২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫
`

আপনি যে পতনের দ্বারপ্রান্তে তা বুঝবেন কিভাবে?

সমকালীন প্রসঙ্গ
-

আপনি যদি নিজের পতনের শঙ্কায় আতঙ্কিত অনুভব করেন, আপনার উচিত নিজের উত্থানের বিষয়টি গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ ও পর্যালোচনা করা। কারণ হাজার বছরের মানবজাতির উত্থান-পতনের একটি সরল-সমীকরণ হলোÑ যার যেভাবে উত্থান হয় সেভাবেই তার জন্য অনিবার্য পতন অপেক্ষা করতে থাকে। আপনার পতনটি যখন আপনার জন্য অপেক্ষা করতে থাকে তখন আপনাকে ঘিরে হররোজ প্রকৃতির কতগুলো লীলাখেলা ঘটতে থাকে। এরপর পতনের ক্ষণ যখন সমাগত হয় এবং আপনার কণ্ঠনালীর কাছাকাছি এসে যায় তখন দুনিয়ার সব মানুষ বুঝতে পারে যে, আপনার অন্তিম সময় সমাগত। কিন্তু নিয়তির নিষ্ঠুর ও নির্মম পরিহাস হলো, সব মানুষ এমনকি আপনার পোষা বিড়ালটি আপনার পরিণতি সম্পর্কে যা বুঝতে পারে তার কিছুই আপনি টের পাবেন না।
আপনার উত্থানটি যদি ভালো হয় সে ক্ষেত্রেও আপনার পতন মন্দ হতে পারে যদি উত্থান ও পতনের মধ্যকার সময়টুকু আপনি নিজেকে দানব-দানবীর মতো ভাবেন এবং সব মন্দ কর্মকে নিজের জন্য অপরিহার্য বানিয়ে নেন, অর্থাৎ আপনার আহার-নিদ্রা ও বর্জ্য ত্যাগের মতোই মন্দ কর্ম যখন আপনার বেঁচে থাকার অনুষঙ্গে পরিণত হয় তখন এটা নিশ্চিত করে বলা যায় যে, এক ভয়ঙ্কর নিয়তি আপনাকে পতনের অন্তিমপ্রান্তে ক্রমাগত টেনে নিয়ে যাচ্ছে। অন্য দিকে, যদি আপনার অবৈধ উত্থান নিশ্চিত ও ঘৃণিত কর্ম দিয়ে জীবন শুরু এবং অন্যের হক নষ্ট করে তা লুণ্ঠন করে সেটাকে নিজের সিংহাসন বানিয়ে যদি আপনার কর্মযাত্রা হয় তবে আপনি নিশ্চিত থাকুন, আপনার কোনো শুভ কর্ম, সৎ প্রচেষ্টা এবং সাঙ্গ-পাঙ্গদের হাজার ফন্দিফিকিরও আপনার নিয়তির গন্তব্যের কোনো হেরফের ঘটাতে পারবে না।
উত্থান-পতনের এ সহজ সরল সমীকরণটি সবার জন্যই সমভাবে কার্যকর। অর্থাৎ একজন প্রান্তিক কৃষক অথবা ভবঘুরে ভিক্ষুকের জন্য যেমন পরিণতি অপেক্ষা করে তদ্রƒপ রাজা-মহারাজা, পাইক-পেয়াদা, আমির-ওমরাহ-উজির-নাজির থেকে শুরু করে ধর্মালয়ের সেবায়েত কিংবা জল্লাদ-সবাইকেই নিজ পরিণতি ভোগ করতে হয়। নিয়তির নির্মম পরিণতি কখনো একক ব্যক্তির জন্য এককজনে আবির্ভূত হয়, আবার গোষ্ঠী-দল-সম্প্রদায় অথবা দেশ-জাতি-রাষ্ট্রের জন্য যুগপৎভাবে আসে। আজকের আলোচনায় ব্যক্তির ব্যক্তিগত জীবনের রস ও রসায়নে, সেটিও মননে এবং আচরণে কিরূপে পতনের চিহ্নসমূহ ফুটে ওঠে সে ব্যাপারে আলোকপাতের চেষ্টা করব।
প্রথমেই আপনার বাহ্যিক আচার-আচরণ ও পোশাক-পরিচ্ছদ সম্পর্কে কিছু বলা আবশ্যক। আপনি যখন পতনের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছবেন তখন হঠাৎ করেই আপনি অতিরিক্ত স্টাইলিস্ট হয়ে পড়বেন। নিত্যনতুন পোশাক, অলঙ্কার এবং সুগন্ধির জন্য আপনি অঢেল অর্থ ব্যয় করবেন। আপনার এসব সাজসজ্জা প্রায়ই হাস্যকর ও বেমানান হয়ে পড়বে। অর্থাৎ আপনি যদি বুড়াবুড়ি হন তবে যুবক-যুবতীদের মতো রং-চঙের পোশাক পরে আপনি যে ঢঙ্গীপনা শুরু করবেন তা দেখে চার পাশে হাস্যরসের বন্যা বয়ে যাবে। আপনার কথাবার্তা, হাসি-তামাশা, প্রেম-ভালোবাসা, কাম-ক্রোধ, কোনোটিরই ধারাবাহিকতা থাকবে না। সকালে যদি আপনি ‘আকাশ’ বলেন তা দুপুরে এসে হয়ে যাবে ‘বাতাস’। আবার ‘বাতাস বাতাস’ বলে যে চিৎকার-চেঁচামেচি শুরু করলেন তা বিকাল বেলায় ‘বাতাসা’ হয়ে যাবে। এভাবে দিনে রাতে আপনি অন্তত পাঁচ-ছয় রকমের কথাবার্তা বলবেন যা আপনার কাছে মনে হবে মেধা ও মননশীলতার উৎকর্ষ কিন্তু সাধারণ মানুষ বুঝে ফেলবে যে, কাজ শেষ হবার পর্যায়ে চলে এসেছে।
পতনের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছালে আপনি মনে করবেন, কেবল আপনিই ভালোÑ বাকিরা খারাপ, আপনার আরো মনে হবে, আপনি হলেন পরশ পার্থ আপনার স্পর্শে সব কিছু স্বর্ণে পরিণত হয়। ফলে পৃথিবীর উর্বর মরুভূমি, দুর্গন্ধযুক্ত ময়লার ড্রেন, দুর্গম শিলাময় পাহাড় ইত্যাদি সব কিছুকে আপনার স্পর্শ লাগিয়ে স্বর্ণে পরিণত করার মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্য আপনি হাজার বছর বেঁচে থাকার চেষ্টা করবেন। আপনার মনে হবেÑ আপনার মধ্যে অলৌকিক বা অতীন্দ্রিয় কিছুর অনুপ্রবেশ ঘটেছে। ফলে আপনি আর নিজেকে সাধারণ মানুষ ভাবতে পারবেন না। এই পর্যায়ে আপনার মধ্যে মনুষ্যজাত সম্পর্কে এক ধরনের তুচ্ছ-তাচ্ছিল্যের ভাব পরিস্ফুট হয়ে উঠবে। আপনি মানুষজনকে অপমান করবেন এবং সবাইকে অবিশ্বাস করা শুরু করে দেবেন। কাউকে বিশ্বাস করা, কারো প্রতি নির্ভর করা এবং কারো সাহায্যের প্রত্যাশা আপনার মন মানসে স্থান পাবে না। আপনার মনে হবে, সবাই আপনার ক্রীতদাস-দাসীর ন্যায়। দাস-দাসীদের যেমন কোনো ইচ্ছা-আকাক্সক্ষা-চাহিদা থাকা অপরাধ হিসেবে গণ্য হয় তদ্রƒপ আপনিও মনে করতে থাকবেন, আপনার অধীনস্থদের কোনো চাওয়া-পাওয়া, বলা-দেখার অধিকার সেই।
পতন যখন আপনার ঘরের চারদিকে উঁকিঝুঁকি দেবে তখন আপনার মধ্যে অহেতুক এবং অপ্রয়োজনীয় কাজ করার প্রবণতা প্রবল হয়ে উঠবে। আপনি প্রয়োজন বাদ দিয়ে অপ্রয়োজনের পেছনে ছুটবেন এবং মানুষের মুখের অন্ন কেড়ে নিয়ে সেগুলোকে পশু-পাখির খাদ্যে রূপান্তরের মধ্যে একধরনের ফুর্তি ফুর্তি ভাব খুঁজে পাবেন। আপনার প্রাত্যহিক জীবনাচরণে ন্যাকামো বেড়ে যাবে। কিশোর-কিশোরীদের মতো চটুল কথাবার্তা এবং বানিয়ে বানিয়ে অভিনব মিথ্যা কথা বলে সবাইকে অবাক করে দেয়াকে নিজের সফলতা মনে করতে আরম্ভ করবেন। আপনার জীবনে এই সময়ে অপব্যয়ের পরিমাণ মারাত্মকভাবে বেড়ে যাবে। নিজের সহায় সম্পত্তি গোপনে বিক্রি করে অথবা চড়া সুদে ঋণ গ্রহণ করে হলেও আপনার অন্তিম দিনগুলোতে বিলাসিতার পরিমাণ বাড়িয়ে দেবেন। লোকজনকে চমক দেখানোর জন্য আপনি অহেতুক মজমা-মজলিস বা দরবার অনুষ্ঠানের আয়োজন করবেন।
অন্তিম সময়ে আপনার আরেকটি বৈশিষ্ট্য হবে, মন্দ লোকদের ‘বাজার মেলানো’। আপনার অধিক্ষেত্রে যত মন্দ লোক রয়েছে আপনি তাদের সেভাবে আকর্ষিত করতে থাকবেন যেভাবে একটি মৌচাকের রানী মৌমাছি হাজার হাজার সাধারণ মৌমাছিকে আকর্ষণ করে থাকে। আপনার আশ্রয় প্রশ্রয়ে থেকে, মন্দ লোকেরা উত্তম লোকদের কিভাবে পরিচালনা করতে হয় সেই নীতিমালা প্রণয়ন করবে। অধার্মিকরা ধার্মিকদের ধর্মগুরু হিসেবে নিয়োগ পাবে। চোরেরা মালখানার দায়িত্ব পাবে এবং ধর্ষকেরা নারী নির্যাতন প্রতিরোধ কমিটির প্রধান হবে। শিশু পাচারকারী ও বলাৎকারকারীরা শিশু অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য পুরস্কৃত হবে এবং মিথ্যাবাদীরা সব শ্রেণীর ওপর প্রভুত্ব করার জন্য নিয়োগপ্রাপ্ত হবে।
আপনি রুচিবোধ এবং পছন্দ অপছন্দের ক্ষেত্রেও বিতর্কিত হবেন। আপনার নিকট ঘোড়ার চেয়ে গাধাদেরই উত্তম মনে হবে এবং গাধার প্রজনন বৃদ্ধি ও ঘোড়া নির্মূল প্রকল্পের জন্য আপনি সর্বশক্তি নিয়োগ করবেন। আপনি বাঘ সিংহের পরিবর্তে বিড়ালের গুরুত্ব সম্পর্কে অভিনব আবিষ্কার করে ফেলবেন এবং বনাঞ্চলে কামান দাগিয়ে বনের রাজাদের নির্মূল করে সেখানে বিড়ালদের অভয়ারণ্য তৈরি করে ফেলবেন। আপনার কাছে কোকিলের চেয়ে কাকের ডাক যুৎসই মনে হবে এবং গরুর পরিবর্তে ছাগল দিয়ে কিভাবে হালচাষ করা যায় তা আবিষ্কারের জন্য বিজ্ঞানীদের নিয়োগ দেয়ার কথা ভাববেন। আপনার কাছে নদীর স্রোত, মেঘের গর্জন, বাতাসের শব্দ ইত্যাদি যেমন অসহ্য মনে হবে তেমনি সূর্যের আলো এবং দিবালোকের কাজকর্মের পরিবর্তে অমাবস্যার নিশুতি রাতের যাবতীয় ক্রীড়া কাণ্ড শোভন বলে বিবেচিত হবে।
পতন দ্বারা প্রলুব্ধ হয়ে আপনি আপনজনকে চিনতে পারবেন না। অধিকন্ত, জাত শত্রুদের মিত্র বানানোর জন্য পাগলপারা হয়ে পড়বেন। আপনি নিজে যেমন কারো প্রশংসা করতে চাইবেন না, তদ্রƒপ আপনার কাছে যদি কেউ অন্য কারো প্রশংসা করে তবে আপনি প্রশংসাকারী এবং প্রশংসিত ব্যক্তি উভয়কেই আপনার শত্রু তালিকায় লিপিবদ্ধ করে ফেলবেন। এই রোগটি আপনার ক্ষেত্রে এত সর্বগ্রাসীরূপে দেখা দেবে যে, নিজের পুত্র-কন্যা, ভাই-বোনদের প্রশংসাও আপনার কাছে অসহ্য মনে হবে। নানা রকমের সন্দেহবাতিক আপনাকে পেয়ে বসবে এবং অজানা শঙ্কায় কেবল সন্দেহের কারণে নিরপরাধ লোকদের ক্ষতি করতে থাকবেন।
ব্যক্তিগত জীবনে অশ্লীলতা, উলঙ্গতা, নোংরামি বৃদ্ধি পাবে এবং মাঝে মধ্যে আপনার নিকট নিজের জীবনটিকে বোঝা বলে মনে হবে। নিজের মনের গহিনের বেদনা শঙ্কা ভয়কে আড়াল করার জন্য আপনি মন্দ লোকের সংস্পর্শ এবং অহেতুক বাদ্য-বাজনা আলোকসজ্জার মাধ্যমে ফুর্তি করার ব্যাপারে বাড়াবাড়ি শুরু করবেন। ফলে আপনার নিদ্রা জাগরণ খাওয়া দাওয়া ইত্যাদি প্রাত্যহিক ফর্মে মারাত্মক অসামঞ্জস্য দেখা দেবে। জাগ্রত অবস্থায় আপনি সর্বদা নিজেকে রঙ্গমঞ্চের নায়ক নায়িকার মতোই সাজুগুজুর মধ্যে যত রাখেন না কেন তা সম্পূর্ণ বুমেরাং হয়ে যাবে নিদ্রার সময়ে। শত চেষ্টা করেও প্রকৃতির স্বাভাবিক নিয়মে ঘুমাতে পারবেন না। বড়জোর তন্ত্রাচ্ছন্ন হতে পারবেন। কিন্তু ভয়ঙ্কর সব দুঃস্বপ্নের ভয়ে আপনি দু’চোখের পাতা একত্র করতে পারবেন না। ফলে ক্লান্তি বিষাদ এবং অন্যান্য মানবিক দুর্বলতাজনিত কারণে তন্দ্রাচ্ছন্ন হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে দুঃস্বপ্নের করালগ্রাসে আপনার মস্তিষ্কের নার্ভগুলো ছিন্নবিচ্ছিন্ন হতে থাকবে যা আপনাকে শেষ অবধি বুদ্ধিপ্রতিবন্ধী বানিয়ে ফেলবে।
পতনকালে পৃথিবীর যাবতীয় সুস্বাদু খাদ্যের ওপর থেকে আপনার রুচি এবং আকর্ষণ কমে যাবে। আপনার ঘ্রাণশক্তিতেও অদ্ভুত পরিবর্তন আসবে। ভালো ঘ্রাণ অনুভব করবেন নাÑ কিন্তু দুর্গন্ধ দ্বারা প্রতিক্ষণে অত্যাচারিত হবেন। আপনার শ্রবণশক্তিও আপনার সঙ্গে বেঈমানি করবে। পৃথিবীর যাবতীয় শুভ, কল্যাণকর এবং আনন্দদায়ক শব্দলহরী আপনার কর্ণ কুহরে প্রবেশ করবে না। কিন্তু আজেবাজে শব্দ, অপ্রয়োজনীয় ও ক্ষতিকর কথাবার্তা আপনার কানের মধ্যে ঢোকার জন্য ভয়াবহ ট্রাফিক জ্যামের সৃষ্টি করবে। জীবনের এই পর্যায়ে আপনার শরীরের রেকটাম ও রেচনতন্ত্র আপনাকে নিদারুণ ভোগাবে। পরিপাকতন্ত্রও উল্টাপাল্টা আচরণ শুরু করবে। হাঁচি কাশি, ঘাম ইত্যাদি দুর্গন্ধ ছড়াবে। ফলে পৃথিবীর আলো-বাতাস, পরিবেশ প্রতিবেশের জন্য আপনি বিষাক্ত হয়ে পড়বেন।
উল্লিখিত লক্ষণগুলো যদি আপনার শরীর-মন এবং মস্তিষ্কে দেখা দেয় তাহলে আপনি নিশ্চিত ধরে নিতে পারেন যে, পতনের নির্মম পরিণতি আপনাকে হাতছানি দিয়ে ডাকছে। আপনি শত চেষ্টা, বহুরূপী ছলাকলা কিংবা জাদুটোনার অপতৎপরতা দ্বারা নিয়তির অভিযাত্রা রুখে দিতে পারবেন না। অধিকন্তু শেষ সময়ে যত বেশি ভণ্ডামিমূলক কাজ করবেন, তত বেশি নির্মম পরিণতি দ্বারা আক্রান্ত হবেন। হ
লেখক : সাবেক সংসদ সদস্য

 


আরো সংবাদ



premium cement