মুক্তিযুদ্ধের টার্নিং পয়েন্ট তেলিয়াপাড়া
- কর্নেল মোহাম্মদ আবদুল হক, পিএসসি (অব:)
- ১৮ এপ্রিল ২০২১, ০১:১৯
পাকিস্তানি শাসন-শোষণের নাগপাশ থেকে মুক্ত হয়ে স্বাধীন হওয়ার আকাক্সক্ষা তীব্র থেকে তীব্রতর হওয়া শুরু করল ৭ মার্চ বর্তমান সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঐতিহাসিক ভাষণের পর। রাজনৈতিক আন্দোলন যেমন এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছিলেন ছাত্র নেতৃবর্গ ও রাজনীতিবিদগণ, সামরিক প্রতিরোধ গড়ে তোলার জন্য পরিকল্পনা ও প্রস্তুতি বেগবান করে যাচ্ছিলেন অবসরপ্রাপ্ত সামরিক কর্মকর্তাগণ যার নেতৃত্বে ছিলেন জেনারেল মুহাম্মদ ইশফাকুল মজিদ ও কর্নেল মুহাম্মদ আতাউল গণি ওসমানী। তারা গোপনে বহু বৈঠক করে অবসরপ্রাপ্তদের ঐক্যবদ্ধ করতে শুরু করেছিলেন সশস্ত্র প্রতিরোধ গড়ে তোলার জন্য। জেনারেল মজিদ ও কর্নেল ওসমানী যখন বুঝতে পারলেন যে, মুজিবের সাথে ভুট্টো ও ইয়াহিয়া খানের বৈঠক কেবল পাকিস্তানিদের সামরিক প্রস্তুতি গ্রহণের জন্য সময় ক্ষেপণের পন্থা, ২৩ মার্চ জাতীয় মসজিদ বায়তুল মোকাররমের উত্তর প্লাজায় তারা অবসরপ্রাপ্তদের নিয়ে আয়োজন করলেন স্বাধীনতা অর্জনের জন্য বিশাল এক শপথগ্রহণ অনুষ্ঠানের। দু’জনের জ্বালাময়ী বক্তব্যে প্রাণচাঞ্চল্য সৃষ্টি হলো সবার মধ্যে। দেশ স্বাধীন করার দৃপ্ত শপথের পর তারা মার্চপাস্ট করে বঙ্গবন্ধুর বাসভবনে গিয়ে তার হাতে তুলে দিলেন স্বাধীনতার তরবারি। এরপর পাকিস্তানি গোয়েন্দাদের হাতে গ্রেফতার হলেন জেনারেল মজিদ। কোনো রকমে গ্রেফতার এড়িয়ে ২৫ মার্চ রাতে ওসমানী চলে গেলেন জিঞ্জিরায় এবং সেখান থেকে কুমিল্লা, ব্রাহ্মণবাড়িয়া হয়ে ভারতের আগরতলা।
২৫ মার্চ রাতে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী অতর্কিতে আক্রমণ চালায় নিরীহ জনগণের ওপর এবং শুরু করে গণহত্যা। এ সময় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের পাঁচটি ব্যাটালিয়নই পাকিস্তানের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করে। পাঁচটি ইউনিট পাঁচ স্থানে, যুদ্ধ তো এত সহজ বিষয় নয়। শক্তিশালী শত্রুর বিরুদ্ধে প্রতিরোধযুদ্ধ তো বিচ্ছিন্নভাবে চালিয়ে যাওয়া যায় না। সফল হওয়া বা শত্রুকে পরাজিত করার লক্ষ্যকে বাস্তবায়ন করার জন্য একক নেতৃত্বের অধীনে ঐক্যবদ্ধভাবে মোকাবেলা করা ভীষণ প্রয়োজন ছিল সে সময়ে। তদুপরি, যুদ্ধের ময়দানে তখন পাঁচটি ইউনিটের কমান্ডই ছিল মেজর ও ক্যাপ্টেনদের হাতে। জেনারেল ইশফাকুল মজিদ গ্রেফতার হওয়ার ফলে তখন সর্বজ্যেষ্ঠ সামরিক অফিসার ছিলেন কর্নেল ওসমানী। তিনি এবং অন্য সব অফিসার একটি কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব ও রাজনৈতিক সরকারের প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করে ৪ এপ্রিল একত্র হওয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন।
উল্লেখ্য, ২৫ মার্চের পর বঙ্গবন্ধু গ্রেফতার হওয়ার আগে থেকেই সব রাজনীতিবিদ দেশ ছেড়ে পালিয়ে যাওয়া শুরু করেছিলেন। পাকিস্তানিরা বঙ্গবন্ধুকে গ্রেফতার করার পর পুরো জাতিই নেতৃত্বশূন্য হয়ে এক মহা-অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়ে। এমনই এক পরিস্থিতিতে মহান আল্লাহর রহমত নাজিল হয় বাংলাদেশের ওপর।
২৫ মার্চের পর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিন ছিল ৪ এপ্রিল এবং ঐতিহাসিক গুরুত্বপূর্ণ স্থান ছিল তেলিয়াপাড়া। এটি ছিল মুক্তিযুদ্ধের টার্নিং পয়েন্ট। সিলেট জেলার হবিগঞ্জ মহকুমার মাধবপুর থানার অন্তর্গত ঢাকা-সিলেট মহাসড়ক কিংবা তেলিয়াপাড়া রেলস্টেশন থেকে প্রায় দুই কিলোমিটার অভ্যন্তরে ভারতীয় সীমান্ত ঘেঁষা স্থানে অবস্থিত তেলিয়াপাড়া চা-বাগানের ম্যানেজার বাংলো। এ বাংলোয় মুক্তিযুদ্ধের প্রথম বৈঠক বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের এক অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। এখানে উপস্থিত হন ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাসহ ২৭ জন বীর সেনানী, যারা ছিলেন স্বাধীনতা যুদ্ধের সংগঠক, অকুতোভয় সিপাহসালার।
২ এপ্রিল কর্নেল ওসমানী প্রথম সীমান্ত অতিক্রম করে আগরতলায় পৌঁছেন। চতুর্থ ইস্ট বেঙ্গলের অধিনায়ক মেজর খালেদ মোশাররফ তার সদর দফতর প্রথমে মাধবপুর ডাক বাংলোয় স্থাপন করেন। সেখান থেকে পূর্ব যোগাযোগের ভিত্তিতে সীমান্ত এলাকায় তেলিয়াপাড়া বিওপির কাছে, ভারতীয় বিএসএফের পূর্বাঞ্চলীয় মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার ভি সি পাণ্ডের সাথে তার সাক্ষাৎ ও মতবিনিময় হয়। উভয় পক্ষের আলোচনায় ৪ এপ্রিল তেলিয়াপাড়া চা বাগানে বিদ্রোহী সেনা কর্মকর্তাদের একটি সমন্বয় সভা অনুষ্ঠানের সিদ্ধান্ত হয়। তিনি বিভিন্ন স্থানে অবস্থানরত সেনা কর্মকর্তা ও ভারত সরকারের প্রতিনিধির সাথে যোগাযোগ করেন। আহ্বানে সাড়া দিয়ে প্রথমে দ্বিতীয় ইস্ট বেঙ্গলের অধিনায়ক মেজর কে এম সফিউল্লাহ ১ এপ্রিল তেলিয়াপাড়া এসে চতুর্থ বেঙ্গলের সাথে যৌথভাবে সদর দফতর স্থাপন করেন। ইতোমধ্যে তেলিয়াপাড়ায় কয়েকজন সেনা কর্মকর্তা সমবেত হন।
৪ এপ্রিল ঐতিহাসিক ওই বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন কর্নেল ওসমানী, লে. কর্নেল (অব:) এম এ রব, লে. কর্নেল সালাউদ্দীন মোহাম্মদ রেজা, মেজর জিয়াউর রহমান, মেজর কাজী মুহাম্মদ সফিউল্লাহ, মেজর খালেদ মোশাররফ, মেজর কাজী নুরুজ্জামান, মেজর নুরুল ইসলাম, মেজর শাফায়াত জামিল, মেজর মঈনুল হোসেন চৌধুরী, ক্যাপ্টেন এ এস এম নাসিম, ক্যাপ্টেন আব্দুল মতিন, ক্যাপ্টেন সুবিদ আলী ভুঁইয়া, লে. হেলাল মোর্শেদ খান, লে. নাসিরউদ্দিন, লে. মাহবুব, লে. আনিস, লে. সেলিম, লে. সৈয়দ মুহাম্মদ ইব্রাহিম প্রমুখ। এ ছাড়া ছিলেন ব্রাহ্মণবাড়িয়ার মহুকুমা প্রশাসক কাজী রকিব উদ্দিন আহমেদ। ভারত সরকারের প্রতিনিধি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন বিএসএফের পূর্বাঞ্চলীয় মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার ভি সি পাণ্ডে, ব্রিগেডিয়ার সুব্রামানিয়ম, কমান্ড্যান্ট মানিক চৌধুরী এবং আগরতলার জেলা ম্যাজিস্ট্রেট উমেশ সায়গল।
সভার কার্যক্রম শুরু হলে এর লক্ষ্য ও বিষয়বস্তু উপস্থাপন করেন চতুর্থ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের অধিনায়ক মেজর খালেদ মোশাররফ। ঐতিহাসিক এ সভায় সর্বসম্মতিক্রমে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়, যা ছিল নি¤œরূপ : ১. সভায় উপস্থিত সেনা কর্মকর্তারা সশস্ত্র প্রতিরোধ সংগ্রাম চালিয়ে যাওয়ার জন্য ব্রিগেডিয়ার পাণ্ডের কাছে অস্ত্রশস্ত্র, গোলাবারুদ এবং রেশন সরবরাহের আবেদন জানান। এ ব্যাপারে তিনি কেন্দ্রীয় সরকারের অনুমতি সাপেক্ষে সীমিত আকারে হালকা অস্ত্রশস্ত্র এবং গোলাবারুদ সরবরাহের আশ্বাস দেন। ২. মুক্তিকামী হাজার হাজার ছাত্র ও যুবকের সামরিক প্রশিক্ষণদানের লক্ষ্যে সীমান্তবর্তী ভারতীয় ভূখণ্ড ব্যবহারের বিষয়টি আলোচনায় আসে। এ ব্যাপারে সভায় উপস্থিত আগরতলার জেলা ম্যাজিস্ট্রেট সায়গল ভারতীয় ভূখণ্ডে মুক্তিবাহিনীর প্রশিক্ষণ কেন্দ্র এবং শরণার্থী শিবির স্থাপনের ব্যাপারে সর্বাত্মক সহযোগিতার আশ্বাস দেন। ৩. সভায় বিদ্রোহী বাহিনীর সদস্যদের একটি কমান্ড চ্যানেলে এনে সমম্বিত প্রতিরোধযুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ায় প্রয়োজনীয়তার কথা বলা হয়েছে। সর্বসম্মতিক্রমে বেঙ্গল রেজিমেন্টের প্রতিষ্ঠাতা কর্নেল ওসমানীকে সর্বাধিনায়কের দায়িত্ব দেয়া হয়। ৪. ব্রিগেডিয়ার পাণ্ডে বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী এলাকায় যুদ্ধরত বিদ্রোহী সেনা কর্মকর্তাদের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করে কোথায় কী ধরনের সশস্ত্র প্রতিরোধ সংগ্রাম চলছে, তা নিয়মিত মনিটরিং করার দায়িত্ব নেন। তিনি সীমান্তবর্তী বিএসএফের কর্মকর্তাদের, বিদ্রোহী বাহিনীকে সর্বাত্মক সহযোগিতা ও সাহায্য করার নির্দেশ দিবেন বলেও আশ্বাস দেন। ৫. উপস্থিত বিদ্রোহী সেনা কর্মকর্তারা এ দিনের কনফারেন্সে দেশটিকে চারটি সামরিক অঞ্চলে বিভক্ত করে প্রতিটি অঞ্চলের সশস্ত্র বিদ্রোহ চালিয়ে যাওয়ার জন্য একজন করে সেনা কর্মকর্তা নির্বাচিত করেছেন। ৬. বৃহত্তর চট্টগ্রাম,পার্বত্য চট্টগ্রাম ও নোয়াখালী জেলার পূর্বাঞ্চল নিয়ে গঠিত এলাকার দায়িত্ব দেয়া হয় মেজর জিয়াউর রহমানকে। বৃহত্তর কুমিল্লা, ঢাকা ও নোয়াখালী জেলার পশ্চিমাঞ্চল নিয়ে গঠিত অঞ্চলে সশস্ত্র প্রতিরোধ যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার জন্য দায়িত্ব দেয়া হয় মেজর খালেদ মোশাররফকে। বৃহত্তর সিলেট এবং ময়মনসিংহ জেলার পূর্বাঞ্চলে সশস্ত্র প্রতিরোধযুদ্ধ চালিয়ে নেয়ার দায়িত্ব দেয়া হয় মেজর সফিউল্লাহকে। বৃহত্তর কুষ্টিয়া, যশোর ও ফরিদপুর জেলা নিয়ে গঠিত অঞ্চলে সশস্ত্র প্রতিরোধ সংগ্রাম চালিয়ে নেয়ার দায়িত্ব দেয়া হয় মেজর আবু ওসমান চৌধুরীকে। ৭. চট্টগ্রাম বিদ্রোহে নেতৃত্বদানকারী মেজর জিয়াউর রহমানের সাহায্যার্থে ওই দিনই ক্যাপ্টেন মতিনের নেতৃত্বে ৪ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের ‘বি’ কোম্পানি এবং ক্যাপ্টেন এজাজের নেতৃত্বে ২ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের ‘সি’ কোম্পানি রামগড়ের উদ্দেশ্যে পাঠাবার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। ব্রিগেডিয়ার পাণ্ডে ওই রাতেই বিএসএফের গাড়ি দিয়ে এ দু’টি কোম্পানিকে ভারতীয় এলাকা হয়ে রামগড়ে পৌঁছানোর দায়িত্ব নেন। ৮. ওই সভায় বেঙ্গল রেজিমেন্ট, ইপিআর, পুলিশ ও আনসার বাহিনীর বাঙালি সেনাসদস্যদের বিদ্রোহকে আইনানুগ ও আন্তর্জাতিকভাবে গ্রহণযোগ্য করে তোলার জন্য সীমান্ত অতিক্রমকারী জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচিত গণপ্রতিনিধিদের নিয়ে একটি প্রবাসী বাংলাদেশ সরকার গঠনের প্রয়োজনীয়তার কথা তুলে ধরা হয়। বিষয়টি নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা হয়। কর্নেল ওসমানীকে এ ব্যাপারে রাজনৈতিক নেতাদের সাথে আলোচনা করার দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। ৯. সভায় সর্বসম্মতিক্রমে, কর্নেল এম এ জি ওসমানী একজন নির্বাচিত এমএনএ বিধায় তাকে শিগগিরই সীমান্ত অতিক্রমকারী অন্যান্য গণপ্রতিনিধির সঙ্গে যোগাযোগ করে একটি সরকার গঠনের উদ্যোগ নেয়ার দায়িত্ব দেয়া হয়। ভারতীয় বিএসএফ প্রধান রুস্তমজী, ব্রিগেডিয়ার ভি সি পাণ্ডে এবং আগরতলার জেলা ম্যাজিস্ট্রেট এ ব্যাপারে কর্নেল ওসমানীকে সর্বাত্মক সহযোগিতা করবেন বলে জানান। ১০. কনফারেন্সে আলোচ্য বিষয়গুলোর কার্যকারিতা পর্যালোচনার জন্য ১০ এপ্রিল একই স্থানে আরেকটি কনফারেন্স অনুষ্ঠানের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়।
এ সভা অনুষ্ঠিত হয়েছিল বাংলাদেশ সরকার গঠনের আগে। তাই নিকট অতীতে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার উদাহরণ বিশ্লেষণ করে লিখিত আকারে সভার কোনো সিদ্ধান্ত সংরক্ষণ করা হয়নি। মৌখিকভাবে বাহিনীর সংগঠন, নেতৃত্ব ও যুদ্ধ পরিচালনার যেসব সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছিল, তা পরবর্তী সময়ে গঠিত বাংলাদেশ সরকারের অনুমোদন পায়। ১১ এপ্রিল নবগঠিত বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের বেতার ভাষণে এই সভার সিদ্ধান্তের কিছু অংশ উচ্চারিত হয়েছিল। পরে এই সভার সিদ্ধান্তগুলোকে পরিবর্ধন, পরিমার্জন, সংশোধন, সংযোজনের মাধ্যমে আরো সময়োপযোগী করে তোলা হয়। এ সভা আমাদের বাহিনীকে সাংগঠনিক ধারণা দেয় এবং তা ‘মুক্তিবাহিনী’ পরিচয়ে আত্মপ্রকাশ করে।
ওই বৈঠক শেষে মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক আতাউল গণি ওসমানী নিজের পিস্তল থেকে ফাঁকা গুলি ছুড়ে আনুষ্ঠানিকভাবে পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেন। দেশকে স্বাধীন করার শপথবাক্যও সবাইকে পাঠ করান তিনি। এই সভাতেই বাংলাদেশের একটি রাজনৈতিক সরকার গঠনের ওপর সর্বাধিক গুরুত্ব আরোপ করা হয়। ১৯৭১ সালের ২১ জুনের পরে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর প্রচণ্ড আক্রমণের কারণে তেলিয়াপাড়া চা বাগানে স্থাপিত সেক্টর হেড কোয়ার্টার সরিয়ে নেয়া হয়।
৪ এপ্রিল অনুষ্ঠিত সভার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, ১০ এপ্রিল তেলিয়াপাড়ায় দ্বিতীয় সেনা বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। প্রথম সভায় উপস্থিত প্রায় সবাই এ সভায় উপস্থিত ছিলেন। এ সভাটি প্রথম সভার সিদ্ধান্ত মূল্যায়নের জন্য প্রয়োজনীয় ছিল। ওই সভার সিদ্ধান্ত ছিল :
সভার শুরুতেই কর্নেল এম এ জি ওসমানী গণপ্রতিনিধিদের নিয়ে সরকার গঠনের ব্যাপারে জানান, বিষয়টি নিয়ে সীমান্ত অতিক্রমকারী বেশ কিছুসংখ্যক এমএনএ এবং এমপিএ-এর সঙ্গে আলোচনা হয়েছে। অধিকাংশ গণপ্রতিনিধিই বিষয়টির গুরুত্ব অনুধাবন করতে পেরেছেন। জনাব তাজউদ্দীন আহমদ শিগগিরই একটি বাংলাদেশ সরকার গঠনের ঘোষণা দিবেন বলে তাকে আশ্বস্ত করেছেন।
বিক্ষিপ্ত সশস্ত্র প্রতিরোধ যুদ্ধটিকে সমম্বিত অ্যাকশনে রূপ দেয়া এবং কমান্ড চ্যানেলে আনার লক্ষ্যে এ দিন পুরো দেশটিকে ৪টির স্থলে ৬টি সামরিক অঞ্চলে বিভক্ত করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। নতুন দু’টি সামরিক অঞ্চলের মধ্যে বৃহত্তর রংপুর ও দিনাজপুর জেলার অংশবিশেষ নিয়ে গঠিত অঞ্চলের যুদ্ধ পরিচালনার দায়িত্ব দেয়া হয় ক্যাপ্টেন নওয়াজেশ উদ্দিনকে। বৃহত্তর রাজশাহী, পাবনা ও বগুড়া জেলা নিয়ে গঠিত অঞ্চলের সশস্ত্র প্রতিরোধযুদ্ধ চালিয়ে নেয়ার দায়িত্ব দেয়া হয় মেজর নাজমুল হককে। ৬টি অঞ্চলের কমান্ডারদেরকে তাদের নিজ নিজ এলাকার বিদ্রোহী বাহিনীর সদস্যদেরকে একটি কমান্ড চ্যানেলে এনে সমম্বিত অ্যাকশনে যাওয়ার সিদ্ধান্ত দেয়া হয়।
বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষে বিশ্বজনমত সৃষ্টির ব্যাপারটিও ওই দিনের আলোচনায় ছিল। এ ব্যাপারে ভারতীয় প্রচার মাধ্যমগুলো সক্রিয় ভূমিকা পালন করবে বলে আশ্বাস দেয়া হয়।
চরম দুর্দশাগ্রস্ত দেশের ক্রান্তিকালে তেলিয়াপাড়া চা-বাগানে অনুষ্ঠিত সেই সভা দু’টি কেবল বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের ইতিহাসে কেবল সেনাবাহিনীর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের প্রথম সমন্বয় সভাই নয়, বরং মহান মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীন বাংলাদেশ সরকারের আনুষ্ঠানিক ভিত রচনার ক্ষেত্রে প্রথম মাইলফলক হিসেবেও স্মরণীয় হয়ে থাকবে। তরুণ সেনা অফিসারদের অত্যন্ত দূরদর্শী ও ত্বরিত সিদ্ধান্ত দেশকে স্বাধীন করার জন্য নিঃসন্দেহে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। তাই তেলিয়াপাড়া চা-বাগান মুক্তিযুদ্ধের সাক্ষী ও টার্নিং পয়েন্ট হিসেবে চির উজ্জ্বল করবে ইতিহাসের পাতাকে।
সে দিন যদি জেনারেল ওসমানীর নেতৃত্বে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর দুর্ধর্ষ, দুঃসাহসী, নির্ভীক, নিখাদ দেশপ্রেমিক তরুণ বাঙালি অফিসাররা সম্মিলিত হয়ে তেলিয়াপাড়া চা-বাগানে বৈঠক করতে না পারতেন, তাহলে মুক্তিযুদ্ধের পুরো নেতৃত্ব হয়তো ইন্ডিয়ান আর্মির হাতে চলে যেত বলেই অনেকের বিশ্বাস এবং ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট ছাড়া পাকিস্তানি বাহিনীকে পর্যুদস্ত করা এত সহজসাধ্য কখনো হতো না। দীর্ঘ সময়ের যুদ্ধে এক সময় ধৈর্যহারা হয়ে যেকোনো পক্ষ রণেভঙ্গ হয়ে পিছপা হতো এবং জাতি হিসেবে আমরা তখন কোন অবস্থায় থাকতাম তা মহান সৃষ্টিকর্তাই ভালো জানেন। হ
লেখক : সামরিক ও নিরাপত্তা বিশ্লেষক
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা