২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫
`

স্বাধীনতার ‘মাঠজরিপ’

-

‘আমাদের স্বাধীনতার ৫০ বছর পূর্তি উদযাপনে স্বাধীন দেশে, স্বাধীনভাবে সভাসমাবেশ করা যাবে না। যদি করতেই হয়, তবে মাঠে ময়দানে নয়; ঘরের ভেতরে, স্কুল-কলেজের বারান্দায় করা যাবে।’ এরকম একটি নির্দেশ পুলিশের পক্ষ থেকে এবার দেয়া হয়েছে। সেই নির্দেশে বলা হয়েছেÑ ১৭ থেকে ২৬ মার্চ পর্যন্ত দেশের কোথাও উন্মুক্ত স্থানে জনসমাবেশ করা যাবে না। কিন্তু স্বাধীনতার ৫০ বছর উদযাপন খোলামেলাভাবে করা যাবে না, এ কেমন কথা।
৫০ বছর ধরে স্বাধীনতাকে ঘিরে মানুষের বুকে কত কথা জমা রয়েছে। কত স্মৃতি ভেসে বেড়াচ্ছে। কত দুঃখ, কত কষ্ট, কত সুখ নিয়ে মানুষ বেঁচে আছে। সেসব কথা, সেসব স্মৃতি মানুষ উন্মুক্ত ময়দানে প্রাণ খুলে বলবে, হাসবে, স্বপ্ন বুনবে, ভবিষ্যত সাজাবে, পরিকল্পনার কথা আদান-প্রদান করবে। কিন্তু স্বাধীনতা উদযাপনে সীমানা বেঁধে দেয়া হলো কেন?
সীমানা ও সীমাবদ্ধতার ছক আঁকা হয়েছিল পাকিস্তান আমলে। কথা বলার সীমানা, লেখার সীমানা, সভা-সমাবেশের সীমানা, গান গাওয়ার সীমানা; এসবে সীমারেখা তৈরি করে তৎকালীন পূর্বপাকিস্তানকে আবদ্ধ রাখা হয়েছিল। এ দেশের মানুষের মুখ বন্ধ করে দেয়া হয়েছিল। দুঃখের বিষয়, স্বাধীন বাংলাদেশে আবার ফিরে এসেছে সেই সীমাবদ্ধতা! অথচ এ অধিকারহীনতা ও সীমাবদ্ধতার বিরুদ্ধেই এ দেশের মানুষ মুক্তিযুদ্ধে জীবন বাজি রেখেছিল।
স্বাধীনতা যে জন্য চাওয়া হয়েছিল, সেই চাওয়ার মতো করে স্বাধীনতা ভোগ করা গেছে কি না, তা নিয়ে তো কথা হতেই পারে। স্বাধীনতার সফলতা-ব্যর্থতা নিয়েও কথা হতে পারে। সুবর্ণজয়ন্তী উদযাপনে ছোট-বড় নানা ধরনের জনসমাবেশ হতে পারে। প্রত্যাশা ও প্রাপ্তি নিয়ে গ্রামে-গঞ্জে, পাড়া-মহল্লায় আলোচনা-সমালোচনা, বিশ্লেষণও হতে পারে। সমাবেশ থেকে সামনে এগিয়ে যাওয়ার প্রত্যয় উচ্চারিত হতে পারে ইত্যাদি বিষয়কে কেন্দ্র করে স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উদযাপন করায় তো দোষের কিছু ছিল না। তবুও এক সপ্তাহ থেকে দেশে সভা-সমাবেশ নিষিদ্ধ করা হলো। তার যৌক্তিকতা প্রমাণিত হয় না। সুবর্ণজয়ন্তীর প্রারম্ভে এ সিদ্ধান্ত অনভিপ্রেত ও হতাশাব্যঞ্জক নয় কি?
বিগত বছরগুলোতেও কোনো না কোনো অজুহাতে সব ধরনের সভা-সমাবেশে বাধা সৃষ্টি করা হয়েছে। এমনকি ধর্মীয় অনুষ্ঠান, জন্মদিনের অনুষ্ঠানও স্বাধীনভাবে করতে দেয়া হয়নি। অনেক ক্ষেত্রে খুতবা পর্যন্ত নিয়ন্ত্রণ করা হয়েছে। একুশে ফেব্রুয়ারি উদযাপনের দিনে সময়ের বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়েছে। বিকেল ৫টার আগেই অনুষ্ঠান শেষ করতে বলা হয়েছে। পয়লা বৈশাখ উদযাপনে সময়সীমা বেঁধে দেয়া হয়েছে। বিজয় দিবস উদযাপনের শর্ত বেঁধে দেয়া হয়েছে। থার্টিফার্স্ট নাইট উদযাপনে বিধিনিষেধ উল্লেখ করা হয়েছে। বিরোধীদলের রাজনৈতিক সভা-সমাবেশ, গণজমায়েত তো করতেই দেয়া হয়নি। এ চিত্র একটি স্বাধীন-সার্বভৌম রাষ্ট্রের চিত্র হতে পারে না। পুলিশ মোতায়েন করে খোদ সরকারি সমাবেশকেও পাহারা দিতে হয়েছে। লক্ষ করার বিষয়, গত বছর বাংলাদেশের মহান স্থপতি বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী উদযাপনের উদ্দেশে ক্ষণ গণনার জন্য প্রতিটি জেলায় ডিজিটাল ঘড়ি স্থাপন করা হয়েছিল। সেই ঘড়ি পাহারা দেয়ার জন্য ২৪ ঘণ্টা পুলিশ নিযুক্ত রাখা হয়েছে।
পুলিশ প্রহরা রাখা একটি স্বাধীন দেশের মর্যাদাকে খাটো করার জন্য যথেষ্ট। তবুও রাজপথ থেকে গলিপথ সব পথের মোড়ে পুলিশ, গুরুত্বপূর্ণ রাষ্ট্রীয় দফতর পাহারায় পুলিশ, পাবলিক বাসস্ট্যান্ডে রেলওয়ে স্টেশনে ও বিমানবন্দরে পুলিশ। তাদের অভিযোগ, তাদের রাখা হয়েছে প্রতিপক্ষ হিসেবে বিরুদ্ধ মত যেন সংগঠিত হতে না পারে, তা প্রতিহত করার লক্ষ্যে। পুলিশ সেটি নিশ্চিত করতে পেরেছে বলে মনে হয়েছে। একটি স্বাধীন-সার্বভৌম রাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ পরিবেশ এ রকম হতে পারা অবাঞ্ছিত। এমন দৃশ্যের অবতারণা হতে দেখা গেছে ইরাকে। যুক্তরাষ্ট্রের আগ্রাসনে ইরাক বিপন্ন হলে ইরাকের পথেঘাটে পুলিশ প্রহরায় রাষ্ট্রীয় কার্যক্রম পরিচালিত হতে থাকে। এ ছাড়াও বিশেষ করে স্বাধীনতাকামী জনপদগুলোতে পুলিশি প্রহরায় রাষ্ট্র পরিচালিত হতে দেখা গেছে। এ দেশের মানুষ সে কাতারে বাংলাদেশকে দেখতে চায় না।

দুই.
স্বাধীনতার ৫০ বছর ধরে উন্নয়ন যা ঘটেছে তা অবকাঠামোতে। অবকাঠামোর উন্নয়ন মানুষকে পুরো স্বস্তিতে রাখতে পারে না। সামাজিক স্বস্তির জন্য মানবতার উন্নয়ন, আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা এবং সেবা খাতে বরাদ্দ বাড়ানো জরুরি। কিন্তু রাষ্ট্রীয় এসব খাতে উন্নতি করা যায়নি তেমন। সেবা দান প্রতিষ্ঠানগুলোতে দালানকোঠায় বাহ্যত উন্নয়নের ছোঁয়া লেগেছে এ কথা ঠিক। পক্ষান্তরে, সেবার মান হয়েছে ক্রমেই অধোগতি। সরকারি সেবা থেকে সাধারণ মানুষ বঞ্চিত দিনের পর দিন। শিক্ষা, চিকিৎসা, বিচার ও আইনের শাসনে বৈষম্য বেড়েছে এবং রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোতে যেভাবে অর্থের অপচয় হয়েছে তার সাথে পাল্লা দিয়ে বেড়েছে আমলাদের দৌরাত্ম্য। ফলে রাষ্ট্রীয় সেবাদান প্রতিষ্ঠানে সেবার পরিবর্তে সাধারণ মানুষ অবজ্ঞা, অবহেলা ও অসম্মানের শিকার। ফলে স্বাধীনতা বাস্তবায়নকে প্রতিটি মানুষ প্রশ্নের মুখোমুখি দাঁড় করিয়েছে।
গত সপ্তাহে ভূমি অফিসে গিয়েছিলাম রেকর্ড সংশোধনের জন্য। কাজের জন্য দাঁড়িয়ে থাকি দীর্ঘ সময়। একজন জীর্ণ মলিন ষাটোর্ধ্ব মানুষ সাইকেল চালিয়ে আমার পাশে এসে দাঁড়ালেন। তার সাইকেলটি এতই পুরনো যে, এ বাজারে তার দাম সর্বোচ্চ ১২ শ’ টাকা হতে পারে। লোকটির পরনে অপরিচ্ছন্ন ফুলহাতা শার্ট ও লুঙ্গি। দেখে প্রথমে দিনমজুর মনে হয়েছিল। লোকটি আমার কাছে এসে অফিসে কেউ আছে কি না জিজ্ঞেস করলেন। বললাম, অফিসের বড় কর্তাসহ মিটিং করছেন।
বিকেল ৪টার আগে তাদের দেখা পাওয়া যাবে না। শুনে লোকটির কপালে ভাঁজ পড়ল। তাকে জিজ্ঞেস করে জানলাম, ৩০ কিলোমিটার পথ তিনি সাইকেল চালিয়ে এসেছেন এবং আজকেই তার প্রথম আসা নয়; এর আগে আরো পাঁচ-ছয় দিন এ অফিস ঘুরেছেন। আমরা কথা বলছি বেলা আড়াইটার সময়। ভাবলাম, লোকটি কাজের খোঁজখবর করে যখন বাড়ি পৌঁছাবেন, তখন নিশ্চয় রাত সাড়ে সাত-আটটা বাজবে। এমন বৃদ্ধ মানুষের জন্য এসব অফিসের কাজ করানো বাংলাদেশে সহজ নয়।
জানা গেল, তিনি মাধ্যমিক স্কুলের অবসরপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক ও একজন মুক্তিযোদ্ধা। তার নাকি আত্মসম্মানে বাধে মুক্তিযোদ্ধার পরিচয় দিতে। বললাম, কেন? তিনি বললেন, সরকারি দফতরে সেবার মান দেখছেন না? হত্যা, খুন, ধর্ষণ, লুটপাট আর পরিবারতন্ত্রের জন্য কি দেশ স্বাধীন করেছিলাম? অস্ত্র জমা দিয়েছি, কিন্তু প্রশিক্ষণ তো আর জমা দেইনি। বয়স থাকলে আরেকবার অস্ত্র হাতে নিতাম। দেখলাম, কথা বলতে বলতে মানুষটি ক্রোধে লাল হয়ে উঠলেন। ক্ষোভে কষ্টে তার ঠোঁট থর থর করে কেঁপে উঠল। নিজেকে সামলে নিয়ে তিনি ইতিহাসের প্রসঙ্গ টেনে বললেন, ১৭৫৭ সালে আমরা ইংরেজদের কাছে স্বাধীনতা হারিয়েছিলাম; একবার সাতচল্লিশে এসে সে স্বাধীনতা; পুনরুদ্ধার হলো একাত্তরে আমরা আমাদের স্বাধীনতা ফিরে কতটা বাস্তবে পেয়েছি? ৫৭ জন সেনা কর্মকর্তাকে আমাদের হারাতে হয়েছে। আমি অবাক হলাম তার মূল্যায়ন দেখে। বললাম, আপনি না একজন মুক্তিযোদ্ধা? তবুও এভাবে বলতে পারলেন? তিনি বললেন, এ জন্য আমরা মুক্তিযুদ্ধ করিনি।


আরো সংবাদ



premium cement

সকল