২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১, ১৫ শাওয়াল ১৪৪৫
`

স্ম র ণ : মোশারেফ হোসেন শাজাহান

-

ভোলা জেলায় জন্মগ্রহণ করা একজন আলোকিত মানুষ মোশারেফ হোসেন শাজাহান। একদিকে তিনি সংস্কৃতিসেবী, লেখক, সাহিত্যিক নাট্যকার সমাজকর্মী ও সমাজসেবী। অন্য দিকে একজন রাজনীতিবিদ। জীবনের প্রথম থেকে তিনি পার্লামেন্ট সদস্য, শেষ জীবনে একজন সফল মন্ত্রী। কাছ থেকে দেখা কিছু বৈশিষ্ট্যের কথাই পাঠকসমাজে তুলে ধরছি। আমার সাথে তার সম্পর্কের সূচনা ১৯৮২ সালে। ১৯৮৮ সাল থেকে তার সান্নিধ্যে; স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে তিনি বরিশাল বিভাগের মূল নেতৃত্বে। ভোলা জেলায় আন্দোলনের তীব্রতা গড়ে তোলেন তিনি। আমরা ছিলাম তার মাঠপর্যায়ের কর্মী। তিনি আন্দোলনকে শাণিত করার লক্ষ্যে রাস্তায় নেমে পড়তেন আমাদের সাথে। সভা, সমাবেশ, মিছিল, মিটিংয়ে অগ্রভাগে থাকতেন সক্রিয়। ১৯৮৮-৮৯ সাল আন্দোলন। ১৯৯০ সালের মাঝামাঝি স্বৈরাচারের দমননীতি প্রকট হওয়ায় হামলা-মামলায় সারা দেশের মতো ভোলায়ও আন্দোলনের বাধাবিপত্তি পরিলক্ষিত হলো। আমি তখন ভোলা সরকারি কলেজ ছাত্র সংসদের নির্বাচিত এজিএস। আমাদের নিয়ে মরহুম শাজাহান যখন মিটিং করতেন তার বাসায়, তখন উন্নত মানের আপ্যায়ন করা হতো। আন্দোলনের সমস্যা উপলব্ধি করতে পারলেন। এবার তিনি নতুন সিদ্ধান্তে উপনীত হলেন। ছাত্রদের মধ্য হতে ১৮ জন ছাত্রের নামের তালিকা নিয়ে আমাদের একটি মিটিংয়ে আহ্বান জানালেন। স্থান ছিল শাজাহানের গদিঘরের পেছনে। বিকেল বেলার সে মিটিংয়ে আমরা ১৮ জনই উপস্থিত হলাম। তিনি আমাদের বললেন, তোমরা এই ১৮ জন; আমার কিছু কাজ করে দিতে হবে। কী কাজ তা তোমাদেরকে এ মিটিংয়ে বলতে পারব না। আগামী সপ্তাহে বলব। দেশে তখন গোলাগুলি, বোমাবাজি, ভাঙচুর, হরতাল-অবরোধ। তিনি আমাদের জানালেন মিটিংয়ের পরদিন বরিশালে যাবেন এবং এক সপ্তাহের মাথায় পরবর্তী মিটিংয়ের তারিখ নির্ধারণ করে দিলেন। তখন আন্দোলনের কাজে তিনি বরিশালে থাকতেন। আন্দোলনের কেন্দ্রীয় কর্মসূচি ফলো করতে এবং বিভিন্ন স্থানে সংযোগের কিছু দায়িত্ব আমাদের দিয়ে তিনি পরদিন বরিশাল চলে গেলেন। আমরা তার দেয়া দায়িত্ব পর্যায়ক্রমে পালন করে যাচ্ছি। হরতাল-অবরোধ-মিছিল অব্যাহত। কর্মীদের নাভিশ্বাস। তখন মোবাইল না থাকায় মুখে মুখেই মিটিংয়ের নোটিশ দেয়া হতো। মিটিংয়ের দিনক্ষণ ঘনিয়ে আসতে লাগল। আমাদের পরস্পরের মধ্যে শঙ্কা কাজ করতে শুরু করল। কারণ, আন্দোলন আরো তীব্র করা সহজ ছিল না। আমাদের অপেক্ষার প্রহর, কী কাজের দায়িত্ব অর্পণ করবেন তিনি আমাদের ওপর। উদ্বিগ্নচিত্তে সবাই মিটিংয়ে উপস্থিত। বেলা ৩টায় মোশারেফ হোসেন শাজাহানের গদিঘরের পিছনের সজ্জিত কক্ষটিতে তিনি এসে বসলেন। রুমে ঢুকতেই দেখলাম তিনি তার চেয়ারে বসা, তার দু’পাশে দুটি বাঁধা কার্টন। আমরা কার্টন দু’টির অবয়ব দেখে আর বুঝতে কারোই বাকি রইল না, মিটিংয়ের শেষ পরিণতি কী। হয়তো খুব বড় কাজ করতে হবে। মিটিং শুরু হলো। তিনি বললেন তোমাদের কিছু কাজ দিব এবং এ কাজগুলো তোমরা আমাকে এক সপ্তাহ সময়ের মধ্যে শেষ করে আমার দেয়া জিনিস ফেরত দিতে হবে।’ আমরা তখন বাকরুদ্ধ। চাকু নিয়ে আসতে বললেন।
দরজা জানালা তখন বন্ধ ছিল। মোশারেফ হোসেন শাজাহানের চেয়ারের দুই পাশের কার্টন দু’টির দিকেই তখন সবার চোখ। গোপনীয়তার মধ্যে তিনি নিজেই চাকু দিয়ে কার্টন দু’টির মুখ কাটলেন। অবাক চিত্তে দেখলাম, কার্টনগুলোতে ভারতের বিখ্যাত লেখক সমরেশ মজুমদারের লেখা কালবেলা ও কালপুরুষসহ দেশীয় লেখকদের লেখা উপন্যাস। হকচকিত হলাম। এগুলো কেন? তিনি নিজ হাতে একটি বই তুলে বললেন, প্রথম পৃষ্ঠাটি তুললেই বাম পাশে কাগজ দিয়ে হাতে তৈরি একটি বক্স। ওই বক্সের মধ্যে এক পৃষ্ঠা সাদা কাগজ, একটি কলম। এবার তিনি আমাদের বললেন, তোমরা প্রত্যেকে এই বইগুলো আগামী এক সপ্তাহের মধ্যে পড়ে আমাকে দিতে হবে। মলাটের বাম পাশের কাগজের বাক্সে সাদা কাগজ আর কলমের অর্থ হচ্ছে তোমরা যখন বইটি পড়বে, এমন কিছু বাংলা শব্দ পাবে যার অর্থ তোমরা বুঝবে না, তখন ওই কলম দিয়ে সাদা কাগজে লিখে আনবে। আগামী মিটিংয়ে তার অর্থ বলে দিবো।’ প্রত্যেকের শরীর থেকে যেন জ্বর নেমে গেল, আমরা স্বাভাবিক হলাম। আমরা উপন্যাসগুলো পড়তে শুরু করলাম। সপ্তাহ শেষে অনুরূপ মিটিং চলল। না বোঝা শব্দগুলো তিনি আমাদের বুঝিয়ে দিলেন, আট-নয় শ’ পৃষ্ঠার বইগুলো আমরা পড়ে শেষ করে ফেললাম। ঘুরিয়ে ফিরিয়ে সব কটি বই পড়া হতো। বই পড়া ও আন্দোলনের কর্মসূচি সমান গতিতে চালিয়ে যেতেন। যখন রাজনীতিকরা কর্মীদের হাতে তুলে দেন অস্ত্র-বোমা ঠিক তখনই এ ব্যক্তিটি আমাদের তুলে দিয়েছেন বই। আজ ৫ মে মোশারেফ হোসেন শাজাহানের ষষ্ঠ মৃত্যুবার্ষিকী। তার মাগফিরাত কামনা করি এ দিনে। হ
লেখক : আইনজীবী, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট

 


আরো সংবাদ



premium cement