২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫
`

বিশ্ববিদ্যালয়ের হালচাল

-

১. ‘কর্তার ইচ্ছাই কর্ম’ এই প্রবাদটি আমরা সবাই জানি। আমাদের এক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সে বিষয়টি বাস্তবে দেখিয়ে দিলেন। গভীর রাতে ক্লাস নিয়েছেন রংপুর রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি কলিমউল্লাহ। সংবাদটি আমাদের জন্য এক ধরনের ‘সৌভাগ্যই’ বলা চলে। এখন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে কোনো ক্লাসই হয় না, সেখানে শিক্ষক মহোদয় ‘দয়া করে ওভার টাইম ও অতিরিক্ত ক্লাস হিসেবে’ ক্লাসটি নিয়েছেন। ছাত্র-ছাত্রীরাও নিশ্চয়ই এই ‘ভিন্নধর্মী মজাদার ক্লাসটি’ বেশ উপভোগ করেছেন। ইদানীং আমাদের শিক্ষক মহোদয়দের এ ধরনের কার্যক্রম আমরা বেশ উপভোগ করি। বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য (ভিসি) নাজমুল আহসান কলিমউল্লাহ গভীর রাতে ২০১৯-২০ শিক্ষাবর্ষে জেন্ডার অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজ বিভাগের ১২তম ব্যাচের প্রথম বর্ষের দ্বিতীয় সেমিস্টারের শিক্ষার্থীদের ‘পলিটিক্যাল থট’ কোর্সের ক্লাস নিয়েছেন। রাত ৩টায় শুরু হওয়া ক্লাস শেষ হয় রাত ৩টা ৫৫ মিনিটে। ক্লাসে অংশ নেয়া এক শিক্ষার্থী বলেছেন, ‘পলিটিক্যাল থট কোর্সের ক্লাস নেবেন বলে স্যার আগে থেকেই জানিয়ে রেখেছিলেন। স্যারের নির্দেশ মতো আমরা ২৮ জন শিক্ষার্থী এই অনলাইন ক্লাসে অংশ নিই। প্রায় এক ঘণ্টা ক্লাস চলে। তবে গভীর রাতে ক্লাস হওয়ায় অনেকেই থাকতে পারেননি। শেষ পর্যন্ত কতজন ছিলেন, তা জানি না।’ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে বিষয়টি বেশ আলোচিত হয়েছে। এ ধরনের ক্লাস নেয়া ভিসি মহোদয়ের জন্য কতটুকু ঠিক হয়েছে তা আমাদের মতো সাধারণ মানুষের উপলব্ধি করা সত্যিই অনেক কঠিন ব্যাপার।
২. রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে এক বিষয়ে ফেল ও দ্বিতীয় বিভাগে দশম হয়েও শিক্ষক হয়েছেন ইন্দ্রনীল মিশ্র নামে একজন। তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনফরমেশন অ্যান্ড কমিউনিকেশন ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগে নিয়োগ পেয়েছেন। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের নিয়োগ নিষেধাজ্ঞাকে তোয়াক্কা না করে প্রফেসর আবদুস সোবহান উপাচার্য হিসেবে শেষ কর্মদিবসে ১৩৮ জনকে অ্যাডহক (অস্থায়ী) নিয়োগ দিয়ে পুলিশি পাহারায় ক্যাম্পাস ত্যাগ করেন। সেদিন ওই নিয়োগকে কেন্দ্র করে বিশ্ববিদ্যালয় ও মহানগর ছাত্রলীগ এবং বিশ্ববিদ্যালয়ে কর্মরত কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মধ্যে সংঘর্ষ হয়। এই নিয়োগকে অবৈধ ঘোষণা করে সেদিনই বিকেলে শিক্ষা মন্ত্রণালয় চার সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করে। তদন্ত কমিটি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে এসে তদন্ত করে গত ২৩ মে তদন্ত প্রতিবেদন শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে জমা দিয়েছে। শেষ অবৈধ নিয়োগে তদন্ত কমিটি বিদায়ী উপাচার্যসহ বেশ কয়েকজনের সংশ্লিষ্টতার প্রমাণ পেয়েছে। আবদুস সোবহানের দেশ ত্যাগেও নিষেধাজ্ঞার সুপারিশ করা হয়েছে প্রতিবেদনে। তবে এখনো শিক্ষা মন্ত্রণালয় দৃশ্যমান কোনো ব্যবস্থা নেয়নি।
৩. মেয়াদ শেষের দিকে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ফারজানা ইসলামও নিয়োগে তৎপর! মেয়াদের শেষ সময়ে এসে তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ে নতুন নিয়োগ দিতে তৎপরতা শুরু করেছেন। গত চার মাসে একে একে ৪৭টি পদে নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি দিয়েছেন। অনলাইনে আয়োজন করেছেন শিক্ষক নিয়োগের মৌখিক পরীক্ষা। ফলে ক্যাম্পাসে সৃষ্টি হয়েছে তুমুল আলোচনা- সমালোচনা। অভিযোগ উঠেছে, পছন্দের প্রার্থীকে নিয়োগ দিতেই উপাচার্যের এমন তৎপরতা দেখা যাচ্ছে। অন্যদিকে, নির্দিষ্ট বয়সসীমা নির্ধারণ না করেই ১০টি পদের আটটিতে কর্মকর্তা নিয়োগের কথা বলা হয়েছে। তিন ধাপে বিভিন্ন বিভাগে মোট ৩৭ জন শিক্ষক এবং ১০ জন প্রশাসনিক ও নিরাপত্তা কর্মকর্তা নিয়োগের বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের দাফতরিক কার্যক্রম বন্ধের মধ্যেও বিভিন্ন নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ ও আবেদনপত্র গ্রহণ করা হয় যেখানে আবেদনকারীদের জন্য অত্যন্ত কম সময় বেঁধে দেয়ারও অভিযোগ রয়েছে। প্রকাশিত বিজ্ঞপ্তিতে ১০টি বিভাগে ৩৭ জন শিক্ষকের নিয়োগের কথা বলা হয়। দর্শন এবং ভূগোল ও পরিবেশ বিভাগে ছয়জন করে এবং রসায়ন বিভাগে পাঁচটি স্থায়ী পদে প্রভাষক নিয়োগের জন্য দরখাস্ত আহ্বান করা হয়েছিল। এদিকে, বিভাগের রীতি লঙ্ঘন করে প্রয়োজনের বেশি শিক্ষক নিয়োগ দেয়া হচ্ছে দাবি করে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) কাছে লিখিত অভিযোগ জানিয়েছেন দর্শন বিভাগের আটজন শিক্ষক। চিঠিতে তারা এই নিয়োগপ্রক্রিয়া বন্ধের দাবি জানিয়েছেন। বর্তমান করোনা পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে সশরীরে মৌখিক পরীক্ষা নেয়ার পক্ষে মত দেন তারা। দর্শন বিভাগের শিক্ষক ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক মঞ্চের মুখপাত্র অধ্যাপক রাইহান রাইন বলেছেন, ‘অনলাইনে শিক্ষক নিয়োগ দেয়ার কোনো যৌক্তিকতা নেই। শিক্ষক নিয়োগে প্রার্থীদের যেখানে শ্রেণিকক্ষে ডেমনস্ট্রেশনের (নমুনা ক্লাস) নির্দেশনা রয়েছে, সেখানে কিভাবে অনলাইনে ‘ভালো শিক্ষক’ পাওয়া যেতে পারে? আমাদের বিভাগে একত্রে এত বেশি শিক্ষকের প্রয়োজন নেই। কারণ, এখনো অনেক শিক্ষকের কোনো কোর্স নেই, আবার কোনো কোনো শিক্ষকের সব বর্ষ মিলে মাত্র একটি বা দু’টি কোর্স আছে। উপাচার্য অধ্যাপক ফারজানা ইসলাম ও বিভাগীয় চেয়ারম্যানের মেয়াদও শেষ হতে চলেছে। তাই হয়তো পছন্দের প্রার্থী নিতে তাড়াহুড়া করছেন।’ করোনাকালেই এর আগে বিশ্ববিদ্যালয়ে ইনস্টিটিউট অব রিমোট সেন্সিং (আইআরএস), আইন ও বিচার বিভাগ, আইআইটি, অর্থনীতি বিভাগে অনলাইনে মৌখিক পরীক্ষার মাধ্যমে নিয়োগ হয়েছে।
জাবিতে অনলাইনে নিয়োগের মৌখিক পরীক্ষার বিষয়ে অবগত নন দাবি করে ইউজিসি সদস্য ড. দিল আফরোজা বেগম বলেছেন, ‘আমাদের কাছে শিক্ষক নিয়োগের কোনো চাহিদাই আসেনি, অনলাইনে শিক্ষক নিয়োগ কোনোভাবেই হতে পারে না। বোর্ডে একজন প্রার্থীকে সামনাসামনি দেখতে হয়, তার সার্টিফিকেট দেখতে হয়। অনলাইনে কিভাবে সম্ভব? আমরা কেবল বলেছি অনলাইনে শিক্ষার্থীদের পরীক্ষা নেয়ার বিষয়ে। তাও অনেক নীতিমালা উল্লেখ করেছি। সেগুলো রেকর্ড করতে বলা হয়েছে।’
উপরের তিনটি কার্যক্রম পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, আমাদের ভিসি মহোদয়দের কেউই ‘স্বাভাবিক’ মানুষ নন, তাদের কার্যক্রমে তারা পুরোমাত্রায় ‘বিকৃত মানুষ’ হিসেবে নিজেদের পরিচয় দিয়েছেন। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর শিক্ষার যদি এ অবস্থা হয়, তবে জাতি হিসেবে আমরা দিন দিন কোথায় যাচ্ছি? তা কি আমরা একবারের জন্যও ভেবে দেখেছি?
প্রথম ঘটনায় আসলে ভিসি মহোদয় মানসিকভাবে সুস্থ আছেন কি না, তা পরীক্ষা করে দেখা প্রয়োজন। একজন মানসিকভাবে সুস্থ মানুষ কখনোই এত রাতে ক্লাস নিতে পারেন না। তিনি এর আগেও বেশ কয়েকটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা ঘটিয়ে দেশে ও জাতির বিশেষভাবে নজর কাড়তে সক্ষম হয়েছেন।
দ্বিতীয় ও তৃতীয় ঘটনায় আমরা দেখি, নিজের ইচ্ছেমতো প্রার্থীকে শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ দেয়া। নিজের ক্ষমতার অপব্যবহার করে পছন্দমতো প্রার্থীকে নিয়োগ দেয়া যাদের স্বভাব তাদের কাছ থেকে জাতি কী শিক্ষা লাভ করবে, তা আমার ক্ষুদ্র জ্ঞানে মোটেই বুঝে আসে না। তাদের মধ্যে যদি ন্যূনতম বিবেক ও কাণ্ডজ্ঞান থাকত, ডিপার্টমেন্টের প্রথম সারির ছাত্র-ছাত্রীদের বঞ্চিত করে এভাবে শুধু দলীয় ও ব্যক্তিগত বিবেচনায় নিয়োগ দিয়ে কোনোভাবে এত বড় অন্যায় করতে পারতেন না। আমরা বাংলাদেশের একজন সাধারণ নাগরিক হিসেবে এই অন্যায় কাজগুলোর তীব্র প্রতিবাদ আগেও করেছি; এখনো করে যাচ্ছি, পাশাপাশি এত বড় অন্যায় কার্যক্রমের প্রতিকার চাচ্ছি; যদিও জানি এ বিষয়ে কারো কাছে কোনো প্রতিকার চেয়ে লাভ হবে না। যাদের কাছে প্রতিকার চাইব তাদের ইশারাতেই যে এসব কার্যক্রম পরিচালিত হয়, তা বুঝতে কারো বাকি নেই। তবুও নিজের বিবেকের দায়বদ্ধতা ও নিজেকে সান্ত্বনা দেয়ার জন্যই এই পাহাড়সম অন্যায়ের প্রতিবাদে আমাদের দু’কলম লেখার অব্যাহত প্রচেষ্টা।


আরো সংবাদ



premium cement