১৭ এপ্রিল ২০২৪, ০৪ বৈশাখ ১৪৩১, ০৭ শাওয়াল ১৪৪৫
`

সৌজন্য প্রদর্শন ও বদান্যতার সময়

অন্য দৃষ্টি
-

করোনা আমাদের দেশে কি ক্ষতি করেছে? এর উত্তরে যদি বলা হয় ১০ হাজার মানুষ মারা গেছে। বিগত এক বছরে ১৭ কোটি জনসংখ্যার একটি দেশে ১০ হাজার মানুষের মৃত্যু আলাদা কোনো অর্থ বহন করে না। যেখানে ডায়াবেটিস হৃদরোগসহ জটিল কঠিন বিভিন্ন রোগে মৃত্যু একই সময়ে বহুগুণ বেশি হয়েছে। এমনকি একই সময়ে এর চেয়ে বেশি মানুষ মারা গেছে আত্মহত্যা করে। সম্প্রতি এক জরিপে মানুষ মৃত্যুর এমন পরিসংখ্যান আমরা দেখেছি। করোনায় এ যাবৎ মানুষের মৃত্যু বাংলাদেশের গড় মৃত্যুহারে এমনকি গড় আয়ুতে কোনো প্রভাব ফেলেনি।
করোনা ঠেকাতে গিয়ে আমরা যে কর্মসূচি হাতে নিচ্ছি সেটাতে বরং এর চেয়ে অনেক বেশি বিপদ ডেকে আনছি। শহুরে দরিদ্র মানুষের আহাজারি প্রতিদিন দেখতে পাওয়া যাচ্ছে। লকডাউনের মধ্যে তারা রাস্তায় কান্নাকাটি করছেন। থাকা খাওয়া কিংবা নিজেদের সম্মান ইজ্জত নিয়ে তারা ভাবতে পারছেন না। তাদের উপস্থিত সমস্যা পেটে ক্ষিধা। তা সহ্য করা যাচ্ছে না। বাধ্য হয়ে শহরের দরিদ্র মানুষ রাস্তায় নেমে আসছেন। পুলিশের নির্দয় আচরণে তাদের নিত্যদিনকার আর্তনাদ প্রধান ধারার সংবাদমাধ্যমে যথেষ্ট না এলেও সামাজিক মাধ্যমে উঠে আসছে। একই সমস্যা গ্রামসহ সারা দেশে। মানুষ অত্যন্ত শঙ্কিত, কিভাবে তাদের আহার জুটবে সেটা নিয়ে।
করোনায় আক্রান্ত হয়ে মারা যাওয়া নয় বরং খাদ্যসঙ্কটের কারণে বেঁচে থাকাটা যে অনেক বড় দায় সেটা বিভিন্ন সংস্থার জরিপে উঠে আসছে। করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ের আগেই দুই কোটি ৪৫ লাখ লোক নতুন দরিদ্র হয়েছে। তার আগে থেকে দেশে তিন কোটি ৪৬ লাখ দরিদ্র ছিল বলে সরকারি পরিসংখ্যানে দেখা গিয়েছিল। মোট মিলিয়ে ৫ কোটি ৯১ লাখ মানুষ দরিদ্র। সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিং (সানেম) আরেক জরিপে জানায়, গত বছর দেশের দরিদ্রতার হার ৪২ শতাংশ। দেশের জনসংখ্যা যদি আমরা ১৭ কোটি ধরি তাহলে সাত কোটি ১৪ লাখ মানুষ দরিদ্র। এবার লকডাউন দরিদ্র জনগোষ্ঠীর সংখ্যা আরেক দফা বাড়িয়েছে।
আইসিইউ, অক্সিজেন, ভেন্টিলেটর, টিকা নিয়ে যে পরিমাণ আলোচনা তার চেয়ে কোনো অংশে কম আলোচনার প্রয়োজন নেই দারিদ্র্য নিয়ে। একজন মানুষ অক্সিজেনের অভাবে এক ঘণ্টা ভুগে মারা যেতে পারবেন। আইসিইউ না পেয়ে তড়পাতে তড়পাতে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করবেন। মানুষটি পৃথিবী থেকে বিদায় নেয়ার মধ্য দিয়ে এক ধরনের ‘সুরাহা’ হচ্ছে। আমরা হয়তো তাকে ভয়াবহ কষ্ট লাঘবে সাহায্য করতে পারিনি। কিন্তু একজন বাবা যখন দেখেন, তার পরিবারে এক মুঠো চাল নেই। তার কাছে একটি পয়সা নেই। ধারদেনা তিনি আগেই করেছেন। এখন সেসব পরিশোধের সময়। এদিকে জীবিকার কোনো উপায় তার হাতে নেই। এই অসহায় মানুষটি যে অবস্থায় পড়েন সেটা অক্সিজেনের অভাবে থাকার চেয়ে কম বিপর্যয়কর নয়। হিসাব মতে, দেশের প্রায় অর্ধেক মানুষ এখন কোনো না কোনোভাবে বিপদে রয়েছেন।
এই বিপুল সংখ্যক মানুষের কষ্ট লাঘবে সরকারি যে উদ্যোগ সেটা পর্যাপ্ত নয়। চারদিক থেকে যেসব খবর পাওয়া যাচ্ছে তাতে বোঝা যাচ্ছে সাহায্য সহযোগিতা নিয়ে করোনার শুরুতে যেভাবে মানুষ হাত বাড়িয়েছিল সেটা কমে গিয়েছে। তখন সাধারণ মানুষ স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন ও রাজনৈতিক দলগুলো সামর্থ্য অনুযায়ী নেমেছিল। এখন এমন সাহায্য আরো বেশি প্রয়োজন হলেও মানুষ উৎসাহ হারিয়েছে তাদের সামর্থ্যও কমছে।
দানের প্রসঙ্গটির গুরুত্বের কথা আমরা বলতে চাই। রমজান মাস চলছে। এই মাসে মানুষ সদকা দেয়। এবার সর্বোচ্চ সদকা নির্ধারণ করা হয়েছে ২৩১০ টাকা। সর্বনি¤œ নির্ধারণ করা হয়েছে ৭০ টাকা। ইসলামিক ফাউন্ডেশনের পক্ষ হতে সর্বোচ্চ সদকা নির্ধারণ করা হলেও সাধারণ সর্বনি¤œ অঙ্কটি অনেক মুসলমান দিয়ে থাকে। কেউ কেউ বেশি দেয়। এই সময়ে ৮ কোটি মানুষ গড়ে একশ টাকা করে সদকা দিলে ৮০০ কোটি টাকা। বাকি সাত কোটি মানুষ যদি এটা পায় সেটা ১০০ টাকার চেয়ে কিছু বেশি হতে পারে। যদিও এর বণ্টনে সমতা প্রত্যাশা করা যায় না। এই সময়ে মানুষ জাকাতও দিয়ে থাকে। কারো কাছে বছর শেষে নিসাব পরিমাণ সম্পত্তি থাকলে তার ওপর শতকরা আড়াই শতাংশ হারে জাকাত দেয়ার বিধান করা হয়েছে। এই বিধান প্রত্যেক ধনী যদি যথাযথ অনুসরণ করেন তাহলে এ দেশে জাকাতের বিশাল অর্থনীতি দাঁড়ায়। এতে করে বহু দরিদ্র মানুষ উপকৃত হতে পারেন। জাকাত ও সদকা বছরের একবারের জন্য নির্ধারণ করা হয়েছে। বছর শেষে দরিদ্ররা এটা পেতে পারে। প্রকৃতপক্ষে মানুষের চাহিদা কেবল বছরের শেষে নয়। সারা বছর মানুষের সাহায্য প্রয়োজন। একজন মানুষের ঘরে খাবারের অভাব যেকোনো সময় হতে পারে। সে যেকোনো সময় রোগগ্রস্ত হতে পারে। যেকোনো ধরনের বিপদে পড়তে পারে। তাই বছর শেষে দান দরদ্রিদের সময়মতো সাহায্যের উপযোগিতা পূরণ করে না।
ধনীদের সংখ্যা বৃদ্ধিতে বাংলাদেশ বিশ্বে প্রথম। ২০১২ থেকে ২০১৭ সালের মধ্যে বাংলাদেশে ১৭ শতাংশ হারে সর্বোচ্চ (আলট্রা) ধনী বেড়েছে। যুক্তরাষ্ট্রকেন্দ্রিক প্রতিষ্ঠান ‘ওয়েলথ এক্স’ এই হিসাব দিয়েছে। ওয়ার্ল্ড আল্ট্রা ওয়েলথ রিপোর্ট ২০১৮ এ তা প্রকাশিত হয়েছে। সংজ্ঞা অনুযায়ী, সর্বোচ্চ এই ধনীদের কাছে বছর শেষে আড়াইশ কোটি টাকা বিনিয়োগযোগ্য অর্থ থাকে। এর মধ্যে তাদের ব্যক্তিগত স্থাবর সম্পত্তি অন্তর্ভুক্ত নয়। ২০১৮ থেকে পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশে অনিয়ম দুর্নীতিসহ লুটপাটের যে খবর প্রকাশ পাচ্ছে তাতে এমন ধনী বৃদ্ধিতে বাংলাদেশ বিশ্বে প্রথম স্থানে রয়ে যাবে ধরে নেয়া যায়। প্রতি বছর দেশ থেকে গড়ে প্রায় ৬০ হাজার কোটি টাকা পাচার হয়ে যাচ্ছে। ১৯৭৫ সালে বাংলাদেশে কোটিপতির সংখ্যা ছিল পঞ্চাশের কম। ২০১৮ সালে দেশে কোটিপতির সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২৫ হাজার। এমনকি এই করোনার সময় বাংলাদেশে ধনীদের অর্থ বাড়ার খবর পাওয়া যাচ্ছে।
বাংলাদেশে ৯০ শতাংশ মানুষ মুসলমান। নব্য ধনীরা প্রায় সবাই মুসলমান। তারা যদি ধর্মের নিয়ম মানে তাহলে আড়াই শতাংশ জাকাত বছর শেষে দেয়ার কথা। ওয়েলথ এক্সের প্রতিবেদন অনুযায়ী অতি ধনী বিরাট একটা গোষ্ঠীর কাছে জাকাত দেয়ার মতো আড়াই শত কোটি বা তার বেশি অর্থ রয়েছে। এ থেকে তারা নিয়ম অনুযায়ী প্রদান করলে এক একজন কমপক্ষে ছয় কোটি ২৫ লাখ টাকা দেবেন। এ ছাড়া মুসা বিন শমসের, বসুন্ধরা গ্রুপ, যমুনা গ্রুপসহ হাজার কোটি টাকার মালিক কয়েক ডজন। আর নিচের দিকে রয়েছেন ২৫ হাজার কোটিপতি। এছাড়া বাকি বিত্তবানরা সবাই নিয়ম অনুযায়ী জাকাত দিলে এতে কোনো সন্দেহ থাকে না যে, কমপক্ষে সেটা কয়েক লাখ কোটি টাকা হবে। এই টাকা সাত কোটি গরিবের দিকে আবর্তিত হলে তাদের চরম দুর্দশা কেটে যায়। এর সাথে যে অর্থনৈতিক প্রাণচাঞ্চল্যও সৃষ্টি হবে তা কোভিড সৃষ্ট দৈন্যদশা কাটিয়ে ওঠাকে সহজ করে ফেলবে। তবে এমনটা আদৌ হওয়ার নয় বলেই মনে হচ্ছে।
মুসলমানরা তাদের নির্ধারিত দায়িত্ব পালন করছে না; দেশের আর্থসামাজিক দুরবস্থা তার সাক্ষী। জাকাত প্রদানের নামে অনেক সময় কিছু ধনী প্রদর্শনের আয়োজন করে। এতে কাজটি ঠিকমতো না হলেও দরিদ্র মানুষের প্রাণহানি পর্যন্ত ঘটছে। ২০১৮ সালের ১৫ মে চট্টগ্রামের সাতকানিয়ায় ত্রিশ হাজার লোক জড়ো করা হয়। একটি শিল্প গ্রুপের মালিক জাকাত দিবেন। এ প্রচার চালিয়ে বিপুল জনসমাগম ঘটানো হয়। ৫ কেজি চাল, ৫ কেজি মসুর ডাল, নগদ এক হাজার টাকা ও একটি শাড়ি তাদের দেয়ার কথা। জাকাত প্রদানের জন্য একটি মসজিদকে কেন্দ্র বানানো হয়েছিল। সকাল ৯টায় মসজিদের দরজা খুলে দেয়া হয়। ত্রিশ হাজার মানুষের তুলনায় স্বল্প জায়গায় জাকাত গ্রহণে হুমড়ি খেয়ে পড়েন তারা। পদদলিত হয়ে তখন ৯ জন নারী প্রাণ হারান। আরো ২৫ জন নারী ও শিশু গুরুতর আহত হয়। ২০১৫ সালে ময়মনসিংহে জাকাত প্রদানের আরেকটি ঘটনায় ২৭ জন নারী ও শিশু প্রাণ হারায়। ওই সময় আহত হন শত শত মানুষ।
সারা দেশে প্রতি বছর জাকাত প্রদানের এমন দৃশ্য প্রায় সব এলাকায় দেখা যায়। মাইকিং করে এর ঘোষণা দেয়া হয়। এভাবে জাকাত প্রদানে হতাহতের ঘটনা ঘটলেও প্রদর্শনের লোভ ছাড়তে পারছে না মুসলমানরা। সূরা নিসার ৩৮ নম্বর আয়াতে এমন দানকারী ‘আল্লাহ ও পরকালে বিশ্বাসী নয়’ বলে আল্লাহ নিজে জানাচ্ছেন। এর পরের আয়াতে তিনি আক্ষেপ করে বলছেন, তাদের কী হতো, তারা যদি আল্লাহ ও পরকালে বিশ্বাস করে দান করত? দানের ব্যাপারে আল্লাহ প্রকাশ্যে ও গোপনে দুইভাবে দিতে নির্দেশ দিয়েছেন। অর্থাৎ দান যদি প্রকাশ্যে হয় অসুবিধা নেই। কিন্তু প্রদর্শনের ইচ্ছাটাকে নিরুৎসাহিত করা হয়েছে। গোপনে দানকে উৎসাহিত করা হয়েছে। সূরা বাকারার ২৭১ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে, এমন দানের ফলে পাপমোচন করা হয়।
জাকাতের নামে মানুষকে কাপড় চোপড় দেয়া হয়। ঈদের আগে বিভিন্ন স্থানে জাকাতের কাপড়ের আলাদা দোকান গড়ে ওঠে। গুরুত্বপূর্ণ স্থান ও মার্কেটের পাশে অস্থায়ী দোকানের এমন সারি দেখা যায়। জাকাতের জন্য আলাদা তৈরি করা শাড়ি লুঙ্গি এই মার্কেটে পাওয়া যায়। কিন্তু এসব কাপড় মানসম্পন্ন নয়। কেবল গরিব মানুষকে দেয়ার জন্য এগুলো বিশেষভাবে তৈরি। দামও কম। অথচ আল্লাহ সূরা বাকারার ২৬৭ নম্বর আয়াতে নির্দেশ দিয়েছেন, তোমরা দানের জন্য নিকৃষ্টটা খুঁজে বের করো না।
দানের ইংরেজি শব্দ ‘চ্যারিটি’। অভিধানে এর বাংলা করা হয়েছে সদয়তা বদান্যতা। আরো ব্যাখ্যা করে বলা হয়েছে গরিবকে সেবা করা বা দান করা। ইংরেজি শব্দটি যে গ্রিক শব্দ থেকে এসেছে তার অর্থ ভালোবাসা। সূরা আলে ইমরানের ৯২ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে, তোমরা কখনো পুণ্য অর্জন করতে পারবে না, যতক্ষণ না প্রিয় জিনিস দান করতে পারবে। জাকাতের নামে আমরা যা করছি সেটা স্রষ্টার প্রদত্ত নির্দেশনার সাথে মিলে না। আমরা দান করে আবার সে লোকদের সেবা গ্রহণ করি। অনেক সময় দানের বিনিময়ে লোকদের অধীনস্থ করে রাখি। সূরা বাকারার ২৬২ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে, দানের পর যারা অনুগ্রহের খোঁটা দেয় না এবং তাকে অন্য কোনো কষ্ট দেয় না, তাদের জন্য আল্লাহর কাছে পুরস্কার রয়েছে।
সূরা বাকারার ২৬১ নম্বর আয়াতে দানকে তুলনা করা হয়েছে শস্যদানার সাথে। বলা হয়েছে, একটি দান হচ্ছে একটি শস্যদানা। সেখান থেকে বের হলো সাতটি শীষ। প্রত্যেকটি শীষে রয়েছে আবার ১০০টি করে দানা। তাহলে প্রত্যেকটি দান সাতশ গুণ বেড়ে যাচ্ছে। তবে ব্যাপারটি এমন নয় যে, এক টাকা দান করে আমরা ৭০০ টাকা পেয়ে যাবো। এমন পুরস্কার শুধু পরকাল বিশ্বাসীদের জন্য। সেটা প্রমাণিত হবে পুনরুত্থান দিবসে। দানকে ঘিরে আমাদের যতসব হীনম্মন্যতা, সেটা পরকাল বিশ্বাসের ঘাটতির কারণে তৈরি হচ্ছে। আমরা দানকে জাকাতের আড়াই শতাংশের মধ্যে সীমাবদ্ধ করে ফেলেছি। সেটাও আবার ঠিকভাবে নিজেরা মানি না। দানের প্রসঙ্গটি মানুষের প্রয়োজনের নিরিখে যাচাই হবে। একজন মানুষ যখন অভাবগ্রস্ত হবে কিংবা বিপদে পড়বে তখনই দেয়ার প্রশ্ন। করোনাকালে সম্ভবত দানের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মওসুম যাচ্ছে। ধনী ও সচ্ছলরা ঠিকভাবে দান করলে দেশের সাত কোটি গরিব সহজে বিপদ কাটিয়ে উঠতে পারবে। হ
jjshim146@yahoo.com


আরো সংবাদ



premium cement