১৮ এপ্রিল ২০২৪, ০৫ বৈশাখ ১৪৩১, ০৮ শাওয়াল ১৪৪৫
`
সুশাসন

করোনা আমাদের স্বাবলম্বনের পথ দেখিয়েছে

-

কোভিড-১৯ সর্বপ্রথম ২০১৯ সালের ডিসেম্বর মাসে চীনের হোবেই প্রদেশে শনাক্ত হয়। পরে ২০২০ সালের প্রারম্ভে ব্যাধিটি সমগ্র বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে এবং বৈশ্বিক মহামারীর রূপ ধারণ করে। কোভিড-১৯ একটি সংক্রামক ব্যাধি এবং এর সাধারণ উপসর্গ হিসেবে জ্বর, সর্দি এবং শ্বাসকষ্ট দেখা দেয়। এ ব্যাধি সংক্রমিত ব্যক্তির হাঁচি-কাশির মাধ্যমে সৃষ্ট বায়ুকণা থেকে ছড়ায়। এ ছাড়া সংক্রমিত ব্যক্তির জীবাণু হাঁচি-কাশির কারণে বা জীবাণুযুক্ত হাত দিয়ে স্পর্শ করার কারণে পরিবেশের বিভিন্ন বস্তুর পৃষ্ঠতলে লেগে থাকলে এবং সেই ভাইরাসযুক্ত পৃষ্ঠতল অন্য কেউ হাত দিয়ে স্পর্শ করে নাকে-চোখে-মুখে হাত দিলে করোনাভাইরাস নাক-মুখ-চোখের শ্লেষ্মাঝিল্লি দিয়ে দেহে প্রবেশ করে।
করোনাভাইরাস রোগ প্রতিরোধের জন্য ঘন ঘন হাত ধোয়া, নির্দিষ্ট দূরত্ব বজায় রাখা এবং অন্য কোনো ব্যক্তির কাছ থেকে ঘনিষ্ঠ, সংস্পর্শ থেকে বিরত থাকা আবশ্যক। করোনায় আক্রান্ত ব্যক্তির জন্য মাস্ক ব্যবহার অপরিহার্য। অপর দিকে আক্রান্ত নয় এমন ব্যক্তির মাস্ক ব্যবহার অপরিহার্য না হলেও সতর্কতামূলক ব্যবস্থা হিসেবে ব্যবহার করা সমীচীন। চীনে করোনাভাইরাসের প্রকোপ দেখা দেয়ার পর সে দেশের সরকার করোনায় আক্রান্ত হোবেই প্রদেশটিকে দেশের অন্যান্য প্রদেশের সাথে এবং সমগ্র বিশ্বের সাথে বিচ্ছিন্ন করে ফেলে। এতে দেখা যায় স্বল্প সময়ের মধ্যে এ দেশটি রোগটির প্রকোপ নিয়ন্ত্রণে অনেকটা সফলতা পায়। করোনাভাইরাস ইউরোপ ও যুক্তরাষ্ট্রে ব্যাপক হারে ছড়িয়ে পড়লে সমগ্র বিশ্বের একটি দেশের সাথে অপর দেশের আকাশ, নৌ ও স্থলপথে যোগাযোগ সম্পূর্ণ বন্ধ করে দেয়া হয়। আক্রান্ত দেশগুলো সরকারি- বেসরকারি কার্যালয়, কলকারখানা এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষণা করে। পরে দীর্ঘ সময় অতিবাহিত হওয়ার পর এর প্রকোপ শিথিল হলে ধীরে ধীরে সরকারি-বেসরকারি কার্যালয় ও কলকারখানা খুলে দেয়া হলেও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো এখনো বন্ধ রয়েছে। আক্রান্ত অনেক দেশ কারফিউ জারি করে দেশের ও শহরের অভ্যন্তরে চলাচলে বিধিনিষেধ আরোপ করে আবার অনেক দেশ লকডাউন ঘোষণার মাধ্যমে মানুষ ও যানবাহন চলাচলে বিধিনিষেধ আরোপ করে।
কোভিড-১৯ পূর্ববর্তী কখনো সমগ্র বিশ্বের আকাশ, নৌ ও স্থল যোগাযোগে ছেদ পড়েনি। ইতঃপূর্বে ঊনবিংশ শতকের দ্বিতীয় দশক এবং বিংশ শতকের দ্বিতীয় দশকে ইউরোপে প্লেগ ও স্প্যানিশ ফ্লু দেখা দিলে অঞ্চলভিত্তিক সব ধরনের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করা হয়। পৃথিবীর সৃষ্টি হতেই মহামারীর প্রকোপ ছিল। বিভিন্ন সময়ে মহামারীতে জনপদ বিরান হওয়ার ঘটনা ঘটেছে।
মহামারীর প্রতিরোধে হাদিসে বর্ণিত বিচ্ছিন্নকরণ ব্যবস্থার নির্দেশনা পাওয়া যায়। বুখারি ও মুসলিম শরিফে বর্ণিত হাদিসের বাণী- ‘যদি তোমরা শুনতে পাও যে, কোনো জনপদে প্লেগ বা অনুরূপ মহামারীর প্রাদুর্ভাব ঘটেছে তবে তোমরা তথায় গমন করবে না। আর যদি তোমরা যে জনপদে অবস্থান করছ তথায় তার প্রাদুর্ভাব ঘটে তবে তোমরা সেখান থেকে বের হবে না।’ হাদিসে বর্ণিত বাণীতে বিচ্ছিন্নকরণ (কোয়ারেন্টিন) বিষয়ে যে প্রক্রিয়ার কথা বলা হয়েছে তার সাথে ১৫ শ’ বছর পরের বিজ্ঞানসম্মত আধুনিক প্রক্রিয়ার কোনো পার্থক্য পরিলক্ষিত হয় না। বর্তমান বিশ্বের কোনো দেশই সম্পূর্ণরূপে স্বয়ংসম্পূর্ণ নয়। একটি দেশের উৎপাদিত উদ্বৃত্ত পণ্য অপর দেশে রফতানি করে দেশটির চাহিদা পূরণ করা হয়; অনুরূপভাবে কোনো দেশে কোনো পণ্যের ঘাটতি থাকলে অথবা কোনো পণ্য উৎপাদিত না হলে আমদানির মাধ্যমে চাহিদা পূরণ করা হয়। এভাবে পৃথিবীর একটি দেশ অপর দেশের ওপর নির্ভরশীল। আর এ নির্ভরশীলতাই আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের উদ্ভব ঘটিয়েছে। আবার এমন অনেক দেশ রয়েছে যে দেশের কৃষিপণ্য বা শিল্পপণ্য উৎপাদনের সক্ষমতা থাকলেও উৎপাদন খরচের আধিক্যের কারণে নিজ দেশে উৎপাদন না করে আমদানির মাধ্যমে চাহিদা মেটানো হয়। অর্থনীতির ভাষায় এটি আমদানি বিকল্প নামে অভিহিত।
জনসংখ্যা ও আয়তন উভয় দিক বিবেচনায় বাংলাদেশ একটি ঘনবসতিপূর্ণ জনবহুল দেশ। জনসাধারণের ঘনত্বের দিক থেকে বাংলাদেশের অবস্থান পৃথিবীর শীর্ষে। স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশকে প্রতি বছর দেশের মানুষের মূল খাদ্য চাল আমদানি করতে হতো। সে সময় গম ও ভুট্টার চাহিদার প্রায় সম্পূর্ণ অংশই আমদানির মাধ্যমে মেটানো হতো। স্বাধীনতা-পরবর্তী নিবিড় চাষাবাদ, উন্নত সার, বীজ ও কীটনাশক এবং প্রয়োজনীয় সেচ সুবিধা প্রয়োগের ফলে কৃষিজ পণ্য উৎপাদনে বৈপ্লবিক পরিবর্তন সংঘটিত হয়েছে। স্বাধীনতা-পরবর্তী প্রতি বছর কৃষিজ ভূমির হ্রাস ঘটলেও তা কৃষিজ উৎপাদন বৃদ্ধিকে ব্যাহত করেনি।
এত স্বল্প পরিমাণ কৃষিজ ভূমি নিয়ে বাংলাদেশ যে আজ ধান, চাল, আলু ও সবজি উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণের পাশাপাশি রফতানিতে সক্ষম এ কৃতিত্বের দাবিদার এ দেশের কৃষক এবং কৃষিসংশ্লিষ্ট ব্যক্তি সবার। এমন অনেক কৃষি ও মসলাজাতীয় পণ্য রয়েছে যার একটি বড় বা ক্ষুদ্র অংশ আমদানি করে দেশের চাহিদা মেটানো হয় অথচ এ পণ্যগুলো উৎপাদনের ক্ষেত্রে আরো সচেষ্ট হলে দেশের সম্পূর্ণ চাহিদা দেশজ উৎপাদনের মাধ্যমে মেটানো সম্ভব। উদাহরণস্বরূপ বলা যায় আদা, পেঁয়াজ ও রসুন এ তিনটি পণ্য বাংলাদেশের সর্বত্র উৎপন্ন হয়। এ তিনটি পণ্যের বড় অংশের চাহিদা অভ্যন্তরীণ উৎপাদনের মাধ্যমে মেটানো হয়। এ তিনটি পণ্যের মধ্যে পেঁয়াজ আমদানির ক্ষেত্রে আমরা আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতের ওপর নির্ভরশীল। ভারত পেঁয়াজ উৎপাদনে উদ্বৃত্ত দেশ হলেও বিগত দু’বছর দেখা গেছে আকস্মিক রফতানি বন্ধের সিদ্ধান্ত নেয়ায় বাংলাদেশকে বিকল্প দেশের সন্ধানে যেতে হয়। এতে দেশের সাময়িক পেঁয়াজের ঘাটতি দেখা দিলে তা জনসাধারণের ক্রয়ক্ষমতার বাইরে চলে যায়।
অপর কিছু কৃষিজ মসলাজাতীয় পণ্য যেমনÑ ধনিয়া, জিরা, এলাচ, গুলমরিচ, মরিচ, দারুচিনি, জায়ফল, জয়ত্রি প্রভৃতির বড় অংশ আমদানির মাধ্যমে মেটানো হয়। এ পণ্যগুলো আমাদের পার্শ্ববর্তী ভারত ও সার্কভুক্ত দেশ শ্রীলঙ্কায় প্রচুর উৎপন্ন হয়। আমাদের দেশের আবহাওয়াও এ পণ্যগুলো উৎপাদনের উপযোগী। এ পণ্যগুলোর মধ্যে এলাচ, গোলমরিচ ও মরিচ আমরা প্রতিটি বাড়ির আঙিনা বা ছাদে চাষ করলে অতিসহজেই গৃহস্থালির প্রয়োজন মিটিয়ে উদ্বৃত্ত পণ্য বিক্রির মাধ্যমে আর্থিক সচ্ছলতার পথে কিঞ্চিৎ হলেও অগ্রগতি সম্ভব। এ জন্য প্রয়োজন কর্তৃপক্ষের পৃষ্ঠপোষকতা ও ব্যক্তিবিশেষের উদ্যোগ। এ পণ্যগুলো নিজ দেশে উৎপন্ন করে অভ্যন্তরীণ চাহিদা মেটানো গেলে বিপুল অঙ্কের বৈদেশিক মুদ্রার সাশ্রয় সম্ভব।
আল্লাহ পাক প্রতিটি দেশের নাগরিকের স্বাস্থ্য উপযোগী ফলমূল সে দেশে উৎপাদনের ব্যবস্থা করে দিয়েছেন। আমাদের দেশে সর্বত্র আম, কাঁঠাল, আনারস, কলা, পেঁপে, তরমুজ, বরই, বেল, পেয়ারা, বাতাবিলেবু, লটকন প্রভৃতি ব্যাপক উৎপন্ন হয়। এসব পণ্য দেশের সম্পূর্ণ চাহিদা মিটিয়ে বিদেশেও রফতানি হয়। আমাদের দেশের কৃষকরা কমলা, মাল্টা, আপেল, আঙ্গুর, ড্রাগন ফল, সৌদি খেজুর প্রভৃতি উৎপাদনে সফলতা পেলেও এ পণ্যগুলোর চাহিদার বড় অংশ আমদানির মাধ্যমে মেটানো হয়। এখন আমাদের নীতিনির্ধারকদের সিদ্ধান্ত নিতে হবে আমরা এ পণ্যগুলো আমদানির মাধ্যমে অবশিষ্ট চাহিদা পূরণ করব নাকি দেশজ ফলের ভোগের পরিমাণ বাড়িয়ে দিয়ে এগুলোর ভোগ সীমিত করব যাতে আমদানি নির্ভরশীলতায় হ্রাস ঘটে অথবা ছেদ পড়ে।
শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে আমাদের সক্ষমতা থাকলেও উভয়ের মান নিয়ে প্রশ্ন দেখা দেয়ায় এবং দেশের বিত্তশালীরা উভয়ের ক্ষেত্রে বিদেশ নির্ভর হওয়ায় প্রতি বছর এ দু’টি খাতে আমাদের বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রার অপচয় ঘটে। আমাদের শীর্ষ রাজনৈতিক নেতারা, ব্যবসায়ীরা, সামরিক-বেসামরিক আমলারা এবং তাদের সন্তানরা দেশের চিকিৎসা এবং শিক্ষাব্যবস্থার ওপর আস্থা রেখে নিজ দেশে চিকিৎসা ও শিক্ষা গ্রহণের কার্যক্রম চালু রাখলে আমরা বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রার অপচয় হতে বেঁচে গিয়ে নিজেদের চিকিৎসা ও শিক্ষা খাতের উন্নয়নসাধন করতে পারব। কিন্তু এ বিষয়ে সর্বাগ্রে যেটি প্রয়োজন তা হলো নীতিনির্ধারকদের কার্যকর উদ্যোগ ও পদক্ষেপ।
কোভিড-১৯ বৈশ্বিক মহামারী আকার ধারণের পর পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ বিদেশ গমন ও বিদেশ হতে আগমনে নিয়ন্ত্রণারোপ করায় করোনা মহামারীকালীন আক্রান্তদের অনেকেই যারা বিদেশী চিকিৎসাব্যবস্থার ওপর নির্ভরশীল ছিলেন তাদের দেশের অভ্যন্তরে চিকিৎসা নিতে বলা হয়। আমাদের চিকিৎসা ব্যবস্থার মান যে সক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও বিদেশ হতে নিম্নের তা করোনা মহামারীকালে ধরা পড়ে। চিকিৎসার ন্যায় আমাদের যেসব শিক্ষার্থী বিদেশী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে অধ্যয়নে বরাবর আগ্রহী করোনা মহামারীকালে বিদেশে প্রবেশের দুয়ার বন্ধ হয়ে যাওয়ায় বাধ্য হয়েই তাদের দেশে অবস্থান করে অনলাইনে শিক্ষা গ্রহণ করতে হচ্ছে। শিক্ষা খাতে বৈদেশিক বৃত্তি ব্যতীত নিজ খরচে বিদেশে শিক্ষা গ্রহণের পথ রুদ্ধ করা হলে স্বল্প সময়ের মধ্যেই আমাদের শিক্ষার মানের উন্নয়ন ঘটবে।
পৃথিবীর যেসব দেশ কৃষিপণ্য, শিল্পপণ্য, স্বাস্থ্যসেবা ও শিক্ষাসেবায় সক্ষম, আংশিক সক্ষম অথবা সক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও বিদেশনির্ভর সেসব দেশসহ আমাদের দেশের জন্য করোনার যে শিক্ষা তা হলো প্রতিটি দেশকে কৃষিজ ও শিল্পপণ্যে এবং স্বাস্থ্যসেবা ও শিক্ষাসেবায় স্বাবলম্বনের সক্ষমতা অর্জন করতে হবে, যাতে করোনার মতো মহামারী বা বিশ্বযুদ্ধ বা যেকোনো দেশের বৈরী নীতির কারণে একটি দেশে এগুলোর অভাব বা ঘাটতি দেখা না দেয়। করোনা মহামারী এ অভাব বা ঘাটতি পূরণে যে পথনির্দেশনা দেখিয়েছে সে পথনির্দেশনাকে নিজেদের স্বাবলম্বনের অবলম্বন হিসেবে ধরে রাখলেই দেশকে কখনো সমস্যার আবর্তে পড়ে ঘুরপাক খেতে হবে না। হ
লেখক : সাবেক জজ, সংবিধান, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক বিশ্লেষক
E-mail: iktederahmed@yahoo.com


আরো সংবাদ



premium cement