অলিম্পিক আসর অনুষ্ঠিত হওয়া সানন্দ্যে সমর্থনযোগ্য।
বর্তমান অলিম্পিক অনুষ্ঠানের পর আগামীতে দক্ষিণ এশিয়ায় আয়োজনের দাবি করা যেতে পারে। বাংলাদেশ ও ভারত এই দাবি করতে পারে। কিন্তু ভারতে যে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা, মসজিদ ভেঙে গুঁড়িয়ে দেয়া এবং হামলাকারীদের সাজা না দিয়ে বেকসুর খালাস দেয়া, গরু নিয়ে হেঁটে যেতে লাগলে বহনকারীকে দলবদ্ধ হয়ে পিটিয়ে হত্যা, ফ্রিজে গরুর গোশত আছে সন্দেহে সঙ্ঘবদ্ধ হয়ে মুসলমান মালিককে পিটিয়ে হত্যা, কাশ্মিরে গণভোটের জাতিসঙ্ঘের সিদ্ধান্ত মানার প্রতিশ্রুতি দিয়ে তা ভঙ্গ করা প্রভৃতি বেআইনি ও মানবতাবিরোধী কার্যকলাপের জন্য অলিম্পিক আসর আয়োজনে ভারতকে বেছে নেয়া হবে বলে মনে হয় না। পক্ষান্তরে বাংলাদেশে বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মধ্যে যে ভ্রাতৃত্ববোধ বিরাজমান বিশ্ব ক্রীড়া জগতের সর্বোচ্চ সম্মান অলিম্পিক লরেল ও নোবেল জয়ে ভূষিত দেশের গর্ব ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সহযোগিতায় বাংলাদেশে অলিম্পিক ক্রীড়া অনুষ্ঠান হওয়া সম্ভব। যদি সরকার ক্রীড়া অনুষ্ঠানের প্রয়োজনীয় অবকাঠামো নির্মাণে সম্মত হয়। হ
লেখক : আইনজীবী ও ভাষা সৈনিক


আরো সংবাদ



premium cement
ফিলিপাইনে ব্রহ্মস পাঠাল ভারত, ৩৭৫ মিলিয়ন ডলারের চুক্তি চীনের মোকাবেলায় নতুন ডিভিশন ভারতীয় সেনাবাহিনীতে! আবারো চেন্নাইয়ের হার, ম্লান মোস্তাফিজ 'কেএনএফ' সন্ত্রাস : সার্বভৌম নিরাপত্তা সতর্কতা অর্থনীতিতে চুরি : ব্যাংকে ডাকাতি পাকিস্তানে আফগান তালেবান আলেম নিহত যুক্তরাষ্ট্রের সাহায্য না করলে এ বছরই রাশিয়ার কাছে হারতে পারে ইউক্রেন : সিআইএ প্রধান রাশিয়ার সামরিক শিল্পক্ষেত্রে প্রধান যোগানদার চীন : ব্লিংকন ইরাকে সামরিক ঘাঁটিতে 'বিকট বিস্ফোরণ' শেখ হাসিনা সব প্রতিবন্ধকতা উপড়ে ফেলে দেশকে এগিয়ে নিয়ে চলেছেন: পররাষ্ট্রমন্ত্রী গাজায় ইসরাইলি গণহত্যা বন্ধে বিশ্ববাসীকে সোচ্চার

সকল