২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫
`

ধর্মানুভূতিতে আঘাত করে নাস্তিকতা নয়

সুশাসন
-

নাস্তিক শব্দটির বিপরীত শব্দ হলো আস্তিক। সৃষ্টিকর্তার অস্তিত্বে অবিশ্বাসীদের বলা হয় নাস্তিক। আর সৃষ্টিকর্তা, মৃত্যুর পর জীবন ও ধর্মগ্রন্থের প্রতি বিশ্বাসীদের বলা হয় আস্তিক। নাস্তিকরা নিজেদের পণ্ডিত ও জ্ঞানী ভেবে থাকেন। বস্তুত তাদের জ্ঞান অশিক্ষিতদের জানার চেয়েও সীমিত। অশিক্ষিত বলতে অক্ষরজ্ঞানবিহীন অথবা আনুষ্ঠানিক শিক্ষালাভ করেননি এমন ব্যক্তিকে বোঝায়। একজন অশিক্ষিত তার সহজাত জ্ঞান দিয়ে স্রষ্টার অস্তিত্ব খুঁজে পান। একজন স্বাভাবিক জ্ঞানসম্পন্ন ব্যক্তির নাস্তিক হওয়ার কোনো সুযোগ নেই। স্বাভাবিক জ্ঞানসম্পন্ন ব্যক্তি জ্ঞানের সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও উপলব্ধি করতে সক্ষম যে, এ পৃথিবীতে তার আগমন নিছক উদ্দেশ্যবিহীন নয়।
পৃথিবী নামক গ্রহটি সৌরজগতের অন্তর্ভুক্ত। সূর্য নামক নক্ষত্রকে পৃথিবী ও অপর কিছু গ্রহ নির্ধারিত নিয়ম-শৃঙ্খলার মধ্য দিয়ে আবর্তন করছে। আবার পৃথিবীকে আবর্তন করছে চাঁদ নামক উপগ্রহটি। সৌরজগতের অপর অনেক গ্রহের এক বা একাধিক উপগ্রহ রয়েছে। পৃথিবীর ভূমি, পানি, নদী-নালা, খাল-বিল, পাহাড়-পর্বত, ঝড়-বৃষ্টি, বন্যা-প্লাবন, আলো-বাতাস, দিবা-রাত্রি, গাছপালা, তরুলতা, জীবজন্তু সব কিছু নিয়মনীতি পালন করে নিজ নিজ অবস্থান থেকে নিজ নিজ দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছে। যেমন- পৃথিবী নিজ অক্ষের ওপর আবর্তিত হচ্ছে এবং নির্দিষ্ট কক্ষপথে সূর্যকে আবর্তন করছে। পৃথিবীর নিজ অক্ষের আবর্তনের ফলে দিবা-রাত্রি ও জোয়ারভাটা হয়; অপর দিকে কক্ষপথে সূর্যকে আবর্তনের কারণে ঋতু পরিবর্তন ও দিবা-রাত্রির হ্রাস-বৃদ্ধি ঘটে। পৃথিবীতে মানুষের জীবনধারণের জন্য অপরিহার্য পানির তিনটি রূপ রয়েছে। কঠিন, তরল ও বায়বীয়। সূর্যের তাপে পানি বায়বীয় রূপ ধারণ করে মেঘে পরিণত হচ্ছে। মেঘ আবার বৃষ্টি হয়ে পৃথিবীর গাছপালা ও তরুলতাকে সজীব করে তুলছে। বায়বীয় পানি পাহাড়ের চূড়ায় বরফ হয়ে কঠিন আকার ধারণ করছে। সূর্যের তাপে গলে নদী দিয়ে প্রবাহিত হয়ে পৃথিবীর বর্জ্য সাগরে নিয়ে ফেলছে। পৃথিবীর বর্জ্য সাগরে পড়ার পরক্ষণেই সাগরের পানির লবণাক্ততার কারণে দূষণমুক্ত হচ্ছে। পৃথিবীতে বসবাসরত মানুষসহ সব জীবজন্তুর জীবনধারণের জন্য অক্সিজেন অপরিহার্য। মানুষসহ সব জীবজন্তু অক্সিজেন গ্রহণ করছে এবং কার্বনডাই অক্সাইড নিঃসরণ করছে। অপর দিকে গাছপালা ও তরুলতা কার্বনডাই অক্সাইড গ্রহণ করছে ও অক্সিজেন নিঃসরণ করছে। পৃথিবী ও বিশ্বজগতের সব কিছু মানুষের কল্যাণে একজন সৃষ্টিকর্তা এককভাবে সৃষ্টি করেছেন। এ কারণেই পৃথিবী ও বিশ্বজগতের সব কিছু নিয়মনীতি ও শৃঙ্খলার মাধ্যমে পরিচালিত হচ্ছে। সৃষ্টিকর্তা দু’জন হলে পৃথিবী ও বিশ্বজগতের নিয়মনীতি ও শৃঙ্খলা কি ধরে রাখা যেত? এক সৃষ্টিকর্তা এককভাবে পৃথিবী ও বিশ্বজগতের সব কিছু সুশৃঙ্খলভাবে নিয়ন্ত্রণের কারণেই মানুষের জীবনধারণের উপযোগী অক্সিজেন ও বিশুদ্ধ পানির অফুরন্ত ভাণ্ডার নিঃশেষিত হচ্ছে না। সৃষ্টিকর্তার নির্ধারিত নিয়মে পৃথিবী সৃষ্টির শুরু থেকে দূষিত পানি বিশুদ্ধ হচ্ছে এবং পৃথিবীতে অক্সিজেন ও কার্বনডাই অক্সাইডের ভারসাম্য রক্ষিত হচ্ছে। প্রকৃতির দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ করলে দেখা যায়, পৃথিবীর কোনো কিছুই অপ্রয়োজনীয় নয়। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়Ñ সরীসৃপ জাতীয় প্রাণী সাপ বছরে একবার খোলস পাল্টায়। খোলসটি পরিবর্তনের পর পরিত্যক্ত আবরণটি সাপের কাছে অপ্রয়োজনীয়। কিন্তু দেখা যায়, ক্ষুদ্র প্রাণী পিঁপিলিকা খোলসটির বিভিন্ন খণ্ড দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে নিজ গৃহে নিয়ে ভবিষ্যতের খাদ্য হিসেবে মজুদ করছে। মানুষ ও বিভিন্ন জীবজন্তু প্রকৃতির ডাকে সাড়া দিয়ে প্রাত্যহিক যে বর্জ্য পরিত্যাগ করছে; তাতে দেখা যায় পোকামাকড়সহ অসংখ্য জলজ ও স্থলজ প্রাণীর জীবন ধারণের উপকরণ রয়েছে। এমন হাজারও উদাহরণ রয়েছে। কিন্তু নিবন্ধের ব্যাপ্তি বিবেচনায় উপরোল্লিখিত দু’টি উদাহরণকে আপাতত প্রাসঙ্গিক মনে হয়েছে।
আমাদের সংবিধানে প্রতিটি নাগরিককে আইন, জনশৃঙ্খলা ও নৈতিকতা সাপেক্ষে যে কোনো ধর্ম অবলম্বন, পালন বা প্রচারের অধিকার দেয়া হয়েছে। এ অধিকার একজন নাগরিকের কোনো ধর্ম পালন না করার অধিকার খর্ব করে না। আমাদের মূল দণ্ড আইন দণ্ডবিধিতে যে কোনো ধর্মাবলম্বীর ধর্ম বা ধর্মীয় বিশ্বাসকে অবমাননা বা ইচ্ছাকৃতভাবে ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত শাস্তিযোগ্য অপরাধ হিসেবে স্বীকৃত। তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি আইন অনুযায়ী ইন্টারনেট ও কম্পিউটার প্রযুক্তির মাধ্যমে ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দণ্ডনীয় অপরাধ।
প্রয়াত বরেণ্য জনৈক কবি ও সাহিত্যিকের সাহিত্যের বিভিন্ন ক্ষেত্রে বিচরণের জন্য যখন কিছু গণমাধ্যম ও ব্যক্তি তাকে সব্যসাচী অভিহিত করে বিভিন্ন সংবাদমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সংবাদ প্রকাশে ব্রতী হয়; তখন সমভাবে তার নাস্তিকতার প্রসঙ্গটিও আলোচনায় আসে।
আমাদের দেশের ৯০ ভাগের বেশি লোক ইসলাম ধর্মাবলম্বী এবং ঐতিহাসিকভাবে আমাদের দেশের জনমানুষ ধর্মপ্রবণ। বাঙালি জাতির অন্যতম শ্রেষ্ঠ কবি কাজী নজরুল ইসলাম তার রচিত একটি গানে ব্যক্ত করেন- ‘মসজিদেরই পাশে আমার কবর দিও ভাই/ যেন গোরে থেকেও মুয়াজ্জিনের আযান শুনতে পাই’। তার গানের মধ্যে সন্নিবেশিত এ বাক্যে ধর্মের প্রতি তার প্রগাঢ় বিশ্বাসের অভিব্যক্তি ফুটে উঠেছে। তিনি আমাদের জাতীয় কবি এবং তার মৃত্যু পরবর্তী এ দেশের মানুষ তার রচিত গানে ব্যক্ত আকাক্সক্ষা পূরণে তাকে দেশের শ্রেষ্ঠ বিদ্যাপীঠ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় মসজিদ প্রাঙ্গণে সমাধিস্থ করেন। আমাদের জাতীয় কবির মনোবাঞ্ছা ও আকাক্সক্ষার বিপরীত বক্তব্য একাধিক কবি সাহিত্যিক তাদের রচনায় তুলে ধরেছেন যা আপামর দেশবাসীর বিশ্বাসে আঘাত হানার শামিল। বাক-স্বাধীনতার কথা বলে এসব ধর্মবিরোধী বক্তব্য গ্রহণযোগ্য হতে পারে না।
একজন মুসলমানকে পাঁচটি বিষয়Ñ ঈমান, রোজা, নামাজ, হজ ও জাকাত এর উপর বিশ্বাস স্থাপন করতে হয়। একজন প্রাপ্ত বয়স্ক মুসলিমের জন্য দিনে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়া ফরজ। এ পাঁচ ওয়াক্ত নামাজের জন্য মুসলমানদের উপাসনালয় মসজিদ হতে প্রতিদিন পাঁচবার আজানের মাধ্যমে আহ্বান করা হয়। ধর্মপ্রাণ যেকোনো মুসলিমের কাছে আজানের ধ্বনি অতি মধুর। আর তাই দেখা যায়, সভা বা যেকোনো অনুষ্ঠান চলাকালীন আজানের ধ্বনি শোনা গেলে আজান শেষ না হওয়া পর্যন্ত সভা বা অনুষ্ঠানের কাজ সাময়িক বন্ধ রাখা হয়। মহিলাদের দেখা যায় আজানের বাণীর প্রতি সম্মানের বহিঃপ্রকাশে মাথা উন্মুক্ত থাকলে তা শাড়ির আঁচল বা ওড়না দিয়ে আবৃত করে নেয়।
আজানের ধ্বনি যে এ দেশের জনমানুষের কাছে সুমধুর এরই বহিঃপ্রকাশ আমরা দেখতে পাই বাংলা সাহিত্যের অপর খ্যাতিমান মহা কবি কায়কোবাদ রচিত ‘আযান’ কবিতায়। কবিতাটিতে তিনি বলেন, ‘কে ওই শোনাল মোরে আযানের ধ্বনি, মর্মে মর্মে সেই সুর, বাজিল কি সুমধুর, আকুল হইল প্রাণ, নাচিল ধমনি, কি মধুর আযানের ধ্বনি।’
প্রয়াত বরেণ্য কবি ও সাহিত্যিকের কাছে আজানের মধুর ধ্বনি উপদ্রব ঠেকলেও কাকের কা কা শব্দ উপদ্রব নয়। অথচ কাকের কা কা শব্দকে উপদ্রব মনে করে না এমন লোক এ দেশে বিরল। প্রয়াত কবির দৃষ্টিভঙ্গি একদিকে তার মানসিকতার পরিচায়ক অপরদিকে এ দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনমানুষের ধর্মানুভূতির ব্যাপারে নেতিবাচক। তার কাব্য নাট্যে উল্লিখিত বাক্যটি আমাদের দণ্ডবিধি অনুযায়ী শাস্তিযোগ্য অপরাধ এবং তার জীবদ্দশায় এ বিষয়ে মামলা হলে সাজা এড়ানোর কোনো সুযোগ ছিল না। যেহেতু একজন অপরাধীর মৃত্যুর সাথে সাথে তার অপরাধেরও মৃত্যু হয় সেহেতু কবিতার মধ্যে ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করে এমন বাক্যের উল্লেখ থাকায় ব্যক্তি হিসেবে তার অপরাধের মৃত্যু ঘটলেও কবিতাটিতে বাক্যটির অবস্থান অপরাধটিকে বাঁচিয়ে রেখেছে। এ বিষয়ে ব্যবস্থা নেয়া জরুরি বিবেচনা করি।
নাস্তিক দুই ধরনের। এর একটি নাস্তিকতার বহিঃপ্রকাশে কখনো কোনো ধরনের অবমাননাকর ও আপত্তিকর বাক্য ব্যবহার করে না। আর অপরটি নিজেদের মহাজ্ঞানী হিসেবে প্রতিষ্ঠার অপচেষ্টায় অপরের ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত হেনে এমন অবমাননাকর ও আপক্তিকর বক্তব্যের প্রকাশ ঘটায় যা প্রকৃতপক্ষে ইচ্ছাকৃত বা বিদ্বেষপূর্ণভাবে কটাক্ষের নামান্তর। একজন আস্তিকের মধ্যে নৈতিকতা, নীতিজ্ঞান ও মূল্যবোধ প্রবল। পক্ষান্তরে একজন নাস্তিকের মধ্যে নৈতিকতা, নীতিজ্ঞান ও মূল্যবোধ শিথিল। এ শিথিলতার কারণে অতিসহজেই তাদের অনেকে বিচ্যুত হয়ে পড়েন। আমাদের দেশে সে বিচ্যুতি আমরা প্রয়াত বরেণ্য কবি ও সাহিত্যিকসহ আরো কিছুর মধ্যে দেখে আসছি। হ
লেখক : সাবেক জজ, সংবিধান, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক বিশ্লেষক
E-mail : iktederahmed@yahoo.com


আরো সংবাদ



premium cement
সকল কাজের জন্য আল্লাহর কাছে জবাবদিহিতার অনুভূতি থাকতে হবে : মাওলানা হালিম বিএনপি জনগণের ভাগ্য পরিবর্তনের জন্য রাজনীতি করে : ড. মঈন খান সাজেকে পাহাড়ি খাদে পড়ে মাহিন্দ্রচালক নিহত জমি রেজিস্ট্রি করে না দেয়ায় বাবার কবরে শুয়ে ছেলের প্রতিবাদ ইসরাইলি হামলায় গাজায় আরো ৭১ জন নিহত পানছড়ি উপজেলায় চলমান বাজার বয়কট স্থগিত ঘোষণা আওয়ামী লীগ দেশের স্বাধীনতাকে বিপন্ন করেছে : দুদু যুক্তরাষ্ট্র টি-টোয়েন্টি দলে নিউজিল্যান্ডের এন্ডারসন লড়াই ছাড়া পথ নেই : নোমান জার্মানির অর্থ যেভাবে সিরিয়ায় যুদ্ধাপরাধে ব্যবহার হচ্ছে জার্মানিতে নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত মোশাররফ হোসেনের মেয়াদ বাড়ল

সকল