২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫
`

থ্যাংক ইউ মি. বোজকির

-

দীর্ঘদিন পর প্রেসিডেন্ট ভবনে যেতে হলো। জাতিসঙ্ঘের সাধারণ পরিষদের প্রেসিডেন্ট ভলকান বোজকিরের সম্মানে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ড. আরেফ আলাভীর পক্ষ থেকে নৈশভোজের আয়োজন করা হয়েছিল। ওই নৈশভোজের আগে সম্মানিত মেহমানকে হিলাল-ই-পাকিস্তান প্রদানের অনুষ্ঠানেরও আয়োজন করা হলো। বোজকিরকে শুধু কাছ থেকে একনজর দেখা ও তাকে শ্রদ্ধা নিবেদনের আশা পোষণ করেছিলাম। পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট যখন সাধারণ পরিষদের প্রেসিডেন্টকে হিলাল-ই-পাকিস্তান প্রদান করলেন, তখন পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠাতা কায়েদে আজম মুহাম্মাদ আলী জিন্নাহর ব্যাপারে চিন্তা করছিলাম। ভলকান বোজকির তার সাম্প্রতিক ইসলামাবাদের সফরের সময় ফিলিস্তিন ও কাশ্মির সমস্যাকে ‘একই চিত্রের দু’টি রূপ’ অভিহিত করেছেন। তিনি বলেছেন, ‘কাশ্মির সমস্যায় উভয় পক্ষই জাতিসঙ্ঘের নিরাপত্তা পরিষদের প্রস্তাবাবলির আলোকে জম্মু-কাশ্মিরের মর্যাদা পরিবর্তন থেকে বিরত থাকা উচিত। আর এ সমস্যার শান্তিপূর্ণভাবে সমাধানের প্রতি মনোযোগ দেয়া উচিত।’ তার এই বক্তব্যে ভারতে হইচই শুরু হয়ে গেছে। ভারত সরকার বোজকিরের বক্তব্যের নিন্দা জানিয়েছে। তার এ বক্তব্য কায়েদে আজমের চিন্তাধারার অনুরূপ ছিল।
কায়েদে আজম মৃত্যুর কিছু দিন আগে ঈদের সময় ২৭ আগস্ট ১৯৪৮ এক বিবৃতি প্রকাশ করেছিলেন। এতে পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠাতা ঈদ মোবারক জানিয়ে বলেন, ‘আমরা সবাই একসাথে বিপজ্জনক ও জটিলতায় ভরা সময় পার করছি। ফিলিস্তিন, ইন্দোনেশিয়া ও কাশ্মিরে রাজনৈতিক ক্ষমতার যে নাটক চলছে, তা আমাদের চোখ খুলে দেয়ার জন্য যথেষ্ট হওয়া উচিত। আমরা নিজেদের ইসলামী ঐক্যের মাধ্যমেই বিশ্বের পরামর্শশালায় নিজেদের আওয়াজের শক্তি অনুভব করাতে পারি।’ (শাহেদ রশিদ সঙ্কলিত আফকারে কায়েদে আজম) তিনি যে সময় ফিলিস্তিন ও কাশ্মিরের পাশাপাশি ইন্দোনেশিয়ার কথা উল্লেখ করেন, সে সময় ইন্দোনেশিয়া ওলন্দাজদের (ডাচ) দখলে ছিল। ১৯৪৯ সালে স্বাধীন হয় ইন্দোনেশিয়া। কিন্তু ফিলিস্তিন ও কাশ্মির আজও স্বাধীন হয়নি। তখনকার সময়গুলোতে সঙ্কট দীর্ঘায়িত করতে ব্রিটিশ শক্তি কেন্দ্রীয় ভূমিকা পালন করে এবং কায়েদে আজম সারা জীবন ব্রিটিশের সাম্রাজ্যবাদী ভূমিকার বিরুদ্ধে কঠোর প্রতিবাদ জানিয়েছেন।
জাতিসঙ্ঘের সাধারণ পরিষদের প্রেসিডেন্টের সম্মানে আয়োজিত নৈশভোজে ইন্দোনেশিয়াসহ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ দেশের রাষ্ট্রদূত উপস্থিত ছিলেন। একজন ইউরোপীয় কূটনীতিবিদ আমাকে জিজ্ঞাসা করলেন, আজকাল কিছু মানুষ প্রশ্ন তুলেছে, পাকিস্তানের মুসলমানরা ফিলিস্তিনিদের সমর্থনে রাস্তায় নামছে, কিন্তু আফগানদের সমর্থনে রাস্তায় নামছে না কেন? অতি শিষ্টাচারিতার সাথে তাকে বললাম, আমি অবশ্যই আপনার প্রশ্নের জবাব দেবো। তার আগে আপনি বলুন যে, লন্ডন ও প্যারিসের লোকেরা ফিলিস্তিনিদের সমর্থনে তো রাস্তায় বেরিয়ে আসে, কিন্তু আফগানদের সমর্থনে রাস্তায় বেরিয়ে আসে না কেন? কূটনীতিবিদ কিছু একটা ভাবলেন। তিনি বললেন, প্রশ্নটা তো ভালোই। তবে এর জবাবও আপনি দেবেন। বললাম, ইসরাইল এক আগ্রাসী, লুটেরা ও জালিম রাষ্ট্রের মতো আন্তর্জাতিক আইনকে উপেক্ষা করে ফিলিস্তিনিদের ওপর উপর্যুপরি বোমাবর্ষণ করে এবং অসংখ্য শিশুকে শহীদ করে দেয়। এ কারণে ইউরোপ ও আমেরিকায় ইসরাইলের বিরুদ্ধে বিশাল বিশাল মিছিল র্যালি বের হয়। আফগানিস্তানেও তো শিশু শহীদ হয়। তবে সেখানে আফগান ন্যাশনাল আর্মি মুসলমান। তালেবানও মুসলমান। যখন মুসলমান পরস্পরের সাথে লড়াই করে, তখন কোনো একটি দলকে ‘বিদেশী শক্তির এজেন্ট’ অভিহিত করা হয়। সুতরাং অবশিষ্ট মুসলমানরা সংশয়ে থেকে যায়। পাকিস্তানের জনগণের রাস্তায় বেরিয়ে আসার কারণ কিছুটা ভিন্ন। পাকিস্তানের জনগণ বংশপরম্পরায় কাশ্মির ও ফিলিস্তিনের মুসলমানদের ওপর জুলুমের কাহিনী শুনে আসছে। এবার ২৭ রমজানুল মোবারকে ইসরাইলি পুলিশ মসজিদে আকসার অবমাননা করলে শুধু পাকিস্তান নয়, আফগানিস্তানেও প্রতিবাদ হয়েছে। সুতরাং পাকিস্তানে এটা এক ধর্মীয় সমস্যা। কেননা মসজিদে আকসা মুসলমানদের প্রথম কিবলা। ইউরোপ ও আমেরিকায় এটা মানবাধিকার সমস্যা। আমাদের আলোচনার মধ্যে একজন তুর্কি কূটনীতিবিদও শামিল হয়েছিলেন। তিনি বললেন, বাহ্যত তুরস্ক একটি সেকুলার রাষ্ট্র। কিন্তু তুর্কিদের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষও ফিলিস্তিনকে একটি ধর্মীয় সমস্যা মনে করে। এ সময় ভলকান বোজকিরকে হিলাল-ই-পাকিস্তান প্রদানের অনুষ্ঠান শুরু করার ঘোষণা দেয়া হলো এবং আমাদের কথাবার্তা শেষ হয়ে গেল।
বোজকির তুর্কি নাগরিক। তিনি ২৮ মে ইসলামাবাদের ন্যাশনাল ডিফেন্স ইউনিভার্সিটিতে দাঁড়িয়ে ফিলিস্তিন ও কাশ্মির সঙ্কট অতি দ্রুত সমাধানের প্রয়োজনীয়তার ওপর জোর দেয়ার পাশাপাশি আফগানিস্তানেরও উল্লেখ করেন, যেখানে শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য পাকিস্তান তার ভূমিকা আদায়ের চেষ্টায় ব্যস্ত রয়েছে। পাকিস্তানকে আফগানিস্তানে শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য ইতিবাচক ভূমিকা অবশ্যই পালন করা উচিত। সেটা হওয়া উচিত কায়েদে আজমের চিন্তাধারা অনুযায়ী। কায়েদে আজমের চিন্তাধারা পররাষ্ট্র বিষয়ক তার বিভিন্ন বক্তৃতা ও বিবৃতিতে আমরা স্পষ্ট দেখতে পাই। তিনি পররাষ্ট্র সচিব হিসেবে ইকরামুল্লাহকে নিজে বাছাই করেছিলেন। ১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট থেকে ২৭ ডিসেম্বর পর্যন্ত প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খানের ক্যাবিনেটে কোনো পররাষ্ট্রমন্ত্রী ছিলেন না। ওই সময় পররাষ্ট্র সচিব সরাসরি কায়েদে আজমের কাছ থেকে নির্দেশনা গ্রহণ করতেন। কায়েদ স্বাধীন পররাষ্ট্রনীতির সমর্থক ছিলেন। তিনি বারবার ফিলিস্তিন সঙ্কট নিয়ে ব্রিটেনের শপথ ভঙ্গের মুখোশ উন্মোচন করেন এবং ফিলিস্তিনের স্বাধীনতা আন্দোলনের গুরুত্বপূর্ণ নেতা মুফতি আমীনুল হুসাইনীর সাথে কয়েক বছর সরাসরি যোগাযোগ রাখেন। কায়েদে আজমের এই বাক্য নিয়ে ভাবুন।
তিনি বলেছেন, ‘স্বাধীনতার জন্য লড়াকুদের ডাকাত ও সন্ত্রাসী বলা নির্মমতা’। তার এ বাক্য ফিলিস্তিনের স্বাধীনতাকামীদের জন্যও প্রযোজ্য। কাশ্মিরের স্বাধীনতাকামীদের জন্যও প্রযোজ্য। কোনো দখলদার বাহিনী অথবা বিদেশী শক্তির প্রতিনিধিত্বকারী পুতুল সরকারের সহায়তাকারী হওয়া কায়েদে আজমের চিন্তাধারার পরিপন্থী। ১৯৪৭ সালের ২৪ অক্টোবর কায়েদে আজম রয়টার্সের প্রতিনিধিকে প্রদত্ত সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, ‘যদি ফিলিস্তিনকে ভাগ করে দেয়া হয়, তাহলে এর দ্বারা নজিরবিহীন ধ্বংসলীলা শুরু হবে। পাকিস্তান আরবদের সর্বাত্মক সমর্থন ও সহায়তা করবে। বরং এই অন্যায় অবিচারকে প্রতিহত করার জন্য তার সাধ্য মোতাবেক সব ধরনের পদক্ষেপ নেবে।’
কায়েদে আজমের এই বাক্য নিয়ে ভাবুন। একটু চিন্তা করুন, আমাদের সাধ্যের ভেতর কী আছে, আর কী নেই? আমরা ফিলিস্তিন ও কাশ্মিরের ইস্যুতে শুধু বক্তৃতা ও বিবৃতিবাজি করছি, কিন্তু আফগানিস্তানে কী করা উচিত? সেখানে সতর্কতার প্রয়োজন। বোজকিরের চিন্তাভাবনা একেবারে সঠিক। শান্তি আলোচনার জন্য সহায়তা অবশ্যই করুন; কিন্তু ওই বিদেশী শক্তিগুলোর ফাঁদে পা দেয়া উচিত নয়, যারা ফিলিস্তিন ও কাশ্মিরের সমাধান করার পথে বাধা হয়ে দাঁড়িয়ে যায়।
পাকিস্তানের জাতীয় পত্রিকা দৈনিক জং ৩১ মে, ২০২১ হতে উর্দু থেকে ভাষান্তর ইমতিয়াজ বিন মাহতাব
ahmadimtiajdr@gmail.com
লেখক : পাকিস্তানের প্রখ্যাত সাংবাদিক ও কলামিস্ট, প্রেসিডেন্ট জি নিউজ নেটওয়ার্ক (জিএনএন)


আরো সংবাদ



premium cement