২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১, ১৬ শাওয়াল ১৪৪৫
`

স্থায়ী শিক্ষা কমিশন প্রয়োজন

-

বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ে অনেকেই চিন্তাভাবনা করে থাকেন। এই চিন্তাভাবনা অনেকটা দুশ্চিন্তার পর্যায়ে পড়ে। শিক্ষা যেহেতু একটি জাতির ভবিষ্যৎ উন্নতি ও অগ্রগতির বীজকে ধারণ করে, তাই সঙ্গতকারণেই অনেক শিক্ষাবিদ বর্তমান ধারার শিক্ষাব্যবস্থার নেতিবাচক দিকগুলোর কথা বলেই ক্ষান্ত হন না; তারা বর্তমান ব্যবস্থাকে পরিবর্তন করে শিক্ষা ক্ষেত্রে সুদূরপ্রসারী ফলপ্রসূ পরিবর্তনের উদ্দেশ্যে বিভিন্ন সুপারিশও করে থাকেন। বলার প্রয়োজন পড়ে না যে, শিক্ষা ও উন্নয়ন প্রায় সমার্থক। বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থাকে উৎপাদনমুখী করে গড়ে তোলার কথা প্রসঙ্গতই এসে যায় এবং যারা শিক্ষাসংক্রান্ত বিষয়ে সুপারিশ করেন তাদের দৃষ্টি থেকে এ দিকটিও বাদ যায় না। বাদ যাওয়ার কথাও নয়। এসব সুপারিশ ব্যক্তি পর্যায়েই হোক বা সরকারি আদেশে গঠিত কমিশন বা কমিটি পর্যায়েই হোক, তা সদিচ্ছা প্রণোদিত। সম্পূর্ণ নিখুঁত শিক্ষাব্যবস্থাটি কী হতে পারে, এ কথার উত্তর সর্বজন গ্রাহ্যভাবে কেউ দিতে পারেন না, দেয়া সম্ভবও নয়। বাস্তবসম্মত একটি শিক্ষাব্যবস্থা সব সময়ই পরীক্ষা-নিরীক্ষার মধ্য দিয়েই উদ্ভাবিত হয়ে থাকে। তাই শিক্ষাসংক্রান্ত যেকোনো ধরনের পরামর্শ বা সুপারিশের ভুলত্র“টি বেরিয়ে আসবেই এবং যারা ভুলত্র“টি ধরিয়ে দেন তারাও যদি শিক্ষাসংক্রান্ত সুপারিশ তৈরি করেন, সেটিও যে নির্ভুল হবে না, তা-ও একরকম ধরেই নেয়া যায়। স্বভাবতই প্রশ্ন জাগে, এ সমস্যা থেকে উত্তরণের কোনো পথ আছে কি?
বাংলাদেশে বেশ কয়েকটি শিক্ষা কমিশন গঠিত হয়েছে। তাদের নামের তালিকা এবং সেসব শিক্ষা কমিশন কর্তৃক প্রণীত শিক্ষাসংক্রান্ত সুপারিশ ও নীতিমালার বস্তুনিষ্ঠতা ও গুণাগুণের উল্লেখ না করেও বলা যায়, সেসব শিক্ষানীতি বা সুপারিশ সর্বজনগ্রাহ্য হয়নি। এ কারণে এর বাস্তবায়নও পুরোপুরি সম্ভব হয়নি। কেন সেসব শিক্ষা কমিশনের রিপোর্ট বা নীতি সর্বজনগ্রাহ্য হয়নি বা হওয়া উচিত ছিল কি না, সেটি আমার আলোচ্য বিষয় নয়। তবে এই বাস্তবায়ন না হওয়া এবং তার পেছনে কোনো যুক্তিসঙ্গত ফাঁক আছে কি না, তা ভেবে দেখার আছে।
আমরা সবাই জানি এবং স্বীকার করি, পৃথিবীটা চলছে। যদি সম্ভাবনার দৃষ্টিতে দেখি তবে বলা যায়, এগোচ্ছে। এই এগোনোর ধারণাটাকে আমরা আমাদের জীবন থেকে বাদ দিতে পারি না। এমনকি শিক্ষা ক্ষেত্রেও নয়। কোনো একটি নির্দিষ্ট সময়ে হয়তো একটি শিক্ষা কমিশন গঠন করা হলো; তার রিপোর্টও যথাসময়ে প্রণয়ন করা হলো এবং যথাসময়ে কমিশন তার রিপোর্ট যথাযথ কর্তৃপক্ষের হাতে দিয়ে দায়মুক্ত হয়ে গেল।
তাদের আর কিছুই করার রইল না। কিন্তু এখানে একটি কথা হয়তো সবাই স্বীকার করবেন, যারা শিক্ষাসংক্রান্ত রিপোর্টটি প্রণয়ন করেছেন, তা বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে যেসব পদক্ষেপ বা কৌশল অবলম্বন করা প্রয়োজন তা রিপোর্টটি প্রণেতাদের চেয়ে হয়তো বেশি ভালো আর কারো জানার কথা নয়। কারণ তারা সম্পূর্ণ বিষয়টির ভেতরে। ভিন্ন হাতে রিপোর্ট যখন বাস্তবায়নের ভার পড়ে তখন বিভিন্ন কারণে বিপত্তি বাধাটাই স্বাভাবিক, রিপোর্ট যত যথাযথই হোক না কেন। তা ছাড়া একটি দায়িত্বের ব্যাপারও আছে। যারা রিপোর্টটি তৈরি করলেন, তাদের ওপর যদি তা বাস্তবায়নের ভার থাকে তবে কাজটি তারা যতটা একাগ্রতার সাথে করবেন, অন্য কারো কাছ থেকে কি ততটা আশা করা যায়?
আরো একটা দিক আছে। কোনো একটি নির্দিষ্ট সময়ে একটি রিপোর্ট প্রণয়ন করা হয় কোনো একটি নির্দিষ্ট সময়কে সামনে রেখে। কিন্তু সময়ের পরিবর্তন ঘটে, তার সাথে সাথে শিক্ষাবিষয়ক ধ্যানধারণা ও চাহিদারও পরিবর্তন আসে। এটিই স্বাভাবিক। এ কারণে কোনো নির্দিষ্ট সময়ে প্রণীত একটি রিপোর্টকে কার্যক্ষেত্রে প্রয়োগ করে তা পরীক্ষা-নিরীক্ষা, মূল্যায়ন, পর্যালোচনা, পরিবর্তন ইত্যাদিরও প্রয়োজন দেখা দেয়। কারণ সময় চলছে। একটি রিপোর্ট হয়তো কতগুলো স্থির ধারণার ওপর নির্ভর করে প্রণীত হয়। কিন্তু পরে আর কিছুই স্থির থাকে না। তাই আসে শিক্ষানীতিকে সময়োপযোগী করে গড়ে তোলার কথা। এ কাজটিও তারাই ভালো পারবেন যারা রিপোর্টটি প্রণয়ন করেছেন, যদি বাস্তবায়ন, তত্ত্ব¡াবধান, মূল্যায়ন এবং এ-সংক্রান্ত যাবতীয় দায়িত্বও তাদেরই ওপর ন্যস্ত থাকে। বিষয়টি নিরন্তর পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে দেখার দাবি রাখে। নিরন্তর পরীক্ষা-নিরীক্ষার মধ্য দিয়ে রিপোর্টটির ত্র“টি-বিচ্যুতিগুলো যেমন তাদেরই কাছে ধরা পড়বে, তেমনি সাথে সাথে সেগুলো সংশোধনও হয়ে যাবে। বিষয়টি হবে একটি চলমান প্রক্রিয়া। দু-একটি বা মারাত্মক কোনো ভুলের কারণে রিপোর্টটি সম্পূর্ণ পরিত্যাজ্য হয়ে শিক্ষাক্ষেত্রে নৈরাজ্য সৃষ্টি করবে না।
এ পর্যন্ত এসে পাঠক হয়তো ধারণা করতে পারছেন, আসলে কী বলতে চাচ্ছি। আমি বলতে চাচ্ছি, একটি স্থায়ী জাতীয় শিক্ষা কমিশনের কথা। স্থায়ী একটি জাতীয় পরিকল্পনা কমিশন আছে, ঠিক তেমনি স্থায়ী একটি জাতীয় শিক্ষা কমিশন থাকা দরকার। এ শিক্ষা কমিশনের গঠন প্রণালী কেমন হলে কার্যকর হয়, তা গভীরভাবে ভেবে দেখার প্রয়োজন আছে। তার উদ্দেশ্য, আদর্শ, কাঠামো ও কার্যপ্রণালী সুনির্দিষ্টভাবে নিরূপণ করতে হবে। এ বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনার অবকাশ আছে। এখানে বিস্তারিত আলোচনায় না গিয়ে আমার মনে হয়, প্রস্তাবিত স্থায়ী জাতীয় শিক্ষা কমিশনের একটি মোটামুটি রূপরেখা নিম্নরূপ দেয়া যেতে পারেÑ বর্তমানে শিক্ষার সাথে সংশ্লিষ্ট যেসব প্রতিষ্ঠান আছে যেমনÑ নায়েম, এডুকেশনাল ইকুইপমেন্ট বোর্ড, আডিট অ্যান্ড অ্যাকাউন্টস ডাইরেক্টরেট, পাঠক্রম ও টেকস্টবুক বোর্ড ইত্যাদি জাতীয় পর্যায়ের প্রতিষ্ঠানগুলোর সমন্বয়ে এবং শিক্ষার সাথে সংশ্লিষ্ট আরো বিষয় যোগ করে প্রস্তাবিত স্থায়ী জাতীয় শিক্ষাকমিশন গঠন করা যেতে পারে। জাতীয় শিক্ষা কমিশনের কাঠামো মোটামুটি নিম্নরূপ হতে পারেÑ ১. জাতীয় শিক্ষা কমিশন গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের একটি সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠন হবে; ২. জাতীয় শিক্ষা কমিশনের নিম্নবর্ণিত বিভাগগুলো থাকতে পারেÑ ক. শিক্ষানীতি প্রণয়ন, বাস্তবায়ন, তত্ত্বাবধান ও মূল্যায়ন বিভাগ; খ. শিক্ষা উন্নয়ন বিভাগ; গ. পাঠক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বিভাগ; ঘ. জনশক্তি প্রশিক্ষণ ও জনশক্তি পরিকল্পনা বিভাগ; ঙ. পরিদর্শন ও হিসাব নিরীক্ষণ বিভাগ। চ. শিক্ষা সম্প্রসারণ ও উন্নয়ন বিভাগ। ছ. বিবিধ বিভাগ। জাতীয় শিক্ষা কমিশনের কর্মকর্তার পদক্রম নিম্নরূপ হতে পারেÑ ১. কমিশনের চেয়ারম্যান; ২. সদস্যমণ্ডলী; ৩. বিভিন্ন বিভাগীয় প্রধান; ৪. বিভাগীয় প্রধানদের অধীনস্থ বিভিন্ন কর্মকতা; ৫. বিভিন্ন বিভাগীয় কর্মচারী।
স্থায়ী জাতীয় শিক্ষা কমিশনের সব কর্মকর্তার পদ বিশ্ববিদ্যালয়, কলেজ ও স্কুলগুলোর শিক্ষকদের দিয়ে পূরণ করা যেতে পারে। জাতীয় শিক্ষা কমিশনের চেযারম্যানের ও বিভিন্ন সদস্যের পদগুলো হবে সাংবিধানিক। বাংলাদেশ সরকারের রাষ্ট্রপতি কর্তৃক মনোনীত ব্যক্তি কমিশনের চেয়ারম্যান ও সদস্য হবেন। প্রতিটি বিভাগে অন্যূন একজন করে বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ সদস্য থাকবেন এবং তারা সম্মিলিতভাবে শিক্ষা কমিশনের সদস্যমণ্ডলীরূপে গণ্য হবেন। প্রতিটি বিভাগে একজন করে বিভাগীয় প্রধান থাকবেন। বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজগুলোর অধ্যাপকদের দিয়ে এসব পদ পূরণ করা যেতে পারে। এভাবে প্রতিটি বিভাগের বিভাগীয় প্রধান থেকে শুরু করে নিচের দিকের কর্মকর্তা পর্যায়ের পদগুলো যথাক্রমেÑ অধ্যাপক, সহযোগী অধ্যাপক, সহকারী অধ্যাপক, প্রভাষক ও স্কুলশিক্ষকদের দিয়ে পদের গুরুত্ব অনুযায়ী পূরণ করা যেতে পারে। সংশ্লিষ্ট বিভাগের গুরুত্ব ও বিস্তার বিবেচনা করে বিভিন্ন পদের সংখ্যা নিরূপণ করা যেতে পারে।
জাতীয় অর্থনীতির ক্ষেত্রে পরিকল্পনা কমিশন যেমন পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা প্রণয়ন ও বার্ষিক পরিকল্পনার মাধ্যমে পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার বাস্তবায়ন সুনিশ্চিত করে থাকে, তেমনি জাতীয় শিক্ষার ক্ষেত্রে প্রতি পাঁচ বছরের জন্য শিক্ষানীতি প্রণয়ন ও বাৎসরিকভাবে মূল পাঁচ বছরের শিক্ষানীতি বাস্তবায়নের জন্য জাতীয় শিক্ষা কমিশন কার্যক্রম গ্রহণ করতে পারে। সাথে সাথে শিক্ষানীতির বাস্তবায়ন, মূল্যায়ন ও অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে শিক্ষানীতির বাস্তবানুগ ও সময়োপযোগী পরিবর্তনও করতে পারবে। এভাবে শিক্ষাক্ষেত্রে একটি চলমান নীতির যেমন প্রচলন ঘটবে, তেমনি সার্বক্ষণিক তদারকির ভিত্তিতে শিক্ষাকে সময়োপযোগী রাখার প্রক্রিয়ার উদ্ভব ঘটবে। অধিকন্তু শিক্ষার বিভিন্ন দিকের মধ্যে সমন্বয় সাধনের একটি স্থায়ী সুযোগ সৃষ্টি হবে বলে শিক্ষাক্ষেত্রে আন্তঃবিষয়ক ও আন্তঃবিভাগীয় ভারসাম্যহীনতারও অবসান ঘটবে। বিচ্ছিন্নভাবে বিভিন্ন সময়ে শিক্ষাবিষয়ক রিপোর্ট ও সুপারিশ প্রণয়ন করার জন্য অস্থায়ী শিক্ষা কমিশন গঠন করে, সে রিপের্টি বা সুপারিশ ভিন্ন হাতে বাস্তবায়ন করা হয় যেসব জটিলতার সৃষ্টি হয়, এর মাধ্যমে তা-ও দূর করা যাবে।
অবশেষে একটি সতর্কবাণী উচ্চারণ করে এই নিবন্ধের ইতি টানতে চাই। আমরা অর্থনেতিক পরিকল্পনার ক্ষেত্রে প্রায়ই লক্ষ করে থাকি, পরিকল্পনা হয় বটে কিন্তু তার যৌক্তিক বাস্তবায়ন সবসময় হয় না। একটি ঘাটতি থেকেই যায়। এর অনেক কারণ থাকতে পারে। তবে যেসব কারণ প্রধান তা হলোÑ প্রকল্প বাস্তবায়নে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের আন্তরিকতা, সততা, ন্যায়পরায়ণতা, দক্ষতা, কর্মতৎপরতা ইত্যাদি গুণের অভাব। শিক্ষাবিষয়ক স্থায়ী জাতীয় শিক্ষা কমিশন গঠন হয়ে গেলেই যে শিক্ষার যাবতীয় সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে তেমন আশা করার কোনো কারণ নেই। দেশের শিক্ষাব্যবস্থাকে চলমান অবস্থার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ রেখে উৎপাদনমুখী ও বিজ্ঞানসম্মত শিক্ষার মানোন্নয়ন ও যথাযথ প্রসারে যদি আমরা আন্তরিক হতে চাই, তবে সময়ে সময়ে বিচ্ছিন্নভাবে গঠিত শিক্ষা কমিশনের তুলনায় একটি স্থায়ী শিক্ষা কমিশনের মাধ্যমে সামগ্রিক শিক্ষার তদারকি করতে পারলে অনেক অনেক বেশি কার্যকর ফল লাভ করা সম্ভব হবে বলে আমার বিশ্বাস। হ
লেখক : অর্থনীতির অবসরপ্রাপ্ত প্রফেসর ও ভাইস প্রিন্সিপাল, মহিলা সরকারি কলেজ, কুমিল্লা

 


আরো সংবাদ



premium cement