২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫
`

শ্রমিক-কর্মচারীদের দুর্দশা চিরস্থায়ীভাবে লাঘব করতে হবে

-

যুক্তরাষ্ট্রের একসময়ের প্রেসিডেন্ট ফ্রাঙ্কলিন ডি রুজভেল্ট ১৯৩৩ সালের ৪ মার্চ নবনির্বাচিত প্রেসিডেন্ট হিসেবে শপথবাক্য পাঠ করেন। তখন মার্কিন অর্থনীতির প্রধান চালিকাশক্তি স্টক মার্কেটের ত্রিশঙ্কু এবং বেহাল এক অবস্থা বিরাজ করছিল, যা ১৯৩৮ পর্যন্ত বহাল ছিল। বিশ্বের দু’টি মহা দুর্যোগের সময় তিনি যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট হিসেবে ক্ষমতায় ছিলেন। প্রথমটি ছিল বিশ্বব্যাপী ভয়ানক অর্থনৈতিক মন্দা এবং অপরটি ছিল দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ। অর্থনৈতিক মন্দা মোকাবেলার জন্য রুজভেল্ট ‘নিউ ডিল’ (ঘবি উবধষ) নামে একটি অর্থনৈতিক কর্মসূচি গ্রহণ করেছিলেন। এই কর্মসূচি ছিল কর্মহীন বেকারদের জরুরি রিলিফসামগ্রী দেয়ার ব্যবস্থা, অর্থনীতি পুনরুদ্ধারের তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা, সামাজিক কর্মসূচির মাধ্যমে নতুন চাকরি সৃষ্টি করা ইত্যাদি।
বর্তমান সময়ের কোভিড-১৯ এর সৃষ্ট চলমান মানবিক দুর্যোগ আরেকটি নতুন চুক্তি (উবধষ) করার সুযোগ তৈরি করে দিয়েছে। বর্তমানে বিশ্বে অনানুষ্ঠানিকভাবে যেসব শ্রমিক-কর্মচারী রয়েছে তারা বিশ্বের সর্বমোট শ্রমশক্তির ৬১ শতাংশ। অবিশ্বাস্য হলেও সত্য যে, বিশ্বের মানবজাতির এই ৬১ শতাংশের জন্য কোনো স্বাস্থ্যবীমা নেই। ছুটির সময় তাদেরকে বেতন ছাড়া ছুটি কাটাতে হয়। অর্থাৎ ছুটির সময়ে তাদের বেতন দেয়ার বিধান নেই। তাদের জন্য জীবন সায়াহ্নে পেনশনের ব্যবস্থা নেই। অথচ এই শ্রমিকেরাই খাদ্য, দুধ, কাপড়, জুতা, বাড়িঘর নির্মাণ ইত্যাদির সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত রয়েছে। তারা স্বাস্থ্যসেবা, শিশু-বৃদ্ধের সেবা ইত্যাদির সাথেও ওতপ্রোতভাবে জড়িত থাকে।
প্রেসিডেন্ট রুজভেল্ট আমেরিকার অর্থনৈতিক মহামন্দার সময় তিনটি বিষয়ের ওপর গুরুত্ব দিয়েছিলেন। তা হলোÑ (১) ত্রাণ (জবষরবভ), (২) পূর্ব ব্যবস্থা প্রাপ্তি (জবপড়াবৎু) এবং (৩) সংস্কার (জবভড়ৎস). কিন্তু এখানে লক্ষণীয়, তিনি এসব কর্মসূচি শুধু যুক্তরাষ্ট্রের অনিয়মিত শ্রমিকদের উদ্দেশ্যে দিয়েছিলেন।
২০২০ সালের প্রথম দিকে আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা (ওখঙ) ভবিষ্যদ্বাণী করেছিল, কোভিড-১৯-এর কারণে সব কিছু বন্ধ (খড়পশ ফড়হি) করে দিলেও বিশ্বের ৮০ শতাংশ অনিয়মিত শ্রমজীবী মানুষ বা ১.৬ বিলিয়ন লোক জীবিকা হারাবে। এসব লোকের জন্য তখন অসহনীয় দুঃখ নেমে আসে, খরচ কমিয়ে ফেলতে হয়, কিছু করার কোনো সুযোগই থাকে না, তাদের নগণ্য সম্পত্তি বন্ধক বা চিরতরে বিক্রি করে দিতে হয়। দীর্ঘ সময় ধরে একই অবস্থা চললে, এদের সংখ্যাগরিষ্ঠ লোক এই জীবনে অর্থনৈতিক অবস্থার উন্নতি ঘটাতে সক্ষম হবে না।
ফলে সর্বহারার লিস্টে চিরজীবনের জন্য তাদের নাম লেখা হয়ে যায়। অনাহার, অর্ধাহারের জীবন তাদের ভাগ্যলিপি হয়ে দাঁড়ায়। গরিব, অনুন্নত বা উন্নয়নশীল দেশে রিলিফের টাকা বা রিলিফসামগ্রী দেয়া ভয়ানক কঠিন কাজ। সরকারের উচ্চপর্যায়ে যদি সিদ্ধান্ত হয়, প্রতি পরিবারের জন ১০ কেজি চাল বরাদ্দ থাকবে, তাহলে বলা যায় ঘোষিত পরিমাণ চালের ৫০ শতাংশ চাল আসল লোকের কাছে পৌঁছানো দুষ্কর হয়ে যাবে। এই অপ্রিয় সত্যগুলো সংশ্লিষ্ট দেশের সরকারের প্রতিস্তরের কর্মকর্তাদের জানা থাকা সত্ত্বেও এর প্রতিকার দেখা যায় না। অবশ্য একটি সময় ছিল যখন অসাধুতা ছিল ব্যতিক্রম, সাধুতাই ছিল নিয়ম। এখন সমস্বরে সবাই স্বীকার করবেন, সততা ও স্বচ্ছতা দেশ, সরকার ও সমাজ থেকে চিরবিদায় নেয়ার সময় যেন এসে গেছে। এই চরম দুরবস্থা বিশ্বের কোনো বিশেষ দেশের জন্য প্রযোজ্য নয়, বরং সর্বত্র প্রায় একই লক্ষণ বিরাজ করছে।
কোভিড-১৯ মহামারীর সময়ে সরকার যখন কোনো বিধিনিষেধ, ব্যবসায়িক সুবিধার জন্য সাময়িকভাবে শিথিল করার নির্দেশ দেন তখন তা শুধু প্রযোজ্য হয় সরকার অনুমোদিত ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলোর ওপর, রাস্তায় যারা হকার তাদের এই সুযোগ নিতে দেয়া হয় না। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী এ ব্যাপারে কঠোরভাবে হুকুম তামিল করে। প্রায় সময় পুলিশ তাদের বিরুদ্ধে গ্রেফতারসহ বিভিন্ন হয়রানিমূলক ব্যবস্থা নিতে দ্বিধা করে না। সারা বিশ্বে যারা এই ধরনের ব্যবসায় জড়িত রয়েছে, তাদের মধ্যে সারা বিশ্বে প্রায় ৬১ শতাংশ লোক ফুটপাথ ব্যবহার করেই এই ব্যবসা করে থাকে।
ক্রমেই পরিষ্কার হয়ে যাচ্ছে, কোভিড-১৯ প্রশমনে বিশ্বের সরকারগুলো যে ফান্ডের ব্যবস্থা করেছে তা বিভিন্ন কলাকৌশলের মাধ্যমে ঊপড়হড়সরপ ঊষরঃব বা অর্থনৈতিকভাবে সর্বোৎকৃষ্ট লোকদের পকেটেই স্থান নিয়েছে। অথচ ভাগ্যের নির্মম পরিহাস, যাদের দুর্দশা লাঘবের জন্য এই আয়োজন, সে দরিদ্রপীড়িত ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের এ সম্পর্কে কিছু জানানোও হয় না।
ভারতে ক্ষুদ্র শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলোর সাথে মাঝারি শিল্পকেও এই ঋণ দেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়ায় বড়দের আশা পূরণ হয়েছে, কাজেই প্রতিবাদ থেমে নিস্তব্ধ হয়ে গেছে। বিশ্বের প্রায় সব দেশের অবস্থা একই। আরেকটি ভবিষ্যদ্বাণীও এর সাথে অনায়াসে যোগ করা যায়। তা হচ্ছে, এই ঋণ পরিশোধ না করার সম্ভাবনা ৯০ শতাংশ। ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারি মাসের যখন কোভিড মহামারী শুরুর পথে, তখন বিশ্বের গরিব দেশগুলোর জন্য সংরক্ষিত বিদেশী ঋণের প্রায় এক ষষ্ঠাংশ ‘ট্যাক্সের স্বর্গ’ বলে কথিত দেশগুলোর ব্যাংকে চলে যায়। কিন্তু অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠানগুলো এবং সংশ্লিষ্ট সরকারগুলোর বিশ্বাস, বেসরকারি করপোরেট সেক্টরগুলোকে ঋণ দিয়ে সহযোগিতা করলে অর্থনীতি উদ্ধারে একটি ইতিবাচক সহযোগিতা হতো।
এ ব্যাপারে বিন্দু পরিমাণ সন্দেহ নেই যে, বিশ্ব আজকে নানা কারণে নিজের অস্তিত্ব সঙ্কটে ভুগছে। এ ব্যাপারে বিশ্বের গোটা মানবজাতি একটি মৌলিক প্রশ্নের সম্মুখীন। সে মৌলিক প্রশ্ন হলো আমরা কি মানুষ এবং প্রকৃতিকে প্রাথমিক মূল্যায়ন করব? নাকি পুঁজি এবং প্রযুক্তি বিদ্যাকে? নিপীড়িত এবং লাঞ্ছিতদের অধিকারসমূহ রক্ষা করার ব্যবস্থা কি করতে হবে? না রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিকভাবে সেরাদের? আজ বিশ্বের সামনে যে সামাজিক এবং অর্থনৈতিক সুবিচারের প্রশ্ন, তার ন্যায্য এবং ত্বরিত ফয়সালা অবশ্যই হতে হবে। বিশ্বের সেরা চিন্তাবিদদের ধারণা, মানবজাতির সম্মুখে এই দীর্ঘ সমস্যার ফয়সালার জন্যই এই মহামারীর আগমন। তা যদি সত্যি হয়, তবে এই সমস্যার একটি ন্যায়সঙ্গত ফয়সালা ছাড়া শুধু টিকা দিয়ে এই মহামারী বন্ধ হওয়ার নয়।
যুক্তরাষ্ট্রের তদানীন্তন প্রেসিডেন্ট রুজভেল্টের প্রবর্তিত সামাজিক ও অর্থনৈতিক কর্মসূচি থেকে আরো উন্নত এবং আরো প্রগতিশীল একটি অর্থনৈতিক কর্মসূচি বিধিবহির্ভূত শ্রমিকদের জন্য প্রণয়ন করতে হবে। এই কর্মসূচির লক্ষ্য শুধু তাদের জন্য আর্থিক সাহায্যের ব্যবস্থা করা নয়, তাদের প্রতি যে জাতিগত এবং অর্থনৈতিক অবিচার করা হয়েছে এর চিরতরে অবসান ঘটাতে হবে।
ওদের প্রতি তুচ্ছ-তাচ্ছিল্যের চির অবসান ঘটাতে হবে। যুগে যুগে তাদের প্রতি অবহেলা এবং অবিচারের কারণে যে ঋণের বোঝা বেড়েছে তা শোধ করা ছাড়া অন্য কোনো পথ বের করা অর্থনীতিবিদদের পক্ষে সম্ভব নয়। সে জন্য বড় বড় অর্থনীতিবিদদের গুরুগম্ভীর বড় লেখাগুলো বর্তমানে খুব একটা চোখে পড়ে না। বিশ্বের বিভিন্ন রাষ্ট্রের সরকারগুলোর উচিত হবে রাস্তা থেকে উচ্ছেদ করা থেকে বিরত থাকা। এই শ্রেণীর শ্রমিকেরা কোভিড-১৯-এর লকডাউন শুরু হওয়ার পর বিশ্বব্যাপী একটি সেøাগান দিয়েছিল। তা হলো, “ডব রিষষ ফরব ড়ভ যঁহমবৎ, হড়ঃ ারৎঁং”. অর্থাৎ আমরা ভাইরাসে মরব না বরং উপবাসে মরব। দ্বিতীয় ব্যবস্থা হলো, এই শ্রমিকদের সাথে সরাসরি আলোচনা না করে তাদের সম্পর্কে কোনো সিদ্ধান্ত না নেয়া। কারণ তাদের সাথে হৃদ্যতার সাথে একটি ঐক্য গড়ে ওঠা সারা বিশ্বের জন্য মঙ্গলজনক।
সম্প্রতি জাতিসঙ্ঘের মহাসচিব অ্যান্তোনিও গুতেরেস বলেছেন, “ডব সঁংঃ সধশব ংঁৎব ভঁহফং মড় যিবৎব ঃযবু ধৎব হববফবফ সড়ংঃ.খধঃবংঃ ৎবঢ়ড়ৎঃং রহফরপধঃব ঃযধঃ ঃযবৎব যধং নববহ ৫ ঃৎরষষরড়হ ফড়ষষধৎং ংঁৎমব রহ ঃযব বিধষঃয ড়ভ ঃযব ড়িৎষফ'ং ৎরপযবংঃ রহ ঃযব ঢ়ধংঃ ুবধৎ. ও ঁৎমব মড়াবৎহসবহঃং ঃড় পড়হংরফবৎ ধ ংড়ষরফধৎরঃু ড়ৎ বিধষঃয ঃধী ড়হ ঃযড়ংব যিড় যধাব ঢ়ৎড়ভরঃবফ ফঁৎরহম ঃযব ঢ়ধহফবসরপ ঃড় ৎবফঁপব বীঃৎবসব রহ বয়ঁধষরঃরবং”. এ বক্তব্য ভাষান্তর করলে দাঁড়ায়, টাকা সেখানে যাওয়া উচিত যেখানে তার বেশি প্রয়োজন। শেষ খবরে জানা যায়, গত বছরে পৃথিবীর সবচেয়ে বড় ধনীদের সম্পদে আরো পাঁচ ট্রিলিয়ন ডলার নতুনভাবে যোগ হয়েছে। আমি সরকারগুলোকে অনুরোধ করব, যেন তারা দরিদ্রদের সাথে একাত্ম হবে অথবা বৈষম্য কমানোর জন্য এর ওপর একটি ট্যাক্স ধার্য করেন যাতে মহামারীকালে সৃষ্ট মানুষের মধ্যকার বৈষম্য হ্রাস করা যায়। হ


আরো সংবাদ



premium cement