২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০, ১৭ রমজান ১৪৪৫
`

বাংলা সনের সার্বজনীনতা

-

বাংলা ভাষার গৌরবের মতোই বাংলার সাংস্কৃতিক অহঙ্কার হলো বাংলা সন। তবে হিজরি থেকে উৎসারিত হয়েছে বাংলা সন। হজরত ওমর রা: ৬৩৯ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে হিজরি সনের প্রবর্তন করেন। বছরটি ছিল ১৭ হিজরি। হিজরি সনের গণনা করা হয় চাঁদের হিসাবে আর বাংলা সন গণনা করা হয় সৌর হিসেবে। চন্দ্র বা চাঁদের হিসাবে ৩৫৪ দিন আর আর সৌর হিসাবে ৩৬৫ দিন। আজ থেকে ৪৩৭ বছর আগে মুঘল সম্রাট আকবর পয়লা বৈশাখ প্রবর্তনের মাধ্যমে বাংলা সনের সূচনা করেন। ইংরেজি ১৫৮৪ সালে পয়লা বৈশাখকে বাংলা সনের প্রথম দিন নির্ধারণ করে বঙ্গাব্দের প্রবর্তন করা হলেও তার কার্যকারিতা দেখানো হয় ইংরেজি ১৫৫৬ সালের ১১ মার্চ থেকে অর্থাৎ সম্রাটের সিংহাসন আরোহণের সময় থেকে। সেই হিসাবে ৪৬৫ বছর আগে ৯৬৩ হিজরিতে ৩৫৪ দিনের গণনায় এনে সম্রাট আকবর নতুন বাংলা সন প্রবর্তন করেন। উল্লেখ্য, আকবরের রাজত্বকাল ছিল ১৫৫৬-১৬০৫ সাল পর্যন্ত।
সন আরবি শব্দ। অর্থ হলো অব্দ বা বর্ষ বা বর্ষপুঞ্জ। আবার সনকে সাল বলা হয়। সাল ফার্সি শব্দ। সম্রাট আকবরের রাজত্বকালে কৃষকদের কাছ থেকে রাজস্ব বা খাজনা আদায়ের সুবিধার্থে হিজরি সনকে ৯৬৩ হিজরিতে ৩৫৩ দিনের স্থলে ৩৬৫ দিন গণনায় এনে নতুন একটি সন প্রবর্তন করা হয়, এটাই বাংলা সন। হিজরি সন হলো চান্দ্র সন। চাঁদ দেখে গণনার ওপর এ সনের ভিত্তি। বাংলা সৌর সন। সৌর সনে দিনক্ষণ গণনা করা সহজ এবং এর একটি নির্দিষ্ট ভিত্তি আছে। সম্রাট আকবরের অর্থ বিভাগের উপদেষ্টা টোডরমলের সহকারী আমির ফতেউল্লাহ সিরাজী বাংলা মাসের নামগুলো নক্ষত্রের নাম থেকে নিয়ে সৌর মাসের দিন মিলিয়ে বাংলা সন প্রবর্তন করেন। সম্রাট আকবরের দরবারে বিখ্যাত ‘নবরতœ সভার’ বাইরেও অনেক মেধাবী পণ্ডিত ছিলেন, যার মধ্যে অন্যতম আমির ফতেউল্লাহ সিরাজী। তাকেই দায়িত্ব দেয়া হয় নতুন বর্ষপঞ্জি প্রণয়নের।
সূত্রে মতে, ১৫৫৬ সালের ১১ এপ্রিলকে পয়লা বৈশাখ ধরে ‘ফসলি’ সন হিসাবে বাংলা নববর্ষের সঙ্গে সম্রাট আকবরের সিংহাসন আরোহণের ঘটনা স্মরণীয় হয়ে আছে। সম্রাট আকবর বাংলাসহ বেশ কয়েকটি প্রদেশ থেকে খাজনা আদায়ের সুবিধার্থে কতিপয় ‘ফসলি সাল’ প্রবর্তন করেন। বাংলা বর্ষ সম্রাট আকবর প্রবর্তিত সেই সব ফসলি সালের একটি। সেই সময় থেকে এ দেশের মানুষ চাষাবাদ, খাজনা পরিশোধ, সংবছরের হিসাব-নিকাশ সব কিছুতেই বাংলা বর্ষপঞ্জি অনুসরণ করে থাকে, যেটা মুঘল শাসন আমল সম্রাট বাবর থেকে শুরু করে বাহাদুর শাহ জাফর পর্যন্ত বিস্তৃত। তারপর পট-পরিবর্তনের পালায় ব্রিটিশ আমল ও পাকিস্তান আমল পার হয়ে বাংলাদেশ আমল পর্যন্ত অব্যাহত রয়েছে বাংলা সন। সম্রাট আকবর দিল্লির সিংহাসনে অধিষ্ঠিত হন ১৫৫৬ সালে। ২৯ বছর রাজত্ব করার পর তিনি পঞ্জিকা ও বর্ষপঞ্জি সংস্কারের উদ্যোগ নেন।
বাংলা নর্ববষের প্রথম দিনটি বাঙালির জীবনে একটি প্রধান উৎসবের দিন হিসেবেই পালিত হয়ে থাকে। প্রতিটি জাতি-গোষ্ঠীর নিজস্ব ধর্মীয় অনুষ্ঠান থাকলেও একমাত্র পয়লা বৈশাখ অনুষ্ঠানটিই বাঙালির অসাম্প্রদায়িক একটি আনন্দ অনুষ্ঠান, যা জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে সব মানুষ পালন করে থাকে। আর তাই পয়লা বৈশাখ হয়ে ওঠে প্রাণের উৎসব। বর্ষ পরিক্রমায় পুরাতন বছর বিদায় নেয় তার গ্লানি আর জীর্ণতা নিয়ে। আগমন ঘটে সম্ভবনাময় নতুন বছরের। নববর্ষের সোনাঝরা সুপ্রভাত নিয়ে আসছে বাংলা আরো একটি নতুন বছর ১৪২৮ সন।
বাংলা সনের ইতিহাস ঘটনাবহুল। চান্দ্র মাসের হেরফেরের কারণে ফসল কাটায় বিলম্ব ঘটত আর সেই বিলম্ব থেকে খাজনা আদায়ের সমস্যা হতো। সেই সমস্যা সমাধানের লক্ষ্যে বাংলা সনের প্রবর্তন। ইতিহাস থেকে জানা যায়, বাঙালিদের বঙ্গ অঞ্চলের সরকারি খাজনা আদায়ের সুবিধার জন্যই আকবরের সময় বাংলা সন বা বঙ্গাব্দ প্রবর্তন করা হয়। জানার বিষয় হলো রাসূল সা:- এর হিজরতের সময় থেকেই বাংলা সনের গণনা ধরা হয়। তবে বাংলা সনের গণনা সম্রাট আকবরের দিল্লির সিংহাসন আরোহণ করার দিন থেকে শুরু হলেও এটা সত্য যে, হিজরি সনই হলো বঙ্গাব্দের মূল ভিত্তি। মহানবী হজরত মুহাম্মদ সা:-এর ইন্তেকালের পর ইসলামের দ্বিতীয় খলিফা হজরত ওমর রা:-এর সময়কালে হজরত আলী রা:-এর প্রস্তাবে মহানবী সা:-এর হিজরতের দিন থেকে হিজরি সন গণনা শুরু হয়। সেটি ছিল ৬২২ সালের ১৬ জুলাই। খ্রিস্টাব্দ যেমন এসেছে হজরত ঈসা আ: তথা যিশুখ্রিষ্টের জন্মের সময় থেকে, তেমনি হিজরি সন গণনা শুরু হয়েছে নবী মুহাম্মদ সা:-এর জন্মের পর থেকে আর হিজরি সন থেকেই সূচনা হয় বাংলা সনের। এর আগে বঙ্গে প্রচলিত শকাব্দ বা শক বর্ষপঞ্জির প্রথম মাস ছিল চৈত্র মাস। কিন্তু ৯৬৩ হিজরি সনের মহরম মাস ছিল বাংলা বৈশাখ মাস। এ জন্য বৈশাখ মাসকেই বঙ্গাব্দ বা বাংলা বর্ষপঞ্জির প্রথম মাস এবং পয়লা বৈশাখকে নববর্ষ ধরা হয়।
বাংলা সনের ইতিহাস বর্তমান প্রজন্মকে জানাতে হবে। বাংলা সাল নিজস্ব সাল। আর প্রতি মাসের নাম যেন নিজস্ব নাম। বাংলা নববর্ষের প্রথম পয়লা বৈশাখ শুধু একটি তারিখ নয়। ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে বাঙালির বিশাল উপলক্ষ, যা অত্যন্ত গর্বের। প্রাণের এই সাংস্কৃতিক উৎসবে মিশে আছে বাংলার মানুষের হাজারো ইতিহাস, ঐহিত্য ও সংস্কৃতি। বৈশাখ আমাদের সম্প্রীতির বন্ধন। বৈশাখ থেকে আমরা শিখতে পারি একটি সুস্থ সংস্কৃতি চর্চা।
বাংলা সনের বয়স আজ ৪৬৫ বছর। বঙ্গাব্দ/নববর্ষ এখন জাতীয় উৎসব ও বাঙালির সবচেয়ে বড় সাংস্কৃতিক মিলনমেলা। নববর্ষ উদযাপনের রীতিও অনেক প্রাচীন। সেকালের প্রাচীন মানুষ নববর্ষে দিন-ক্ষণ-লগ্নি ঠিক করত সূর্যের উত্তরায়ণে ও দক্ষিণায়নে ঋতু পরিবর্তন দেখে। তাই বলা হয়, নববর্ষ ঋতুভিত্তিক বা আর্তব উৎসব। বাংলা ভাষার মতো বাংলা বর্ষগণনা পদ্ধতি বাঙালির হাজার বছরের ঐতিহ্য লালিত সংস্কৃতির এক গুরুত্বপূর্ণ অবিচ্ছেদ্য অংশ। নতুন বাংলা সনের প্রবর্তনের আগে এ অঞ্চলে বিভিন্ন নামে বিভিন্ন ভাবে বর্ষ গণনার প্রচলন ছিল। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল- মল্লাব্দ, শকাব্দ, বিক্রমাব্দ, হর্ষব্দ, বুদ্ধাব্দ, পালাব্দ, চৈতন্যাব্দ, গুপ্তাব্দ, নশরত শাহী সন, শালিবাহন সন, জালালী সন, সেকান্দর সন, ভাতর সন ইত্যাদি। তখনকার প্রচলিত সনগুলোর বেশির ভাগই গণনা করা হতো চান্দ্র মাসের হিসাবে অনুযায়ী।
সময়ের গতিময় নিজস্বতা ভুলে আমরা যতই বিশ^জনীন হয়ে উঠি না কেন, আমাদের অস্তিত্বে প্রেরণাজুড়ে বৈশাখের প্রথম দিনটিই যেন ছড়িয়ে দেয় লাল আভা। নববর্ষের পয়লা বৈশাখ বাঙালির আকাশে এক নতুন সূর্যোদয়। বাঙালি জাতির জীবনে এক মহা আনন্দের দিন। পয়লা বৈশাখ থেকে শুরু হয় আরেকটি নতুন বছরের শুভ সূচনা, নতুনভাবে পথচলা, নতুনের আবাহন। বাঙালি জাতীয়তাবাদ সমুন্নত রাখার ক্ষেত্রে বাংলা নববর্ষের ভূমিকা অনস্বীকার্য ও অপরিহার্য। অসাম্প্রদায়িক চেতনাবোধে উজ্জ্বীবিত এ মিলনমেলা। বাঙালি সংস্কৃতির প্রাণকেন্দ্র স্বরূপ। সার্বজনীনতার ক্ষেত্রে এর কোনো তুলনা নেই। যেটা আমাদের ঐক্যসূত্রে গাঁথার এক মূলমন্ত্র। বাংলা নববর্ষ আমাদের জাতীয় সত্তার প্রতীক ও ইতিহাস ঐতিহ্যমণ্ডিত। বাঙালির সংস্কৃতির স্বতন্ত্র বিকাশে একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ দিন এই বাংলা নববর্ষ। পয়লা বৈশাখ বাঙালির ইতিহাস ও চিরায়ত ঐতিহ্য, প্রত্যাশার একটি রেখাচিত্র। ১৪২৮ নববর্ষে সবার জীবন আনন্দময় হয়ে উঠুক সেই প্রত্যাশা। হ
লেখক : সাবেক অধ্যক্ষ, কলারোয়া সরকারি কলেজ, সাতক্ষীরা


আরো সংবাদ



premium cement
ঢাবির কলা, আইন ও সামাজিক বিজ্ঞান ইউনিটে প্রথম হয়েছেন যারা স্বাস্থ্যমন্ত্রীর আশ্বাসে আন্দোলন স্থগিত ইন্টার্ন চিকিৎসকদের নিজ দেশে ৫ বছর পর ফিরল দিপক চট্টগ্রামে ৬ কিশোর গ্যাংয়ের ৩৩ সদস্য আটক শ্রমিকদের অধিকার আদায়ের জন্য সংগঠন মজবুত করতে হবে : শামসুল ইসলাম ইউরো ২০২৪’কে সামনে রেখে দল নির্বাচনে বিপাকে সাউথগেট ভারতীয় পণ্য বর্জনকে যে কারণে ন্যায়সঙ্গত বললেন রিজভী মাকে ভরণ-পোষণ না দেয়ায় শিক্ষক ছেলে গ্রেফতার প্রথম বাংলাদেশী আম্পায়ার হিসেবে আইসিসির এলিট প্যানেলে সৈকত ঢাবির সব ইউনিটের ভর্তি পরীক্ষার ফল প্রকাশ নিরাপত্তা-বিষয়ক আলোচনা করতে উত্তর কোরিয়ায় রুশ গোয়েন্দা প্রধান

সকল